মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ২১ নভেম্বর ১৯৭১ সালে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর বীর সেনানীরা মুক্তি পাগল বাঙ্গালীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথভাবে আক্রমণের সূচনা করেছিলেন।
দিনটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত টার্নিং পয়েন্ট। বাংলাদেশ ও ভারতের সেনা সদস্যদের নিয়ে গড়া মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
এরপর থেকে প্রতিবছর দিনটিকে স্মরণ করে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত হয়। আগে তিন বাহিনী ভিন্ন ভিন্নভাবে দিবসটি পালন করলেও আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে সম্মিলিতভাবে দিবসটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। এ বছর বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে অনুষ্ঠান স্বল্প পরিসরে হবে।
১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় (বর্তমানে মুজিবনগর) বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠন করা হয়।
মুহম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি করা হয়। তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাঠপর্যায়ে সকল ইউনিটসমূহ একত্রিত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
রণকৌশল হিসেবে বাংলাদেশকে ১১ সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। প্রতিটি সেক্টরে একজন জ্যেষ্ঠ সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গেরিলা যুদ্ধের জন্য গণবাহিনী সাধারণ জনগণের মধ্য থেকে গড়ে উঠেছিল।
নিয়মিত যুদ্ধের জন্য সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে একটি নিয়মিত বাহিনী গড়ে ওঠে; যা তিনটি বিগ্রেডে ভাগ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- (১) জেড ফোর্স, (২) এস ফোর্স ও (৩) কে ফোর্স।
বাংলাদেশ ফোর্সেসের অধীনে ১১ সেক্টর ও তিনটি বিগ্রেড ৪ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী গঠনের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানি হায়নাদের বিরুদ্ধে প্রবল যুদ্ধে তাদেরকে কাবু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর গৌরব শুধুমাত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় বাংলাদেশেও সমানভাবে অবদান রেখে চলেছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্বে সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা বাংলাদেশকেই সম্মানিত করেছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করে শুধু সেসব দেশে শান্তি ফিরিয়েই আনেনি, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রসহ পুনর্বাসন ক্ষেত্রে এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যার জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
১৯৯৭ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তি করার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও পার্বত্য শান্তি চুক্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে অনেক সদস্য জীবন দিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে এলিট ফোর্স র্যাবের সদস্য হয়ে রেখে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের নেতৃত্ব দিয়ে সীমান্তকে সুরক্ষা দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
যে কোনো দুর্যোগেই- সেটা প্রাকৃতিক কিংবা মানুষ সৃষ্ট হোক সেসব দুর্যোগে এখনও জনগণের আস্থা ও ভরসার নাম সশস্ত্র বাহিনী। ঘূর্ণিঝড়, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে উদ্ধার, ত্রাণ তৎপরতা ও পুনর্বাসনে সামনের কাতারে এসে দাঁড়ায় সশস্ত্র বাহিনী সদস্যরা।
পদ্মাসেতু, জাতীয় মহাসড়ক, ফ্লাইওভার, হাতিরঝিল, মেট্রোরেল, এলিভেটেট এক্সপ্রেসসহ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্থাপনাসমূহ তৈরিতে রেখে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী আমাদের গর্ব ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশেও সংকটের সময় জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে বারংবার।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্য সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৮৮ সাল থেকে সেনাবাহিনী, ১৯৯৩ সালে নৌ ও বিমানবাহিনী, ১৯৮৯ সাসে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা শান্তিরক্ষী পরিবারের সদস্য হন। জাতিসংঘের ৬৮টি মিশনের ৫৪টিতেই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, নামিবিয়া, কঙ্গো, উগান্ডা, হাইতি, কসোভো, জর্জিয়া, পূর্ব তিমুর, তাজিকিস্তান প্রভৃতি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা, অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্যদের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল।
সশস্ত্র বাহিনী নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবেলা করে জনগণের মধ্যে আস্থা অর্জন করেছে। তার অন্যতম উদাহরণ মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ে শারীরিক দূরত্ব ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে কাজ করা।
করোনা মহামারিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশে জনগণের পাশে দাঁড়ায় সশস্ত্রবাহিনী। করোনা যুদ্ধে জয়ী হতে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ১৬ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। নির্দেশনা নিয়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি সদস্য মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।
স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে লকডাউন কার্যকর, ত্রাণ সহায়তা, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাসহ করোনা মোকাবেলায় রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পেশাগত দায়িত্ব পালনের সঙ্গেসঙ্গে দেশ ও জাতির উপর অর্পিত দায়িত্বও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে আসছে। ছবিসহ ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট তৈরি করে দেশে-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব সময়ই দুর্গত মানুষের পাশে থেকেছে। ২০০৭ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালে আইলা এবং অতিসম্প্রতি আম্ফানের সময় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা হয়েছে জনগণের কাছে প্রশংসিত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা সশস্ত্র বাহিনী দিবসের এক সভায় বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত সশস্ত্র বাহিনী আমাদের জাতির অহংকার। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নে কাজ করছে। কারণ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। সশস্ত্র বাহিনীকে কখনও আমাদের ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করিনি। ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বার বার ক্যু করে শত শত অফিসার-সৈন্যদের হত্যা করিনি। আমরা চেয়েছি শান্তি ও নিরাপত্তা স্থাপন করে একে একটি সুন্দর সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে এবং এই সশস্ত্র বাহিনী যেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন হয়। শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণ নয়, সারাবিশ্বে আস্থা-বিশ্বাস যেন অর্জন করে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র বাহিনীর যে সূদৃঢ় ভিত্তি রচনা করে গেছেন তারই উপর দাঁড়িয়ে আজ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও কর্মদক্ষতা দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত ও প্রশংসিত।’
অতীতে কিছু উচ্চাভিলাসী সদস্যদের কারণে বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলেও বর্তমান সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রম দেশের জনগণ ও বহির্বিশ্বে আস্থা, বিশ্বাস ও সম্মানের আসনে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের যে কোনো সংকটে জনগণের পাশে সশস্ত্র বাহিনী অতীতের মতো পাশে দাঁড়াবে আজকের দিনে সেই শুভ প্রত্যাশাই কামনা করি।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
ইমেইল: haldertapas80@gmail.com