সন্তানসন্ততিকে জীবনের অর্জন ধরে নিয়ে আশাতীত মানসিক প্রশান্তি খোঁজার প্রবণতা আছে আমাদের সমাজে। অথচ একটি শিশুর জন্ম জগতের আর পাঁচটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বৈ কিছু নয়। সন্তানসন্ততিকে ব্যক্তি জীবনের অর্জন হিসাবে দেখা কাজের কিছু না। এটি বিভ্রান্তিমূলক। অথচ এটি মানব জীবনের সারসত্য হিসাবে জারি আছে যুগের পর যুগ।
অর্জনের বিপরীতে থাকে না-পাওয়া কিংবা শূন্যতা। সুতরাং যার বা যাদের সন্তানসন্ততি থাকে না, তারা একে ব্যর্থতা অথবা গ্লানি হিসাবে দেখতে শেখেন, কষ্টে ভোগেন, বিশেষত নারীরা। কেননা নারী জন্মের সার্থকতা বলে এক ধরনের অহেতুক অপলাপ প্রতিষ্ঠিত আছে সমাজে, যা সন্তান জন্মদানকে নারীর অভীষ্ট অথবা নারীত্বের অহংকার হিসাবে প্রচার করে। ফলে নারীর অন্যান্য অর্জন আসলে অর্জন হিসাবে বিবেচ্য হয় না, যদি তার একটি সন্তান না থাকে।
সন্তান শুধু ব্যক্তির না পরিবারেরও অর্জন হিসাবে দেখা হয়। মনে করা হয় সন্তান না থাকলে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, পুত্র সন্তান না থাকলে পরিবার ব্যবস্থা টেকে না বা বংশরক্ষা হয় না। অর্জনের পাল্লায় পুত্রসন্তান আবার ওজনে ভারী। সুতরাং 'পোলাই হইতে হইবো' মীনার চাচার মতো অনেকেই এভাবে ‘বাত্তিহীন’ বংশ নিয়ে আহাজারি করেন অথবা ‘বুড়া বয়সে কে দেখবে’ অথবা 'কবরে মাটি কে দেবে' এই প্রশ্ন আকাশে ছুড়ে দুহাতে চুল ছিঁড়তে থাকেন অনেক মুরব্বি।
তবে যুগ বদলেছে। ছেলে সন্তান নেই এমন অনেক পিতামাতাকেই বলতে শুনি ‘মেয়ে বাচ্চাই ভালো। বুড়ো বয়সে খোঁজখবর করবে, ছেলেরা তো বউবাচ্চা নিয়ে পর হয়ে যায়।’
সুতরাং সন্তান যাই হোক, সে তোমার জীবনের অর্জন – এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সন্তানসন্ততিকে জীবনের অর্জন ভেবে নিজের স্বপ্ন পূরণের মাধ্যম হিসাবে দেখেন একদল। ফলে বাচ্চাদের ওপর ইংলিশ, বাঙলা, ফ্রেঞ্চ, নৃত্য, কলা, বিজ্ঞান সব চাপিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করেন কখন ছেলে বা মেয়ে এসে বলবে ‘মা আমি ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছি।’ কারণ তারা নিজেরা যা অর্জন করতে পারেন নি, তা বাচ্চাদের ওভারডোজ দিয়ে জীবনের ঝুলিতে ভরতে চান কেবল অর্জন আর পেতে চান ‘মানুষের মতো মানুষ’ এক একটা বাচ্চা।
প্রাণিজগতে আর কোনো প্রাণীকে নিজের সাথে তুলনীয় করে দেখার প্রচলন নেই। কিন্তু মানুষের আছে। যেমন কোনো বাঘকে ‘বাঘের মতো বাঘ’ বা কোনো হনুমানকে ‘হনুমানের মতো হনুমান’ হতে না হলেও মনুষ্য সমাজে মানুষের ওপর নিদারুণ এক চাপ থাকে ‘মানুষের মতো মানুষ’ হবার।
এই ‘মানুষের মত মানুষ’ হওয়া এক নিরন্তর প্রচেষ্টা, এর কোনো শেষ নেই। তবে সন্তান ‘মানুষের মত মানুষ’ না হলে লোকসমাজে পিতামাতার মুখ দেখানোই দুষ্কর হয়ে পড়ে।
সন্তানসন্ততিকে অর্জন হিসাবে দেখার আরেকটি বিভ্রান্তি হলো, যারা সন্তান জন্মদানকে পছন্দ হিসেবে নিতে চান, তারা খুব অযাচিতভাবেই ‘অর্জন-পক্ষীয়দের’ কাছে বিরোধী দল হিসাবে বিবেচিত হন। ফলে ‘পছন্দ-পক্ষীয়দের’ হেদায়েত করার দায়িত্ব নেন ‘অর্জন-পক্ষীয়রা’ এবং ‘এক সময় পস্তাতে হবে’ এমন ওহিও নাজেল করেন অনেকে।
অথচ একটি সন্তান পৃথিবীতে আসা নর ও নারীর ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছার সাথে যুক্ত। এখানে ভূমিষ্ট না হওয়া সন্তানের কোনো হাত বা অজুহাত নেই। সে জানেও না যে সে কারও জীবনের অর্জন হতে যাচ্ছে কিনা! সন্তান হওয়া বা তাদের জীবনে স্থান দেয়া ব্যক্তির জীবনের একটি ঘটনা, দায়িত্বের অধ্যায়। ব্যক্তি স্মৃতিচারণ করতে পারে যে সেই ঘটনা বা দায়িত্ব পালনকালে তার কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল? কিভাবে সে পাড়ি দিয়েছিল সেই দুস্তর পারাবার? কারা পাশে দাঁড়িয়েছিল? কিভাবে তারা সহায়তা করেছিল অথবা করেনি?
সন্তান জন্মদান ও প্রতিপালন উভয়ই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও অধ্যবসায়ের বিষয়। কিন্তু সন্তানকে যখন সামাজিকভাবে অর্জন হিসাবে দেখা হয়, তখন কেউ কেউ এই অনাবশ্যক ভাবনার চাপ নেন। সেই চাপ এমনকি পরিবারে, সমাজে একটা উচ্চক্রম তৈরি করে। ‘বাঁজা মহিলা’ কোনো কোনো সমাজিক অনুষ্ঠানে অস্পৃশ্য। অনেকে বাচ্চার অনাকাঙ্ক্ষিত অমঙ্গলের আশংকায় নিজের সন্তানকে সেইসব নারীর কোলে পর্যন্ত দিতে চান না।
আপনি শিশু ভালোবাসেন, শিশুর মোহনীয় হাসি, দুষ্টু-মিষ্টি আলাপ, বাঁদরামি আপনাকে অভিভূত করে। আপনি কাজের ব্যাঘাত ঘটলে ‘দূর হ’ বলে সরিয়ে দিয়ে পরক্ষণেই বুকে জড়িয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে পছন্দ করেন। আপনি সহজাতভাবে অথবা সমাজ নির্মিত পুনরুৎপাদনের ধারণার সাথে খাপ খাইয়ে বেছে নিয়েছেন আপনি মা হবেন বা বাবা হবেন। আপনার এই ব্যক্তি অভিজ্ঞতাকে অর্জন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা মানে অন্যের মনোযন্ত্রণার কারণ হওয়া। তাছাড়া সন্তানকেন্দ্রিক যে অর্জন ভাবনা, তা নারী ও পুরুষের সামাজিক নির্মিত ভূমিকার সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। এখানে বিবাদ আছে, বিভেদ আছে, নির্যাতন আছে, নিপীড়ন আছে, সম্মান-অসম্মান ভাবনা জড়িত আছে এবং সবকিছুই নারীর লিঙ্গীয় ভূমিকাকে অর্থাৎ পুনরুৎপাদনের সামর্থ্যকে নারীর সাথে অপরিহার্য করে দেখে। আবার একই সমাজে মা সন্তানের বৈধ অভিভাবক হিসাবে বিবেচিতই হন না। ফলে সন্তানসন্ততি কার অর্জন, অথবা কার অর্জন নয়, তা নিয়ে বিস্তর ভাবনার অবকাশ আছে।
সাদিয়া আফরিন: নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক