জর্ডানে বাংলাদেশের নারী পোশাক শ্রমিকরা আন্দোলন করছে, এই সংবাদের পাশাপাশি ডাস্টবিনে নারী গৃহকর্মীর লাশ পাওয়াকে কেন্দ্র করে প্রবাসী শ্রমিক বিশেষত নারী শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার সংকটের প্রশ্নটি আবার আলোচনায় এসেছে।
জর্ডানের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান ক্লাসিক ফ্যাশন অ্যাপারেল। এই কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। কারখানার শ্রমিকদের বেশির ভাগ নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সেখানে তিরিশ হাজারের মতো শ্রমিক রয়েছে।
দেশটিতে মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা দেয় এমন একটি সংস্থা তামকিন ফর লিগাল এইড অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস বলছে, এই শ্রমিকদের অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশি নারী। চুক্তিপত্রে দেখা যায়, প্রত্যেক কর্মীর মাসিক বেতন জর্ডানিয়ান মুদ্রায় ১১০ জেডি বা ১৯ হাজার টাকা। প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করতে হবে। ওভারটাইম দুই ঘণ্টা। সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন। এক বছর সফলভাবে চাকরি করলে বেতন বাড়বে সাড়ে ৭ জেডি। ফলে মজুরি পেয়ে নিজের খরচ এবং দেশে টাকা পাঠানোর পর হাতে তেমন কিছু থাকে না শ্রমিকদের। করোনাকালে তাই প্রচণ্ড দুর্দশায় পড়েছে জর্ডানে কর্মরত বাংলাদেশি পোশাক শ্রমিকরা।
তামকিন ফর লিগাল এইড অ্যন্ড হিউম্যান রাইটস সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক লিন্ডা আখলাস জানান, জর্ডানে পোশাক খাতে শ্রমিকদের বেতন একটি বড় সমস্যা। এই খাতের মজুরি জর্ডানে অন্য যেকোনো খাতের শ্রমিকদের চেয়ে কম। পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ১১০ জর্ডানিয়ান দিনার। কিন্তু অন্য যেকোনো খাতে সর্বনিম্ন মজুরি ১৫০ দিনার। স্বল্প মজুরির শ্রমিকের সন্ধান করতে থাকে সেখানের মালিকেরা। সস্তা শ্রমিকের দেশ বাংলাদেশ থেকে তাই তারা শ্রমিক নিয়ে থাকে। ২০১০ সাল থেকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বোয়েসেল জর্ডানে দক্ষ নারী কর্মী পাঠাচ্ছে। প্রত্যেক নারী কর্মীর সঙ্গে সাধারণত তিন বছরের চুক্তি করা হয় এবং চুক্তির শর্ত অনুযায়ীই প্রত্যেক কর্মী বেতন পান। প্রতি বছর গড়ে তাদের ৫ থেকে ৭ শতাংশ হারে বেতন বাড়তে থাকে। তিন বছর পর আগ্রহীরা জর্ডান যেতে চাইলে নিয়োগকর্তারা আবার তাদের নিয়ে যান। ২০০০ সালে ৯৫ জনের যাত্রার মধ্য দিয়ে জর্ডানে বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু হয়। ২০১২ সালে দেশটির সাথে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ। এরপর থেকে সেখানে বাংলাদেশি কর্মী বাড়তে থাকে। জর্ডানের বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য মতে, সেখানে আনুমানিক ৭০ হাজারের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছে যার অর্ধেকের বেশি পোশাক শ্রমিক।
শুধু জর্ডান নয় যেখানেই কাজের সন্ধান পাওয়া যায় সেখানেই ছুটছে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা। এ বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৯০ হাজার নারী শ্রমিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গিয়েছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে প্রায় ৫৪ হাজার, জর্ডানে ১৬ হাজার ৪৭১, ওমানে ১০ হাজার ৪৯৬ এবং কাতারে গিয়েছেন ৩ হাজার ২৪১ জন। নারী শ্রমিকরা বিদেশ গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছেন। বেকারত্বের চাপ মোকাবিলা করা, সংসারের হাল ধরা, উন্নত জীবনের আশায় সাহসের সাথে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াচ্ছেন নারীরা। দীর্ঘদিনের সংস্কারকে অতিক্রম করে নারী অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তারা জানে, গৃহকর্মী হিসেবে দেশে এবং বিদেশে কাজের অনেক ঝুঁকি আছে তারপরও সৌদি আরব, জর্ডান, লেবানন, কাতারসহ বিভিন্ন দেশে বৈধভাবে যাওয়ার জন্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক নারী কর্মী তালিকাভুক্ত হচ্ছেন।
যদিও শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দেশ যারা মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক পাঠায়, তারা যেসব দেশে নারীদের নির্যাতনের অভিযোগ আছে, এমন দেশে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিক পাঠানো অব্যাহত আছে। এর কারণ খুঁজতে হবে দেশের ভিতরে। যে নারীরা গ্রামের বাড়ি থেকে বাজারে আসতে সঙ্কোচ করত, যারা কখনও হয়তো ঢাকা তো দূরের কথা কোনো বড় শহরেও একা যায়নি, তারা অচেনা দেশে, অজানা ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিবেশে কাজ করতে যাওয়ার ঝুঁকি কেন নিতে পারেন, তা ভাবলে তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথাটা সামনে চলে আসে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৬৩টি দেশে প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৭ প্রবাসী রয়েছেন। এর মধ্যে ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৪৩২ নারী কর্মী। এদের মধ্যে সৌদি আরবেই রয়েছেন ৩ লাখ ৩২ হাজার ২০৪ জন।
এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (বিএমইটি) দেওয়া তথ্যে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে কাজ করতে গিয়েছেন ৪ লাখ ৭০ হাজার ২৬৫ নারী শ্রমিক। যা ১৯৯১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত পরিসংখ্যান হিসেবে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরব, ওমান ও কাতার এই তিনটি দেশে যথাক্রমে ২ লাখ ৬৮ হাজার ১১২ জন, ৫৩ হাজার ৯৮১ এবং ৪৪ হাজার ৬৮৪ নারী কর্মী গিয়েছেন।
আবার ২০১৯ সালের মে মাসে সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী শ্রমিক যান কিন্তু নির্যাতনের ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার কারণে সেপ্টেম্বরে আবার নারী শ্রমিক গমনের হার কমে আসে। ২০১৮ সালে অনলাইনে শ্রমিকরা যেসব অভিযোগ করেন তার মধ্যে শুধু সৌদি আরব থেকেই শ্রমিকদের ১৭৮টি অভিযোগ আসে। ব্র্যাক মাইগ্রেশনের তথ্যে, ২০১৯ সালে ১০ মাসে ৯৫০ নারী শ্রমিক সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন। বিদেশে কাজ করতে যাওয়া ৪৮ নারীর মৃতদেহ দেশে এসেছে সৌদি আরব থেকে। তবে প্রবাসীকল্যাণ ডেক্সের তথ্যে, সে বছরে কয়েক মাসে দেশে ফিরেছেন ১ হাজার ২৫০ কর্মী। ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশ থেকে লাশ হয়ে দেশে ফিরেছে ৩৯০ নারী শ্রমিক। চলতি বছর প্রথম ১০ মাসেই দেশে এসেছে ১১৯ নারী শ্রমিকের লাশ। নারী কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সৌদি আরব, জর্ডান, লেবানন, ওমান ও আরব আমিরাতে মৃত্যু ঘটছে। নিয়োগ কর্তার মাধ্যমে যৌন নির্যাতন, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের জন্য আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়াও অতিরিক্ত কাজের চাপ ও মানসিক যন্ত্রণার ফলে স্ট্রোকজনিত কারণেও তাদের মৃত্যু হচ্ছে।
এই করোনাকালেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের সর্বোচ্চ বলে সরকার যখন স্বস্তি প্রকাশ করছেন, তখন এই সত্য তো মেনে নিতে হবে যে এর জন্য অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব প্রবাসী শ্রমিকদের। দেশের আমদানি-রফতানি ঘাটতি মেটানো, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ থেকে বিলাসবহুল গাড়ি, গাড়ির তেল, যন্ত্রপাতি, ধনীদের বাথরুমের আধুনিক সরঞ্জাম, পদাতিক, বিমান ও নৌবাহিনীর অস্ত্র সরঞ্জাম যাই কেনা হোক না কেন তার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা লাগে। এই বৈদেশিক মুদ্রার বড় যোগানদাতা প্রবাসী শ্রমিকরা। বিদেশের মাটিতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে, নানা ধরনের অপমান সহ্য করেও পরিবারের সদস্যদের মুখের হাসি দেখার জন্য যারা নিজেদের কান্না আড়াল করে, কম খেয়ে, কষ্টকর পরিবেশে থেকে টাকা বাঁচিয়ে যারা দেশে পাঠায়, তাদের জন্য আমরা কি করছি? একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে প্রবাসী নারীরা পুরুষদের তুলনায় টাকা বেশি পাঠায়। তাদের এই টাকা আমরা গুনছি রেমিটেন্স হিসেবে, কিন্তু তাদের ঘাম অথবা চোখের জলের মূল্য দিচ্ছি কি?
রাজেকুজ্জামান রতন: বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক ছাত্রনেতা