দিনটা ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর। দেশ তখন যুদ্ধক্ষেত্র, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তির লড়াই তখন চূড়ান্ত সাফল্যের পথে।
ঠিক এমন সময়ে এই দিনে তখনকার ঢাকা জেলার অন্তর্গত মানিকগঞ্জের অগ্রগামী জনপদ ‘তেরশ্রী’ আক্রান্ত হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর দ্বারা।
সেদিন খুব ভোরে রাজাকারদের সহায়তায় পাকস্তানি সেনারা হিন্দু অধ্যুষিত তেরশ্রী গ্রাম চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। ঘরে ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত মানুষের উপর গুলিবর্ষণ করে, আগুনে জ্বালিয়ে দেয় পুরো গ্রাম।
এ সময় গ্রামের ৪৩ জন মানুষকে গুলি করে, আগুনে পুড়িয়ে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এতগুলো নিরপরাধ মানুষের লাশ আর তাজা রক্ত সেদিন গোটা এই জনপদকে; গোটা মানিকগঞ্জকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। শোকার্ত করে তুলেছিল পুরো জাতিকে।
দেশের প্রগতিশীল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্র এই তেরশ্রীতে নির্বিচারে এমন জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্য ছিল সেইসব ব্যক্তিবর্গ; যারা গ্রামটিতে শিক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, প্রচার ও প্রসারে অপরিসীম ভূমিকা রেখেছিলেন। গণহত্যার পরিকল্পনাকারীরা চেয়েছিল নানা দিক থেকে অগ্রগামী জনপদটিকে স্বাধীনতার ঠিক আগ মুহূর্তে মেধাশূন্য করে ফেলতে।
উল্লেখ্য, এই গ্রাম থেকে নানা বয়সের বড় একটি গ্রুপ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। অন্যরা নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে যাচ্ছিলেন। রাজাকারদের কাছে সেসব সংবাদ ছিল। তাদের নজরদারি ও সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এই দিনে অতর্কিতে হামলা চালায়। গ্রামের ঘরে ঘরে ঢুকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে শিক্ষক-কৃষক-শ্রমিকসহ বহু জ্ঞানী-গুণীজনকে।
সেদিন অনেকে লুকিয়েও প্রাণে রক্ষা পাননি। নিরস্ত্র মানুষদের হাত-পা-চোখ মুখ বেঁধে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা হয়, গুলি করা হয়, গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। সেদিন গণহত্যা শেষে রক্তপিপাসু হায়েনার দল উল্লাসে মেতে বিবর্ণ করে দিয়েছিল ভোরের আলো।
তেরশ্রীর জমিদার সিদ্ধেশ্বরী রায় প্রসাদ চৌধুরী ছিলেন ওই অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এলাকার নামকরা স্কুল তেরশ্রী কালী নারায়ণ ইনস্টিটিউশন এবং মানিকগঞ্জ জেলার প্রথম কলেজ তেরশ্রী কলেজসহ এলাকার আরও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তার অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল। বিদ্যোৎসাহী এই ব্যক্তি গণহত্যার প্রথম শিকার ছিলেন।
দানশীল মানুষটিকে প্রথমে তার ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে মাঠে এনে হাত-মুখ-চোখ মুখ বেঁধে গুলি করা হয়, তারপর গায়ে কাপড় পেঁচিয়ে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। তেরশ্রী কলেজের তখনকার অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানকেও তার আবাসস্থল থেকে বের করে বাইরে এনে বেয়োনেটে খুঁচিয়ে, চোখ উপড়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। হানাদাররা সে সময় যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে।
নিধনযজ্ঞের তালিকায় আরও ছিলেন সাধন কুমার সরকার, বিপ্লব কুমার সাহা, সচীন্দ্রনাথ গোস্বামী, মাখন চন্দ্র সরকার, রমজান আলী, মহেন্দ্র দাস, নিতাই চন্দ্র দাস, শ্যামলাল সূত্রধর, জগদীশ চন্দ্র দাস, যোগেশ সূত্রধর, নারায়ণ সূত্রধর, রামচরন সূত্রধর, দেলবর আলী, মাধব দত্ত, যাদব দত্ত, যোগেশ দত্ত, শ্যামাপদ নাগ, রাজবল্লভ নাগ, গেদা মিয়া, কছিম উদ্দিন, একলাছ মোল্লা, তফিল উদ্দিন, ওয়াজ উদ্দিন, সাধু চরন দাস, সুধন্য দাস, সুরেন্দ্র দাস, যোগেশ চন্দ্র দাস, গৌড় চন্দ্র দাস, মনিন্দ্র চন্দ্র দাস, শ্রীমন্ত দাস, প্রাণ গোবিন্দ সাহা, যোগেশ ঘোষ, জ্ঞাণেন্দ্র ঘোষ, তছিম উদ্দিনসহ আরো সাতজন। তাদের তাজা রক্তে সেদিন ভেসে গিয়েছিল তেরশ্রী গ্রাম।
তেরশ্রীর গণহত্যাসহ মানিকগঞ্জের এমন আরও অনেক যুদ্ধগাঁথা একাত্তরের প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসে গুরুত্ব পায়নি। এলাকার মুক্তিযোদ্ধারাও পাননি তাদের প্রাপ্য সম্মান। এলাকার জনমানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল এই বীর শহীদদের স্মরণে নির্মিত হবে অন্তত একটি স্মৃতিস্তম্ভ। তাতে শহীদদের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান জানানো হবে। রাজনৈতিক-প্রশাসনিক নানাবিধ জটিলতা কাটিয়ে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর ২০১২ সালে তেরশ্রীতে নির্মিত হয় সেই স্মৃতিস্তম্ভ।
নতুন প্রজন্ম পুরোপুরি জানে না তেরশীর সেদিনের ইতিহাস, সেই বেদনা, সেই ট্র্যাজেডি। এখন চলতি পথে এই স্মৃতিস্তম্ভের দিকে চোখ পড়লে তারা হয়ত জানতে চাইবে কী ঘটেছিল সেদিন? কেন ঘটেছিল জঘন্য নরহত্যা? নবনির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি মৃত্যুঞ্জয়ী ৪৩ জন শহীদের খোদাইকৃত নাম নিয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকবে কালের সাক্ষী হয়ে। দেশজুড়ে স্বাধীনতার লড়াই-সংগ্রাম, জীবনদানের বিস্মৃতপ্রায় এই সব বীরত্ব গাঁথা বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে, বাঙালি জাতির ইতিহাসকে করেছে গৌরবান্বিত।
প্রতি বছর তেরশ্রী গণহত্যা দিবসে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় দল মত নির্বিশেষে স্থানীয়রা একত্রিত হন, শহীদদের স্মরণ করেন ও নানাভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। তবে পরিতাপের বিষয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে এই গণহত্যাকে এখনও স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি, তেরশ্রী গণহত্যাকে রাষ্ট্র যেন স্বীকৃতি দেয়। পাশাপাশি রাষ্ট্র যেন এই স্থানীয় ও অবহেলিত ইতিহাস সংরক্ষণের দ্বায়িত্ব নেয়। স্থানীয় হলেও এই ইতিহাস বাঙালি জাতির জন্য একইসঙ্গে শোকের, গর্বের ও অহংকারের।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী