গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকায় সাল ১৯৯০ হয়ত অনেকের জীবনেই তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তবে আমার স্মৃতিতে এর একটি বিশেষ অবস্থান আছে। জীবন স্রোতে হতাশা, প্রাপ্তি আর এগিয়ে চলার যে প্রথম এক উপলব্ধি তার উৎস হয়ত এই নব্বুই। আর এই বছরটিতেই আমি চিনেছিলাম তাকে, বরং বলতে পারি জেনেছিলাম তাকে- দিয়াগো আরমান্দো মারাদোনা ফ্রাংকো, আমার প্রিয় ম্যারাডোনা।
বয়স দুই অংকে পৌঁছায়নি তখনও। তখনকার ঢাকায় মিরপুর বেশ দূরের, আমরা থাকতাম শাহজাহানপুররের রেলওয়ে কলোনিতে সাবলেট বাসায় ভাড়া। ১৯৯০ এর ফেব্রুয়ারিতে বাসা বদল। মাত্র থিতু হতে শুরু করা স্কুল, কলোনির পরিবেশ, সদ্য বুঝতে শেখা বন্ধুত্ব আর পিছুটানের তরতাজা অনুভূতি নিয়ে জীবন স্রোতে ভেসে চলার শুরু।
বাসায় ২০ ইঞ্চির সাদাকালো নিপ্পন ব্র্যান্ডের টেলিভিশনটি ছিলো ওই সময়ের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য খানিকটা অহংকারের সম্পদ। বাসা বদলের আরও বছর চারেক আগেই পরিবারে এর আগমন। তখনও ঢাকায় মধ্যবিত্ত পরিবারে টেলিভিশন খুব সহজলভ্য তো ছিলো না। হয়ত তাই, মিরপুরে আমাদের নতুন ভাড়াবাসাটি অন্তত প্রথম তিন-চার মাস প্রতিবেশীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল টেলিভিশনটির গুণে। বিশেষ করে নব্বুইয়ের জুন-জুলাইয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল। ম্যাচগুলো ইতালি থেকে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন- বিটিভি।
ফুটবল বিশ্বকাপ ঘিরে উন্মাদনার ছোঁয়া বুঝতে শেখার বয়স হয়েছে মাত্র। ‘ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন’ দলটির নাম আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপের নায়ক ম্যারাডোনা। ফুটবল খেলার বুঝি না ছাই কিছুই, অথচ ঘরে-বাইরে সবখানে ম্যারাডোনা আর ম্যারাডোনা। রাস্তায় রাস্তায় পতাকা বিক্রি, ভিউকার্ড আর পোস্টারের ছড়াছড়ি। ঘরে ঘরে ফুটবল কেনার হিড়িক। দোকান, মাঠ, মহল্লা, বাসার ড্রয়িং রুম বা শোবার ঘর এমনকি গোরস্থানের দেয়ালে- সর্বত্র তিনি বিরাজমান।
ছিয়াশিতে ঘরের মাঠে সাধারণ ভালো মানের আর্জেন্টিনা দলকে অনেকটাই একক নৈপুণ্যে বিশ্বকাপ জিতিয়ে ততদিনে ফুটবল আইকন ম্যারাডোনা। কিন্তু বিশ্বজয়ী নায়ক অধিনায়ক ম্যারডোনাকে আমি দেখিনি। আমি যাকে দেখেছি, চিনেছি, তিনি এক পরাজিত কিংবদন্তি, শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়া এক ফুটবলারের স্থায়ী স্মৃতি তিনি আমার কাছে। নব্বুইয়ের ৮ জুলাই রোমের স্টেডিয়ামে যেনো শত-সহস্র টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল কোটি মানুষের প্রত্যাশা- জার্মানির লোথার মাথিউসের হাতে বিশ্বকাপ, মাথা নুইয়ে মেডেল গলায় ম্যারাডোনা।
অবশ্য ঢাকায় তখনকার তরুণদের সেই শোক সামলে উঠতে সময় লাগেনি বেশি, প্রাপ্তির নাম ‘স্বৈরাচার পতন’। গণঅভ্যুত্থান নব্বুইয়ে উড়িয়ে দিলো উর্দি আর বন্দুকের নল। গণঅভ্যুত্থান- কঠিন শব্দের প্রয়োগ যে একটা জাতির ইতিহাসের কতোটা অপরিহার্য বাস্তবতা, তখন বুঝতে না পারলেও এখন অন্তত গৌরব অনুভব করি। যাই হোক, প্রসঙ্গ থেকে সরে যাওয়ার অজুহাত নেই। নব্বুই আক্ষরিক অর্থেই আমার কাছে ঢাকা-র নতুন অধ্যায়ের শুরু, ইতিহাসের এক পটপরিবর্তন, এবং একটি ম্যারাডোনাময় বছর।
লেখার এই তাগিদটা হয়ত অনুভব করতাম না, যদি না তিনি বিদায় নিতেন- ২৫ নভেম্বর, ২০২০ মৃত্যু আলিঙ্গন করল ম্যারাডোনাকে। বিদায় নয়, বরং নিশ্চিত অমরত্বই হয়ত পেলেন এর মধ্যদিয়ে। এ তো হারিয়ে যাওয়া নয়, মানসপটে বারবার ফিরে আসা। যারা ভালোবেসেছেন ম্যারাডোনাকে, কীভাবে ভুলবেন! গত শতাব্দীতে হাতেগোণা যে কয়জন মানুষ ঈশ্বরতুল্য জনপ্রিয়তায় ভেসেছেন তিনি তাদেরই একজন। কিন্তু তিনি আমাদের মতোই ছিলেন ভঙ্গুর- লোভ, পাপ, ভোগের এক বিশৃঙ্খল অধ্যায়ও এঁকেছেন। নায়ক থেকে খলনায়ক হিসেবে চরিত্র বদলে খুব বেশি সময় লাগেনি।
প্রথমবার ফুটবলে নিষিদ্ধ হলেন ১৯৯১ সালে। নিষিদ্ধ মাদক কোকেন সেবনের দায় এড়াতে পারেননি ডোপ পরীক্ষায়, ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা। যদিও পতনের শুরুটা আরও আগেই। পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন বলে, স্পেনের ক্লাব বার্সেলোনায় তখনকার দিনে ট্রান্সফার ফি-র রেকর্ড গড়ে পাড়ি দেয়ার পরই আটকা পড়েন মাদকের খপ্পরে। নেশার এই বীজ ডালপালা মেলে যখন তার ঠিকানা গড়ায় ইতালির ক্লাব নাপোলিতে। কোকেন আসক্তি থেকে স্থায়ী ছাড় আর কখনোই মেলেনি তার। ইতালিতে ফুটবল মাঠের বাইরের ম্যারাডোনা কারো কাছেই খুব পছন্দের হতে পারেন না সম্ভবত। অপরাধচক্রের সঙ্গে মাখামাখি, দুর্নীতির অভিযোগ, মাদক সেবন, সাংবাদিককে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া- সংবাদমাধ্যমে চাপা পড়েনি।
কিউবার বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধু বনে গেলেন মাদকাশক্তি থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে। লা পেদ্রেরা ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে গিয়ে কোকেন ছাড়তে না পারলেও সিগার জুটিয়ে নিয়েছিলেন। পশ্চিমা পুঁজিবাদের শত্রু কাস্ত্রো আর বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম ব্র্যান্ড ম্যারাডোনার এ এক অদ্ভুত বাবা-ছেলের সম্পর্ক। দেড় বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মাঠে ফিরলেও আর ছন্দে ফেরা হয়নি ‘এল পিবে দি অরো’র- ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গোল্ডেন বয়’।
নাপোলি থেকে বের করে দেয়ার পর যেটুকু আশা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপে আবারও মাদক পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে তাও মিলিয়ে গেল। আর আমি- অথবা আমরা, কী যে এক স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায়! স্কুলে আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল, আবাহনী বনাম মোহামেডান, পাকিস্তান বনাম ভারত- আমি জানি আজকের প্রজন্মের কাছে এ এক অর্থহীন আলাপন। অথচ শৈশব-কৈশোরের সেই খেলার দ্বৈরথের উন্মাদনা কেমনে ভুলি! বিশেষ করে কে সেরা? পেলে না ম্যারাডোনা! আহা, চুরানব্বইয়ে লস অ্যানজেলিসে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে রোমানিয়ার বিপক্ষে সাইড বেঞ্চে বসে চেয়ে চেয়ে দেখলেন দলের আরেকটি পরাজয়, আবারও চোখে পানি নিয়ে বিদায়। পরের দিন ব্রাজিল-সমর্থক, পেলেভক্ত বন্ধুদের টিটকারীতে নাজেহাল আমিও পরাজিত। বিশ্বকাপ জিতে নিলো ব্রাজিল!
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবলের প্রতি আমার ভালোবাসা বাড়লেও, দেশে ক্রিকেট জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। আবাহনী-মোহামেডানের সেই রোমাঞ্চ চুপিসারে জীবন থেকে হারিয়ে গেল, হারিয়ে গেল সাব্বির-আসলাম শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তর্ক। আকরাম খান, রফিকরা এলেন, এলেন আশরাফুলও। আলোচনায় সাইদ আনোয়ার, শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারারা উজ্জ্বল। ফুটবল তখন সাইডবেঞ্চে। কিন্তু ভুলিনি ম্যারাডোনাকে, ভোলা যায় না।
আমাদের জীবনেও সমান্তরালে চলেছে উত্থান-পতন। তখনকার সময়ে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজে ভালো স্কুলে ভালো ফল করা, বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ, ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে পারা ছিল যেন সাফল্যের মাপকাঠি। আমিও স্রোতের বাইরে ছিলাম না। ম্যাট্রিকের নম্বর কিছুটা বলার মতো থাকলেও উচ্চ মাধ্যমিকে পাশ দেয়াটা হয়ত আমি নিজেই মনে রাখতে চাই না। তবুও চালিয়ে গেছি পড়ালেখা, জীবনে টেনে নিয়ে চলেছি। উত্থান-পতনের এই গল্প শুধু আমার একার নয়, আমি চিনি-জানি এমন একটি গোটা প্রজন্মের এভাবেই কেটেছে দিন। অনুপ্রেরণার একটি উৎস হয়ত তিনিই ছিলেন- ম্যারাডোনা।
নিজেকে এতটা অপচয়ের পেছনে মূল কারণ হয়ত ছিল তারকাখ্যাতিই। ম্যারাডোনা তবুও হাল ছাড়েননি। বিশ্ব ফুটবল মঞ্চে আরেকবার তিনি দেখা দিলেন আর্জেন্টিনার কোচের ভূমিকায়, যে দলের প্রাণভোমরা আরেক মহাতারকা লিওনেল মেসি। আবারও ব্যর্থতা-নিষেধাজ্ঞা! বলিভিয়ার কাছে শোচনীয় পরাজয়, টেনেটুনে বিশ্বকাপের মূল আসরে জায়গা করে নেয়া আর্জেন্টিনা, সাংবাদিককে গালমন্দ করে দুই মাস সব ধরনের ফুটবল থেকে বহিষ্কার- এরই নাম ম্যারাডোনা! ২০১০ সালের জুলাইয়ে সাউথ আফ্রিকায় মেসি-ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে কোয়ার্টার ফাইনালে ৪-০ গোলে বিদায় করে দিলো পুরানো প্রতিপক্ষ জার্মানি। ওই মাসেই কোচের পদ থেকে বরখাস্ত হন ম্যারাডোনা।
আর্জেন্টিনার সমর্থক আমরা আরও একবার হতাশ। তবে তাতে বেশিরভাগেরই জীবন থেমে থাকেনি। যেমন থেমে থাকেননি ম্যারাডোনা। অসম্ভব-সম্ভব বর্ণিল, বিচিত্র, আলোচিত-সমালোচিত, বিতর্কিত এবং তারপরেও তিনি অনুপ্রেরণা। আমার কাছে, আমার প্রজন্মের কাছে ম্যারাডোনা শুধু একজন তারকা ফুটবল খেলোয়াড় নন, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আবেগ আর প্রত্যাশা থেকে হতাশার নাম।
একজন মানুষের জীবনে সাফল্যের মাপকাঠি কতটা উঁচুতে উঠতে পারে, আর পরাজয়ের গ্লানি কতখানি তলিয়ে নিতে পারে- সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। ম্যারাডোনাকে যত বেশি গালাগাল দেয়া যায়, তাকে ততটাই আপন করে নিতেও ইচ্ছা করে- এই তো জীবন। জীবনের লক্ষ্য যাই থাক জয়-পরাজয়ের উপাখ্যান প্রত্যেকের জন্য অনিবার্য- আর সেই অনিবার্যতার এক অনন্য উদাহরণের হলো যবনিকাপাত! তাই আবারও বলি নানান উত্থান-পতনের পরেও বর্ণিল জীবনের অনুপ্রেরণার নাম- ম্যারাডোনা।
লেখক: সাংবাদিক