বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মারাদোনা, ম্যারাডোনা আর ফুটবল ঈশ্বরের মহাযাত্রা

  • ফাহাদ এ. আব্দুল্লাহ   
  • ২৭ নভেম্বর, ২০২০ ১৫:১৩

ফুটবলের পাশাপাশি তার ব্যক্তিজীবনে পড়ে পাদপ্রদীপের আলো। দুই শতাব্দীর উপনিবেশি শাসনে ইংরেজ পত্রিকা আর স্রেফ পয়সার জোরে আমেরিকান সংবাদ কোম্পানি পুরো বিশ্বের খবর আমাদের কাছে পৌঁছায়। ওসব সংবাদ সংস্থা যেখানে যেখানে আলো ফেলে, শুধু সেসব জায়গাই আলোকিত হয়। দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনার আর্হেন্তিনো নাম হয়ে যায় ইংরেজ ম্যারাডোনা।

আর্হেন্তিনার অন্যতম বড় ক্লাব আর্হেন্তিনোস জুনিয়র্স। ওদের ইয়ুথ ক্লাব লস সেবোলিতাসে নতুন এক ছেলে ঢুকেছে। বছর দশেক বয়স। সে ছোকড়ার পায়ের এমনই জাদু; তাতে ভর করে টানা ১৩৬ ম্যাচে অপরাজিত লস সেবোলিতাস।

ক্লাবের সতীর্থরা ওকে ‘এল পিবে দে ওরো’ ডাকতে শুরু করলেন। এদেশে জিপিএ ফাইভ পেলে যেমন সোনার ছেলে বলে ওরকম। এ সোনার ছেলেকে আমরা সবাই হাড়ে-মজ্জায় চিনি। বাপ-দাদা, মা-নানী সকলে মিলে চেনেন। চার বছরান্তে ফুটবল বিশ্বকাপের সময়, রাতে টিভির সামনে বসে ইংরেজির ছাত্রী নানী আমাকে মনে করান দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনার কথা। নিজের প্রেমাস্পদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার তরুণ কেমন তার দ্বিতীয় কন্যাকে কোলে নিয়ে রাতে মারাদোনার দেশের খেলা দেখতেন সেকথা। খেলার উত্তেজনার পারদ চড়ে, নানীর কথা বন্ধ হয়ে যায়। ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধে ক্লান্ত নানী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মারাদোনার দেশ মাঠে এইটুক জেনেই তাঁর প্রশান্তি।

বিলিতি পত্রিকায় অবশ্য সোনার ছেলে বনে যান দানব। এ কেমন লোক? ঝাঁকড়া চুল, বেঁটেখাটো গড়ণ, তামাটে গায়ের রঙের এই ডেঁপো কিশোর যেন তাবড় তাবড় ফুটবলারদের নাকানি চোবানি খাইয়ে এক অনধিকার চর্চা করছে। সে অবশ্য বিলিতিরা আমাদের ক্ষুদিরামকেও সন্ত্রাসী বলেছে। মাস্টারদা সূর্যসেনকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। অস্ত্রের মুখে আর্হেন্তিনার ইসলা মালভিনাস কেড়ে নিয়ে ব্রিটিশরা করেন অন্যায়ের প্রতিবাদ। ফুটবল মাঠে ও ব্যাটা হাতে গোল দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে খেলার জয়। ওদিকে তখনও ফকল্যান্ডে ইংরেজ 'ব্ল্যাক অ্যান্ড ট্যানস'। রোমান ক্যাথলিক মারাদোনা স্মিত হেসে হয়তো বলেছিলেন, শুনেছি ঈশ্বরের মর্জি বিনা গাছের পাতা নড়তে অক্ষম; তাহলে এ গোল স্বয়ং ঈশ্বর হাতে করে দিয়েছেন। পরে অবশ্য পায়েও গোল দিয়েছিলেন। নির্বিবাদে সেটাকে মেনে নিয়েছিলেন সবাই।

ফুটবলের পাশাপাশি তার ব্যক্তিজীবনে পড়ে পাদপ্রদীপের আলো। দুই শতাব্দীর উপনিবেশি শাসনে ইংরেজ পত্রিকা আর স্রেফ পয়সার জোরে আমেরিকান সংবাদ কোম্পানি পুরো বিশ্বের খবর আমাদের কাছে পৌঁছায়। ওসব সংবাদ সংস্থা যেখানে যেখানে আলো ফেলে, শুধু সেসব জায়গাই আলোকিত হয়। দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনার আর্হেন্তিনো নাম হয়ে যায় ইংরেজ ম্যারাডোনা। পায়ের জাদুর বদলে নাকের নস্যির সংবাদে আলো পড়ে বেশি। ‘হ্যান্ড অফ গড’ নিয়ে মতামত লিখতে বসে যান ইংরেজ খেলা পাতার সাংবাদিকেরা। পরকীয়া, কোকেন, কামোরি মাফিয়া যোগাযোগ এসবই ধরা দিতে থাকে আমাদের প্রতিদিনের সংবাদে। ধীরে ধীরে ফুটবলার মারাদোনা ব্যাকস্টেজে আর সামনে আসেন কোকেন আসক্ত, উদ্দাম জীবন আর পরকীয়াপ্রেমী ম্যারাডোনা। ইংরেজ আর আমেরিকান মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির মুচমুচে কনটেন্টে হাতে গোলের জায়গা কম। মারাদোনার খেলোয়াড়ি মনোভাবের অভাব নিয়ে অশ্রু বিসর্জন করেন ইংরাজ সাংবাদিক, যদিও হয়তো খোঁজ নিলে দেখা যাবে তিনি যে পত্রিকায় চড়া বেতনে কাজ করেন সে পত্রিকার মালিকের আকাশচুম্বি সম্পদের চাবি লুকানো প্রায় ৪০০ বছরের ইংরেজ উপনিবেশের ইতিহাসে।যে গ্রামে ১৯৬০ সালে জন্মান মারাদোনা সেখানে ঘরের ভেতরে টয়লেট একটা বিলাসিতা। শিশুকালে, পুরো গ্রামের মানুষের মল জমা হয় যে গর্তে তাতে পড়ে গেছিলেন। ডুবে মরতে বসেছিলেন; ভেবে দেখুন ফুটবলের ঈশ্বর গ্রামের মানুষের দু-তিন বছরের জমা হওয়া বর্জ্যে ডুবে মরতে বসেছিলেন। সেখান থেকে বনে যান আর্হেন্তিনার সোনার ছেলে। গ্রামের রাস্তায়, পাড়ার ছেলেদের পায়ের কারিকুরি দেখাতে দেখাতে দিয়েগো একদিন আর্হেন্তিনার জাতীয় দলের কাণ্ডারি, ফকল্যান্ড দ্বন্দ্বের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেওয়া মারাদোনা। জার্সি নম্বর দশের দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা।

মারাদোনা কখনো গ্রামের সেই দারিদ্রকে পেছনে ফেলে আসেননি। মাদক সেবন, পরকীয়া, পুলিশ, মামলা-হামলা, স্বাস্থ্যের অবনতি এসবের মাঝে যখন তিনি আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তাকে এক সাংবাদিক ধরলেন এই ভয়ংকর চাপ সামলাবার উপায় বাতলাতে। মারাদোনা বললেন, ‘চাপ! আমি কোন চাপে নেই। চাপে আছেন তিনি, ভোর চারটেয় ঘর থেকে জীবিকার সন্ধানে বেরিয়েও একশ পেসো ঘরে আনতে ব্যর্থ। ঘরে পাঁচ-ছটি শিশু তার ফেরার অপেক্ষায়। বাবা ফিরবে, চুলোয় হাঁড়ি চড়বে। সে হাঁড়িতে দেবার মত খাবারের জোগান করতে না পারা বাবার চাপের কাছে, আমার এসব কিছুই না। আমি মোটেও চাপে নেই।’ এই দিয়েগো সেই গ্রামের মানব বর্জ্যে ডুবে মরতে বসা দিয়েগো, পায়ের জাদুতে আর্হেন্তিনার জাতীয় দল, পরে পুরো বিশ্বের মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়া মারাদোনা।

যে সময়ের কথা হচ্ছে, সেই আশির দশকে এসকোবারের কোকেন রাজত্বের ভোক্তা অ্যামেরিকার ওয়াল স্ট্রিট। ওয়াল স্ট্রিটের কাছে বেঁচে দেওয়া কোকেনের পয়সায় মেদেজিন কার্তেল, কালি কার্তেল জেঁকে বসে লাতিন আমেরিকার সরকার কাঠামোয়। ওয়াল স্ট্রিটের ঝাঁ চকচকে স্যুট পরা এক্সিকিউটিভদের নিত্য কোকেনের চাহিদা মেটাবার মত অশ্লীল রকমের পয়সা ছিল। তবু এই কোকেন বন্যায় ইংরেজ সাংবাদিকের অনুসন্ধানি নজর পড়েনা। আমেরিকার চিরবর্ধমান আয় বৈষম্য, সামাজিক কল্যাণ খাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ লাফিয়ে লাফিয়ে নামা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিতে এসে দেনার দায়ে জর্জরিত হওয়ার ঘটনাকে তাদের অখেলোয়াড়ি আচরণ মনে হয়না। ওটা শুধু গরীব ম্যারাডোনার হাতে দেওয়া একটা গোলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনার উদ্দাম জীবন আমাদের সকলের ভেতরের চেপে রাখা বাসনা।

কোভিডে ঘরে আটকানোর পরে, প্রথম কদিন যথেচ্ছ নিদ্রা, টিভি সিরিজের বিনজ ওয়াচ, আলসেমি আমরা সবাই করেছি। কদিন পরে সব সিরিজ যখন ফুরিয়ে গেল, ঘুমাতে ঘুমাতেও ক্লান্তি ভর করলো শরীরে, বেনিয়াদের ভাঁড়ার বাদে সবার ভাঁড়ারে টান পড়লো তখনি আমাদের নতুন উদ্দমে পৃথিবীতে ফেরার ইচ্ছে জাগলো। কড়াকড়ি শিথিল হতেই, যে ব্যক্তি কদিন আগে ঘরে ঘরে থাকুন চেঁচাতেন, তিনি মুখোশ-দূরত্বের তোয়াক্কা না করে চলে গেলেন সাজেক। এখন দেখুন দেশে সাজেকেও সিট খালি নেই, আইসিইউতেও জায়গা বাড়ন্ত। আমাদের সকলের মাঝেই এক কোকেনখোর, পরনারী/পরপুরুষে আসক্ত উদ্দাম দানব লুকিয়ে আছে। তবে সেটা আমার ঘরে বসত করা ক'জনার একজনা মোটে। পুরো আমি নই।

তখন মারাদোনা আর্হেন্তিনার জাতীয় দলের কোচ। দল কোন একটা ম্যাচ হেরেছে। সমর্থকদের কানে তালা লাগা নিস্তব্ধতা। খেলোয়াড়েরা মাথা নিচু করে, কাঁধ গুঁজে ড্রেসিং রুমের পথ ধরছেন। ঢোকার পথে ধূসর স্যূটে, কাঁধ পর্যন্ত কোঁকড়া কাঁচাপাকা চুল, হলিউডি দাড়ি, হাতে আংটিতে সজ্জিত হয়ে দাঁড়ানো তিনি। সেই মুহুর্তের মারাদোনা এক স্নেহময় পিতার প্রতিচ্ছবি। প্রতি খেলোয়াড়ের গালে চুমু, আদর করে চুল এলোমেলো করে যেন বলছেন, ‘আরে ওসব হয়! সামনের ম্যাচে দেখিস, আমরাই খেল দেখাব!’ এরকম পিতৃপুরুষ কী আমরা সবাই চাইনি? তরুণ বয়সে দুনিয়া দাবড়ে বেরিয়েছেন, এখন মুটিয়ে গেছেন, তবু দরাজ গলায় হাসেন, মোটা চুরুট ফোঁকেন, বিপ্লবীদের দঙ্গলে আনাগোণা করেন। আর পা পিছলালে সবার আগে দৌড়ে এসে টেনে দাঁড় করান। ধুলো ঝেড়ে বলেন ‘আরে ওসব হয়। আমি কতবার পড়েছি। সামনে ঠিক হয়ে যাবে’খন সব’। এমন পিতৃপুরুষের ৬০ বছরে বিদায় বড় জলদি। আরও ৪০ বছর আপনার দিকনির্দেশনার প্রয়োজন ছিল।

ইংরেজি ম্যারাডোনা আর আর্হেন্তিনো মারাদোনার মাঝে যোজন যোজন ফারাক, তবে দুজনেই একই ব্যক্তির দুই সত্ত্বা। তবে মনে রাখি দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা সারাজীবন পুঁচকে লোকটার পক্ষেই ছিলেন। যাকে কেউ মনে রাখেনা তার কথাই বারবার বলেছেন। ফুটবলের ঈশ্বর যখন পুঁচকে লোকের কথা বলে, দেবালয় শোনে। নাহলে ঈশ্বর ভদ্রপল্লীতেই গোঁত্তা খেতেন। নোংরা গ্রামে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হোত। এহেন মানুষকে বিদায় বলতে গেলেও গলায় কোথায় যেন আটকে আসে।

লেখক: ফাহাদ এ. আব্দুল্লাহ, শিক্ষক ও গবেষক।

এ বিভাগের আরো খবর