বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিক্ষার্থীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ হবেন শিক্ষক

  • সজীব সরকার   
  • ১৪ নভেম্বর, ২০২০ ১৫:১৭

শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের ‘দাস’ নয় আর শিক্ষকরা শিক্ষার্থীর ‘প্রভু’ নয়। অনেক শিক্ষকের মধ্যে এমন প্রবণতা রয়েছে, তারা মনে করেন শিক্ষক মানে শিক্ষার্থীদের চেয়ে উন্নততর মানুষ। একজন শিক্ষক যদি তার শিক্ষার্থীদের ‘অধম’ শ্রেণিভুক্ত মনে করেন, তাহলে দুই পক্ষের মধ্যে সৌহার্দ্য বা হৃদ্যতা গড়ে ওঠার সুযোগ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।

সমাজে শিক্ষকদের শর্তহীন মর্যাদা দেয়া হয়। আমি নিজে শিক্ষক হয়েও এর বিরোধিতা করি। আমার মতে, শিক্ষকমাত্রই সীমাহীন মর্যাদার অধিকারী হতে পারেন না; কঠোর সাধনায় তাকে এই মর্যাদা অর্জন করতে হবে।

কেবল ক্লাসরুমে লেকচার দেওয়া বা বই থেকে পড়া শেখানো নয়; একজন শিক্ষকের প্রকৃত দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীর অন্তর থেকে অন্ধকার দূর করে তাকে আলোকিত করা, প্রকৃত জ্ঞানদানের মাধ্যমে তার মন থেকে কুসংস্কার ও অজ্ঞতা দূর করা, শিক্ষার্থীর জীবন গঠনে অবদান রাখা এবং সমাজ থেকে পশ্চাৎপদতা দূর করতে আন্তরিক ভূমিকা রাখা। এই ভূমিকাগুলো যথাযথভাবে পালন করলেই কেবল একজন শিক্ষক মর্যাদার সুউচ্চ আসনে আসীন হতে পারেন।

শিক্ষকতা কেবল একটা চাকরি নয়। শিক্ষকতার পরিসর কেবল সময় বেঁধে অফিসে যাতায়াত আর ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার মধ্যে সীমিত নয়। একজন শিক্ষক ক্লাসরুমে পড়াবেন, ক্লাসরুমের বাইরেও শেখাবেন। একজন শিক্ষককের শেখাবার  গণ্ডি হতে হবে সুদূর বিস্তৃত। একজন শিক্ষক নিজেই একটি বই হবেন, পাঠশালা হবেন, একটি শাস্ত্র হবেন।

মহামতি বুদ্ধের শিষ্যরা একবার তাকে প্রশ্ন করেন, ‘আমাদের জন্যে আপনার কী বার্তা রয়েছে?’ ভগবান বুদ্ধ উত্তর করেন, ‘আমার জীবনই তোমাদের জন্যে আমার বার্তা।’ একজন শিক্ষককেও তা-ই হতে হবে; কেবল ক্লাসরুমে শেখালে-পড়ালেই চলবে না, একজন শিক্ষকের সার্বিক জীবন-যাপন এমন হতে হবে যেন তার জীবনাচরণ থেকেও শিক্ষার্থীরা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক শিক্ষা অর্জন করতে পারে।

স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে ক্লাসরুমে কম পড়ানো বা অস্পষ্টভাবে পড়ানোর একটি প্রবণতা রয়েছে; এতে বাসায় প্রাইভেট পড়ানো বা কোচিংয়ের ব্যবসা ভালো জমে। পরীক্ষা আর সার্টিফিকেট নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার কারণে আমাদের দেশে এই চর্চা বেশ প্রবল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে শিক্ষার্থীর মতকে দমন করা বা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায়-অনৈতিক লেনদেন এবং দলবাজি বা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির প্রবণতা রয়েছে।

স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষকের কাছে হেনস্তা হয়ে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার নজিরও এদেশে রয়েছে। যারা এ ধরনের কাণ্ড ঘটাচ্ছেন, তারা প্রকৃত অর্থে শিক্ষক নন; তারা শিক্ষকতা পেশার মহত্বকে বিনষ্ট করছেন।

একজন শিক্ষককে উদার মনের মানুষ হতে হবে। নিজের মতের সঙ্গে শিক্ষার্থীর মত না মিললে তাকে তুচ্ছ বলে খারিজ করে দেয়া যাবে না, তার বিরুদ্ধে আগ্রাসী বা সহিংস হয়ে ওঠা যাবে না। কেবল শিক্ষকের সুরের সঙ্গে সুর মেলাতে না বলে শিক্ষার্থীর নিজের মতামত প্রকাশে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষকের কাজ শিক্ষার্থীকে নিজের প্রতিলিপি হিসেবে গড়ে তোলা নয় বরং শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ ও স্বতন্ত্র একজন মানুষ হিসেবে তৈরি করা। শিক্ষার্থীকে নিজের ছায়া নয় বরং নিজের চেয়ে অগ্রগামী করে গড়ে তোলাই একজন শিক্ষকের দায়িত্ব এবং শিক্ষকের সফলতা। মনে রাখতে হবে, মতের ভিন্নতা আর বৈচিত্র্যই নতুন জ্ঞানের জন্ম দেয়।

শিক্ষক হওয়া মানে অহঙ্কারি ও রাগী ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ হওয়া নয়; শিক্ষক হওয়া মানে শিক্ষার্থীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ হওয়া, তার কাছের মানুষ হওয়া। একজন শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর সেই পরম বন্ধু, যার কাছে শিক্ষার্থীরা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়গুলো পরম আস্থার সাথে, পরম বিশ্বাস ও নির্ভরতার সাথে প্রকাশ করতে পারবে এবং আলোচনা করে তার করণীয় ঠিক করতে পারবে। শিক্ষককে বলা হয় শিক্ষার্থীর জীবন গড়ার কারিগর; শিক্ষার্থীর জীবন গড়ায় যদি ভূমিকা রাখা না যায়, তাহলে শিক্ষক হওয়া যায় না।

কেবল ক্লাসরুমে পড়ানো নয়, ক্লাসরুমের বাইরেও জীবন ও জগত সম্পর্কে শিক্ষার্থীর জরুরি বোঝাপড়া তৈরি করতে সহায়তা করা শিক্ষকের দায়িত্ব। একজন শিক্ষার্থীর অ্যাসাইনমেন্ট তৈরিতে বা তার পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা থেকে শুরু করে তাকে সিলেবাসের বই এবং এর বাইরেও জীবনের জন্যে দরকারি অন্যান্য বই পড়তে উৎসাহিত করা, গবেষণায় উৎসাহিত করা এবং প্রয়োজনে সে কাজেও সহায়তা করা একজন শিক্ষকের দায়িত্ব।

শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের ‘দাস’ নয় আর শিক্ষকরা শিক্ষার্থীর ‘প্রভু’ নয়। অনেক শিক্ষকের মধ্যে এমন প্রবণতা রয়েছে, তারা মনে করেন শিক্ষক মানে শিক্ষার্থীদের চেয়ে উন্নততর মানুষ। একজন শিক্ষক যদি তার শিক্ষার্থীদের ‘অধম’ শ্রেণিভুক্ত মনে করেন, তাহলে দুই পক্ষের মধ্যে সৌহার্দ্য বা হৃদ্যতা গড়ে ওঠার সুযোগ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।

একজন শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি সরল ও সহজ যোগাযোগের সম্পর্ক তৈরি ও তা রক্ষা করা। শিক্ষককে প্রীতিকর হতে হবে, ভীতিকর নয়। ভীতি জাগানো একজন মানুষ কখনোই শিক্ষার্থীর আপনজন হতে পারেন না। একজন শিক্ষককে তার শিক্ষার্থীদের কাছে পরম আপনজন, পরম নির্ভরতার জায়গা হয়ে ওঠা চাই। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীর প্রতি উদার ও সদয় মনের না হন, তবে তিনি শিক্ষার্থীদের কাছের মানুষ হতে পারবেন না। আর একজন দূরের মানুষ হিসেবে তিনি কখনো শিক্ষার্থীদের জীবন গড়ার কারিগর হতে পারবেন না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পদে চাকরি করা মানেই ‘শিক্ষক’ হওয়া নয়। নিয়োগপত্রে পদের নাম ‘শিক্ষক’ হওয়া আর একজন শিক্ষক হয়ে ওঠার মধ্যে বিস্তর তফাৎ। ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নিলেই কেউ ব্রাহ্মণ হয় না, তাকে সেই বিদ্যা বা শাস্ত্রজ্ঞান রপ্ত করতে হয়; ডাক্তারের ঘরে জন্মালেই কেউ ডাক্তার হয় না, তাকে ওই বিদ্যালাভের মাধ্যমে ডাক্তার হয়ে উঠতে হয়। তেমনি শিক্ষক পদে নিয়োগ পেলেই কেউ শিক্ষক হয়ে যায় না; কঠোর সাধনায় তাকে শিক্ষক হয়ে উঠতে হয়।

কেবল শিক্ষকরাই যে শিক্ষার্থীদের দিকনির্দেশনা দিয়ে তার জীবন গড়ে দিতে পারেন, তা নয়; একজন শিক্ষকের জীবনে তার শিক্ষার্থীদেরও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে এজন্যে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেই সম্পর্কটুকু একজন শিক্ষককে তৈরি করে নিতে হবে।

যে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর দ্বিমত বা ভিন্নমত সহ্য করতে পারেন না, তিনি শিক্ষক নন। যে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন, তিনি শিক্ষক নন। যে শিক্ষক ক্লাসে বা ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার্থীর আত্মসম্মান বোধে আঘাত করেন, তিনি শিক্ষক নন। যে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন, তিনি শিক্ষক নন। যে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে লোলুপ দৃষ্টিতে দেখেন এবং যৌন হয়রানি করেন, তিনি শিক্ষক নন। শিক্ষার্থীর সঙ্গে অন্যায়-অনৈতিক সুবিধাদির বিনিময় ব্যবস্থা তৈরি করলে তিনি শিক্ষক নন। শিক্ষার্থী বেশি জানলে বা শিক্ষার্থীর অর্জন দেখে ঈর্ষাকাতর হলে তিনি শিক্ষক নন।

প্রাচীনকালে বিদ্যালাভের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীরা নিজের ঘর ছেড়ে সুদূর গাঁয়ে গুরুগৃহে বাস করতো। বহু বছর সেখানেই বিদ্যাচর্চা চলতো। গুরুকুলনির্ভর পাঠ ব্যবস্থায় এই দীর্ঘ সময়ে তাদের মধ্যে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক গড়ে উঠতো। গুরু যিনি, তিনি তার শিষ্যদের বিদ্যা শিক্ষা দেওয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন আর পাঠলাভের বাইরে অবসর সময়ে শিষ্যরা সবাই মিলে গুরুগৃহের গৃহস্থালি কাজগুলো সারতো। গুরু যখন ঘরের বাইরে বেরোতেন, পরম ভক্তিবশত শিষ্যরা গুরুর মাথায় ‘ছত্র’ (ছাতা) ধরতো যেন রোদ-বৃষ্টিতে গুরু কষ্ট না পান; সেই জন্যে গুরুর শিষ্যদের ‘ছাত্র’ (ছত্র ধরে যে) বলা হয়।

শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য এবং পরস্পরনির্ভরশীল; একজনকে ছাড়া অন্যজনের অস্তিত্ব অর্থহীন। এই সম্পর্ক আত্মিক। দুজনের মধ্যে আত্মার সূত্রে আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পরস্পরের পরিপূরক; তারা একে অপরকে পূর্ণ করে। শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষকের এই সম্পর্কই হওয়া দরকার।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সহজ, সরল ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে উঠলেই সত্যিকার সেই শিক্ষক হয়ে ওঠা সম্ভব, সমাজে যিনি অন্য সবার চেয়ে বাড়তি মর্যাদার অধিকারী। উভয়ের মধ্যে এমন সম্পর্ক গড়ে উঠলেই শিক্ষার্থী ক্রমে বিদ্যার্থী হয়ে উঠবে এবং জাতি উপকৃত হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।

এ বিভাগের আরো খবর