সপ্তাহ শেষে বৃহস্পতিবার বিকেলে মানুষ যখন ঘরে ফেরার তাড়ায়, তখন রাজাধানীর বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ ৯টি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হয়। এই মুহূর্তে দেশে রাজনৈতিক উত্তেজনাকর কোনো পরিস্থিতি নেই, আন্দোলন নেই, কোনো দলের কর্মসূচিও ছিল না। তাহলে বাসে আগুন দিল কারা?
সেদিন ঢাকা-১৮ আসনে উপনির্বাচন ছিল। একে কেন্দ্র করে বিরোধী কোনো পক্ষ নাশকতার উদ্দেশে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটাতে পারে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছে। কিন্তু বিষয়টি হয়তো এত সরল নয়। তবে জনমনে একটা আতঙ্ক আছে, তবে কি ২০১৩-১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের সেই ভয়ঙ্কর আগুনসন্ত্রাস ফিরে এল আবার?
যদি এটি হয়, তাহলে বিষয়টি হবে খুব দুঃখজনক। করোনায় বিপর্যস্ত মানুষ যখন ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে তখন এমন সহিংসতা মানুষকে আরেক দফা কষ্টের মধ্যে ফেলবে। এমনিতেই একটি সাম্প্রদায়িক শক্তি যখন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ বিঘ্নিত হলে সামগ্রিকভাবে সবার জন্য অমঙ্গল বয়ে আনবে।
হঠাৎ করে একের পর এক এভাবে গণপরিবহনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় নগরজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এই পদক্ষেপ নিতেই হবে। কিন্তু রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও অস্থিরতা শুধুমাত্র ভোটকে কেন্দ্র করে হচ্ছে, এমন ভাবনা যেন পেয়ে না বসে সবাইকে। কেমন যেন মনে হয় এটি এক অন্য আবহ। কোনো পক্ষ কি চাচ্ছে দেশে একটা অস্থিরতা তৈরি হোক? তারা যেন সফল না হয়, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।
রাজনীতি সুস্থ সমাজ গঠনের স্তম্ভ। তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দেশের পরিবেশ। ক্ষমতা অধিকার করতে পারার মতো ভরসা মানুষের মাঝে সৃষ্টি যারা করতে পারে না, তারাই আসলে সহিংসতার পথ বেছে নেয়। রাজনীতির পরিসরে অসুস্থ রাজনীতি সহজ হয়ে গেলে, রাজনৈতিক কৌশলের বদলে সন্ত্রাসের রণনীতি বেছে নিলে তার ফসল কারা ঘরে তুলবে সেটাও ভাবা দরকার।
উন্নয়নের বদলে উন্মাদনা চাইলে সেটা অবশ্য অন্য কথা। যারা হিংস্রতা দেখাতে চায়, সহিংস হতে চায়, তাদের জন্য যুক্তি লাগে না, লাগে কেবল একটি উপলক্ষ। সে উপলক্ষ দেশের ভেতরে সৃষ্টি করতে পারে, বা বাইরের কোনো দেশের ঘটনায়ও দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করা যায়।
গুলিস্তান, শাহবাগ, মতিঝিলসহ রাজধানীর কয়েক জায়গায় বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় একটি কল রেকর্ড পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলছেন, সেটি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। যারা কথা বলেছেন তাদের পরিচয় জানতে কাজ করা হচ্ছে।
বছর পাঁচেক পর আবার আগুনে বাস পুড়তে দেখল মানুষ। আগুন সন্ত্রাসের সেই সময়টায় কত পরিবার শেষ হয়ে গেছে, সে কথা ভাবলে এখনও ভয়ে শরীর হিম হয়ে যায়। পৃথিবীর আর কোথাও এমন হিংসা আর উন্মাদনার রাজনীতি দেখা যায় না। রাজনৈতিক বিরোধিতায় দরিদ্র মানুষকে বাসের ভেতর, সিএনজি অটোরিকশার ভেতর, মাইক্রোবাসের ভেতর, ঠেলাগাড়িতে পুড়িয়ে মারার রাজনীতি কোনো জনপদে কখনও হয়নি। এটি এক অনন্য নজির। ব্যক্তি, দল নির্বিশেষে শুভচিন্তার উন্মেষের মধ্য দিয়ে যদি বন্ধুত্বের, সম্প্রীতির বাতাবরণ বজায় থাকে, সেটিই হবে সুস্থ মানসিকতার পরিচয়। এই বিশ্বাস যাদের নেই, মানুষকে যারা আস্থায় নেয় না, তারাই এমন করে মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে।
রাজনীতির এই অসুস্থতা কল্পনাও করেনি কেউ কখনও। মূলত যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সেই আগুন সন্ত্রাসের বড় মূল্য দিয়েছে দরিদ্র মানুষ। এই মারাত্মক ব্যাধির প্রসার ও বাড়বাড়ন্ত যেন ফিরে না আসে। সেই সময়টায় রাজনীতির নামে প্রবল হিংসায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়েছে পুরো দেশ।
আমরা জানি সরকার সচেতন আছে, সতর্ক আছে। অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে জরুরি ভিত্তিতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়, নিশ্চয়ই সরকার সেটি নেবে। অপরাধমূলক কাজকর্মের ইতিহাস আছে এমন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে তারাও, যারা সবসময় এখানে-ওখানে হিংসার আয়োজন প্রস্তুত রাখে। তারা কুমিল্লায়, লালমনিরহাটে ইতোমধ্যেই ধর্মীয় অনুভূতির নামে অঘটন ঘটিয়েছে।
শান্ত সময়ে হঠাৎ এই আগুন নিছক কোনো সাধারণ সমস্যা নয়। কোনো গোষ্ঠী হয়তো জাতীয় সংহতি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্য দেশ জুড়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাদের পর্যুদস্ত করতেই হবে। হিংস্র, ক্রূর, পিশাচতুল্য পথভ্রষ্ট সেই শক্তি যেন কোনো জায়গা থেকে কোনো ধরণের প্রশ্রয় না পায়।
পুলিশি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি শাসক দলকে গঠনমূলক রাজনীতিও করতে হবে। সুসংগঠিত সুস্থতার রাজনীতি। আমরা যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের কথাও বলি। সেই উদার ও অসাম্প্রদায়িক সব শক্তি সচেতন থাকুক, জাগ্রত থাকুক। হিংসার মাত্রা বাড়িয়ে তা থেকে রাজনৈতিক লাভ নিষ্কাশন করার সুযোগ যেন কোনো পক্ষ না পায়।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: সাংবাদিক