বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

খলিলউল্লাহ থেকে মুন্না: এক ভয়ংকর মানসিক অসুস্থতা

  •    
  • ২৭ নভেম্বর, ২০২০ ১২:৪০

সমাজে নেক্রোফিলিয়া খুব একটা দেখা যায় না এবং এ সংক্রান্ত তেমন কোনো তথ্য উপাত্তও নেই। এরপরেও অনেকে মনে করেন ধারণার চেয়ে হয়ত বেশিই আছে এই রোগ। ১৯৮৯ সালে এ রকম ১২২টি ঘটনার সন্ধান পাওয়া গেছে। নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্তরা শুধু যে পুরুষ হবেন, এমন না। ১৯৮৯ সালের পাওয়া যাওয়া হিসাবের শতকরা ৯২ জন ছিলেন পুরুষ। বাকি আট জন নারী।

আমরা ছোটবেলায় ভূতের চেয়ে বেশি ভয় পেতাম ‘কলিজাখেকো’ খলিলউল্লাহকে। সেই সত্তরের দশকে খলিলউল্লাহ আবির্ভূত হয় এমন ভয়ংকর এক মানুষ হিসেবে, যে নাকি আজিমপুর কবরস্থানের কবর থেকে মানুষের কলিজা বের করে খেত। তৎকালীন দৈনিক বাংলা ও বিচিত্রাতে খলিলউল্লাহর কাহিনী ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর মানুষের বিশেষ করে শিশুদের মনে দারুণ ভয় সৃষ্টি হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, নরমাংসের নেশায় ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ঢোকায় হাসপাতাল কর্মচারীরা খলিলউল্লাহকে ধরে ফেলেন। তারপর তাকে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কাছে হাজির করা হয়। সেখানে আনা হয় কয়েকজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞকে।

খলিলউল্লাহ জানিয়েছিল, মর্গের কর্মী রবি ডোম আর খলিলউল্লাহ ছোটবেলায় বন্ধু ছিল। রবি ডোমের বাবা ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রথম ডোম। সে-ই নাকি খলিলউল্লাহ আর রবি ডোমকে প্রথম মরা মানুষের মাংস খেতে দিয়েছিল। পরে রবি ডোম নরমাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়। কিন্তু খলিলউল্লাহ তা ছাড়তে পারেনি। শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ নয়, মিটফোর্ড হাসপাতালের দুজন ডোম তাকে মরা মানুষের মাংস খেতে দিত।

নরমাংস ছাড়াও লাশের কাফনের কাপড় চুরি করা ছিল খলিলউল্লাহর নেশা। ঢাকার বিভিন্ন কবরস্থান থেকে কবর খুঁড়ে কাপড় এনে তা মৌলভীবাজারের কাছাকাছি পুরনো কাপড়ের দোকানে বিক্রি করত সে। কাপড় বিক্রির টাকা দিয়ে স্বাভাবিক খাবার খেত।

এসব কাহিনী শুনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, খলিলউল্লাহকে আর জনসমক্ষে রাখা যায় না। তাকে থানায় নেয়ার পর পুলিশ নিশ্চিত হয়েছিল, খলিলউল্লাহ কোনো দাগি ক্রিমিনাল নয়, একজন জটিল মানসিক রোগী।

মানসিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে ঢাকার আদালতে পাঠানো হয়। সবকিছু শুনে বিচারক তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।

শোনা যায়, অনেক পরে খলিলউল্লাহকে আবার আজিমপুর গোরস্থানে দেখা গিয়েছিল।

এতগুলো বছর পর আমার সেই খলিলউল্লাহর কথা আবার মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল কারণ মৃতদেহ সংক্রান্ত আরেক মানসিক বিকারের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের খবর: রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গের ডোম জতন কুমার লালের ভাগ্নে মুন্না ভগত মর্গে আসা মৃত নারীদের ধর্ষণ করে।

খলিলউল্লাহ যেমন একজন জটিল মানসিক রোগী ছিল, এই মুন্নাও ঠিক তেমনি একজন বিকারগ্রস্ত মানুষ। নয়ত এইসব ভয়াবহ ঘটনা একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে ঘটানো অসম্ভব।

১১ থেকে ১৭ বছরের যে পাঁচজন কিশোরীর লাশ মুন্নার লালসার শিকার হয়েছে, সেগুলো মর্গে এসেছে আত্মহত্যার পথ বেয়ে। কোনো না কোনোভাবে জীবনের কাছে ধাক্কা খেয়ে বা অভিমান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল ওই কিশোরীরা। পরিবার বা আপনজনের দুর্ব্যবহার, অবহেলা, নির্যাতন এবং সহানুভূতি ও সমানুভূতির অভাব হয়ত তাদের ঠেলে দিয়েছে এই পথে। কিন্তু মরে গিয়েও রেহাই পায়নি তারা। মর্গে তাদের লাশ কাটাছেঁড়া করতে নিলে সেখানেও মৃত অবস্থায় ‘লালসার’ শিকার হতে হয়েছে তাদের। বিষয়টা সুস্থভাবে কল্পনাও করা যায় না।

মুন্না ভগতের বয়স ২০। সে তার মামার সঙ্গে ওই হাসপাতালের মর্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করত। দুই-তিন বছর ধরে মুন্না মর্গে থাকা নারী মরদেহের সঙ্গে যৌনক্রিয়া করে আসছিল।

সাধারণত মৃতদেহ মানুষের মনে এক তীব্র আবেগের সৃষ্টি করে। মৃতদেহ দেখলে হয় মানুষ বিষণ্ন হয়। সব মৃতদেহের প্রতি সম্মান দেখানোর রেওয়াজ প্রতিটি সমাজ ও ধর্মে প্রতিষ্ঠিত, এমনকি ওই ব্যক্তি যদি ভয়ংকর অপরাধী বা শত্রুও হয়ে থাকে। একই কারণে জীবিত নারীর দেহ যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, প্রাণহীন দেহে সেই আবেগের কোনো স্থান নেই এবং এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু মৃতদেহের প্রতি মুন্না ভগতের এই যৌন আগ্রহ একটি বিশেষ ধরনের মানসিক সমস্যা, যার নাম নেক্রোফিলিয়া। নেক্রোফিলিয়া নানারকমের অস্বাভাবিক যৌনচিন্তা বা অস্বাভাবিক যৌন ইচ্ছার অন্তর্গত, যাদের একসঙ্গে বলা হয় প্যারাফিলিয়া।

নেক্রোফিলিয়া বিরল বলে রোগটির সম্পর্কে আমাদের খুব জানাশোনা নেই। বাংলাদেশে এ রকম একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমরা নির্বাক হয়ে পড়েছি। অনেকে ঘটনাটি বিশ্বাসই করতে পারছেন না। কিন্তু সেই অসুস্থ অপরাধী যখন নিজের মুখে তার অপরাধ স্বীকার করেছে, ডাক্তাররা এই রোগ সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্য শেয়ার করছেন, তখন যতই বিস্মিত হই না কেন, একে মেনে নিতেই হচ্ছে।

মৃতদেহের সঙ্গে যৌনক্রিয়া করার এই প্রবণতা নিয়ে ১৬ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত আইনি ও মেডিক্যাল সংক্রান্ত আইনি বইগুলোতে এই আলোচনা আছে। নেক্রোফিলিয়া আরও আগে সমাজে ছিল, কিন্তু মানুষের আলোচনায় আসেনি। প্রাচীনকালে সমুদ্র যাত্রায় কারো মৃত্যুর পর মরদেহ পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা জাহাজের নাবিকদের বিরুদ্ধে নেক্রোফিলিয়ার অভিযোগ এনেছেন এমন অনেক নজির আছে। প্রাচীন মিশরে অনেকের মধ্যেই এমন স্বভাব ছিল বলে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস লিখেছিলেন, মিশরীয়রা এই ভয় থেকেই তাদের পরিবারের সুন্দর মেয়েদের মরদেহ ৩/৪ দিন ঘরে রেখে, এরপর সংরক্ষণ করতে দিত।

নানা ধরনের নেক্রোফিলিয়া আক্রান্ত রোগী আছে। এদের কেউ মৃত ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি যৌনক্রিয়া করে, কেউ তাদের প্রিয়জনের দেহ বহুদিন লুকিয়ে রেখে দেয়, কেউ কেউ শুধু ভেবেই আনন্দ পায়, কিন্তু শারীরিক সম্পর্ক চায় না। কেউ কেউ আছে যৌনক্রিয়ার জন্য ভিকটিমকে মেরেই ফেলে।

সমাজে নেক্রোফিলিয়া খুব একটা দেখা যায় না এবং এ সংক্রান্ত তেমন কোনো তথ্য উপাত্তও নেই। এরপরেও অনেকে মনে করেন ধারণার চেয়ে হয়ত বেশিই আছে এই রোগ। ১৯৮৯ সালে এ রকম ১২২টি ঘটনার সন্ধান পাওয়া গেছে। নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্তরা শুধু যে পুরুষ হবেন, এমন না। ১৯৮৯ সালের পাওয়া যাওয়া হিসাবের শতকরা ৯২ জন ছিলেন পুরুষ। বাকি আট জন নারী।

দেখা গেছে, যেসব মানুষ নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত, তাদের শতকরা ৫৭ ভাগেরই পেশাগতভাবে মৃতদেহর কাছে যাওয়ার সুযোগ থাকে। যেমন ডোম, মর্গের পাহারাদার, হাসপাতালের আর্দালি এবং গোরস্থানে কর্মরত মানুষ।

গবেষকেরা মনে করেন, কয়েকটা ফ্যাক্টর মানুষের মধ্যে এই রোগের সূত্রপাতকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন যাদের খুব দুর্বল আত্মবিশ্বাস, চরম কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকলে, অন্যের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় নিয়ে বাঁচে যারা, অথবা যারা ভাবে এমন একজনের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করবে, যে তাদের বাধা দিতে পারবে না বা ‘না’ করতে পারবে না।

শতকরা ৬৮ ভাগেরই নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার এটাই মূল কারণ। শতকরা ২১ ভাগ চায় চলে যাওয়া প্রিয়জনের কাছে যেতে। এছাড়া অনেকে মৃত মানুষের উপর শক্তি প্রদর্শন করে নিজেদের দুর্বল আত্মবিশ্বাসকে চাঙা করতে চায়। আরো আছে হেলুসিনেশন ও অপ্রতিরোধ্য যৌন ইচ্ছা। তবে পুরো ব্যাপারটাই এক ধরনের মানসিক ভারসাম্যহীনতা। কিছু কিছু পশুপাখির মধ্যেও এই আচরণ দেখতে পাওয়া যায়। রোগী কম বলে খুব একটা ভাবা হয়নি এর চিকিৎসা নিয়ে।

এ ধরনের মানসিক অসুস্থতা ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ কারণে দেখা দিতে পারে, আবার পরিবেশ পরিস্থিতিও ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের আক্রান্ত করতে পারে। শিশু-কিশোর বয়সেই যদি এমন চরিত্রগুলোর অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়, তাহলে সময় মতো ব্যবস্থা নিলে সেটা অপরাধের পর্যায়ে যায় না বা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।

কিন্তু আমরা সবাই যদি ধরে নেই, মানুষ আদর্শ এবং একটি অপরাধ ঘটলেই অপরাধীকে চরম পাপী ভেবে চরম শাস্তির মুখে ঠেলে দিতে হবে, তাহলে কিন্তু কোনোভাবে পরবর্তী বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না। নেক্রোফিলিয়া কেন হয়, এর সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এর সঙ্গে ব্যক্তির জেনেটিক সম্ভাব্যতা ও বেড়ে ওঠার পরিবেশের সম্পর্ক আছে। কখনও কখনও পরিস্থিতির কারণেও এটি তৈরি হতে পারে। তাই সব ক্ষেত্রেই চিকিৎসার একটা ব্যবস্থা থাকা উচিৎ।

মুন্না ভগতের বয়স এখন ২০। গত কয়েক বছর থেকেই সে তার মামা জতন কুমার লালের সঙ্গে মর্গে সহযোগিতা করে। অর্থাৎ সে যখন থেকে মর্গে লাশ নাড়াচাড়া শুরু করে তখন সে শিশু। হাসপাতালের মর্গে সদ্য মৃত কিশোরীদের নিরাভরণ লাশ নাড়াচাড়া করছে ১৬-১৭ বছরের একজন কিশোর।

মামা বলেছে, গ্রামে খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা থাকায় ভাগ্নে মুন্নাকে গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী থেকে এনে তিনি তার সঙ্গে রাখতেন। এর মানে মানসিক ডিসঅর্ডারের লক্ষণ মুন্নার মধ্যে আগে থেকেই ছিল, যা সাইকোপ্যাথিক আচরণের পূর্বলক্ষণ।

সাইকোপ্যাথি, পর্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা প্যারাফিলিয়া মানসিক সমস্যা হলেও তার কারণে করা অপরাধ শাস্তিযোগ্য। আর তাই নেক্রোফিলিয়া হলেও এই মুন্নার শাস্তি হবেই, যেমনটা হয়েছিল খলিলউল্লাহর। মর্গে নিয়োগের সময় যথাযথ স্ক্রিনিং, ট্রেনিং ও মনিটরিং প্রয়োজন।

একটি খবরে দেখলাম যে, সুইডিশ লিবারেল পার্টির যুব শাখা নেক্রোফিলিয়াকে বৈধতা দেয়ার দাবি তুলেছে। তাদের দাবি, মানুষের উচিৎ মৃত্যুর পর তার দেহ কী হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার। কেউ চাইলে গবেষণার কাজে দিতে পাওে, কেউ চাইলে জাদুঘরে দিতে পারে। সে রকম যৌনক্রিয়ার জন্যেও কেউ যদি দেহ দিয়ে যেতে চায়, তাহলে তা আইনত বৈধ হওয়া উচিৎ।

তবে কেন্দ্রীয় লিবারেল পার্টি এর সঙ্গে একমত নয়। ইউরোপে এ ধরনের দাবি এটাই প্রথম নয়। তবে কোনো সরকারই এসব কাজকে আইনগত ভিত্তি দেয়নি। বরং সব দেশেই এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সামাজিক সুস্থতার ক্ষেত্রে গঠনমূলক পথে না এগোলে সুইডিশ লিবারেল পার্টির যুব শাখার মতো আমাদের ছেলেমেয়েরাও অনেক বিকৃতিকেই আইনগত বৈধতা দেয়ার দাবি তুলবে, এটা নিশ্চিত। আমরা যদি শুধু শাস্তির পথে যাই বা কিশোর-তরুণদের বিভিন্ন ইস্যু ও চাহিদাগুলোর ব্যাপারে মনোযোগ না দেই, তাহলে এই অশান্ত ও বৈষম্যমূলক সমাজে আক্রান্ত মানুষ নেশা ও আত্মঘাতের পথে এগোবে।

মুন্নার এই অপরাধ কিন্তু সরাসরি ‘পথভ্রষ্ট’ হওয়া থেকে নয়। যাদের এমন হয়, তাদের সামনে পথ থাকে না বা তারা সেই পথ দেখতে পায় না। যথাযথ চিকিৎসা না করিয়ে শুধু শাস্তি দিলে তাকে সমাজ থেকে দূরে রাখা যায়, কিন্তু তাকে সুস্থ করা যাবে না। সেই সঙ্গে আরও যাদের এমন হবে তাদের ঠেকানো যাবে না। সেই জন্য সামাজিক সুস্থতার ক্ষেত্রে গঠনমূলক পথে এগোতে হবে এবং এর জন্য চাই বিষয়গত শিক্ষা ও কিছু গোপন না করে শুরুতেই ব্যবস্থা নেওয়া।

লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

এ বিভাগের আরো খবর