বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

করোনায় ‘ছায়া মহামারি’ নারী নির্যাতন

  •    
  • ২৯ নভেম্বর, ২০২০ ১৯:৪৫

এ বছর করোনা মহামারিতে সহিংসতা শতাংশের মাত্রায় পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ শব্দটি সংযোজন করেছে। জাতিসংঘ বলছে, প্রতি তিনজনে দুই জন সহিংসতার শিকার হচ্ছে এই মহামারিতে। একে ‘ছায়া মহামারি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ। বৈশ্বিক মহামারি পরিস্থিতির সঙ্গে আমার দেশও রয়েছে দ্বিগুণের কোঠায়।

২২ দিন আগে শোনা এক জীবনের গল্প। ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে প্রতিদিনের নির্যাতনের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানো এক নারীর গল্প।

নিত্য দিনের নির্যাতন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মারের আঘাতে শরীর রক্তাক্ত হলেও মনের আঘাতের কাছে শরীরের আঘাত ছিল খুবই ক্ষীণ।

খুব অকপটে হাসিমুখে বলছিল সে, একদিন ঝাড়ু দিয়ে পেটানোর সময় শলাকাগুলো যখন বিঁধছিল পিঠে, তখন যেমন টের পায়নি আবার শলাকাগুলো একে একে যখন চামড়ার ভেতর থেকে ওঠানো হচ্ছিল তখনও ব্যাথা অনুভব করেনি।

ব্যাথা যে অনুভব করেনি বিষয়টি কিন্তু তা নয়, এই অনুভূতিহীন নীরবতা ছিল প্রতিবাদ; কঠোর প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে সে।

গল্পটা আমার দেশের ৫৪.২ শতাংশ নারীর যারা স্বামীর দ্বারা শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়। এছাড়াও দুই-তৃতিয়াংশ নারী লিঙ্গভিত্তিক অর্থাৎ লিঙ্গীয় পরিচয়ের কারণে সহিংসতার শিকার হয়।

এটি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মোতাবেক। যুগের পর যুগ নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি সহিংতার এই ধারা অব্যাহত রয়েছে যা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।

এই চিত্র বিশ্বব্যাপী। জাতিসংঘের মতে, প্রতি তিনজনে একজন নারী তার জীবদ্দশায় সহিংসতার শিকার হয়। ভৌগলিক সীমারেখায় সংস্কুতিতে ভিন্নতা থাকলে নারীর প্রতি সহিংসতার ধরনে রয়েছে অভিন্নতা। যদিও কারণে ভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায়।

১৯৪৮ এর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার সনদ এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার সনদ নারীর সার্বজনীন মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে পরে আসে সিডও। যা নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপের সনদ হিসেবে পরিচিত।

এর ধারাবহিকতায় এসেছে নাইরোবি সম্মেলন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ, বেইজিং প্লাটফর্ম ফর একশন ইত্যাদী।

বেইজীং অঙ্গীকারের ২৫ বছরে পা রেখে নারীর ক্ষমতায়নের ইন্ডিকেটরে অর্জন প্রমাণ করতে পারলেও সহিংসতা প্রতিরোধে আমাদের অর্জন এখনও প্রশ্নের দাবিদার। আর সহিংসতার শিকার নারীর অর্থনেতিক সাবলম্বিতা কতটা ক্ষতায়নের পরিমাপে ধোপে টেকে সে বিষয়ে আমি অজ্ঞ।

’নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ ১৬ দিনব্যাপী লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান যা নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতাকে চ্যালেঞ্জ করে। প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস থেকে ১০ ডিসেম্বর, মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত এই প্রচার চালানো হয়।

১৯৯১ সালে উইমেন গ্লোবাল লিডারশিপ ইনস্টিটিউট এর অবতারণা করে, যা রটগার্স ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর উইমেন লিডারশিপ এ অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৯১ সাল থেকে প্রায় ১৮৭ টি দেশের ছয় হাজারেরও বেশি সংস্থা এই প্রচারে অংশ নিয়েছে। বিশ্বে ১৮৭ টি দেশে সরকারি বেসরকারিভাবে এই ১৬ দিনব্যাপী বিভিন্ন স্তরে প্রচারণার পরেও সহিংসতার মাঝে রয়ে গেছে প্রতি তিনজনে একজন নারী।

বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের দেশেও রয়েছে একই কাতারে। কিছু ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো সামাজিক রীতি-নীতি ও কুসংস্কারের কারণে এর মাত্রা আরও বেশি।

দুদিন আগে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা নিয়ে এক আলোচনার কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি। যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনায় বলা আছে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি থাকা আবশ্যক।

একজন মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী বললেন, কমিটি করার কথা বলা আছে এবং অবশ্যই করতে হবে। আর একে সাফল্যের ইন্ডিকেটরে রেখে দিয়েছেন আমার সেই বিজ্ঞ সহকর্মী। পার্থক্যটা এখানে।

আমার জানামতে, খুব কম সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও কর্মস্থলে কার্যকর কমিটি রয়েছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান অবগতই না। একশনএইড বাংলাদেশের একটি গবেষণা বলছে, ৮৪ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ৬৪.৫০ ভাগ কর্মস্থল এই নির্দেশনা সম্পর্কে অবগত নয়।

কাছাকাছি চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিদ্যমান আইনের ক্ষেত্রে। তৃণমূলে দরকার সচেতনতার পাশাপাশি কার্যকরী প্রয়োগে পর্যাপ্ত তথ্য। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কাঠামোয় যতই পদক্ষেপ নেওয়া হোক না কেন এর বাস্তবায়নে নজর না দিলে ২০৪০ এ বসেও জাতিসংঘকে বলতে হবে প্রতি তিনজনে একজন নারী তার জীবদ্দশায় সহিংসতার শিকার হয়।

এ বছর করোনা মহামারিতে সহিংসতা শতাংশের মাত্রায় পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ শব্দটি সংযোজন করেছে। জাতিসংঘ বলছে, প্রতি তিনজনে দুই জন সহিংসতার শিকার হচ্ছে এই মহামারিতে। একে ‘ছায়া মহামারি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ। বৈশ্বিক মহামারি পরিস্থিতির সঙ্গে আমার দেশও রয়েছে দ্বিগুণের কোঠায়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসে মোট এক হাজার ৩৪৯ টি ধর্ষণ, ৪৮৩ জন পারিবারিক সহিংসতা শিকার ও ২০৫ জনকে হত্যা করেছে স্বামী, ১৮০ জন শিকার হয়েছে যৌন সহিংসতার যার মধ্যে আত্মহত্যা করেছে ১৪ জন।

নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সহিংসতার সংখ্যা এই পরিসংখ্যানের থেকে অনেক বেশি। লকডাউনে চলাচলে সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক নারীই রিপোর্ট করেনি।

আবার মানিয়ে নেয়ার সংস্কৃতি অনেককে দূরে রেখেছে ঘটনা প্রকাশে। পরিবারের পুরুষ সদস্যের উপর নির্ভরশীলতা এবং আরও বহুবিধ কারণ তাকে দূরে রেখেছে প্রতিকার থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যৌতুক ও পারিবারিক সহিংসতার হার গত ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে- এই ৭২ দিনে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে তার আগের ৭২ দিনের তুলনায় দ্বিগুণ।

ব্র্যাকের এক তথ্যও একই কথা বলছে। গত বছরের একই সময়ে ব্র্যাকে ৪০৮ জন সহিংসতার শকার নারী আইনি সহায়তার জন্য এলেও এ বছর এর সংখ্যা ৬.৯ শতাংশ বেড়েছে।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এর সাময়িক পূর্বাভাস অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্য ১৯৩ টি দেশে তিন মাসের লকডাউন চলাকালে পারিবারিক সহিংসতা গড়ে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এটি বৈশ্বিরকভাবে স্বীকৃত যে, যে কোন মহামারী বা দুর্যোগে নারী প্রতি সহিংসতা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। এই প্রেক্ষাপটে এ বছরের ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

এ বছরের করোনা পরিস্থিতি এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবন্ধকতার শীর্ষে অবস্থান করবে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে যথোপযুক্ত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপে বিলম্বতা বা দীর্ঘসূত্রতার খেসারত টানতে হবে সুদূরপ্রসারী।

গল্পের সেই প্রতিবাদী নারী ঘরে ঘরে জন্মায় না। ‘এ পৃথিবীকে সকলের বাসযোগ্য করে যাব আমি’ এবারের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষে এটাই হোক পুরুষ এবং নারী সকলের প্রত্যয়।

তাছলিমা আক্তার, মানবাধিকার কর্মী এবং ডেপুটি ম্যানেজার- উইমেন রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইক্যুইটি, একশনএইড বাংলাদেশ

এ বিভাগের আরো খবর