বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কুখ্যাত দায়মুক্তি অধ্যাদেশ

  • বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক   
  • ১২ নভেম্বর, ২০২০ ২০:১০

১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে একটি আইন পাসের মাধ্যমে জাতির জীবনের কলঙ্ক ইমডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয়। এটি ছিল জাতির জীবনে এক দায়মোচন।

পৃথিবীর বহু দেশে বিভিন্ন সময় বহু ঘৃণিত কালো আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে হত্যাকারীদের বিচারের দায় থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স এবং পরে দায়মুক্তি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, সারা বিশ্বে তার নজির নেই।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে কয়েকজন সুবেদার, মেজর, কর্নেল। পর্দার আড়ালে থাকা নীল-নকশাকারীদের প্রত্যক্ষ নির্দেশ এবং পরিকল্পনায় সেইসব সামরিক ব্যক্তিসহ সব হত্যাকারী এবং হত্যায় জড়িতদের বিচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি দেয়ার পঙ্কিল পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর একটি তথাকথিত অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়।

সেই অধ্যাদেশে খুনি খন্দকার মোশতাক দস্তখত করেছিলেন। কারণ তখন অবৈধ হলেও তিনি ছিলেন দৃশ্যমান রাষ্ট্রপতি। কিন্তু পুরো বিষয়টায় যে খুনি জিয়ার হাত ছিল তা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়।

ওই তথাকথিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সাধিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তনের এবং সামরিক আইন ঘোষণার জন্য কোনো পরিকল্পনা প্রস্তুত ও বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বা এরূপ পরিবর্তন বা ঘোষণার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে হিসেবে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো কাজকর্ম, বিষয় বা ঘটনার জন্য বা কারণে বা প্রসঙ্গে এরূপ ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট ও কোর্ট মার্শাল কোনো আদালতের বা কর্তৃপক্ষের সমীপে বা নিকটে বা দ্বারা কোনো মামলা, অভিশংসন বা অন্য আইনগত বা শৃঙ্খলামূলক কার্যধারা গ্রহণযোগ্য হবে না বা গৃহীত হবে না। বর্তমানে যে কোনো প্রতিরক্ষা সার্ভিস সংক্রান্ত যে কোনো আইনের আওতায় রয়েছেন বা কোনো সময়ে আওতায় ছিলেন এমন কোনো ব্যক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত।’

প্রাথমিকভাবে এটি তথাকথিত অধ্যাদেশ আকারে প্রণয়ন করা হলেও ১৯৭৯ সালে খুনি জিয়া এটিকে আইনে পরিণত করার পদক্ষেপ নেন এবং তা করেনও।

দেখার মতো বিষয় হলো, তথাকথিত অধ্যাদেশ এবং আইনে পরিকল্পনা প্রস্তুতের সঙ্গে জড়িতদের কথাও বলা হয়েছে, যা নিশ্চিতভাবে জিয়া, মোশতাক, চাষি, তাহের ঠাকুর, ওবায়দুল হক, শাহ মোয়াজ্জেম, নুরুল ইসলাম মঞ্জু, মোমেন খানসহ যেসব খুনি পর্দার আড়াল থেকে হত্যাকাণ্ডের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করেছে, তাদেরও দায়মুক্তিতে আনার জন্য বেআইনি চেষ্টা হয়েছে, যা প্রাথমিকভাবে প্রমাণ করে যে হত্যার নেপথ্যে ছিল এই আইনের পরিকল্পনার আসল হোতারা।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতায় ছিল যেসব পাকিস্তানি চরেরা, তারা একাত্তরে পরাজিত হয়ে পরে তাদের পাকিস্তানি, চীনা এবং আমেরিকান প্রভুদের নির্দেশে দেশকে আবার পকিস্তানে রূপান্তর করার মানসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। তাই তারা শুধু সেই তথাকথিত অধ্যাদেশ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা প্রত্যক্ষ খুনিদের প্রমোশন দিয়ে বিভিন্ন বাংলাদেশি দূতাবাসে লোভনীয় পদে পদায়ন করে। তাদের বিচার করা তো দূরের কথা, পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসে তারাও ছিল পাকিস্তানপন্থি এবং তাই তারা্ও তাদের বিচারের কথা ভাবেনি। কারণ বিচার করতে গেলেই খুনি জিয়া, খুনি মোশতাকসহ জড়িত নেপথ্যের খলনায়কদের নাম আসত।

একটি সত্য কথা, যা আইনের জগতের বাইরে অনেকেই জানেন না, তা হলো এই যে, তথাকথিত অধ্যাদেশ যেহেতু আইনের দৃষ্টিতে জন্ম থেকেই অচল ছিল, সেহেতু বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িতদের বিচারে এই বেআইনি অধ্যাদেশ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারত না।

অবশেষে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর তথাকথিত অধ্যাদেশটি পার্লামেন্টে বাতিল ঘোষণা করে আইন পাস করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আওয়ামী লীগ সরকার।

তবে এখানে উল্লেখ্য যে, এই অধ্যাদেশ এবং আইন বাতিল না করেও বিচারে আইনগত কোনো বাধা ছিল না। কারণ প্রায় কাছাকাছি সময়ে বিষয়টি ফারুক রশিদের করা মামলায় হাইকোর্টে উঠলে হাইকোর্ট স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছিলেন, এই অধ্যাদেশ এবং আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বিধায় এটি সূচনা থেকেই অবৈধ। অর্থাৎ এই আইন কখনও বৈধ ছিল না। যার অর্থ দাঁড়ায়, এই বেআইনি অধ্যাদেশ সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে কখনো বাধা ছিল না। যেহেতু এটা সবসময় অবৈধ ছিল।

আরও পরে ২০০৫ সালে পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে প্রথমে হাইকোর্ট এবং পরে আপিল বিভাগ আরও গভীরে গিয়ে খুনি জিয়ার সামরিক শাসনামলে প্রণয়ন করা সমস্ত ঘোষণা, রেগুলেশন, রুল, বিধি অবৈধ বলে ঘোষণা করেন, যার মধ্যে সেই ১৯৭৯ সালে প্রণীত দায়মুক্তি আইনটিও অন্তর্ভুক্ত।

এখানে উল্লেখ্য, খালেদা জিয়াও তার খুনি স্বামীর অনুসরণে ২০০৩ সালে অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে যারা সারা দেশব্যাপী বিচারবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলেন। তাদের দায়মুক্তি দেয়ার জন্য একটি ইনডেমনিটি আইন করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি হাইকোর্টে গেলে হাইকোর্ট অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেন, খালেদা জিয়ার ইনডেমনিটি আইনও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বিধায় জন্ম থেকেই অবৈধ।

আমাদের সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদে সরকারকে দায়মুক্তি আইন করার যে ক্ষমতা দেয়া আছে, তা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা শত্রুকে ঘায়েল করেছে তাদের জন্য এবং সে ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রযোজ্য। অন্য কোনো পরিস্থিতিতে হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো ধরনের দায়মুক্তি দেয়া যায় না। 

লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারক

এ বিভাগের আরো খবর