স্বৈরাচার ও সামরিক একনায়ক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলনরত আওয়ামী লীগের নেতৃতাধীন ৮ দল, বিএনপির নেতৃতাধীন ৭ দল ও বামপন্থিদের ৫ দল মিলে এরশাদ পরবর্তী সরকার ব্যবস্থা কীরূপ হবে তার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল। ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর ওই তিনটি জোট আলাদা আলাদা সমাবেশে রূপরেখা তুলে ধরে। এর ১৫ দিনের মাথায় এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
এই ঘটনার ঠিক ৩০ বছর পর আজ মনে প্রশ্ন জাগে, পরবর্তী তিন দশকে যে শাসন ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি, তাতে কতটা প্রতিফলিত হয়েছে এই রূপরেখা? আমি দেখছি, রূপরেখার প্রায় পুরোটাই আমরা বিসর্জন দিয়েছি। আর এই বিসজর্ন প্রক্রিয়া শুরু হয় রূপরেখা প্রণয়নের অব্যবহিত পর থেকেই।
ওই রূপরেখার প্রধান দিক ছিল মৌলবাদ ও স্বৈরাচার যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেই প্রত্যয়। ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার।
যেহেতু সব গণতান্ত্রিক দল মিলে তৈরি করেছিল সেই রূপরেখা, তাই সেটাকে জাতীয় সনদ বলাই যায়। সেটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দলিল হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়ার কথা।
রূপরেখায় স্বৈরাচারের পতনের পর জাতীয় সংসদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ভোটারদের ইচ্ছামতো ভোট দেওয়ার বিধান নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। অনেক কিছুই ছিল রূপরেখায়। অঙ্গীকার করা হয়েছিল হত্যা, অভ্যুত্থান, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অবসান, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ‘সার্বভৌম সংসদ’ প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক অধিকার পরিপন্থি আইন রহিত করার ব্যবস্থা করা হবে। সেখানে ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে পুনঃগণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
তিন জোটের তুমুল আন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ‘রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক আচরণবিধি’ নামে একটি অঙ্গীকারনামাও স্বাক্ষর হয়েছিল। তিন জোট সেটি জনসমক্ষে প্রকাশও করেছিল। তাতে অঙ্গীকার করা হয়েছিল যে— ‘...আমরা তিনটি জোটের নেতৃবৃন্দ সুষ্ঠুভাবে অবাধ ও নিরক্ষেপ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের নিম্নবর্ণিত অভিন্ন অঙ্গীকার পালনের জন্য আমাদের সকল কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
ওই আচরণবিধির তিন নম্বর ধারা: ‘আমাদের তিনটি জোটভুক্ত দলসমূহ ব্যক্তিগত কুত্সা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকবে। আমাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় প্রদান করবে না এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সমবেতভাবে প্রতিরোধ করবে।’
চার নম্বর ধারায় বলা হয়েছে: ‘নির্বাচনী কার্যক্রমে সর্বোতভাবে সংঘাত পরিহার করার জন্য তিনটি রাজনৈতিক জোটভুক্ত দলসমূহ অঙ্গীকার করছে। সেজন্য এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের চিহ্নিত সহযোগী ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের আমাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহে স্থান না দেয়ার জন্য আমাদের ইতিপূর্বে প্রদত্ত ঘোষণা কঠোরভাবে কার্যকর করা হবে। ভোটাররা যাতে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং ভোটকেন্দ্রে শান্তি-শৃংখলা বজায় থাকে সে বিষয়ে আমাদের তিনটি জোটভুক্ত দলসমূহ সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।’
একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, এরশাদের পতনের পরপরই ওই রূপরেখাকে ছুড়ে ফেলে দেয় বিএনপি। তিনজোটের চুক্তি অনুযায়ী স্বৈরাচারের দোসরদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেদিন এম কে আনোয়ার ও কেরামত আলীকে বিএনপি মনোনয়ন দিয়ে প্রথম আঘাতটা আনে রূপরেখায়।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় না দেওয়ার কথা বলা হলেও নির্বাচনি প্রচারে বিএনপি ধর্মের কার্ড খেলা শুরু করে। বক্তৃতা বিবৃতিতে বলতে থাকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে উলুধ্বনি দেওয়া শুরু হবে।
এ দুটি বিষয় ছিল আচরণবিধি সংক্রান্ত সমস্যা। কিন্তু রাষ্ট্রের মূল কাঠামোতে আঘাতটা হানে বিএনপি জামায়াতের সাথে সরকার গঠন করে।
১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি যে প্রক্রিয়ায় সরকার গঠন করে, সেখানেই তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে।
যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু হয়েছিল ‘৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে, তাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়ে ’৯১ সালে জামায়াতের সহায়তায় সরকার গঠন করে বিএনপি। ওই নির্বাচনে কোনো দলই সরকার গঠনের মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিএনপি ১৪০টি আসন পেয়েছিল। সরকার গঠন করতে হলে তাদের দরকার ছিল আরও ১১টি আসন। জামাত পেয়েছিল ১৮টি আসন আর বামপন্থিরা ১৩টি আসন। বিএনপি চাইলেই বামপন্থিদের দিকে হাত বাড়াতে পারত। বামদলগুলো বিএনপিকে সমর্থন দিতেও রাজী ছিল। কিন্তু বিএনপি সেদিকে যায়নি।
সেদিন যদি বিএনপি জামাতের সাথে চুক্তিবদ্ধ না হয়ে বামপন্থিদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতো, তাহলে নিশ্চয়ই আজকের বাংলাদেশে মৌলবাদের যে আস্ফালন, তা দেখতে হতো না।
কেন বিএনপি বামদলগুলোর প্রস্তাব না মেনে জামায়াতের সাথে হাত মিলিয়েছিল? তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের দেওয়া তথ্যে। তিনি ২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত তার বাংলাদেশ: এ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিমস বইতে লিখেছেন, বিএনপিকে জামায়াতের সহায়তায় ক্ষমতায় আনার অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল নূরউদ্দীন খান।
উইকিলিকসের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানি জেনারেলরা এরশাদকে সরিয়ে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন সেনাপ্রধান জেনারেল নূরউদ্দীন জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সেই আগ্রহ নেই। তখন পাকিস্তানি জেনারেলরা বিএনপির পক্ষে কাজ করার জন্য ওই জেনারেলকে পরামর্শ দেন।
ওই বইতে মওদুদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সেনাপ্রধান নূরউদ্দীন খান, খালেদা জিয়া, গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর মধ্যে একটি বৈঠক হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক জি ডব্লিউ চৌধুরীর বাসভবনে। এই জি ডব্লিউ চৌধুরী ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রী ও ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টা ছিলেন। ওই বৈঠকেই গোলাম আযমের নাগরিকত্ব আর তার আমিরত্ব মেনে নেয়ার শর্তে ১৮ আসনধারী জামাত বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এ বৈঠকের পরই রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়ে জামায়াত সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়ার কথা ব্যক্ত করে।
পরবর্তীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্ব তুমুল গণআন্দোলনে বিএনপি গোলাম আযমকে আটক করতে বাধ্য হলে বিএনপি-জামায়াত সমঝোতা ভেঙ্গে যায়।
মওদুদ লিখেছেন, ‘কী করে সমঝোতা রদ হলো, সে প্রশ্নটি কোনো আদালতের মামলার বিষয় ছিল না। কিংবা তার নাগরিকত্বের কারিগরি দিক নিয়েও ছিল না। এমনকি অধ্যাপক গোলাম আযম একজন কোলাবরেটর ছিলেন কি ছিলেন না, কিংবা এই প্রশ্নও ছিল না যে বাংলাদেশ থেকে তাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল কি ছিল না।’
এরপর মওদুদ বলেন, ‘কিন্তু এই প্রশ্নটি এক বিশাল বিস্ময়ের সঙ্গে তোলা যেতে পারে যে, কী করে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে গঠিত সরকার তাদের আমীরকেই কারাগারে পাঠিয়েছিল? সেটা কেবল দুই নেতার মধ্যেকার সমঝোতার লঙ্ঘন নয়, সেটা রাজনৈতিক আস্থা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটি ঘোরতর প্রতারণাও বটে। যদি জামায়াত ও অধ্যাপক গোলাম আযম পাাকিস্তানি দখলদার সরকারের সহযোগীই হয়ে থাকবেন, তাহলে বেগম জিয়া কেন সরকার গঠনে ১১ বামপন্থি সংসদ সদস্যের সমর্থন নিলেন না?’
মওদুদ ইঙ্গিত দেন যে, ওই বাম দলগুলো, যাদের কেউ কেউ এখন মহাজোটে সক্রিয়, তারা খালেদা জিয়াকে সমর্থন দিতে চেয়েছিল।
বিএনপি-জামায়াত সখ্য রদের পর আমরা ’৯৬-এর নির্বাচনি প্রচারণায় দেখি আওয়ামী লীগ নেতাদের আচরণে ধর্মের ছাপ। ’৯৬-এর নির্বাচনে জামায়াত আলাদা নির্বাচন করে মাত্র তিনটি আসন পায়। আর আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন দেয় এরশাদের জাতীয় পার্টি। আওয়ামী নীতি নির্ধারকদের মধ্যে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ধর্মীয় কার্ড খেললে জয়ের সম্ভবনা বাড়ে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত তাদের অতীতের ভুলের মাশুল দিয়ে বুঝতে পারে, তাদের এক পাতে ভাত খেতেই হবে নয়তো আর ক্ষমতায় আসা যাবে না। আবারও ধর্মের কার্ড খেলে তারা ক্ষমতায় আসে। তার আগেই ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি জামায়াত ও জাতীয় পার্টিকে নিয়ে চার দলীয় জোট গঠন করে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থেকে এটা বুঝতে পারে, এ দেশে ধর্মের বাইরে গিয়ে ক্ষমতায় থাকা কঠিন। যে কারণে আজও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মোল্লা তোষণের অভিযোগ। আর এই কারণেই কি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি করেও মোল্লারা পার পেয়ে যাচ্ছে?
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম: ’৭২ সালে যে লক্ষে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, যা ’৭৫-এ হাতছাড়া হয়ে যায়, সেটা ’৯১-তে ফিরিয়ে আনার সুযোগ পেয়েও ফিরিয়ে আনা যায়নি।
সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ কি বারবার আসবে?
লেখক: সাংবাদিক, শিক্ষক গবেষক। সম্পাদক, ডিবিসি