‘যে যায়, সে যায়’– কথাটা ভীষণভাবে তোলপাড় করে মনের ভেতর; প্রিয় কেউ চলে গেলে আপন মনে গুনগুন করি। দুদিন ধরে চলছে সেই গুনগুন। চলে গেলেন কবি হিমেল বরকত! এ কথা বিশ্বাস করতে হচ্ছে এবং এ কথা বিশ্বাস করতে হবে; কোনো দিন আর দেখা হবে না, কোনো দিন না!
ছবিভরা অ্যালবামের মতো স্মৃতিগুলো উল্টেপাল্টে দেখব। যে মানুষ তিন দিন আগেও ছিল ‘বর্তমান’, আজ সে ‘অতীত’! আমার টেবিলে তার বই, মাথা জুড়ে অজস্র স্মৃতি। হু-হু করে ধাবমান স্মৃতিগুলো জাপটে ধরছে। এই সেদিনও ঘর গোছাতে গিয়ে ছোট্ট একটা চিরকুট পেলাম, হিমেল বরকতের হাতে লেখা– কিছু বইয়ের তালিকা। তখনও কী জানতাম, হিমেল চলে যাবে! আজ জানি হিমেল চলে গেছে। যতবার স্মৃতির তোরঙ্গ খুলে বসি, ততবার স্মৃতি জুড়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমে আসে, ঝাপসা চোখে স্মৃতিগুলো দেখি।
হিমেল বরকত– হিমেল ভাই! রুম নম্বর ৩১৯, আফম কামালউদ্দিন হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই রুমের সঙ্গে সে সময়ের কার যোগাযোগ ছিল না?- কবি, লেখক, ছাত্রনেতা, সংগঠক- সেটাই ভাবি।
বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম, কে কে কবিতা লেখে। স্বেচ্ছায় যারা বাংলা পড়তে আসতো তারা তখন কবি-সাহিত্যিকেরই খোঁজ করত। জানলাম, অনেক অনেক কবি আছে বাংলা বিভাগে– অভী চৌধুরী, হিমেল বরকত, সোহেল হাসান গালিব, মাদল হাসান, রাশেদুজ্জামান। জানলাম, হিমেল বরকত খুব ভালো ছাত্র। কবি ও ভালো ছাত্র– এই দুইয়ের অভাবিত সম্মিলন আমাকে উদ্দীপিত করল। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কনিষ্ঠ জন– এই খবর আমার কাছে ছিল ঘোর বিস্ময়ের ব্যাপার। একদিন পৌঁছে গেলাম তার খোঁজে; গিয়ে দেখি, সাদাসিধা, খানিকটা গম্ভীর মনে হলেও, মূলত হাস্যোজ্জ্বল একজন মানুষ- দারুণ ভদ্র ও বিনয়ী।
সে রুমে কবিতা পড়া হতো; রাতের বেলা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পকেটে কবিতা নিয়ে হাজির হতাম। ভয় ছিল হিমেল-গালিব-মাদল কী বলে! আমরা ছোটরা বরং ওদের কবিতা ও কথা শুনতাম। দরাজ গলায় হিমেল ভাই হাসতেন। মনে পড়ে, সেখানেই এক দিন ঠিক হলো বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করা হবে। সাহিত্য-সংক্রান্ত বিভাগ হওয়া সত্ত্বেও বাংলা বিভাগ থেকে তখন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হত না। এই শূন্যতা পূরণের আকাঙ্ক্ষা ছিল হিমেল বরকতের। অতএব উদ্যোক্তা হলেন তিনি। আমরা সহায়ক। প্রতি বর্ষ থেকে একজন করে সম্পাদনা পর্ষদে নেয়া হলো। হিমেল ভাই আমাকেও নিয়ে নিলেন সেই পত্রিকায়।
পত্রিকার নাম রাখা হলো: হৃদ্যরৌদ্র। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হলেও স্নাতকোত্তর পর্বের অগ্রজরা হিমেল বরকতকে স্নেহ ও সম্মান দুই করতেন। আর তাই তার সম্পাদনায় প্রকাশিতব্য পত্রিকার পর্ষদে সদস্য হতে কারো কোনো জড়তা বা আপত্তি দেখিনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে এ রকম একটি প্রকাশনার সঙ্গে জড়িয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। আমার মফস্বলি জীবনে সম্পাদনার অভিজ্ঞতা ছিল জেনে হিমেল বরকতও ভরসা করেছিলেন।
খেয়াল করলাম, হিমেল বরকত খুবই গোছানো মানুষ, পরিকল্পনা করে গুছিয়ে কাজ করেন; আমি তার প্রায় শতভাগ উল্টো। হাতে লিখে সুন্দর করে গুছিয়ে তৈরি করে ফেললেন হৃদ্যরৌদ্রের পুরো পরিকল্পনা– প্রচ্ছদ, লেখক তালিকা, সম্ভাব্য বিজ্ঞাপন, প্রুফ, মুদ্রণ– একটি পত্রিকার সমস্ত ধারাবাহিকতা কাগজে লেখা শেষ। লেখক তালিকায় আমার নাম; বললেন, ‘একটি কবিতা দিতে পারো অথবা একগুচ্ছ কবিতা দিতে পারো। তবে দুই পৃষ্ঠার বেশি নয়।’গুচ্ছ কবিতার আহ্বান নিঃসন্দেহে লোভনীয় ব্যাপার। কিন্তু আমার ছিল একটা দীর্ঘ কবিতা। আর ছিল নিজের লেখা প্রিয় একটা কবিতা। মনে মনে আমি চাইছিলাম, দুটিই প্রকাশিত হোক।
রাতের বেলা ভয়ে ভয়ে হাজির হলাম কবিতাগুলো নিয়ে। হিমেল ভাই গভীর মনোযোগের সঙ্গে কবিতা দুটি পড়ে বললেন, ‘অসাধারণ!’ ওই বয়সী কবির কাছ থেকে ছন্দ নিয়ে নিরীক্ষা তাঁর কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তিনি দুটিই পছন্দ করলেন, কিন্তু জায়গা কম বলে দীর্ঘটি ছাপতে চাইলেন; কারণ দুই পৃষ্ঠায় সুন্দরভাবে এঁটে যায়। আমি হাসলাম, মুখে কিছু বললাম না। বললেন, ‘বুঝেছি স্বরবৃত্তটির প্রতি তোমার দুর্বলতা আছে। কবিতাটা সুন্দর। আচ্ছা, তাহলে দীর্ঘটা থেকে একটা অংশ বাদ দিই।’
অতঃপর বিজ্ঞাপনের জন্য অভিযান। পুরো সাভারে সম্ভাব্য সব জায়গায় ঘুরে ফেললাম, আমি এবং অন্যরা হতাশ হচ্ছিলাম। কিন্তু হিমেল বরকত মৃদু হেসে আশা রাখছিলেন এবং আমরা বিজ্ঞাপন পেয়েও গেলাম! হৃদ্যরৌদ্র প্রকাশিত হলো। সে কী উচ্ছ্বাস আমাদের। ওই পত্রিকার প্রায় সবার লেখার বিষয়, প্রসঙ্গ আমার মনে আছে। আমার জন্য অভাবিত রকম প্রেরণা হিসেবে পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলেছিলো এই পত্রিকা।
যে শূন্যতা থেকে হৃদ্যরৌদ্রের জন্ম হয়েছিল সেই শূন্যতা পূরণ করতে পেরেছিলাম চাকরি-জীবনে বাংলা বিভাগে প্রবেশ করে। বিভাগ থেকে বৈশাখের পাঁচালি ও নবান্ন নামে দুটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতে পেরেছিলাম আমরা– যা নিয়মিতভাবে প্রকাশ করার জন্য ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্র দ্বারা অনুমোদিত। এর সত্যিকার প্রেরণা ছিল সেই হিমেল বরকতের সম্পাদনায় প্রকাশিত হৃদ্যরৌদ্র এবং আমাদের ছাত্রজীবনের সমবায়িক অভিজ্ঞতা।
মূলত এই পত্রিকা দিয়েই হিমেল বরকতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল; সেটিই তৈরি করে দিয়েছিল বন্ধুত্ব ও অভিভাবকত্ব। আমাদের সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা আরও জোরালো হয়েছিল সংকীর্তন নামের সংগঠনের সূত্রে। সে সময় এর পরিচালনায় ছিলেন তিনি। আমি মোটেও সংগঠনপ্রেমী লোক ছিলাম না। কিন্তু হিমেল বরকতের ডাকে ঠিক ঠিক চলে যেতাম টিএসসিতে। সংগঠনপ্রেমী নই বলে হিমেল ভাই আমাকে দিয়েছিলেন নেপথ্যের কাজ– লেখা, স্ক্রিপ্ট রেডি করা, সম্পাদনা করা, নতুন আইডিয়া যোগ করা ইত্যাদি। সংকীর্তনের চমৎকার একটি অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়েছিল অডিটোরিয়ামের সেমিনার কক্ষে। সেই সন্ধ্যা, সেই শীত, সেই সুর আজও কানে বাজছে।
হিমেলের কবিতার বই বের হবে, নাম চোখে ও চৌদিকে। আমাকে পাণ্ডুলিপি পড়তে দিয়ে বললেন, ফ্ল্যাপ লিখে দাও। আমি বিস্ময় সামলাতে পারি না! আমি! কী করে সম্ভব! ফ্ল্যাপ তো লেখেন বড়রা! বড় কোনো কবি, লেখক; হায়াৎ মামুদ স্যার বা খালেদ হোসাইন স্যার লিখতে পারেন। আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি, হিমেল ভাই স্নাতকোত্তরে। হিমেল বললেন, ‘তুমিই লেখো। ব্যতিক্রমী হলো বিষয়টা। পরে না হয় স্যারদের দেখিয়ে নিবো।’জীবনে সেই প্রথম বইয়ের ফ্ল্যাপ লিখলাম! আমার বুকে জুড় তীব্র উত্তেজনা, হিমেলের কবিতা তো পড়বেই, কিন্তু আমার লেখা ফ্ল্যাপ পড়বে সবার আগে।
বই বের হলো। কী সুন্দর প্রচ্ছদ, রঙ, বিন্যাস! আজকের দিনের ভাষায় ‘খুব সুন্দর প্রডাকশন!’ সে সময় হলগুলোতে বই, পত্র-পত্রিকা বিক্রি করার প্রচলন ছিল। আমরা হলে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করলাম চোখে ও চৌদিকে। হিমেলের অনেক কবিতা তখন মুখে মুখে ঘুরত। যারা সাধারণত কবিতা পড়তেন না, তাদের কণ্ঠেও শোনা যেত হিমেলের কবিতা।
চোখে ও চৌদিকের ফ্ল্যাপের প্রথম বাক্য, ‘বাংলা কবিতায় তাত্ত্বিক-হুল্লোড় এবং দুর্বোধ্যতা চর্চার সমকালীন প্রতিযোগিতা ও প্রবণতা এড়িয়ে হিমেল বরকত একটি পৃথক স্বর।’আমি আজও তা-ই বিশ্বাস করি। হিমেল দুর্বোধ্য হতে চান নি। মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা তাকে আলোড়িত করত। সাহিত্য ও গবেষণায় তার স্বাক্ষর ছিল। একই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত যৌক্তিক আন্দোলন ও সংগ্রামে তাকে দেখা গিয়েছে। সম্ভাব্য পেশাজীবনে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে জেনেও হিমেল আন্দোলন ও লড়াইয়ে যু্ক্ত ছিলেন। তার খেসারত তাকে দিতে হয়েছিল।
আমার সৌভাগ্য এই যে, রাজনৈতিক প্রতিরোধ বিষয়ে আমার সচেতনতার হাতেখড়ি হিমেল বরকতের সূত্র ধরে। বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি আমাকে নিয়ে যেতেন, হিমেল কবিতা পড়তেন কিংবা বক্তৃতা করতেন। আমি খুব বেশি যেতাম না। বিভাগের ছাত্রনেতা ফারুক ওয়াসিফ, সঞ্জয় দের সঙ্গে হিমেলের রাজনৈতিক সখ্য ছিল। তার কিছু রেশ আমি পেলেও রাজনৈতিক বা লড়াই সংগ্রামকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখতাম না, জীবন সম্পর্কে মোটেও ইতিবাচক ধারণা পোষণ করতাম না। যদিও শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে থাকায় বামপন্থার প্রতি ছিলাম দুর্বল। হিমেল ভাই বরাবরই রাজনীতি সচেতন ও প্রতিবাদী। সামগ্রিকভাবেই আমি রাজনীতির প্রতি বিরক্ত ছিলাম, ঘৃণাও বোধ করতাম। রাজনৈতিক ও প্রতিবাদমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে সন্দেহের চোখে দেখতাম। হিমেল ভাইয়ের সংস্পর্শে এসে বদলে যেতে থাকে আমার মন।
ভালো ছাত্রত্ব, সাহিত্য-সংশ্লিষ্টতা, পেশা নির্বাচন, ব্যক্তি জীবন– বহুরঙিন বিষয়ের আদানপ্রদান তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমাদের। স্নাতকোত্তরে হিমেল ভাই থিসিস করবেন। বললেন, ‘বিষয় বলো। কী নিয়ে করা যায়।’ বললাম, ‘আমি বললাম বুদ্ধদেব বসু নিয়ে করেন।’ তাঁর ইচ্ছে ছিল রবীন্দ্রনাথের কোনো বিষয় নিয়ে করার। বললাম, বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ ও সাহিত্য-সমালোচনা নিয়ে করেন। তাঁর সাহিত্য-সমালোচনা নিয়ে কাজ হয় নি বাংলাদেশে। ঠিক হলো, বুদ্ধদেব বসু নিয়েই কাজ করবেন। আমি বললাম, ভবিষ্যতে আমি কাজ করলে তিরিশের অন্য কবিদের প্রবন্ধ নিয়ে কাজ করব। আমাদের ইচ্ছে ছিল ধারাবাহিকভাবে তিরিশের দশকের কবিদের প্রবন্ধ, সাহিত্য-সমালোচনা ও নন্দনতাত্ত্বিক অবস্থানকে স্পষ্ট করে তোলা। আমি সেই ধারাবাহিকতায় স্নাতকোত্তরে বিষ্ণু দের প্রবন্ধ নিয়ে কাজ করি। আমাদের যৌথযাত্রার এটিও একটি পর্ব।
একসময় হিমেল বরকত নিয়োগ পেলেন বাংলা বিভাগে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি আমার শিক্ষকই হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দূষিত রাজনীতি শিকার হয়ে সেবার নিয়োগ পেয়েও যোগ দিতে পারেন নি। পুরো নিয়োগ-প্রক্রিয়া বাতিল হয়ে গিয়েছিল। যেদিন বাতিল হলো, সেদিন প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলাম আমরা। অবশ্য এতে করে কিছু দিনের মধ্যেই ভাগ্য খুলে যায় আমার এবং অন্য অনেকের। আমি যোগ দিই। সেবারও হিমেল ভাই নিয়োগ পেলেন না। প্রচণ্ড কষ্ট ও লজ্জা বোধ হচ্ছিল আমার। হিমেল ভাই যোগ দিতে পারেন আমার যোগদানের বছর খানেক পর। এই বছর জুড়ে আমাদের যোগাযোগ ছিল অক্ষত। পেশাগত ব্যবধানকে হিমেল বরকত কোনো দিন ঈর্ষার চোখে দেখেননি। কারণ তার সেই চোখটিই ছিল না। আমি তার স্নেহের ছায়া থেকে কোনো দিন বঞ্চিত হইনি, আমিও তাকে শ্রদ্ধার আসন থেকে কোনো দিন সরাইনি। আমার জীবনের পরম উচ্ছ্বাস ও আনন্দের একটি দিন ছিল হিমেল বরকতের চাকরি প্রাপ্তির দিন।
আমাদের কতো কতো পরিকল্পনা– পাঠক্রম, বিভাগীয় ছাত্র সংসদ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রভৃতিতে বদল আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাতিষ্ঠানিক অচলায়তনে আমাদের কিছু কিছু চিন্তা ও কর্মকাণ্ড ছিল বেশ বৈপ্লবিক। আমরা তাই পরস্পরের রাশ টেনে ধরতাম, সামলাতাম। পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করে নিজের চিন্তাকে যাচাই করে নিতাম। কোনো বিষয় নিয়ে মতবিরোধ তৈরি খুব কম সময়ই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সংসদ সাংস্কৃতিকভাবে সচল হতে পেরেছিল হিমেল বরকতের অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে। নতুন নতুন অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করতেন তিনি। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এসব কাজ করতে গিয়ে নিজের লেখালেখি ও গবেষণায় হিমেল বরকত পূর্ণ মনোযোগ পারেনি। আমি আশা করতাম, হিমেল দারুণ সব কবিতা লিখবে, বই করবে; ভাবতাম হিমেল স্থবির হয়ে গেলে আমিও স্থবির হয়ে যাবো।
গান নিয়ে তার গভীর আগ্রহ ছিল। একবার একটা গানের বই এনে উপহার দিলেন- গানের ঝরাপাতা। আমি খেপাতে চাইলাম, ‘গাতক হইছেন!’ হা হা হা করে হাসলেন, বললেন, ‘গাইতে তো পারি না।’ নতুন বই বের হলেই নিয়ে আসতেন, রুমে ঢুকতেই টেবিলের ওপর মেলে ধরতেন। তারপর লিখে উপহার দিতেন। সর্বশেষ দেখালেন নিজের এবং কন্যা অতন্দ্রিলার বই; অসাধারণ দুটি বই– বাবা ও মেয়ের বই এক সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে। বললাম, আমাকে প্রচ্ছদ দেন। ইচ্ছে ছিল আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ওয়েব ম্যাগাজিন সহজিয়ায় বই পরিচিতি হিসেবে দুটো বইয়ের প্রচ্ছদ ও পরিচিতি ছাপব। হিমেল ভাই অতন্দ্রিলার বইয়ের প্রচ্ছদ দিলেন। প্রকাশ হওয়ার আগেই হিমেল ভাই বিদায় জানালেন। অথচ আরও অনেক কাজ করার কথা ছিল; সহজিয়ায় ছন্দ-অলঙ্কার নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লেখার কথা ছিল। লেখা প্রস্তুতও করছিলেন। হায়, তিনিই হয়ে গেলেন লেখার বিষয়!
গত বছর আমার একটি কবিতার বই বের হয়েছে। উৎসর্গ করেছিলাম হিমেল বরকতকে। লিখেছিলাম, ‘প্রিয়দের একজন... প্রিয় কথাগুলো তাঁর জন্য।’ হিমেল জানতেন না। প্রতি বারের মতো বই কিনে বাসায় গিয়েছেন। বিভাগে এসে আমাকে বললেন, বই কিনেছেন এখনও পড়েন নি। আমি তখনও কিছু বললাম না। তিন-চার দিন পর হঠাৎ ফোন, ‘আরে, কী মিয়া, উৎসর্গ করছ। কিছু তো বললা না! আজ পড়তে গিয়ে দেখি এই কাণ্ড! হা হ হা...’ আমি বললাম, ‘আপনার এই কথাগুলো শোনার জন্য কিছু বলিনি।’ তিনি উচ্চস্বরে হাসলেন; আমি দেখতে পেলাম, হিমেল ভাইয়ের আনন্দে উচ্ছ্বসিত চকচকে চোখ! পরশু থেকে ভাবছি, কেন উৎসর্গ করলাম? আমি কী বুঝতে পেরেছিলাম কিছু? এই সব অর্থহীন ভাবনা আমাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে।
জীবনের স্বল্পায়তন পরিসরে হিমেল যতটুকু কাজ করেছেন বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মৌলিক রচনা ও গবেষণা দুই দিকেই তার সমান টান ছিল। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশের কবিতা, পথকবিতা, সুন্দরবন, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি বিষয়ে তার শ্রমসাধ্য গবেষণাকর্ম আছে। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের চেষ্টা আছে প্রতিটি পদক্ষেপে। পশ্চিমি আধুনিকতার প্রতি তার ও আমার দৃষ্টি মূলত প্রত্যাখ্যানের। জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে আমরা একই রকম ভাবনা ভাবতাম। পথকবিতা প্রসঙ্গে আমাদের অভিমত ছিল কাছাকাছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য নিয়েও ছিল প্রায় সমধর্মী মত। বিদ্যাচর্চায় আমরা বি-উপনিবেশায়নের কথা ভাবতাম। বেশি চাইতাম সেই চিন্তার প্রয়োগ। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলা বিভাগের বিদ্যায়তনিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রশ্নে প্রায় একই ধরনের চিন্তা করতাম আমরা।
সম্ভবত আমরা একই পথে হাঁটছিলাম। আমার সৌভাগ্য যে, বিভিন্ন কারণে হিমেলের সঙ্গে আমার নামটি উচ্চারিত হয়: হিমেল-সুমন। কল্পনা করি, শেষ দিগন্তের দিকে উড়ে যাচ্ছে দুটো পাখি। ডানা খসে হিমেল ঝরে গেছে, সুমন আছে! দুটো নাম লিখে তাকিয়ে আছি। কিন্তু বেশি ক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে। আমাদের নাম দুটো অসীমে ঝুলে থাক... ভালোবাসা দীর্ঘজীবী হোক...
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।