এই প্রশ্নটি আমার মাথায় ঘুরছিল অনেকদিন ধরেই। গুজবের ধরণ ভিন্ন হলেও এর বিস্তৃতি ছিল আগেই। সমাজের আনাচা-কানাচে গুজবের চর্চা দেখা যেত। তবে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আসার পর মনে হচ্ছে, এর ভয়াবহতার মাত্রা ছাড়িয়েছে। একটি গুজব যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, এর উদাহরণ আমরা সম্ভবত প্রথম পাই ২০১৩ সালে, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্বের বাঙালি এক হয়েছিল। গর্জে উঠেছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে। ঘরে ঘরে তখন একটাই স্লোগান ছিল। সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই সামিল হয়েছিল একই স্লোগানে। পাকিস্তানের এদেশীয় এজেন্ট জামায়াতে ইসলামীর ষড়যন্ত্রকারীরা যখন দেখল কোনোভাবেই আর বিচারকে ঠেকানো যাচ্ছে না, তখনই তারা সামনে নিয়ে এসেছিল ধর্মকে। নাস্তিক-আস্তিক ট্যাগ দিয়ে পাল্টা খেলা শুরু করেছিল জামাত-বিএনপি।
সাঈদীকে চাঁদে দেখা গিয়েছে ঘোষণা দিয়ে হত্যা করেছিল কয়েকটি তাজা প্রাণ। আগুন দিয়ে ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তাণ্ডব চালিয়েছিল একটি এলাকাকে কেন্দ্র করে, আর সেই হত্যাকাণ্ডের টার্গেট ছিল ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা। এরপর এমন কাণ্ড আমরা আরও দেখেছি। দেখেছি ছেলেধরা বলে প্রচার করে কেমন করে একজন মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে একদল উন্মাদ লোক। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার নামে বানানো স্ট্যাটাস দিয়ে হিন্দুদেরকে নাজেহাল করার উদাহরণও কম নয়।
কোটা আন্দোলন বা নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনেও চালানো হয়েছিল এই গুজবের ট্রাম্প কার্ড। সেসব গুজবে অংশ নিয়েছে সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষজনও। আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, ফেসবুক সেলেব্রিটি যারা আমাদের কাছে সচেতন ও জাগ্রত মানুষ হিসেবে পরিচিত, তারাও অংশ নেয় এসব গুজবের নাটকে।
কেন? এর উত্তর জানাটা অত্যন্ত জরুরি। আমরা মনে হয় ভুলতে বসেছি যে সমালোচনা আর মিথ্যাচার এক নয়। আপনি যেকোনো ব্যক্তি বা সরকারের যেকোনো কাজের সমালোচনা করতেই পারেন, কিন্তু সেটা করতে হবে নিজের মত প্রকাশের মাধ্যমে। অন্যের মত প্রকাশের রাস্তাকে বন্ধ বা আক্রমণ করে নয়। অথচ আমরা এমন মানুষকেও এসব গুজবের প্রচারণায় অংশ নিতে দেখেছি, যারা নিজেরা হরহামেশা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে লেখালেখি করেন। বক্তব্য দেন বা প্রচার করে থাকেন। কিন্তু আরেক জনের কোনো কাজ যখন তাদের মতের সাথে না মেলে, তখনই দেখা যায় সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে মিথ্যা একটি অবস্থানকে সমর্থন করতে।
আমরা মানুষ। মানুষ মাত্রই তার বিবেকবোধ থাকে, নিজস্ব ভাবনার ক্ষমতা থাকে। অর্থাৎ, কোনটা ভালো বা কোনটা মন্দ সেটিকে বিবেচনা করার জন্যই কিন্তু আমাদের মগজের উপস্থিতি। মানুষ ভাবতে পারে এবং সেই ভাবনাকে প্রকাশও করতে পারে। এই বিষয়টি মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। অথচ আজকাল দেখা যায় আমরা বেশিরভাগ মানুষ এই ‘মগজ’ নামক যন্ত্রটিকে অকেজো করে ফেলছি। মরচে ধরে যাচ্ছে কেবল ব্যবহারের অভাবে। অন্ধভাবে কাউকে ফলো করা একজন স্বতন্ত্র মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত না। কাউকে ফলো করতে হলেও কিন্তু নিজের অবস্থানকে আগে পরিষ্কার করা লাগে। আপনার যুক্তি-বুদ্ধির কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হয়। অথচ, দেখা যাচ্ছে এর উল্টো চিত্র। যে কেউই চাইলে খুব সহজেই বেশিরভাগ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারছে বিনা দ্বিধায়।
এর পিছনে কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণ আছে কিন না, সেটি হয়তো সমাজবিজ্ঞানীরা ভেবে দেখবেন কিন্তু এর পেছনে যে একটি রাজনীতি আছে সেটি পরিষ্কার। আর এই রাজনীতিটি করছে একদল চিহ্নিত মানুষ, যারা চায় না দেশ আগাক, যারা চায় না সমাজে একটি সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা ফিরে আসুক, যারা চায় না মানুষের জীবন এগিয়ে যাক বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে। বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ এগিয়ে চলেছে আর আমাদের দেশের একদল মানুষ পিছিয়ে চলতে চাইছে। বিনা বিবেচনায় পিটিয়ে মানুষকে মেরে ফেলা যেন নর্মাল হয়ে আসছে দিনে দিনে। এ কেমন হিংস্রতা? ধর্মের নামে, অনুভূতির নামে ধুয়া তুলে চাইলেই যে কাউকেই মেরে ফেলা যায়? তাহলে আর আমরা আগালাম কোথায়? সভ্য হলাম কোথায়? সভ্য রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে আইন-কানুন বা নিয়ম শৃঙ্খলার মাধ্যমে।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব অথচ এখন যেন আমাদের দেশে মানুষ মানেই ভয়ঙ্কর প্রাণী হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। কখন কোথায় কে কেমন করে গুজব ও আক্রমণের শিকার হচ্ছে বা হবে বলা মুশকিল। এ যেন তুঘলকি কাণ্ড শুরু হয়েছে। মিথ্যাবাদীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সমাজকে অস্থির করতে চাইছে। এই ভয়ঙ্কর রাজনীতিকে ঠেকাতে হবে। কেবল আধুনিক পোশাক পরলে আর পেট ভরে খেতে পারলেই সভ্য হওয়া যায় না। এর জন্য দরকার মানবিক মূল্যবোধ ও মানবিকতার শিক্ষা। সেসব আজ কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে! নারীরা আজ রাস্তাঘাটে খোলা জায়গায় সবার সামনে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে একদল গুজব সৃষ্টিকারী মানুষ তাদের উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করে যাচ্ছে, অথচ বিবেকবানেরা চুপ করে থাকছে।
এ চর্চা ভয়ঙ্কর। এর ভয়াবহতা থেকে দেশ ও সমাজকে রক্ষা করার জন্য দরকার প্রতিটা ঘটনার পিছনের কারণটি খুঁজে বের করা এবং যথাযথ আইনের প্রয়োগ। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত না করা গেলে, এমন অপরাধের সংখ্যা বেড়েই যাবে। গুজব একটি মানসিক ব্যাধি কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজব ছড়ানো একটি মারাত্মক অপরাধ। এই অপরাধের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ। যেখানেই গুজব সেখানেই প্রতিরোধ।
লীনা পারভীন: কলাম লেখক