ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ এক শ্রেণির মানুষ বহু আগে ঘর ছাড়া হয়ে জীবন যাপনের জন্য বেছে নিয়েছিল আশীর্বাদ প্রদানের এক জীবন। দিনে দিনে যারা পরিচিতি পান হিজড়া হিসেবে।
দলবদ্ধ এই জনগোষ্ঠীর জীবন প্রণালী সম্পর্কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকসহ কম বেশি সবারই জানা। এই কমিউনিটির একজন হিসেবে আমার এখানকার আলোচনার মূল বিষয় সেটি নয়।
মনে খটকা বা প্রশ্ন জাগে, আমি যদি তৃতীয় লিঙ্গ হই তাহলে প্রথম লিঙ্গ কে আর দ্বিতীয় লিঙ্গ-ই বা কে? আর এই তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটাই বা আমার মাথার উপর চাপিয়ে দিল কে বা কারা? জানি মনে মনে অনেক প্রশ্ন হয়ত অনেকের আসবে আবার কারও-ই কোনো প্রশ্ন আসবে না।
এই তৃতীয় লিঙ্গ শব্দ তৈরি হওয়ার পেছনে অবদান আমাদের সমাজের ছোট বড় সবার। সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ সব অবস্থানেই এই মানুষদের আসন সংখ্যার মান ৩। আবার কোথাও শূন্য। যদিও তাতে কারও তেমন কিছুই আসে যায় না।
আমি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ (সৌভাগ্য/দুর্ভাগ্যক্রমে)। সমাজের নানান লোক বিভিন্ন প্রয়োজনের তাগিদেই কখনও পাশে থাকে, কখনো পরিচয় দেয় আবার কখনও বা রাস্তায় দেখা হলে চিনেও না চেনার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আগে এগুলো দেখলে খুব কষ্ট লাগত। কিন্তু এখন ধারণ ক্ষমতা হয়ত একটু হলেও বেড়েছে, তাই কষ্ট কম লাগে।
ইদানিং খুব হিড়িক পড়েছে সবাই হিজড়া বা থার্ড জেন্ডার ইস্যুতে কাজ করতে চান। ছোট বড়, নামহীন, ছদ্মনাম, অংশ নামের নানা সংস্থা বা গুটিকয়েক ব্যক্তি আছেন যারা কাজ করতে চান।
হয়ত ফোনে, না হয় সামনে পেলে এক গাদা পরিকল্পনা শুনিয়ে ছেড়ে দেন। মাঝেমধ্যে পাল্টা প্রশ্ন করি, এই যেমন উদ্দেশ্য কী? বা কেনো করবেন? ভবিষ্যতে কী কাজে লাগবে?
কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই এমন ভাব করেন যেন প্রশ্ন করাই আমার ভুল ছিল। যাই হোক, জীবন এভাবেই চলছে, হয়ত চলবে।
এর মাঝে কিছু পর্যবেক্ষণ আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। তার কিছু না বললেই নয়; এলোমেলো করে কেটে গেছে মেয়ে-ছেলে বেলা। কোনো কিছু বুঝে উঠবার আগেই কেমন যেন সব কিছু শেষ হবার পালা।
যে বয়সে আমার সমবয়সী একটি ছেলে বা মেয়েকে রাতে মা না খাইয়ে দিলে তার খাওয়া হয় না, সেই বয়সেই নিজের খাবারের জোগানসহ থাকার জায়গা খুঁজে নিতে হয়েছে। সেই সঙ্গে পড়াশোনা। কখন যে জীবন থেকে কিশোর বয়সটা হারিয়ে গেল টেরই পেলাম না। কোমল ছোট্ট একটি শিশু কখন যে বদমেজাজি, রাগী কঠোর পরিশ্রমী হয়ে উঠল বুঝতেই পারলাম না। ঢঙ করে কথা বলার বয়সে কেমন যেন বারুদ বের হয়।
যাই হোক, এই কমিউনিটির একটি বিরাট অংশ অশিক্ষিত, কারণ তাদের পরিবার থেকে ড্রপ আউট আমার থেকেও অনেক আগে। সুতরাং তাদের জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়া অনেক কঠিন।
এই মানুষগুলোর দিন কাটে পথে পথে। একদিন পথে না নামলে খাবার জোটে না। এই সব সহজ সরল মানুষের মাথা খাওয়ার জন্যই ভিড় করে আশেপাশে কিছু সুবিধাবাদী। যারা রাতারাতি নিজেদের ‘স্টার’ প্রমাণ করার জন্য এই মানুষগুলোর সঙ্গে মেশেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর স্বার্থ হাসিল হলে কেটে পরেন।
অবশ্য যারা সত্যিকার অর্থে কাজ করেন তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু এই সরল মনের কমিউনিটির মানুষকে এটা বোঝাবে কে?
তারা কীভাবে বোঝে আপনি সুবিধা নিচ্ছেন, তা কি জানেন?
এটা তারা বোঝে যখন দেখে কাজ ফুরিয়ে গেলে আপনাদের আর কোনো খবর থাকে না। আর এর প্রভাব কোথায় পড়ে জানেন? সত্যিকার অর্থে যিনি বা যারা কাজ করতে যায় বা যান তাদের ওপর। তখন আপনি বা আপনারা শিশিরদের আবিষ্কার করেন বদ মেজাজি, আক্রমণাত্মক, গা ছাড়া, অল্পতেই রেগে যাওয়া স্বভাবে মানুষ হিসেবে।
প্রকল্প আসে প্রকল্প যায়, কিন্তু শিশিরদের ভাগ্য বদল হয় না, শিশিরদের আচরণ সংশোধনের জন্য চলে সেশন, সেশন এবং সেশন। অথচ শিশিরদের জন্য নেয়া প্রকল্পে যোগ দিয়ে অনেকে শ্রীলঙ্কা, কাল জাপান ঘুরে বেড়ান। আর আশ্চর্য হলেও সত্যি বিভিন্ন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, কিন্তু শিশিরদের ‘আচরণ’ শেখানোর কার্যক্রম শেষ হয় না।
এ কথা বলাই যায়, আপনাদের প্রয়োজনে হয়ত শিশিরদের বিশেষ কোনো ট্রেনিং বা কিছু কিছু জায়গায় পাঠানো হয় (ডোনারদের চাপে), কারণ সেখানে আপনাদের প্রয়োজন পড়ে এ ধরনের একজন কমিউনিটি রিপ্রেজেন্টেটিভের।
এই কমিউনিটির বিশেষ বিশেষ কিছু মানুষকে পাওয়া যায়, যারা সুন্নতে খাতনা থেকে শুরু করে এমন কোনো অনুষ্ঠান নেই যেখানে যান না। যাওয়া নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা সেখানেই হয় যখন দেখি এত বছর কাজ করেও যারা এখনও বোঝেন না কোন বয়সে কোথায় কী কথা বলা উচিত। কোথায় যাওয়া উচিত। এ ধরনের ব্যক্তিদের সামনে শুধু কিছু শেখানো কথা ছাড়া আর কিছু বলারও হয়ত উপায় থাকে না।
কমিউনিটির বিশেষ কিছু মানুষ আছেন, যারা সুবিধা ভোগ করে মূলধারার মানুষের সঙ্গে মিশে কিছু বিষয়ের নাম শিখেছেন, কিছু ট্রেনিং করেছেন। কিন্তু ট্রেনিং থেকে শেখা বিষয় ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেমন খুব একটা কাজে লাগে না, কমিউনিটির উন্নয়নেও এর ভূমিকা সামান্য।
আরেক দল মানুষ আছেন, যাদের সঙ্গে কমিউনিটির মূলধারার মানুষের মানুষের কোনো যোগাযোগ নেই। তারা না আছেন মানুষের কল্যাণে, না অকল্যাণে।
কিছু অসাধু ব্যক্তি এতটাই অসৎ যে, তারা শুধুই নিজেদের কথা চিন্তা করেন, নিজেদের নিয়েই ভাবেন। কোনো পড়াশোনা নেই, বরং শুধু সমালোচনাতে লিপ্ত, পাশের সহকর্মীকে নিজেরদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন।
এ তো গেল কমিউনিটির দোষের কথা। আমি আমার চাকরি জীবনে যে কয়েকটি সংস্থায় কাজ করেছি, কম বেশি সব কলিগকে একটা প্রশ্ন করেছি- আচ্ছা আপনার ছেলে বা মেয়ে যদি একজন ট্রান্সজেন্ডারকে বিয়ে করে বা করতে চায় আপনি বাবা/মা হিসেবে কী করবেন?
কেউ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন, কেউ বা অনেক বাজেভাবে কথা বলছেন, কেউ চিরদিনের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। একবারও ভাবেননি তাদের ঘরেও এমন সন্তান আসতে পারে।
অনেকেই অনেক দিন ধরে কমিউনিটির উন্নয়নে কাজ করছেন, কিন্তু কী কাজ করেছেন আজও বুঝলাম না। কথা দিয়ে হয়ত অনেক কথার ঝুরি বানানো যাবে। কিন্তু শোনার মানুষ কই। তাই কমিউনিটির মানুষদের প্রতি আজ বেগম রোকেয়ার মতো বিনীত আহ্বান- জাগো গো ভগিনী।
নিজেদের ভালো মন্দ নিজেরা কবে বুঝবেন? এখনো কি সময় হয়নি? আর কত? আলো আসে আলো যায়, অন্ধকার ফুরায় না...।
লেখক: নাট্যকর্মী ও ট্রান্সজেন্ডার রাইটস এক্টিভিস্ট