আবু ইউনুস মো. শহীদুন্নবী জুয়েল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। একাডেমিকভাবে আমার এক বছরের জুনিয়র। হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার সাথে দেখা হয়েছে বা চলতে গিয়ে গায়ে গা লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাইব্রেরি সায়েন্সে অনার্স-মাস্টার্স করে শিকড়ে মানে রংপুরে ফিরে গিয়েছিলেন জুয়েল। সেখানে একটি কলেজে শিক্ষক কাম লাইব্রেরিয়ানের চাকরি করতেন। তার সব স্বপ্ন ছিল স্কুলের লাইব্রেরিকে ঘিরে। লাইব্রেরিটি আরো সমৃদ্ধ করতে চাইতেন, চেষ্টা ছিল ই-লাইব্রেরিতে রূপান্তরের। জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়াটাই ছিল তার আরাধনা। কিন্তু টানা ২৪ বছর চাকরির পর গতবছর তাকে ছাটাই করা হয়। তারপর থেকে তিনি বেকার। টুকটাক নানা কিছু করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু করোনার কারণে সুবিধা করতে পারেননি। দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় হতাশা গ্রাস করে তাকে। মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধও খেতেন। ভারতীয় সেই ওষুধের খোঁজে মাসে একবার তাকে লালমনিরহাটের বুড়িমারী যেতে হতো। গিয়েছিলেন গত বৃহস্পতিবারও। কিন্তু আর ফিরে আসেননি। ধর্মোন্মদনার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন তিনি। কী ভয়ঙ্কর!
জুয়েলকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, এমন একাধিক ব্যক্তির সাথে আমার কথা হয়েছে। ফেসবুকে তার বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া পড়েছি। সাংবাদিকরা তার বাড়ি গিয়ে দেখেছেন। সব মিলে জুয়েল সম্পর্কে ধারণাটা হলো, তিনি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। সহজ, সরল ধার্মিক মানুষ। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। যেহেতু লাইব্রেরিয়ান ছিলেন, তাই বইয়ের সাথেই ছিল তার কারবার। দেশি-বিদেশি বই পড়তেন। বিশেষ করে কোরআন-হাদিস, ইসলামি বইয়ের প্রতি ছিল তার বিপুল আগ্রহ। জুয়েলের স্ত্রী জানিয়েছেন, প্রতিবছর তিনি একাধিকবার কোরাআন খতম দিতেন। এবার করোনাকালেও দিয়েছেন। আগামী বছর স্ত্রীকে নিয়ে হজে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। সাংবাদিকরা রংপুরে তার বাসায় গিয়ে দেখেছেন, সেখানে ইসলামি বইয়ের বিশাল সংগ্রহ, দেয়ালে দেয়ালে ইসলামি সংস্কৃতির নিদর্শন ঝোলানো। এমন একজন পরহেজগার মুসলমানকে পিটিয়ে এবং পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে এবং সেটা হয়েছে ইসলামের নামেই। কী দুর্ভাগ্যজনক!
কোনো ব্যবসা বা ভারতীয় ওষুধের খোঁজেই বুড়িমারী গিয়েছিলেন জুয়েল। আসর নামজের ওয়াক্ত হওয়ায় স্থানীয় মসজিদে যান নামাজ পড়তে। নামাজ শেষে পড়ার জন্য তাক থেকে কোরআন শরিফ নামাতে যান। সেখানে এক বা একাধিক কোরআন শরিফ নিচে পড়ে যায়। দ্রুত তিনি সেটা তুলে চুমু খেয়ে তাকে রাখেন। কিন্তু এ নিয়ে মসজিদের খাদেমের সাথে তার তর্ক হয়। তারপর দ্রুত ছড়িয়ে যায় গুজব- এক যুবক কোরআন শরিফ অবমাননা করেছে। জুয়েল এবং তার বন্ধুকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানেই গুজবের ওপর ভর করে উন্মত্ত জনতা জুয়েলকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তারপর মরদেহে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং সেই নৃশংসতা আবার ফেসবুকে লাইভ করা হয়। কী নিমর্মতা।
অথচ জুয়েলের বিরুদ্ধে কোরআন অবমমাননার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাহলে কে এই গুজব ছড়ালো? একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে পিটিয়ে-পুড়িয়ে মেরে ফেলা হলো এই দেশে। যদি জুয়েল ধর্মপ্রাণ নাও হতেন, যদি ভিন্নধর্মীও হতেন, যদি তিনি সত্যি সত্যি কোরাআন বা ধর্ম অবমাননা করতেনও; তাহলেও কি তাকে এভাবে পিটিয়ে-পুড়িয়ে মেরে ফেলা যায়? দেশে আইন-কানুন আছে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারোরই নেই। ফ্রান্সে মহানবীর কার্টুন করে ধর্ম অবমাননার সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ হয়েছে বাংলাদেশে। ডাক দেওয়া হয়েছে ফ্রান্সের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন ও পণ্য বয়কটের। বাংলাদেশে ফ্রান্সের পণ্য বয়কট করলো। কিন্তু ফ্রান্স যদি বাংলাদেশের পণ্য বয়কট করে এবং তার প্রভাব যদি অন্য ইউরোপিয়ান দেশেও পরে, বাংলাদেশের অর্থিনীতির যে ধস নামবে তা কি সামাল দেওয়া যাবে? যারা ফ্রান্স বয়কটের ডাক দিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, তারা কি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে পিটিয়ে-পুড়িয়ে মেরে ফেলার প্রতিবাদে রাস্তায় নামবেন? প্রতিবাদ করবেন?
ধর্ম মানুষকে নৈতিকতা শেখায়, শালীনতা শেখায়, শৃঙ্খলা শেখায়। কিন্তু আমরা ধর্মের ভালোটা না শিখে উগ্রতা আর নিষ্ঠুরতাকেই ধর্ম মনে করি। ধর্ম বুড়িমারীর সেই মানুষদের পুরো মানুষ বানাতে পারেনি, পশু বানিয়েছে। আমি ততটা ধার্মিক না হলেও আমার জন্ম সত্যিকার অর্থেই এক সম্ভ্রান্ত, মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে। আমার পূর্বপুরুষরা সৌদিআরব থেকে এ দেশে এসেছিলেন ধর্ম প্রচার করতে। গ্রামে আমাদের বাড়ির নাম মৌলভি বাড়ি। গ্রামের জামে মসজিদ, ঈদগাহ, কবরস্থান আমাদের বাড়িতেই। তাই ছেলেবেলা থেকেই ইসলাম ধর্মেরর সৌন্দর্যটা আমি কাছ থেকে দেখেছি। ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা ছিল আমাদের ঘরে, আমাদের বাড়িতে। সকালে মক্তবে যাওয়া, সুর করে কোরআন শরিফ পড়ে দিন শুরু করা, আজান হলেই মসজিদে যাওয়া ছিল প্রাত্যহিক চর্চা। দুই ঈদ, শবে কদর, শবে মেরাজ, শবে বরাত উদযাপন, রাত জেগে বার্ষিক মাহফিলে ওয়াজ শোনা- দারুণ উৎসবমুখরতায় কেটেছে আমাদের ছেলেবেলা। আমাদের নানাবাড়িও ছিল ধার্মিক। দুই পরিবার ধার্মিক হলেও কোনো গোঁড়ামি দেখিনি। তাই আমরা বেড়ে উঠেছি মুক্ত পরিবেশে। চিন্তা করতে শিখেছি স্বাধীনভাবে। আমাদের গ্রামে না থাকলেও নানাবাড়ি রঘুনাথপুরে অনেক হিন্দু পরিবার ছিল। পূজার ছুটিতে আমরা নানাবাড়ি চলে যেতাম। অংশ নিতাম পূজার উৎসবেও। আমাদের আনন্দ ডাবল হয়ে যেত। শীতকালে ওয়াজ শুনতে যেতাম যেমন, যাত্রাপালা হলেও যেতাম। আমাদের বাড়ি বা নানাবাড়ি এলাকার ধার্মিক মুসলমানদের দেখলে আপনাআপনি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসতো। শান্ত, সৌম্যকান্তি একেকজন সুফি মানুষ। কিন্তু ইসলামের নামে এখন দেশে দেশে যে নির্মমতা আর ছেলেবেলা থেকে দেখে আসা আমার ইসলামকে মেলাতে পারি না। ইসলাম শব্দের অর্থই শান্তি; ইসলাম শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম। এখন ধর্মের নামে যা হচ্ছে তা কোনোভাবেই ইসলাম নয়। এভাবেই কিছু উগ্রমানুষ শান্তির ধর্ম ইসলামকে সন্ত্রাসের সমার্থক করে তুলেছে। তারা ইসলামের ক্ষতি করছে, ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। ইসলামের স্বার্থেই এদের ঠেকাতে হবে।
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম কখনোই কোনো সন্ত্রাস বা জবরদস্তিকে সমর্থন করে না। কিন্তু কিছু মানুষ পান থেকে চুন খসলেই ধর্ম অবমাননার দোহাই দিয়ে জেহাদি জোশে রাস্তায় নেমে পড়ে। কথায় কথায় তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। ইসলামের মতো একটি ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের অনুভূতি এত ঠুনকো হবে কেন? ইসলাম নিয়ে কিছু লিখলেই গালি আর হুমকির বন্যা বয়ে যায়। কোনো কথার তারা পাল্টা যুক্তি দেয় না, গালি দেয়। তারা যে ভাষায় কথা বলে, যে ভঙ্গিতে, তা কখনো ইসলামসম্মত হতে পারে না।
প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরা আপনারা ইসলামের আসল সৌন্দর্যটা অনুধাবনের চেষ্টা করুন। আপনার অস্ত্র তো দূরের কথা, আপনার মুখের কথায়ও যেন কেউ আঘাত না পায়। আপনার কথায়-আচরণে যেন ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা না ছড়ায়। শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিন, ঘৃণা-বিদ্বেষ-নিষ্ঠুরতা নয়।
প্রভাষ আমিন: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ