খট্ খট্ খট্। স্বর্গের দরজায় টোকা পড়ছে। - ভেতর থেকে খোঁজ, কে?আমি। -আমি কে? হ্যান্ড অফ গড!সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। -ওয়েলকাম ডিয়েগো!ভিতরে তখন ত্যাঙ্গোর তাল, সুরের মুর্চ্ছনা!
বুধবার, ২৫ নভেম্বর থেকে দিয়োগো ম্যারাডোনা তার ‘জীবন মাঠ’বদলে ফেলেছেন। সবুজ মাঠ ছাড়িয়ে এখন নীল আকাশে। এবং আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন ম্যারাডোনা সেখানেও যথারীতি ‘লাল গালিচা’ সম্বর্ধনাই পাচ্ছেন!
যখন ফুটবল খেলতেন তখনো প্রভাবী-প্রতিভা। যখন ছাড়লেন তখনো তাই, সম্ভবত আরো বেশি। আবার ঠিক যখন জীবন থেকে বিদায় নিলেন তখনো ঠিক একই বিস্ময় হয়ে রইলেন। চিরকালিন বিখ্যাত।
২০০৮ সালে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসব ম্যারাডোনাকে অতিথি করেছিল। ঐতিহ্য অনুযায়ী কানের লাল গালিচায় হেঁটে ফটোগ্রাফারদের ছবি তোলার সুযোগ দেন সেলুলয়েড জগতের বিখ্যাত সব তারকারা। কিন্তু ম্যারাডোনা লালগালিচায় না হেঁটে, যেখানে দাঁড়ালেন সেটাই যে ছবি তোলার সবচেয়ে সেরা জায়গা হয়ে দাড়ালো। কালো রংয়ের ঢিলেঢালা জগার্স ট্র্যাকশুট পরে ম্যারাডোনা উঠে গেলেন সামনে রাখা সাদা রংয়ের ছোট্ট টেবিলের ওপর। ম্যারাডোনা যেখানে থাকবেন সেখানে ফুটবল থাকবে না-তা কি হয়? বল নিয়ে সেই ছোট্ট টেবিলেই কারিকুরির শুরু! কাঁধে-কপালে বল নিয়ে শুরু করলেন জাগলিং! দুই হাত প্রসারিত করে ডিয়েগো হাসছেন। বল কপালের সামনেভাগে স্থির। ম্যারাডোনার সেই মুহূর্তটা কান চলচ্চিত্রের আইকনিক ছবি হয়ে গেল! পেছনে প্রায় শ’খানেক ফটোগ্রাফার সেই ছবির মুহূর্ত তোলার জন্য ক্যামেরার লেন্সে চোখ; আর সামনে বলকে শূন্যে ভাসিয়ে দু’হাত ছড়িয়ে ম্যারাডোনা-দ্বিগবিজয়ীর বেশে!
-দ্বিগবিজয়ী!
সত্যিকার অর্থেই তাই। গোল একটা ফুটবল দিয়ে পুরো বিশ্বকেও জিতে নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। পক্ষ-প্রতিপক্ষ সবাই মোহিত ম্যারাডোনায়। কখনো আর্জেন্টিনা যায়নি, বিশ্বম্যাপে আর্জেন্টিনা ঠিক কোন গোলার্ধে সেটাও অনেকের জানা না। কিন্তু আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনাকে কেউ চিনে না-এতখানি বোকামো দাবি সম্ভবত কেউ করবে না।
সেই অর্থে ঠিক আইকনিক ক্যারেক্টার বলতে যা বোঝায়-ম্যারাডোনা কিন্তু পুরোদুস্তর তা নন। এই জীবন আমার, আর এটাকে আমার মতোই করেই উপভোগ করবো আমি-এমন দর্শন নিয়ে ‘জীবন ম্যাচ’খেলে গেছেন ম্যারাডোনা।
কি আশ্চর্য বিষয়, তার দুষ্ট-ভ্রষ্ট কখনো বা নষ্ট চারিত্রিক দোষকেও কি অবলীলায় বিশ্ব ‘ও কিছু না বলে’ এড়িয়ে গেছে। কারণ এই মানুষটাকে পুরো বিশ্বকে যে ফুটবল আনন্দ দিয়ে গেছেন সেই তুল্যমুল্যে বিচার করলে ম্যারাডোনার বাকি সব দোষত্রুটি এমনকি স্খলনকেও শিশুতোষ মনে হবে!
হাত দিয়ে গোলের অভিযোগ উঠলো আর কি অবলীলায় তিনি ঘোষণা করলেন- ওটা ছিল হ্যান্ড অব গড! আর কি আশ্চর্য, সেই থেকেই বিশ্বও যেন তাকে ঈশ্বরের প্রতিভু হিসেবেও মেনে নিল! আর তাই তো ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবরে ফ্রান্সের ট্যাবলয়েড দৈনিক ল্যকিপ শিরোনামও করল- DIEU EST MORT’! ইংরেজিতে ‘GOD IS DEAD!’
ম্যারাডোনা নিজেও ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন। তবে নিয়ম করে চার্চে যাওয়ার দলে তার নাম উঠানো যাবে না। বাম পায়ে বল নিয়ে দৌড়ানো, প্রতিপক্ষের মার খেয়ে উঠে দাড়ানো, জেতার জেদ, রেফারির সঙ্গে তীব্র প্রতিবাদী শারীরিক দৃষ্টিভঙ্গি, ড্রিবলিং জাদুতে প্রতিপক্ষ ডিফেন্সকে সম্মোহনী করে রাখার মতো- তার বিশ্বাস , জীবনবোধ, উপভোগমন্ত্র, আনন্দ-আচরণ; সবকিছুতেই ম্যারাডোনার নিজস্ব একটা ঘরানা ছিল। কোন আদর্শিক ব্র্যাকেটেই আপনি তার জীবন দর্শনকে আটকে রাখার সাহস দেখাবেন না। অথচ কি আশ্চর্য, তার আত্মজীবিনী পাঠ করে শোনানো হয় আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের চার্চে!
সেই চার্চের নাম?-ম্যারাডোনিয়ান চার্চ!
জীবন সম্পর্কে ম্যারাডোনার দর্শন খুবই সাধাসিধে। সোজা হিসেবÑজীবন হলো উপভোগের। ঠিক তেমনই মৃত্যুবিষয়ক চিন্তা ভাবনায় কোন জটিলতা নেই-‘জীবন হলো জীবন। যখন ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নেবেন সময় হয়েছে যাওয়ার, সময়টা তখনই আসবে।’
- তোমার এপিটাফে কি লেখা দেখতে চাও তুমি? এক টিভি শোতে তাকে এই প্রশ্ন শুনতে হয়েছিল বছর কয়েক আগে।
ম্যারাডোনার জবাব-‘ফুটবলকে ধন্যবাদ, খেলাটা আমাকে সেরা আনন্দ দিয়েছে। আমি পেয়েছি স্বকীয়তা, স্বাধীনতা। আমি যেন হাত দিয়ে আকাশকে ছুঁয়েছি। ফুটবল তোমাকে ধন্যবাদ।’
খুব কম মানুষই নিজের এপিটাফে শব্দ লেখার ইচ্ছেশক্তি রাখেন।
মাদক গ্রহণ। বিশ্বকাপ থেকে বহিস্কার। মদে আসক্তি। লম্বা সময় পর্যন্ত নিজের ছেলেকে অস্বীকার। স্ত্রী, কন্যার দায়িত্ব এড়িয়ে বিছিন্ন থাকা। গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে মারামারি। সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া। সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কের রেশ। ম্যারাডোনার জীবন গল্পের বেশ বড় অংশই অন্ধকার।
কিন্তু তারপরও ম্যারাডোনা মানেই আলোকময় ফুটবল। ফুটবলের আলোটাই তার বাকি সব অন্ধকারকে সরিয়ে শেষদিন পর্যন্ত তাকে আলোয় রেখেছে। ভালবাসা দিয়েছে। মানুষ তাকে ভালবেসেছে দ্বিধাহীন চিত্তে। পক্ষ-প্রতিপক্ষ ভুলে!
প্রতিভাবান অনেকেই। কিন্তু এমন উদার ভালবাসা সবাই পায় না। ম্যারাডোনা অমনই একজন। এবং সম্ভবত একমাত্র!
কোথায় যেন পড়েছিলাম, স্বর্গে নাকি বয়স বাড়ে না। ছবিটা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি, ম্যারাডোনা এখন এই বয়সেও ওখানে ত্যাঙ্গোর তালে তাল মেলাচ্ছেন, ঠোঁটের ফাঁকে হাভানা চুরুট, হাতে পানপাত্র অন্যহাত ক্ষীণকটির কাঁধে!
লেখক: এম. এম. কায়সার, ক্রীড়া সম্পাদক, বার্তা২৪