আমি তখন এটিএন নিউজের নিয়মিত টক শো নিউজ আওয়ার এক্সট্রা উপস্থাপনা করছিলাম। প্রডিওসার টক ব্যাকে বললেন, একটা ব্রেকিং নিউজ আছে। ম্যারাডোনা মারা গেছেন। একটা ব্রেকিং নিউজ যে কতটা হার্ট ব্রেকিং হতে পারে, সেটা তখন টের পেলাম। এমন একটা ব্রেকিং নিউজ শোনার পর লাইভ টক শো চালিয়ে নেয়া আমার জন্য কষ্টকর ছিল। আমার পৃথিবী দুলে উঠেছিল। ম্যারাডোনাকে নিয়েই ছিল টক শোর বাকি আলোচনা। পরে জেনেছি, ম্যারাডোনা অসুস্থ ছিলেন। ছিল অতিরিক্ত মাদক গ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা। গত মাসেই মাথায় একটা অপারেশন শেষে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছিলেন। বাসাতেই বিশ্রামে ছিলেন। সেখানেই হৃদযন্ত্র তাকে চির বিশ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে।
আমি চিরকালীন ব্রাজিলভক্ত। জীবনভর বিশ্বকাপ এলেই ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা, পেলে না ম্যারাডোনা- এই অর্থহীন তর্ক করে গেছি। অথচ এখন মৃত্যুর পর টের পাচ্ছি, ম্যারাডোনার জন্য হৃদয়ের গোপন কুঠরিতে কতটা আবেগ, কতটা ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছিলাম। ১৯৮৬ সালে আমি ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ি, থাকি নিউ হোস্টেলে। ঐ বয়সে ছেলেদের পড়ার টেবিলে প্রেমিকার ছবি বা প্রিয় নায়িকার ছবি থাকে। আমার পড়ার টেবিলে ছিল ম্যারাডোনার ছবি।
ম্যারাডোনাই আমাদের প্রেম, আমাদের মুগ্ধতা। কাল ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর এক ব্রাজিলভক্ত বেশ গর্ব করে বলছিলেন, আমি ৮৬এর বিশ্বকাপ দেখেছি, কিন্তু ম্যারাডোনায় আচ্ছন্ন হইনি। আমার তার জন্য করুণা হয়েছে। ৮৬-এর বিশ্বকাপ দেখেও যিনি বা যারা ম্যারাডোনায় আচ্ছন্ন হননি, হয় তিনি ফুটবল বোঝেন না, নয় দলীয় সমর্থন তাকে অন্ধ বানিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে অনেক মানুষ আছেন, দলীয় আনুগত্য যাকে অন্ধ বানিয়ে রাখে। আওয়ামী লীগ সমর্থক বিএনপির ভালো কিছু দেখে না, বিএনপি সমর্থকের কাছে আওয়ামী লীগের সব খারাপ। সেই ব্রাজিলভক্তের দশাও হয়েছে সেই অন্ধদের মতো, দলীয় সমর্থন তাকে অন্ধ করে রেখেছে।
এখন যেমন ক্রিকেট, একটা সময় বাংলাদেশে তেমন ছিল ফুটবল। বলা ভালো, তারচেয়েও অনেক বেশি। এখনও চারবছর পর ফুটবলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসাটা টের পাওয়া যায়। বাংলাদেশের আকাশ ঢেকে যায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকায়, কারো বাড়ির রঙ বদলে যায়। আমি নিশ্চিত, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে বাংলাদেশে যত আবেগ, যত মাতামাতি; ওই দুই দেশেও ততটা নয়। তবে ১৯৮৬ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে ফুটবল মানেই ব্রাজিল, আর ফুটবলার মানেই পেলে। ততদিনে পেলে ব্রাজিলকে তিনটি বিশ্বকাপ জিতিয়ে নিজে রাজার আসনে বসে আছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, ৮৬এর বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত গোটা ফুটবল বিশ্বই ব্রাজিলশাসিত ছিল। এমনকি ১৯৭৮ সালে আর্জন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ও তাতে তেমন ভাগ বসাতে পারেনি। কিন্তু ১৯৮৬এর মেক্সিকো বিশ্বকাপে ম্যারাডোনায় তাতে ভাগ বসিয়েছেন। শুধু বসিয়েছেন নয়, একজন চিরকালীন ব্রাজিল সমর্থক হিসেবেও স্বীকার করছি- বাংলাদেশে এবং বিশ্বে আর্জেন্টিনার সমর্থক সংখ্যায় বেশি। আর এর পুরো কৃতিত্ব ম্যারাডোনার একার। ৩৪ বছর আগের সেই ম্যারাডোনা জাদুতে আচ্ছন্ন এখনও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। ৩৩ বছর কেটে গেছে, কেউ কথা রাখেনি; আর্জেন্টিনা আর শিরোপা জেতেনি। কিন্তু তবুও ম্যারাডোনাতেই মুগ্ধ বিশ্ব।
ম্যারাডোনা চারটি বিশ্বকাপ খেলেছেন। ৮২ সালের প্রথম বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে লাল কার্ডে, ৮৬-এর বিশ্বকাপ একাই জিতেছেন, ৯০-এর বিশ্বকাপেও একাই দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন, ৯৪ সালে তার বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে। বিশ্বকাপ এবং জাতীয় দল ছাড়াও বার্সেলোনা, বোকা জুনিয়র্স আর নেপোলির হয়ে করেছেন অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড-কারখানা। নেপোলিতে তিনি পূজিত হন ঈশ্বরের মর্যাদায়। আসলেই তিনি ঈশ্বর ছিলেন- ফুটবল ঈশ্বর। সেই ঈশ্বরের বিদায়ে তাই কাঁদছে ফুটবল বিশ্ব। ম্যারাডোনা যদি আর কিচ্ছু না করে শুধু ৮৬-এর বিশ্বকাপটিই খেলতেন, তাহলে তিনি শ্রেষ্ঠই থাকতেন।
আমি ফুটবলভক্ত, বিশেষজ্ঞ নই। তাই ম্যারাডোনাকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধু বুঝি মাঠের ম্যারাডোনা অবিশ্বাস্য, অপ্রতিরোধ্য, বিস্ফোরক। জাদুকর যেমন মানুষের চোখের সামনেই তার চোখে ধুলো দিয়ে দেয়; ম্যারাডোনাও তেমন, মানুষ নন জাদুকর। ফুটবলের রাজা পেলের খেলা দেখিনি, সিনিয়রদের কলমে পড়েছি। পরিসংখ্যানও তার পক্ষে। তিনটি বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন ব্রাজিলকে। আমি ৮২-এর বিশ্বকাপ থেকে বিশ্ব ফুটবল দেখছি। জিকো থেকে এমবাপ্পে- সবার খেলাই দেখেছি টিভি পর্দায়। আমি অন্তর থেকে বলছি, ম্যারাডোনাই শ্রেষ্ঠ। তার ধারে কাছেও কেউ নেই।
১৯৮৬-এর বিশ্বকাপ বললাম বটে। তবে ম্যারাডোনাকে আরো সংক্ষিপ্ত করে আনলে সেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি। সেই এক ম্যাচই তাকে অমরত্ব দিয়েছে, শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে। সেই ম্যাচটি যেন ম্যারাডোনার ৬০ বছরের জীবনের সারাংশ। একই সঙ্গে সবার সেরা, একই সঙ্গে সবচেয়ে বিতর্কিত। ফকল্যান্ড যুদ্ধের পরপর ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনার সেই ম্যাচ যেন নিছক ফুটবল ম্যাচ নয় যুদ্ধ। আর ম্যারাডোনা প্রমাণ করেছেন- নাথিং ইজ আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। ম্যারাডোনা ছিলেন ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। ইংল্যান্ডের গোলমুখে উড়ে আসা বল তার নাগালের বাইরে ছিল। তিনি এমনই জাদুকর, রেফারির চোখে ধুলো দিয়ে হাত দিয়ে গোল দিয়ে দেন। পরে ম্যারাডোনাও স্বীকার করেছেন, গোলটি করেছে ঈশ্বরের হাত। তবে ম্যারাডোনা নিজেই তো ফুটবল ঈশ্বর, ইংল্যান্ডকে হারাতে তার ঈশ্বরের হাতের সাহায্য লাগবে কেন? এই প্রশ্নের জবাব দিতে সময় নিলেন মাত্র ৫ মিনিট। ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত গোলটি করার ৫ মিনিট পর ম্যারাডোনা যা করেছেন; তা অবিশ্বাস্য, অতুলনীয়, ফুটবল ক্ল্যাসিকের প্রথম পাতা। নিজেদের অর্ধে বল পেয়ে ৬ জনকে ছিটকে ফেলে দেয়া সেই গোলটি গতি, ড্রিবলিং, ফিনিশিংএর এক জাদুকরি মিশেল।
বলছিলাম ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচটি ম্যারাডোনার জীবনেরই একটা মিনি ভার্সন যেন। একই সঙ্গে সবার সেরা এবং সবচেয়ে বিতর্কিতও। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তাকে ভালোবাসে বটে, কিন্তু কেউই চাইবেন না তার সন্তান ম্যারাডোনার মতো হোক। মাদক তার বিশ্বকাপ শেষ করেছে, এখন তার জীবনও কেড়ে নিল সেই মাদকই। অবাধ সম্পর্ক, ট্যাক্স ফাঁকি, সাংবাদিকদের দিকে গুলি ছোড়া- বিতর্কের বারুদে ঠাসা তার জীবন। ম্যারাডোনা এক খেয়ালী রাজপুত্র, এক পাগলা রাজা। তিনি জীবনভর তাই করেছেন, যা তার মন চেয়েছে। আমরা অনেককিছুই করতে চাই। ধর্ম, রাষ্ট্র, আইন, সমাজ আমাদের আটকে রাখে। ম্যারাডোনা কিছুই কেয়ার করেননি; মাঠে যেমন, জীবনেও তেমন- কেউ তাকে আটকাতে পারেনি। ম্যারাডোনাকে বর্ণনা করার ভাষা আসলে আমার নেই। প্রায় শতবছর আগে বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলাম ম্যারাডোনার জন্যই বুঝি লিখে গেছেন-
'আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!'
আমি অনেক বিবেচনা করে দেখলাম, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন ম্যারাডোনা। বিশ্বে তাকেই চিনত সবচেয়ে বেশি মানুষ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তাকে ভালোবেসেছে। তিনিও নিপীড়িত ভালোবেসেছেন। প্রচণ্ড আবেগই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। তিনি ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বন্ধু, চে গুয়েভেরা উল্কি আঁকান শরীরে। তিনি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, মানুষকে ভালোবেসেছেন। জানি না, হয়ত ভবিষ্যতে ম্যারাডোনার চেয়ে ভালো ফুটবলারও জন্মাবে। তবে খ্যাতিতে-বিতর্কে-অপকর্মে এমন বর্ণাঢ্য সার্বজনীন চরিত্র আর কখনোই আসবে না। আবারও কবিতায় সমর্পন করি- এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর...।
প্রভাষ আমিন: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ