বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যুদ্ধ নয়, আক্রান্ত হলে প্রস্তুতি থাকবে

  • মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.), রাজনৈতিক বিশ্লেষক   
  • ২৯ অক্টোবর, ২০২০ ২০:৫১

শেখ হাসিনা নিজ সাধনায় ও যোগ্যতায় প্রধানমন্ত্রীর স্থানকে অতিক্রম করে এখন বিশ্বের অন্যতম রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছেন। ঠিক একই সঙ্গে বাংলাদেশকে তিনি এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছেন, যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বের সব আলো আর দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের ওপর।

আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধ চাই না। তবে কখনো যদি আক্রান্ত হই, তা মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চাই। কথাগুলো বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পটুয়াখালী শেখ হাসিনা সেনানিবাসে তিনটি ব্রিগ্রেড ও পাঁচটি ইউনিটের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে ২৮ অক্টোবর বুধবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

শেখ হাসিনা নিজ সাধনায় ও যোগ্যতায় প্রধানমন্ত্রীর স্থানকে অতিক্রম করে এখন বিশ্বের অন্যতম রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছেন। ঠিক একই সঙ্গে বাংলাদেশকে তিনি এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছেন, যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বের সব আলো আর দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের ওপর। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তি বলয়ের চরম দ্বন্দ্ব- প্রতিযোগিতার বাস্তবতা ও সন্ধিক্ষণে আজ সব শক্তিকে তিনি যেভাবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সঙ্গী করে রেখেছেন তা এক কথায় অভাবনীয়।

কিন্তু সব সময় এক রকম যাবে ইতিহাস সে কথা বলে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত নীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। বাংলাদেশ এ নীতিতে অটল আছে, থাকবে এবং থাকতে হবে, যে কথা প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন।

আমরা কারো বিরুদ্ধে যাব না, আবার কারো সামরিক জোটের সঙ্গীও হব না। কিন্তু কৃত্রিম অজুহাত অথবা পরোক্ষভাবে কোনো সংকট সৃষ্টি করে কেউ যেন আমাদের চাপ দিতে বা টলাতে না পারে এবং জাতীয় স্বার্থের প্রতি সব হুমকির বিরুদ্ধে শক্তিশালী ডেটারেন্স বা প্রতিরোধক শক্তি তৈরি করা আজ বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠেছে। প্রকারান্তরে সে কথাই প্রধানমন্ত্রী বুধবার বলেছেন যে, কখনো যদি আক্রান্ত হই, তা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চাই।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তার দূরদৃষ্টির দ্বারা ঠিকই বুঝেছিলেন অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের সব শক্তির জন্য একটা আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হবে। অনেক উত্থান-পতন এবং চড়াই উতরাই পেরিয়ে শেখ হাসিনার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর সেই কথা আজ সত্য হয়েছে।

বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের মানুষের দেশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেভাবে ঘটছে তা অব্যাহত থাকলে বিশাল মধ্যবৃত্ত শ্রেণি তৈরি হবে, যাদের সম্মিলিত ক্রয় ক্ষমতা এত বড় হবে যে, বিশ্বের তাবত বড় বড় কর্পোরেট হাউস এই বিশাল বাজার দখলের জন্য বাংলাদেশকে ঘিরে প্রতিযোগিতায় নামবে, যার লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে।

তারপর বিশ্বের সব অঞ্চল যেখানে সমুদ্র সম্পদের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় সীমানা নিয়ে ক্রমশই দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে, সেখানে ভারত-মিয়ানমারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সীমানা সমস্যার মীমাংসা করতে পারায় বহুমুখী সম্ভাবনাময় বিশাল সমুদ্র সম্পদের নিষ্কণ্টক মালিক হয়েছে বাংলাদেশ। সুতরাং বিশ্ব শক্তি বলয় ও কর্পোরেট হাউজের দৃষ্টি বাংলাদেশের ওপর পড়ার এটি একটি অতিরিক্ত কারণ। তাই স্বার্থ  ও সম্পদের প্রতিরক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং সক্ষমতা ও শক্তি বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব বুঝেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বহু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের সময় গড়ে ওঠা সশস্ত্র বাহিনীকে পুনর্গঠন করেন। ১৯৭৪ সালে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করেন। প্রতিষ্ঠা করেন সেনাবাহিনীর মর্যাদার প্রতীক বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি। সে সময়ের অত্যাধুনিক মিগ-২১ যুদ্ধবিমান এবং সেনাবাহিনীর ট্যাংক ও আর্টিলারি কামান আনেন। নৌ-বাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করেন।

বঙ্গবন্ধুর পরিবার সেনাবাহিনীর সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। শেখ জামাল স্বাধীনতার পর প্রথম ব্যাচের সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত স্যান্ডার্স মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার হন। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশিক্ষণ নিয়ে অফিসার হন এবং যুদ্ধে যোগদান করেন।

প্রধানমন্ত্রী বুধবার বলেছেন শেখ রাসেলের স্বপ্ন ছিল সে সামরিক অফিসার হবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সবকিছু তছনছ হয়ে যায়। দুই সামরিক শাসক ও তাদের প্রতিভূরা সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি করেছে, কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়নে তেমন কিছুই করেনি।

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সশস্ত্র বাহিনীর সার্বিক কলেবর বৃদ্ধি, সঠিক  সক্ষমতা অর্জন ও আধুনিকায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেন। কয়েকটি নতুন পদাতিক ডিভিশন, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেকগুলো বিগ্রেড, ইউনিট গঠন এবং সেনাবাহিনীর সব শাখাকে শক্তিশালী করা হয় যাতে সার্বিক সক্ষমতার জায়গায় কোনো ঘাটতি না থাকে। আধুনিক ট্যাংক, সব ধরনের নতুন নতুন আর্টিলারি কামান, মিসাইল, স্যাটেলাইট যোগযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুই এখন সেনাবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে। সেনাবাহিনী রয়েছে নিজস্ব স্বয়ং সম্পূর্ণ এয়ার রেজিমেন্ট বা বিমান শাখা। বেশ কয়েকটি নতুন সেনানিবাস হয়েছে। নৌ-বাহিনী এখন জল, স্থল আকাশ, ত্রিমাত্রিক বাহিনীর রূপ নিয়েছে।

নৌ-বাহিনীর ঘাঁটি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণসহ যোগ হয়েছে সাব-মেরিন। বিমান বাহিনীতে আধুনিক যুদ্ধ বিমান, অত্যাধুনিক রাডার, পরিবহন বিমান এবং বহু মাত্রিক হেলিকপ্টার সংযোজিত হয়েছে। ঘাঁটির সংখ্যা বৃদ্ধিসহ সার্বিক কাঠামোগত পরিবৃদ্ধি ঘটেছে।

তিন বাহিনীর জন্য সব ধরনের আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং অফিসারদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মনন, মেধা ও প্রজ্ঞার সম্প্রসারণের জন্য রয়েছে নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনিস্টিটিউটসহ ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ।

শান্তি ও যুদ্ধাকালীন মেডিকেল সাপোর্ট নিশ্চিতকল্পে স্থাপন করা হয়েছে নিজস্ব মেডিকেল কলেজ ও আধুনিক হাসপাতাল। ঢাকার অদূরে পিস, সাপোর্ট ট্রেনিং সেন্টার এখন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র, যেখানে আমেরিকাসহ সব বন্ধু দেশের সেনা সদস্যরা প্রশিক্ষণের জন্য আসেন। আধুনিকতায় বিশ্বের সঙ্গে তাল যাতে রক্ষা হয় সে রকম করেই সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে। আর এর প্রয়োজনও রয়েছে।

জাতিসংঘসহ বিশ্বের নেতারা আজ মুখে শান্তির কথা বললেও সব দেশই পাল্লা দিয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামাদির ব্যবসা ও প্রতিযোগতা গত ১০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বড় শক্তিগুলো পাল্লা দিয়ে বানাচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্র। অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও সামরিক শক্তির মাসল প্রদর্শন এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির খেলায়  বাংলাদেশ আজ সম্মুখ সারির রাষ্ট্র।

আমাদের চারিদিকের সব দেশই সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। বাংলাদেশের লাইফ লাইন বঙ্গোপসাগর এবং তার লিংকেজ ভারত মহাসাগর আজ সামরিক দ্বন্দ্ব-প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের এই অঞ্চল ঘিরে বৃহৎ শক্তির চরম বিভাজন ও মেরুকরণ আজ স্পষ্ট। আর শেষ কোথায় তা কেউ বলতে পারছে না। তারপর চরম ডানপন্থি মতাদর্শের রাজনীতি সর্বত্র যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তাতে শান্তির আশা কখন যে নিরাশায় পরিণত হয় তার কিছুই বলা যায় না। তারপর মরার ওপর খাড়ার  ঘাঁয়ের মতো রোহিঙ্গা সংকট আমাদের ওপর যেভাবে চাপে বসেছে তা নিয়ে আশঙ্কার কোনো শেষ নেই।

আমরা শান্তি চাই, যুদ্ধ চাই না, প্রধানমন্ত্রী এ কথা জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু বিশ্ব ও আঞ্চলিক শান্তি আজ অনিশ্চিত। আমরা অশান্তি চাই না। কিন্তু কেউ নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আমাদের ওপর অশান্তি চাপিয়ে দিতে চাইলে তা প্রতিহত করার সক্ষমতা আমাদের অবশ্যই থাকতে হবে। সে লক্ষ্যেই সশস্ত্র বাহিনীর অগ্রায়ণ হচ্ছে। আর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অতিরিক্ত শক্তি হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনাশক্তি আমাদের বিশাল সম্পদ।

বাস্তবতার নিরিখেই বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী তার আধুনিকায়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে সেটাই প্রত্যাশিত। কারণ যুদ্ধ নয়, কিন্তু আক্রান্ত হলে তার জন্য প্রস্তুতি অবশ্যই থাকতে হবে।

লেখক: গবেষক এবং রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর