বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইলেকটোরাল কলেজ কতটা গণতান্ত্রিক

  • মাসুদ কামাল   
  • ১২ নভেম্বর, ২০২০ ১৬:৫০

ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি বাতিলের জন্য কংগ্রেসে এ যাবত ৭২টি প্রস্তাব উঠেছে। কিন্তু তারপরও রয়ে গেছে দুই শতাধিক বছর আগের নিয়মটি। কেবল ঐতিহ্য রক্ষার নামে আমেরিকানরা সযত্নে ধারণ করে রেখেছে চরম অগণতান্ত্রিক এই পদ্ধতিকে। জাতি হিসাবে তাদের স্ববিরোধিতা এখানেই স্পষ্ট হয়ে যায়।

চার বছর পর পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের পাশাপাশি প্রতিবার অবধারিতভাবে যে বিষয়টি আলোচনায় এসেই যায় সেটি হচ্ছে- 'ইলেকটোরাল কলেজ'। এই পদ্ধতিটা আসলে কী, এর কারণে নির্বাচনটি সহজ হচ্ছে নাকি জটিল, পদ্ধতিটি থাকতেই বা কেন হবে- এরকম নানা প্রশ্নও শোনা যায়।

এবারের নির্বাচন হয়ে গেল নভেম্বরের ৩ তারিখে। এরপর এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, কিন্তু অফিসিয়াল ফল এখনও ঘোষণা করা হয়নি। মিডিয়া বলছে জো বাইডেন জিতেছেন, ট্রাম্প ও তার অনুসারীরা হার স্বীকার করছেন না। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। আমেরিকা একটা আধুনিক দেশ। অর্থ, শক্তি, প্রযুক্তি, জ্ঞান, বিজ্ঞান- সকল ক্ষেত্রেই এরা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ হিসাবে ভাবতে ভালবাসে। এমন অগ্রসর একটি দেশ পুরো নয় দিন সময় নিয়েও দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের ফল ঘোষণা করতে পারে না কেন? এটা কি একটু অবাক করা বিষয় নয়? জাতীয় নির্বাচনের ফল ঘোষণা নিয়ে এমন লেজেগোবরে অবস্থা কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে চিন্তাই করা যায় না। তাহলে কি এর জন্য তাদের নির্বাচন পদ্ধতিই দায়ী? না, অত সরলীকৃত অভিযোগ করা বোধকরি ঠিক হবে না। তবে এতটুকু কিন্তু বলাই যায়, ওদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটা যদি ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে না হতো, তাহলে এত ঝামেলা হতোই না।

ভোটের হিসাব এরইমধ্যে যতটুকু জানা গেছে, বাইডেন প্রায় ৪৭ লাখ ভোট বেশি পেয়েছেন ট্রাম্পের চেয়ে। যা কিছু ভোট গোনা এখনও বাকি আছে, সেই অমীমাংসিত ভোটের তুলনায় এই সংখ্যাটি অনেক বেশি। তাই সহজেই ঘোষণা আসতে পারত বাইডেনের পক্ষে। কিন্তু ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির কারণে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, এই পদ্ধতিটি এতটাই অদ্ভুত যে, কম ভোট পেয়েও একজন প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেন। বেশি অতীতে যাওয়ার দরকার নেই, এখন যে ক্ষমতাসীন ট্রাম্প, তিনিও ২০১৬ সালে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট কম পেয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমেরিকার ইতিহাসে এমন ঘটনা আরও চারবার ঘটেছে। ২০০০ সালে জর্জ ডাব্লিউ বুশ তার প্রতিদ্বন্দ্বী আল গোরের চেয়ে ৫ লাখ ভোট কম পেয়েও নির্বাচিত বলে ঘোষিত হয়েছিলেন। এমন ভাগ্যবান আরও ছিলেন জন অ্যাডামস, রাদারফোর্ড হেইস এবং বেঞ্জামিন হ্যারিসন।

আধুনিক গণতন্ত্রের যে চরিত্র তার সঙ্গে এই ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি কতটা বেমানান সেটা বুঝতে খুব বেশি একটা মাথা খাটানোর দরকার পড়ে না, কেবল এই সিস্টেমটার কার্যপদ্ধতির দিকে একবার তাকালেই হয়। সহজ করে বলতে গেলে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়টি কে কত ভোট পেল তার ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে কে কোন স্টেটে কত ভোট পেল তার ওপর। যেমন এবার প্রতিটি স্টেটের ভোটাররা বাইডেন বা ট্রাম্পের চেহারা দেখে ভোট দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা আসলে নির্বাচিত করেছে এই দুই দলের কিছু প্রতিনিধিকে। এদেরই নাম দেওয়া হয়েছে ইলেকটোরাল কলেজ। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বিভিন্ন স্টেটের ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক ইলেকটোরাল কলেজ আছে। যেমন সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে, তাই এখানে ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি- ৫৫টি। বড় স্টেটগুলোর মধ্যে টেক্সাসে ৩৮টি, নিউ ইয়র্ক ও ফ্লোরিডায় ২৯টি করে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। আবার ছোট ছোট স্টেটে, যেমন- মেইনে ৪টি, নেব্রাস্কায় ৫টি, আইওয়ায় ৬টি নেভাডায় ৬টি, ওয়াশিংটন ডিসিতে ৩টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। এভাবে সব মিলিয়ে রয়েছে ৫৩৮ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। নিয়মটা হচ্ছে- যে স্টেটে যে দল জিতবে, সেই স্টেটের সকল ইলেকটোরাল কলেজ সে পেয়ে যাবে। এভাবে ৫৩৮-এর মধ্যে ২৭০ বা তার বেশি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট যে প্রার্থী পাবেন, তিনিই প্রেসিডেন্ট হবেন।

এই যে বললাম, এটা হলো মোটা দাগের বলা। এখানেও কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন যে রাজ্যে যে বেশি ভোট পাবে, সে সেই স্টেটের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাওয়ার নিয়মটি কিন্তু মেইন ও নেব্রাস্কার জন্য প্রযোজ্য নয়। সেখানে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ভাগাভাগি হয়ে যায়। যেমন এবার মেইনের ৪টি ইলেকটোরাল কলেজের মধ্যে ৩টি পেয়েছেন বাইডেন, আর ১টি ট্রাম্প, নেব্রাস্কার ৫টির মধ্যে ৪টি ট্রাম্প ও ১টি বাইডেন। কেন এই ব্যতিক্রম? আবার এই ব্যতিক্রমটি যদি ভালো হয় তাহলে বাকি ৪৮টি স্টেটে কেন এটি অনুসরণ করা হয় না? এসব প্রশ্নের সহজ কোনো জবাব নেই।

গণতন্ত্রের একেবারে প্রাথমিক একটা নিয়ম হচ্ছে- এক মাথা এক ভোট। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি মানুষের সমান ভোটাধিকার। তা সে খোদ প্রেসিডেন্টই হোন কিংবা খেটে খাওয়া দিন মজুর, কিংবা বাস্তুহারা নিঃস্ব কোনো মানুষই হোন- সকলেরই একটি করে ভোট। সবার ভোটেরই সমান মূল্য। ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে কি গণতন্ত্রের সেই নিয়মটি পালিত হয়? ক্যালিফোর্নিয়ার একজন ভোটার এবং ওয়াশিংটন ডিসির একজনের ভোটাধিকারের মূল্য কি সমান? এবারের নির্বাচন থেকেই না হয় উদাহরণটি দেওয়া যাক। ক্যালিফোর্নিয়ায় এবার মোট ভোট কাস্ট হয়েছে ১ কোটি ৫২ লাখের মতো। আর এখানে ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে ৫৫টি। অর্থাৎ প্রতি ২ লাখ ৭৬ হাজার ভোটারের জন্য একটি ইলেকটোরাল ভোট। বিপরীত দিকে ওয়াশিংটন ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার কথা ধরি, সেখানে এবার মোট দিয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার মানুষ। এখানে ইলেকটোরাল কলেজ রয়েছে ৩টি। এর মানে প্রতি ৯৭ হাজার ভোটারের জন্য ১টি ইলেকটোরাল কলেজ। তাহলে দাঁড়ালোটা কী? ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার একজন ভোটারের সমান হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার তিনজন ভোটার! একই দেশে, একই গণতন্ত্রে, দুইটি স্টেটের ভোটারদের এই মূল্যায়ন কি সমান হলো?

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এমন উদ্ভট নিয়ম আমেরিকানরা করলো কেন? যখন এই নিয়মটি হয় তখন অবশ্য এর পিছনে কিছু যুক্তি ছিল। এই নিয়মটি হয় সেই ১৭৮৭ সালে। সেই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। বিশাল দেশ আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে সংবাদ পৌঁছতে তখন অনেক সময় লাগত। একই দিনে ভোট করলেও, তাৎক্ষণিকভাবে তার ফল প্রকাশ করতে পারত না। তাই তারা নিয়ম করেছিল, নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরের মঙ্গলবার ভোট হবে, ডিসেম্বরের দ্বিতীয় বুধবারের পরের সোমবার স্টেটগুলো থেকে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটারদের সার্টিফিকেট দেওয়া হবে এবং তারপর তারা (ইলেকটোরাল কলেজ ভোটারগণ) সেই সার্টিফিকেট নিয়ে ওয়াশিংটনে যেয়ে জানুয়ারিতে আরেক দফা ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। সেই সময় আরও একটা বিষয় অবশ্য কাজ করেছিল। সেটা ছিল ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে অভিজাত শ্রেণির উদগ্র বাসনা। আগেই বলেছি- স্টেটগুলোতে ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যা নির্ধারিত হয় সেখানকার জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে। সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্রীতদাস প্রথা চালু ছিল। আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের কিছু কিছু জায়গায় এ প্রথা উঠে গেলেও দক্ষিণাঞ্চলে প্রবলভাবেই ছিল। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরা অর্থনৈতিকভাবে ধনীও ছিল। তাই তারা বাড়িতে ক্রীতদাস রাখতে পারত। ক্রীতদাস বা কালোদের ভোটাধিকার না থাকলেও তাদেরকে আদমশুমারিতে ঠিকই গোনা হতো। তবে তাদেরকে পূর্ণ মানুষ হিসাবে নয়, প্রতিজন কালো মানুষকে বিবেচনা করা হতো একজন শ্বেতাঙ্গের ৫ ভাগের ৩ ভাগ হিসাবে। এভাবেও দক্ষিণাঞ্চলের মোট মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে তারা তাদের ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়ার একটা ব্যবস্থা করেছিল।

এসব অবশ্য একেবারে শুরুর দিকে কথা। যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন আর আগের অবস্থায় নেই। কেবল আমেরিকাতেই নয়, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে তথ্য দূরতম কোনো প্রান্তে এখন পাঠানো যায় মুহূর্তেই। ক্রীতদাস প্রথা উঠে গেছে অনেক আগে। নারীদের মতো কালোদেরও এখন রয়েছে ভোটাধিকার। তবুও কেন থাকবে আগের সেই নিয়ম? আপত্তি কি ওঠেনি এর মধ্যে? উঠেছে, খোদ আমেরিকাতেই উঠেছে। ২০১৬ সালে এই পদ্ধতির যে সুবিধাভোগী, সেই ডনাল্ড ট্রাম্পও অনেকবার এর বিরোধিতা করেছেন। ২০১২ সালে তিনি অনেকটা আনুষ্ঠানিকভাবেই এই উদ্ভট নিয়মের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছেন। ডেমোক্র্যাট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স দুদিন আগেও নিয়মটির বিরুদ্ধে বলেছেন, এটি বাতিল করা দরকার বলে দাবি করেছেন। কেবল এখনই নয়, বহুদিন ধরেই আমেরিকান রাজনীতিকরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার। সরব জনপ্রতিনিধিরাও। জানা গেছে ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি বাতিলের জন্য সেখানকার কংগ্রেসে এ যাবত ৭২টি প্রস্তাব উঠেছে। কিন্তু তারপরও কাজ হয়নি। রয়েই গেছে দুই শতাধিক বছর আগেকার নিয়মটি। কেবল ঐতিহ্য রক্ষার নাম করে আমেরিকানরা সযত্নে ধারণ করে রেখেছে চরম অগণতান্ত্রিক ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিকে। জাতি হিসাবে তাদের স্ববিরোধিতা বোধকরি এখানেই স্পষ্ট হয়ে গেছে।

 

মাসুদ কামাল: সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর