বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আবুল হাসনাতের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই

  • ড. মিল্টন বিশ্বাস   
  • ৩ নভেম্বর, ২০২০ ০১:০০

আবুল হাসনাত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত গভীর অনুধ্যানী এক ঋষি। তিনি প্রাণিত করে গেছেন প্রগতিশীল সাহিত্যের আঙিনা। তিনি এদেশের সাহিত্য জগতের নোংরা দলাদলি পরিহার করে পরিচ্ছন্ন আস্তিনে রেখেছিলেন তারুণ্যের জয়কেতন। তার প্রয়াণ আমাদের বেদনাবিদ্ধ করবে আজীবন।

১ নভেম্বর প্রয়াত হলেন কবি, সম্পাদক, প্রাবন্ধিক আবুল হাসনাত (১৯৪৫-২০২০)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের সময় দৈনিক পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখার সূত্রে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। সেটা হবে ১৯৯৫ সালের ঘটনা। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

তখন আমাদের বিচরণের প্রধান একটি জায়গার মধ্যে বাংলা একাডেমি ছিল অন্যতম। সেখানে পরিচালক ছিলেন সেলিনা হোসেন। তার রেফারেন্সে আমি দৈনিক সংবাদ অফিসে আবুল হাসনাতের সঙ্গে দেখা করে নিজের লেখা প্রবন্ধ দিয়ে আসি। প্রবন্ধটি অসম্ভব বড় হওয়ায় তিনি তা ছাপতে পারেননি। সংবাদপত্রে ছাপানোর জন্য বেশি বড় লেখা যে নবীন লেখকের জন্য ক্ষতিকর তা তখনই বুঝতে পেরেছিলাম।

এরপর সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাতের সঙ্গে অনেক জায়গায় সাক্ষাৎ হয়েছে। বিশেষত বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভায় তার উপস্থিতি সবসময়ই চোখে পড়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেও তার সঙ্গে একাডেমি চত্বরে সাক্ষাৎ হয়েছে। আনিসুজ্জামান স্যার তখন বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। সবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করা স্যারের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তখন কিন্তু আবুল হাসনাত তার সমকালের ঘনিষ্ঠজন দ্বারা পরিবেষ্টিত দেখেছি।

স্মরণীয় ২০০৩ সালে কালি ও কলম পত্রিকার সূচনা হয়েছিল সম্পাদক আবুল হাসনাত এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ড. আনিসুজ্জামানের মাধ্যমে। আবুল হাসনাত মিতবাক ছিলেন। বেশি কথা বলা, বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা কিংবা দুঃখের দিনে মুষড়ে পড়ে হা-হুতাশ করা কোনোটাই তার বৈশিষ্ট্য ছিল না। তাকে দূর এবং কাছ থেকে দেখেছি। তার বক্তৃতা শুনেছি। বেঙ্গল প্রকাশনা থেকে কোনো গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি আমাদের আনন্দিত করেছে। এককথায় আবুল হাসনাত ছিলেন সজীব কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্তের একশভাগ বাঙালিয়ানা চরিত্রের মানুষ। তার হাত ধরে যারা লেখক হিসেবে এদেশে খ্যাতি অর্জন করেছেন তারা সবাই আজ শোকগ্রস্ত। তিনি ঢাকা শহরের বাসিন্দা ছিলেন, কিন্তু সারা দেশের কবি-সাহিত্যিকদের চোখের মণিতে পরিণত হয়েছিলেন।

আবুল হাসনাত ১৯৪৫ সালের ১৭ জুলাই পুরান ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্যে তার ছদ্মনাম ছিল মাহমুদ আল জামান। জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, কোনো একদিন ভুবনডাঙায়, ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়াল তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর ও অন্যান্য ও জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দীন ও অন্যান্য। শিশু ও কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়, টুকু ও সমুদ্রের গল্প, যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুরে, রানুর দুঃখ-ভালোবাসা প্রভৃতি গ্রন্থ।

দীর্ঘ ২৪ বছর দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করা আবুল হাসনাত আমৃত্যু কালি ও কলমের সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। পাশাপাশি চিত্রকলা বিষয়ক ত্রৈমাসিক শিল্প ও শিল্পীরও তিনি সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮২ সালে টুকু ও সমুদ্রের গল্পর জন্য তিনি অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার পান। ২০১৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলো মনোনীত হন। ছায়ানটের কার্যকরী সংসদের সদস্য আবুল হাসনাত একসময় সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। তার স্ত্রী নাসিমুন আরা হক সাংবাদিক। তিনি বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি। তাদের একমাত্র মেয়ের নাম দিঠি হাসনাত। তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।

মুর্তজা বশীরের চিত্রভুবনে ও স্মৃতিকথায়, স্বরূপসন্ধানী আনিসুজ্জামান, বিদ্যাবতী ও ভ্রামণিক নবনীতা দেবসেন, শামসুর রাহমানের কবিতায় সময়-চেতনা, কাজী হাসান হাবিব, সাহিত্যপ্রেমিক ও মার্কসবাদী অশোক মিত্র, তার কথা, সংগীত-বিশেষজ্ঞ করুণাময় গোস্বামী প্রভৃতি প্রবন্ধ কালি ও কলমে প্রকাশিত হয়। এসব প্রবন্ধে আবুল হাসনাত সাহিত্য ও শিল্প-সমালোচক হিসেবে নিজস্ব মূল্যায়ন উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু কবিতা, উপন্যাস, চিত্র-সমালোচনাসহ সাহিত্যের নানা বিভাগে পদচ্ছাপ থাকলেও তিনি পরিচিতি লাভ করেছিলেন একজন বিচক্ষণ ও সংবেদনশীল সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। মনে রাখতে হবে তার হাত দিয়ে কালি ও কলম-এর কলকাতা-সংস্করণও বের হয়েছে।

আশির দশকে আবুল হাসনাত সম্পাদিত গণসাহিত্য পত্রিকাটি ছিল বিষয়বস্তুতে সমৃদ্ধ এবং মুদ্রণে অনন্য একটি পত্রিকা। অন্যদিকে কেবল সাহিত্য সম্পাদক নন তিনি গ্রন্থ সম্পাদনায় ছিলেন অগ্রগণ্য। সন্ধানী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গল্প এবং কবিতা সংকলনের ভূমিকাংশ তার অনবদ্য গদ্যশৈলির আলোতে উদ্ভাসিত। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের সংকলন বের করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক।

মাহমুদ আল জামান নামে তার যখন ফিরছি মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক কবিতার একটি অংশ এরকম- যখন ফিরছি/ সরে যায় সমস্ত ঘরবাড়ি, আনন্দের/ পূর্ণতার ছবি/ যখন ফিরছি/ যখন ফিরছি।

কালি ও কলম প্রথম সংখ্যা থেকেই বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। মুদ্রণে পরিপাটি এবং এপার বাংলা-ওপার বাংলার লেখকদের একজায়গায় করে বিচিত্র লেখা প্রকাশ করায় এদেশের সাহিত্য জগতে পত্রিকাটি মননশীলতায় দীপ্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে বাৎসরিক গ্রাহক তৈরি করে পত্রিকাটির নির্দিষ্ট সংখ্যক বোদ্ধা পাঠক গোষ্ঠীও তৈরি হয়। আবার বেঙ্গল প্রকাশনীর মধ্য দিয়ে নান্দনিক মুদ্রণ ব্যবস্থাপনা এটিকে সুন্দর করে তোলে। ফলে দেশের প্রকাশনা জগতে অল্পদিনের মধ্যেই বেঙ্গল নাম করে।

গ্রন্থ প্রকাশনায় আবুল হাসনাত ছিলেন সামগ্রিক দায়িত্বের শীর্ষে। পাণ্ডুলিপি নির্বাচন করা থেকে শুরু করে যত্ন সহকারে লেখকের হাতে গ্রন্থ পৌঁছে দিয়ে তিনি নিজে তৃপ্তি পেতেন। এজন্য লেখকরা তার আন্তরিকতায় ছিলেন মুগ্ধ। আবুল হাসনাতের কালি ও কলমের আনিসুজ্জামান এবং বিদ্যাসাগর সংখ্যা সত্যিই সংরক্ষণে রাখার মতো প্রকাশনা।

আবুল হাসনাত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত গভীর অনুধ্যানী এক ঋষি। তিনি প্রাণিত করে গেছেন প্রগতিশীল সাহিত্যের আঙিনা। তিনি এদেশের সাহিত্য জগতের নোংরা দলাদলি পরিহার করে পরিচ্ছন্ন আস্তিনে রেখেছিলেন তারুণ্যের জয়কেতন। তার প্রয়াণ আমাদের বেদনাবিদ্ধ করবে আজীবন।

 

লেখক: লেখক, কবি, কলামিস্ট; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর