বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কলঙ্কের দিন

  • মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)   
  • ৭ নভেম্বর, ২০২০ ০০:৪১

আতঙ্কের মধ্যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিচ্ছে কারা এবং কেন? তারপর তো আস্তে আস্তে সবই জানা গেল।

বাংলাদেশের কপালে কলঙ্ক লেপন শুরু হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে।

সেই সূত্র ধরে একই বছর ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। একই সূত্রে চারদিন পর ৭ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ফোর্স ও সেক্টর কমান্ডার জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল তাহের এবং সাব-সেক্টর কমান্ডার কর্নেল হুদাসহ আরও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়।

১৫ আগস্ট, ৩ ও ৭ নভেম্বরের ঘটনাসমূহের পরম্পরায় যারা নিহত হলেন তার মধ্যে আছেন জাতির পিতাসহ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের মাঠে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে যারা পরাজিত করেছেন সে সব সাহসী সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা। এর বিপরীতে রাজনৈতিক এবং সশস্ত্র বাহিনীতে যারা ছিলেন তাদের একজনের গায়েও সামান্য একটা টোকা পর্যন্ত লাগেনি। তাহলে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে, যারা জিঘাংসা-প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর, তারাই এইসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে?

এত বড় জিঘাংসা যারা চরিতার্থ করেছে, কোনো বিবেচনায় কি তাদের বাংলাদেশের প্রকৃত নাগরিক বলা যায়? এরা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট এবং পাকিস্তানে বিশ্বাসী, বাংলাদেশে নয়। যারা আইন করল স্বঘোষিত এই খুনিদের বিচার করা যাবে না, তাদের কী বলবেন? খুনিদের রক্ষা ও পুরস্কৃত যারা করলেন, তাদের বর্তমান পরিচয় কি, তাদের কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে, তাহলে তারা কি বাংলাদেশের নাগরিকত্বের অধিকার ভোগ করতে পারে? আমার উপলব্ধিতে তাদের কোনো পরিবর্তন হয়নি, অথচ রাজনীতিসহ সকল অঙ্গনে তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট। এখান থেকে বের হতে না পারলে কোনো কিছু নিয়েই আমরা নিশ্চিত হতে পারব না।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ফিরে যাই। আমরা ৫৫ জন ক্যাডেট ভারতের দেরাদুন মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ অর্ধসমাপ্ত রেখে সবেমাত্র নভেম্বরের এক তারিখে ঢাকায় ফিরে এসেছি। প্রশিক্ষণের বাকি অংশ শেষ করার জন্য কুমিল্লায় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে যোগদানের অপেক্ষায় ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থান করছি। বাইরে যাওয়ার কোনো অনুমতি নেই। সকলে একসঙ্গে অবস্থান করছি। ৩ নভেম্বর ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপেক্ষিতে আমাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগত অস্ত্র ও গুলি ইস্যু করা হয়েছে, যা রাতদিন ২৪ ঘন্টাই আমাদের কাছে থাকত।

বাইরে কী ঘটেছে তার কোনো খবরই পেতাম না। তখন তো মোবাইল ছিল না। পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন – কোনো কিছুই আমাদের সঙ্গে ছিল না। আমাদের মধ্যে ঢাকায় যাদের আত্মীয়-স্বজন ছিল, তারা দুয়েকজন হঠাৎ করে এলে একটু-আধটু বাইরের খবর পেতাম।

নভেম্বর ৩ তারিখের জেলহত্যার খবরটি আমরা ছয় তারিখে শোনার পর সবার চোখে-মুখে কেমন একটা অনিশ্চয়তায় ছাপ দেখা যায়। ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে বারোটা বা একটার দিকে ঢাকা সেনানিবাসের দিক থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলি শব্দ শুনে সন্ত্রস্ত অবস্থায় সবাই উঠে পড়ি।

গোলাগুলির শব্দের মধ্যেই দূর থেকে স্লোগানের আওয়াজ আসতে থাকে। সব স্লোগানের ভাষা বুঝতে পারছিলাম না। ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ কথাটা ভাল করে বুঝতে পারি। আরও দুটি স্লোগান শোনা যায়, যা ছিল আমাদের জন্য আতঙ্কের। শুনতে পাই, স্লোগান আসছে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এবং ‘সিপাই-সিপাই ভাই-ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’।

আতঙ্কের মধ্যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিচ্ছে কারা এবং কেন? তারপর তো আস্তে আস্তে সবই জানা গেল।

এতদিন পর এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, আমরা হয়তো সেদিন ভাগ্যজোরে বেঁচে গেছি। কিন্তু ৭ নভেম্বরের ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক গভীর অন্ধকার সুড়ঙ্গে মধ্যে পড়ে যায়। সেই সুড়ঙ্গ এতই অন্ধকার ও অনিশ্চিত ছিল যে, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনা পরম্পরায় এক বছরের মাথায় রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যিনি অন্ধকার যাত্রার নেতৃত্ব দিলেন, তিনিও মাত্র কয়েক বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে ওই গুহার মধ্যে এমনভাবে নিমজ্জিত হলেন, যার খবর আর কেউ নিল না।

রাষ্ট্রপতি, মুক্তিযুদ্ধের ফোর্স কমান্ডার ও বীর উত্তম নির্মমভাবে নিহত হলেন, অথচ তার বিচার কেউ চাইল না। ক্ষমতা আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি কত নিষ্ঠুর এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে পারে, এটি তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। পরবর্তীতে স্ত্রী ও পুত্র দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও স্বামী ও পিতা হত্যার বিচার চায় নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে শুরু। তারপর ৩ ও ৭ নভেম্বর। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হলো। তারপর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, লে. কর্নেল হায়দার, কর্নেল হুদা, কর্নেল তাহের, জেনারেল মঞ্জুর এবং শেষ পর্যন্ত জেনারেল জিয়া, পাঁচজন বীর উত্তম খেতাবধারী সাহসী চৌকস সেক্টর ও ফোর্স কমাণ্ডার একই ঘটানার সূত্রে ও পরম্পরায় নির্মমভাবে নিহত হলেন। এটা কি একাত্তরের প্রতিশোধ নেওয়ার সুপরিকল্পিত জিঘাংসা নয়?

এই জিঘাংসা সেখানেই থামেনি। এরপরেও সামরিক শাসকের ক্ষমতা বলে পাকিস্তানের এদেশীয় এজেন্টরা বাংলাদেশ নামের ওপর কলঙ্ক রচনা করেছে একের পর এক।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যদি আমাদের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হয়, তাহলে এর মাধ্যমে আমরা যা কিছু পেয়েছি এবং অধিকার করেছি তার সবকিছুই আমাদের জন্য গৌরবের। একই যুক্তিতে এর বিপরীতে যা ঘটেছে, যে জায়গা তৈরি হয়েছে তার সব কিছুই বাংলাদেশের জন্য কলঙ্ক।

দু-চারটি উদাহরণ দিই। এক. ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনার পথ ধরে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসা দুই সামরিক শাসক এবং পরবর্তীতে তাদের প্রতিভূগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাবলী, জাতির পিতা, জাতীয় চার নেতা, মুজিবনগর সরকার, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রসহ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে রাষ্ট্রের সকল অঙ্গন থেকে বিদায় দিলেন।

দুই. মুক্তিযুদ্ধের ফসল, প্রকৃত বাংলাদেশের পরিচয় বহনকারী বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে দুই সামরিক শাসক যা করেছেন, তাকে কেউ কেউ পবিত্র সংবিধানের বলাৎকার বলেছেন।

তিন. পাকিস্তানের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রধান প্রধান সহযোগীরা প্রধানমন্ত্রীসহ বড় বড় মন্ত্রী হলেন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে এসে এসব মন্ত্রী বলা শুরু করলেন, বাংলাদেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। এর থেকে বড় কলঙ্ক বাংলাদেশের জন্য আর কী থাকতে পারে?

কিন্তু বাংলাদেশ ও বাঙালি পরাজিত হওয়ার জাতি নয়। বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অনেক কলঙ্কই আমরা মোচন করেছি। কিন্তু এখনও বাকি আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ৩ ও ৭ নভেম্বর এবং পরবর্তীতে রচিত সব কলঙ্ককে চিরদিনের জন্য মুছে ফেলার সংগ্রামে সকলকে আহবান জানাই।

 

লেখক: গবেষক এবং রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

 

এ বিভাগের আরো খবর