বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাকিব তো ভুল করেননি, ক্ষমা চাইলেন কেন?

  • প্রভাষ আমিন   
  • ১৭ নভেম্বর, ২০২০ ২১:৫৬

সাকিব তো সেই উগ্র মৌলবাদীর দাবি মেনে ক্ষমা চেয়ে তার দাবিকেই বৈধতা দিলেন। অনেকে বলছেন, সাকিবের আর কিছু করার ছিল না। নিরাপত্তার কারণেই তাকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। কিন্তু সাকিবকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তো সরকারের।

বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। নিষেধাজ্ঞায় এক বছর বাইরে থাকলেও করোনার কারণে এই সময় ক্রিকেট না থাকায় তার শ্রেষ্ঠত্বের আসন অক্ষুন্নই আছে। নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার সাকিব। শুধু বাংলাদেশের নয়, সাকিব বিশ্বেরই সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার কিনা তা নিয়েও আলোচনা করা যায়। কারণ অলরাউন্ডারদের মধ্যে কেউ ব্যাটিং অলরাউন্ডার, কেউ বোলিং অলরাউন্ডার। কিন্তু সাকিবকে তেমন বলা কঠিন। সাকিব দলে থাকলে বাংলাদেশ আসলে একজন বেশি খেলোয়াড় নিয়ে মাঠে নামে। তিনি সত্যিকার অর্থেই অলরাউন্ডার।

মাঠের পারফর‌ম্যান্সে যেমন তিনি সবার সেরা, মাঠের বাইরের বিতর্কেও সবার আগে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে বিতর্কিত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। কখনও ইচ্ছায়, কখনও অনিচ্ছায়, কখনও কারণে, কখনও অকারণে বিতর্কে জড়ান সাকিব। ভক্তকে পিটিয়েছেন, ক্যামেরায় অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেছেন, বাংলাদেশের হয়ে না খেলার হুমকি দিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে বিসিবি তাকে সতর্ক করেছে, শাস্তিও দিয়েছে। বিতর্কের চূড়ায় উঠেছেন ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব গোপন করে। এবার বিসিবি নয়, আইসিসি তাকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল। সবার আশা ছিল নিষেধাজ্ঞা শেষে সাকিব ফিরবেন নতুন সাকিব হয়ে। কিন্তু না, সাকিব আছেন সাকিবের মতোই, একটুও বদলাননি; মাঠে যেমন মাঠের বাইরেও সেই আগের সাকিবই যেন।

গত ২৯ অক্টোবর সাকিব আল হাসানের এক বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়। তখন তিনি সপরিবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। ৬ নভেম্বর তিনি দেশে ফেরেন। বিদেশফেরত সবাইকে যখন বাধ্যতামূলক দুই সপ্তাহের কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা, তখন সাকিব দেশে ফেরার ১০ ঘণ্টার মধ্যে গুলশানে একটি সুপারশপ উদ্বাধন করতে যান। স্বভাবতই সেই অনুষ্ঠানে সামাজিক দূরত্বের বালাই ছিল না। স্বাস্থ্যবিধিও মানা সম্ভব হয়নি।

সাকিব আল হাসান আমাদের সেরা সম্পদ। তাকে নিরাপদে রাখাও আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেও সাকিব যখন দেশে ফিরে প্রথম তৎপরতা হিসেবে একটি সুপারশপ উদ্বোধনকে বেছে নেন, আমরা উদ্বিগ্ন হই। আমাদের উদ্বেগ এখানেই শেষ নয়। গত ১২ নভেম্বর তিনি সড়কপথে কলকাতা যান, ফিরে আসেন পরদিন। কিন্তু এই ঝোড়ো সফরে তিনি তুলেছেন বিতর্কের ঝড়।

সাকিব আল হাসান কেন কলকাতা গিয়েছিলেন বা সেখানে কী করেছেন; তাতে পরে আসছি। কিন্তু সাকিবকে সড়কপথে সেখানে যেতেই হলো কেন? যত জরুরি কাজই হোক, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন কাবু সবাই, তখন অতি জরুরি কাজ ছাড়া দেশের বাইরে যেতে হবে কেন?

সাকিব বিসিবির সাথে চুক্তিবদ্ধ। তিনি চাইলেই তার ইচ্ছামতো যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন না, অন্তত পারা উচিৎ না। অবস্থাটা এমনই জটিল, ভারত এখন পর্যন্ত মেডিক্যাল ও বিজনেস ভিসা ছাড়া অন্য কোনো ভিসা দিচ্ছে না। তখন সাকিবকে বিশেষ ব্যবস্থায় ভিসা নিয়ে কলকাতা যেতে হলো কেন, কোন জরুরি কাজে?

বিতর্ক যেন সাকিবের হাত ধরে চলে। কলকাতা যাওয়ার পথে বেনাপোলে সেলফি তুলতে আসা এক ভক্তের মোবাইল ফোন ভেঙে ফেলেন। সাকিব দাবি করেছেন, সেই ভক্ত স্বাস্থ্যবিধি না মেনে তার শরীরের ওপর উঠে সেলফি তোলার চেষ্টা করছিলেন। তিনি হাত দিয়ে সরাতে গেলে তার ফোনটি পড়ে ভেঙে যায়।

আমি তার কথা বিশ্বাস করেছি। সাকিব আল হাসান যদি দেশে ফেরার ১০ ঘণ্টার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে সুপারশপ উদ্বোধন করতে যেতে পারেন, এক সপ্তাহের মধ্যে খুচরা কাজে সড়কপথে কলকাতা যেতে পারেন; তাহলে আর বেনাপোলের সেই ভক্তের কাছে আপনি কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি আশা করবেন?

নিশ্চয়ই সাকিব এর আগে কখনও বেনাপোল যাননি। সেখানকার একজন মানুষের তো সাকিবকে সামনে দেখলে পাগল হয়ে যাওয়ার কথা। সেই ভক্তও নিশ্চয়ই তাই হয়েছেন। সাকিবকে কখনও কাছে পেলে আমিও তো একটা ছবি তোলার চেষ্টা করব। আমি জানি সাকিবও একজন মানুষ। তিনিও বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু খ্যাতির বিড়ম্বনা সামলানোটাও একটা আর্ট। আর এই প্রথম তিনি মেজাজ হারিয়েছেন, তাও নয়। বারবার মেজাজ হারানো, মারামারি করার অতীত আছে তার।

এটা মানতেই হবে, মাঠে যতটা ভালো পারফরমার তিনি, মাঠের বাইরে ততটাই খারাপ। তিনি ভালো পারফরমার বটে, তবে স্পোর্টস আইডল নন। যিনি ভক্তদের সাথে মারামারি করেন, ফোন ছুড়ে ফেলেন, জুয়াড়িদের সাথে দিনের পর দিন আলাপ চালিয়ে যান; তিনি আর যাই হোন অনুসরণযোগ্য হতে পারেন না।

তবে সব বিতর্ক যেন জমিয়ে রেখেছিলেন কলকাতার জন্য। সাকিব তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক পরেশ পালের আমন্ত্রণে কলকাতা গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বেলেঘাটায় ৬৭ বছরের পুরানো একটি ঐতিহ্যবাহী কালী মন্দিরে কালী পূজার অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেই পূজায় প্রতিবছরই দেশি-বিদেশি সেলিব্রিটিরা যোগ দেন।

প্রথম নিউজ হয়, সাকিব সেখানে কালীপূজা উদ্বোধন করেছেন। তাতেই তুলকালাম বাংলাদেশে। বাংলাদেশের কারও কারও ভঙ্গুর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। মহসিন তালুকদার নামে সিলেটের এক তরুণ ফেসবুকে রামদা নিয়ে সাকিবকে ক্ষমা চাইতে বলেন, নইলে হত্যার হুমকি দেন।

সেই হুমকির পর সাকিব ফেসবুকে এসে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। সাকিব কেন ক্ষমা চাইলেন? তার অপরাধটা কী? আমার বিবেচনায় সাকিবের অপরাধ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কোয়ারেন্টিনে না গিয়ে সুপারশপের উদ্বোধন করা এবং সড়কপথে কলকাতা যাওয়া। কালী পূজার উদ্বোধন করা কোনো অপরাধ নয়। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। সাকিব তো পূজা করেননি। পূজাকে ঘিরে যে উৎসব, তাতে অংশ নিয়েছেন, প্রদীপ জ্বালিয়েছেন। সাকিব যদি পূজা উদ্বোধন করেও থাকেন, সেটা কোনো অন্যায় তো নয়ই, বরং এই ঘটনায় সাকিব হতে পারতেন দুই দেশের সম্পর্ক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য এক উদাহরণ।

কিন্তু সাকিব হার মানলেন উগ্র মৌলবাদীদের কাছে। যতদূর জেনেছি, বেলেঘাটায় পরেশ পালের উদ্যোগে যে ঐতিহ্যবাহী কালীপূজা হয়, সাকিব সেটা উদ্বোধন করতে বা অংশ নিতেই কলকাতা গেছেন। যদিও সাকিব দাবি করেছেন, তিনি অন্য একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে তিনি ৪০/৪৫ মিনিট ছিলেন। সেই স্টেজের পাশেই ছিল পূজার আয়োজন। মূল অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে পরেশ পালের অনুরোধে তিনি দুই মিনিটের জন্য গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি প্রদীপ জ্বালিয়েছেন এবং ছবি তুলেছেন।

তাহলে আমার প্রশ্ন, সাকিবের দাবি অনুযায়ী তিনি যে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে কলকাতা গিয়েছিলেন, সেটি কী অনুষ্ঠান? কী এমন জরুরি অনুষ্ঠান, যাতে অংশ নিতে বিশেষ ব্যবস্থায় সড়ক পথে কলকাতা ছুটে গিয়েছিলেন। সাকিবের সাড়ে সাত মিনিটের ক্ষমা প্রার্থনায় তার ব্যাখ্যা নেই। সাকিব বলেছেন, ‘পূজার উদ্বোধন আমি কখনোই করিনি এবং সচেতন মুসলমান হিসেবে আমি করব না।’

পুলিশ এরই মধ্যে সাকিবকে কুপিয়ে কেটে ফেলার হুমকি দেওয়া মহসিন তালুকদারকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু সাকিব তো সেই উগ্র মৌলবাদীর দাবি মেনে ক্ষমা চেয়ে তার দাবিকেই বৈধতা দিলেন।

অনেকে বলছেন, সাকিবের আর কিছু করার ছিল না। নিরাপত্তার কারণেই তাকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। কিন্তু সাকিবকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তো সরকারের। আর সেই মহসিন তালুকদার তো চাইলেও কোপানোর জন্য সাকিবকে সামনে পেত না।

সাকিব দাবি করেছেন, তিনি একজন গর্বিত মুসলমান। তাকে ধন্যবাদ। একজন মুসলমান হিসেবে আমিও গর্বিত। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেই হিন্দুদের একটি পূজার উৎসবে অংশ নেওয়া যাবে না, তা উদ্বোধন করা যাবে না – এমনটা আমি মনে করি না। ধর্ম একজন মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস অন্তরে লালন করেও অপরের ধর্মকে, অপরের বিশ্বাসকে সম্মান জানানো যায়। আপনার ধর্ম বিশ্বাস, অনুভূতি যদি শক্ত হয়; কথায় কথায় তাতে আঘাত লাগবে না। আপনার বিশ্বাসে কোনো খাদ থাকলেই আপনার মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হবে।

সাকিব বলেছেন, ‘আমি আমার ধর্মকে ছোট করে, অন্য ধর্মকে বড় করব না।’ কিন্তু পূজায় অংশ নিলে বা উদ্বোধন করলে কোনো ধর্মকেই ছোট বড় করা হয় না। আবহমানকাল ধরে এই বাংলায় সব ধর্মের মানুষ শান্তিতে পাশাপাশি বাস করে আসছে। ঈদের নামাজটা পড়ি আমরা, উৎসবটা করে সবাই। পূজা উৎসবের ধর্মীয় অংশটা করে হিন্দুরা, উৎসবটা করে সবাই। সাকিব বলেছেন, তার পূজায় যাওয়াটা ঠিক হয়নি, আর কখনও যাবেন না। কী ভয়ঙ্কর কথা! তিনি মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আলাদা হলেও আমরা দুর্বল। এক থাকলেই স্ট্রং।’

সরি সাকিব। আপনার কাছ থেকে এমন আহ্বান আশা করিনি। আপনি মানবতার ঐক্যের ডাক দিতে পারতেন। আমরা সবাই মিলে কল্যাণের দিকে যাত্রা করব। আর রুখে দাঁড়াবো সব অপশক্তির বিরুদ্ধে। সাকিব একজন গর্বিত মুসিলমান। কিন্তু তিনি তো সবার প্রিয়, সবার নয়নের মনি। আর বাংলাদেশে তো মুসলমান ছাড়াও আরও ধর্ম ও জাতির মানুষ আছে। এ আহ্বান তো তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে।

সাকিবের সামনে সুযোগ এসেছিল উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লড়া্ইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার। কিন্তু মাঠের লড়াকু সাকিব হুমকির মুখে এভাবে ভেঙে পড়বেন, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। সাকিবের অবিমৃশ্যকারিতায় মৌলবাদীদেরই জয় হলো। তারা প্রমাণ করল, এভাবে হুমকি দিয়ে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা যায়। সাকিব ক্ষমা চাইতে পারতেন, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে সুপারশপ উদ্বোধন করতে যাওয়ায়, মেজাজ হারিয়ে ভক্তের ফোন ভেঙে ফেলায়, বিশেষ ব্যবস্থায় কলকাতা যাওয়ায়। কিন্তু মাঠে বারবার বাংলাদেশকে জেতানো সাকিব অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে হারিয়ে দিলেন মৌলবাদীদের কাছে। সরি সাকিব।

 

 

প্রভাষ আমিন: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

এ বিভাগের আরো খবর