সম্প্রতি সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপন একটি নির্মম ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরে বিরাজমান একটি গভীর ক্ষতের চেহারা বেরিয়ে এসেছে। একজন মানসিক রোগীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। সেখানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ধ্বস্তাধস্তি ও আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য যে সে সময় হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন সনদপ্রাপ্ত কোনো চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন না। পুরো বিষয়টি নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এর একটি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।
সিনিয়র এএসপি আনিসুল একজন মেধাবী কর্মকর্তা ছিলেন। ৩১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মেধাতালিকায় তার ব্যাচে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় একজন ছিলেন আনিসুল। এ পর্যায়ের একজন বিসিএস ক্যাডারভুক্ত পুলিশ অফিসার তৈরি করতে রাষ্ট্রকে কী পরিমাণ অর্থ ও সময় বিনিয়োগ করতে হয় তা সহজেই অনুমেয়। অতএব তার মৃত্যু শুধু পারিবারিক নয়, চূড়ান্ত অর্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি। হত্যার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার মধ্য দিয়েই কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
আনিসুল করিম মানসিক রোগী ছিলেন। সিনিয়র এএসপির মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি ধীরে ধীরে মানসিক রোগীতে পরিণত হন। তার আচরণের পরিবর্তনের বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই সহকর্মীদের নজরে আসার কথা। ডিপার্টমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি জানবেন না এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখন প্রশ্ন হলো তিনি কতদিন ধরে মানসিক রোগী (সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট) ছিলেন? তার অসুস্থতার সময়কালে তিনি যেসব কাজ করেছেন বা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেগুলো কি যথাযথ ছিল? সেইসব সিদ্ধান্তের ফলে আইন প্রয়োগের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছিল কি? তাতে মানুষের বা রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি? এই বিষয়গুলোর একটি বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন হওয়া উচিত।
নানাভাবে জানা যায় তিনি প্রমোশন বঞ্চিত ছিলেন। তিনি কি ডিপার্টমেন্টের ভেতরে কোনো জটিল মারপ্যাঁচ বা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন? এর উত্তরটিও জানা জরুরি। কারণ এসব প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে আনিসুলের মানসিক রোগের সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক নয়।
আনিসুলের আচরণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তিনি ক্ষিপ্ত ও সহিংস (violent) হয়ে ওঠেন। এ অবস্থায় তাকে ৯ নভেম্বর সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের দিকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট হাসপাতালে আনা হয়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন ভগ্নিপতি ডা. রাশেদুল হাসান, ডাক্তার বোনসহ অন্যরা। তাদের সঙ্গে তিনজন পুলিশ ছিল।
রোগীকে অবজারভেশন রুমে রেখে প্রয়োজনীয় জরুরি চিকিৎসা দেয়া হয়। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহানা পারভীন রোগীকে দেখেন এবং ভর্তির উপদেশ দেন। আনিসুলের সঙ্গে থাকা কেউ তাকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে রাজি হয় না। (সরকারি হাসপাতাল সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব আমাদের শিক্ষিত ও সম্পন্ন পরিবারের অধিকাংশের মধ্যে দেখা যায়)। তারা রোগীকে কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করতে আগ্রহী। রোগী নিয়ে সবাই চলে যান। এর মধ্যে রোগীর লোকজন একই হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেন। তারা ডা. মামুনের কাছে আশেপাশের কয়েকটি মানসিক হাসপাতালের নাম-ঠিকানা জানতে চায়। ডা. মামুন কয়েকটি হাসপাতালের নাম বলেন। পারিবারিক সিদ্ধান্তে আনিসুলকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে নেয়ার পর হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে।
স্বাভাবিকভাবে হত্যা মামলা রুজু হয়। পুলিশ মাইন্ড এইড হাসপাতালের অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে। পুলিশ গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে ডা. মামুন নিয়মিত মাইন্ড এইড হাডপাতালে রোগী রেফার্ড করতেন বা রোগী পাঠাতেন। এবং তিনি হাসপাতাল থেকে রেফারেল ফি বা কমিশন গ্রহণ করতেন।
পুলিশ হত্যা মামলার আসামি হিসাবে ডা. মামুনকে গ্রেফতার করে (রোববার তিনি জামিন পেয়েছেন)। তদন্তে জানা যায়, মাইন্ড এইড হাসপাতালটি অনুমোদনহীন অর্থাৎ অবৈধ। খোদ রাজধানী ঢাকার বুকের উপর একটি অবৈধ হাসপাতাল দিনের পর দিন চলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেটা দেখবে না? কোন হাসপাতালের লাইসেন্স আছে, কোনটির নেই এই তথ্য রোগীর জানার কথা নয়। চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তারের দায়িত্ব নয় হাসপাতালের লাইসেন্স চেক করার। বিষয়গুলো দেখাভাল করার জন্য সরকারি দপ্তর রয়েছে। সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা এই দেশের আমজনতার টাকায় হয়। দেশে ১৫ হাজারের বেশি প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১২ হাজারের অনুমোদন বা লাইসেন্স নেই। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
আনিসুলকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নেয়া হয়েছে পারিবারিক সিদ্ধান্তে। তার ভাই গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান। এখানে ডা. মামুনের কোনো দায় নেই! কারণ তিনি এক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছেন বলে কোনো সূত্রেই জানা যায়নি।
কোনো রোগী সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে না চাইলে তাকে কোনো প্রাইভেট হাসপাতালের নাম বলা বা সেখান রেফার করা বেআইনি নয়। আনিসুলের চিকিৎসার সঙ্গে ডা. মামুন যুক্ত ছিলেন না। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট হাসপাতাল অথবা মাইন্ড এইড হাসপাতাল কোথাও তিনি আনিসুল করিমকে রোগী হিসেবে অ্যাটেন্ড করেননি। অতএব ডা. মামুনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এনে তাকে গ্রেফতার করা যায় না। বড়জোর রেফারেল ফি বা কমিশন নেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করা যায়। সেক্ষেত্রে তাকে গ্রেফতার করতে হলে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি থাকতে হবে।
তাহলে পুলিশ ডা. মামুনকে তাড়াহুড়ো করে গ্রেফতার করল কেন? এর উত্তর খুঁজতে হলে আনিসুলের মানসিক রোগের কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। এজন্য অনুসন্ধানের মূলক্ষেত্র হবে তার অফিস ও পরিবার। সন্দেহ করা যেতে পারে, তদন্তকারী দলের অনেকে চাচ্ছেন না আনিসুলের মনোরোগের কারণ খোঁজা হোক। এতে কী কোনো থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে পারে? এমন প্রশ্নের উঁকি দেওয়ায় স্বাভাবিক!
চিকিৎসার মতো একটি অতি প্রয়োজনীয়, সংবেদনশীল পেশাকে জড়িয়ে পানি ঘোলা করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যারা ডা. মামুনকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছে। প্রথমটি হলো- আনিসুলের মৃত্যুতে বেদনাবিদ্ধ ক্ষুব্ধ পুলিশের নানান স্তরের লোকজনের ক্ষোভ প্রশমনের পথ পাবে। দ্বিতীয়টি হলো তারা অনুমান করেছে ডা. মামুনকে গ্রেফতার করা হলে নিশ্চিতভাবে চিকিৎসক সমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। তারা মাঠে নামবে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হবে। চিকিৎসকেরা ধর্মঘটে যাবে। সারাদেশে এর প্রভাব পড়বে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। লোকজন বিক্ষুব্ধ হবে। বাস্তবে ঘটনা সেইদিকেই যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট(বিএপি)’ সারাদেশে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। মনে রাখতে হবে সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা দুই কোটির মতো। এদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ২৭০ জন। এর মধ্যে আরও কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে প্রাইভেট চেম্বার বন্ধের কথা ভাবছে। তরুণ চিকিৎসকরা উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত। চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন মনোরোগ চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে যাচ্ছে।
করোনা মহামারির মহাসংকটে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও বিধ্বস্ত। নতুন করে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। করোনাযুদ্ধে চিকিৎসকেরা হচ্ছে প্রথম সারির যোদ্ধা। এ সময় তাদের রাখতে হবে চাপমুক্ত। কিন্তু কিছু 'ঘোলা পানিতে মাছ শিকারি'র কারণে সম্মুখযোদ্ধারা বিক্ষুব্ধ। তারা আন্দোলনে নামতে যাচ্ছে। এসবের সরল অর্থ হচ্ছে দেশব্যাপী অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টারত একটি কুচক্রি মহল সফল হতে যাচ্ছে।
পুলিশের বর্তমান তদন্তকারী দল যে পথে অগ্রসর হচ্ছে তাতে আনিসুল হত্যার তদন্ত দিশা হারাচ্ছে। এই তদন্তকে কেন্দ্র করে সারাদেশে একটি অস্থির পরিস্থিতি তৈরির প্রয়াস পরিষ্কারভাবে লক্ষ্যণীয়। তাই ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মামলার তদন্তভার পুলিশের পরিবর্তে র্যাব অথবা পিবিআইকে দেয়া হোক। একই সঙ্গে হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক ডা.মামুনকে। দেশের প্রতিটি মানুষ আনিসুল হত্যার ন্যায়বিচার চায়। এখন সহজেই বোঝা যাচ্ছে কিছু মাছ শিকারি নানাভাবে দেশের পানি ঘোলা করতে চাচ্ছে। এরা মুখোশধারী। নানা নাম-পরিচয়ে বিভিন্ন ছদ্মবেশে রাষ্ট্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এরা লুকিয়ে আছে। এদের চিহ্নিত করে প্রতিরোধ করা আব্যশক। এ কাজে দেরি করা যাবে না। পরিপূর্ণ তদন্ত সাপেক্ষে আনিসুল হত্যার ন্যায়বিচার হোক।
লেলিন চৌধুরী: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অধিকার কর্মী
ই-মেইল: Choudhurybd16@gmail