‘শিশু ধর্ষণের দুই সপ্তাহের মধ্যে রায়, আসামির যাবজ্জীবন।’ সংবাদটি গত ১৯ অক্টোবর সব গণমাধ্যমেরই শিরোনাম হয়েছে। যেখানে বলা হয়, বাগেরহাটে শিশু ধর্ষণের ঘটনার দুই সপ্তাহের মধ্যে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে একমাত্র আসামি আবদুল মান্নান সরদারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের মামলায় এর আগে এত দ্রুত সময়ে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হয়নি। যে কারণে আইনজীবীরাও এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করেছেন।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, ১১ অক্টোবর মামলাটি আমলে নিয়ে পরের দিন অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ১৩ ও ১৪ অক্টোবর পুলিশ, চিকিৎসক, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ ১৬ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। ১৫ অক্টোবর আদালত আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনে সাফাই সাক্ষ্য নেন। ১৮ অক্টোবর যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে পরদিনই রায় দেওয়া হয়।
স্মরণ করা যেতে পারে, সিলেটের শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যা মামলার পুরো বিচারকাজও শেষ হয়েছিল দ্রুত, মাত্র ১৭ কার্যদিবসে। বাগেরহাটের ঘটনাটি রাজন হত্যা মামলার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। দেশের আদালতগুলোয় যেখানে প্রায় ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন, সেখানে দুই সপ্তাহের মধ্যে কোনো মামলার রায় দেওয়ার ঘটনা নিশ্চয়ই বড় বিষয়। মনে রাখা দরকার, শিশু ধর্ষণ মামলায় এত দ্রুত রায় দেওয়ার ঘটনাটি ঘটল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার ছয় দিনের মাথায়।
২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির একটি সংবাদ সম্মেলনের কথা অনেকের মনে আছে নিশ্চয়ই। ধর্ষণের শিকার মেয়েকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে বিচার চেয়েছিলেন একজন বাবা। ধর্ষণের শিকার শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে একজন বিচারপ্রার্থী অসহায় বাবার এমন সংবাদ সম্মেলনের দৃশ্য এর আগে বাংলাদেশ কখনও দেখেনি। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার ওই অসহায় পিতা কি তার শিশু সন্তানের ধর্ষণের বিচার পেয়েছিলেন?
গাজীপুরের হযরত আলীর কথা মনে আছে? আট বছরের মেয়ে আয়েশা আক্তারের শ্লীলতাহানির বিচার না পেয়ে মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষায় স্থানীয় প্রভাবশালী থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসন- সবার কাছেই গিয়েছিলেন হযরত আলী। কিন্তু পদে পদে অপদস্থ হতে হয়েছে তাকে। পেয়েছেন পাগল উপাধি। সবশেষ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের আয়োজনও চূড়ান্ত করা হয়। প্রকাশ্যে দা, লাঠিসোটা নিয়ে দরিদ্র হযরত আলী দম্পতির ওপর চড়াও হয় স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। অবশেষে এই অমানবিক এবং ন্যায়বিচারহীন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হযরত আলীকে নিশ্চয়ই আমরা এতদিনে ভুলে যেতে পেরেছি। ধর্ষণের শিকার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসা বাবার কথাও নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছি। যদি না ভুলে গিয়ে থাকি, তাহলে বাগেরহাটে দুই সপ্তাহের মধ্যে একটি শিশু ধর্ষণ মামলার রায় হয়েছে বলে আনন্দে উদ্বেলিত হবার কোনো কারণ নেই। কারণ শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে বাবার সংবাদ সম্মেলন কিংবা ন্যায়বিচার না পেয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে বাবা-মেয়ের আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটে যে সমাজে, সেখানে কোনো একটি ধর্ষণের মামলার রায়ের নিউজ ভ্যালু বা সংবাদমূল্য থাকলেও আখেরে এই ঘটনা পুরো ব্যবস্থার পরিবর্তনে কতটুকু ভূমিকা রাখবে—তা নিয়ে সংশয় প্রকাশের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
বলা হয়, বিচার বিলম্বিত হলে অবিচারের ঝুঁকি বাড়ে। সেক্ষেত্রে যেকোনো ঘটনার দ্রুত বিচার হলে সেখানে ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা বাড়ে। ফলে আইনের নাম যখন হয় দ্রুত বিচার আইন, তাতে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু দ্রুত বিচার হলেই কি সেখানে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা থাকে? কারণ যেকোনো বিচার নির্ভর করে মূলত মামলার তদন্ত রিপোর্ট ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর। নৃশংস কোনো ঘটনায়ও অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না, যদি তদন্ত প্রতিবেদন দুর্বল হয় বা পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকে। সুতরাং দ্রুত বিচার নয়, বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। হযরত আলীরা যাদের কারণে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন, যাদের কারণে ধর্ষণের শিকার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সংবাদ সম্মেলনে একজন অসহায় বাবাকে কাঁদতে হয়, তাদের সবার বিচার নিশ্চিত করা না গেলে অন্য কোনো মামলার দ্রুত বিচারে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই।অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশের অবস্থাটাকে ইংরেজিতে বলে কোনান্ড্রাম। মানে একদিকে ভালো আবার অন্যদিকে তেমন ভালো হচ্ছে না। তার মতে, এখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম সমস্যা হলো, বিচার পাওয়ার সুযোগের অভাব। এটা খুবই ব্যয়বহুল এবং একই সঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত। ক্ষমতাহীন, গরিব বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়া খুব কঠিন বলেও তিনি মনে করেন। সুতরাং কোনো একটি ঘটনায় দ্রুত বিচারকাজ শেষ হলেই যে পুরো বিচারব্যবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেছে বা ন্যায়বিচারের পথে সমস্ত বাধা অপসারিত হয়েছে; বিচারপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা ক্ষমতাহীন মানুষের বিচার পাওয়া সহজ হয়ে গেছে—বিষয়টা সেরকম নয়।
যে কারণে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার পক্ষে-বিপক্ষেও নানা মত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, সমাজ থেকে ধর্ষণ পুরোপুরি বন্ধ করতে আইনি কাঠামো শক্তিশালী করার চেয়েও বেশি প্রয়োজন অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করা। ধর্ষণের মতো অপরাধে যারাই যুক্ত থাকে, তাদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে সমাজের ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালী অংশ। তাদের হয় রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে, নয়তো অর্থনৈতিক ও সামাজিক। দ্বিতীয়ত, যারা অপরাধ দমনে মূল ভূমিকা পালন করেন, সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে ভয়াবহ দুর্নীতিও অপরাধীদের সুরক্ষা পাওয়ার বড় অস্ত্র। ফলে শুধু শক্ত আইন করেই যে ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না তার প্রমাণ খুনেরও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড; কিন্তু তারপরেও সমাজ থেকে খুন দূর হয়ে যায়নি।
আবার কোনো একটি অপরাধের শাস্তির পরিমাণ বাড়ানোর সাথে সাথে কেউ যাতে অবিচারের শিকার না হয়, সেটি নিশ্চিত করাও জরুরি। অর্থাৎ ধর্ষণের মিথ্যা মামলায় যেন কোনো নিরপরাধ লোক শাস্তি না পান বা কেউ যাতে অবিচারের শিকার না হন; জায়গা-জমি বা রাজনৈতিক বিরোধের কারণে প্রতিপক্ষের লোক যাতে ধর্ষণ মামলায় ফেঁসে না যান, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
ধর্ষণ বলতে কী বুঝায় এবং কোন পরিস্থিতিতে একটি ঘটনাকে ধর্ষণ হিসেবে গ্রহণ করা হবে, তারও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা দরকার। সমঝোতার ভিত্তিতে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পরে সেই পুরুষের সাথে মনোমালিন্যের কারণে একজন নারী যদি ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন, সেটি আমলযোগ্য হবে কি না এবং সেই শারীরিক সম্পর্কটি আসলেই সমঝোতার ভিত্তিতে হয়েছিল নাকি জোরপূর্বক—সেটি প্রমাণের সর্বজনগ্রাহ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলাও আবশ্যক।
প্রথম আলোর একটি খবর বলছে, দেশের ৭২টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে যে দেড় লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন, তার একটি বড় অংশই মিথ্যা মামলা। ৮০ শতাংশ মামলা যৌতুক, ধর্ষণ ও যৌন পীড়নের অভিযোগে দায়ের করা হলেও এর আড়ালে রয়েছে অন্য ধরনের বিরোধ।
বিবিসির একটি প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের প্রচুর মিথ্যা মামলা হয়। বিশেষ করে যারা মিথ্যা মামলা দেন তাদের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটা বড় সুবিধা হলো যে, এই আইনে জামিন পেতে বেগ পেতে হয়। পুলিশের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে দেশব্যাপী ১৫ হাজারের কিছু বেশি নারী নির্যাতনের মামলা হলেও প্রায় চার হাজার মামলার ক্ষেত্রে পুলিশি তদন্তে ঘটনার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আবার অনেক মামলায় পরিবারের একজন দোষী হলেও পুরো পরিবারকে জড়ানো হয়েছে। ধরা যাক স্বামীর সাথে বিরোধ। কিন্তু স্ত্রী যখন মামলা করেন, তখন তিনি মামলায় শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদকেও আসামি করেন। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের অন্য কেউ অপরাধে জড়িত নন। সুতরাং ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা কিংবা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করা এক অর্থে সাধুবাদযোগ্য হলেও এসব ক্ষেত্রে মিথ্যা মামলা প্রতিরোধ এবং হযরত আলীর মতো বাবাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে যে ধরনের শক্ত আইনি ও সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলা দরকার—সেই পথে আমাদের কী অর্জন, সেটি নিয়েও ভাববার অবকাশ রয়েছে।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন