ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিম। তিনি শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পৌর এলাকার মন্ত্রণাসভার সদস্যই নন, তিনি বহুল আলোচিত ও সমালোচিত সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের পুত্রধন এবং তার শ্বশুরমশাইও একজন সাংসদ। তাহলে ইরফান সেলিম একজন পুচকে জনপ্রতিনিধি নন শুধু, ধারে ও ভারে এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে তিনি প্রবল ক্ষমতাধর একজন ব্যক্তি। তার ক্ষমতার ধার ও ভার আমরা টের পাই, যখন র্যাব তার বাসায় অভিযান পরিচালনা করে ৩৮টি ওয়াকিটকি, অবৈধ অস্ত্র ও মদ এবং নির্যাতন কেন্দ্রের সন্ধান পায়। আমরা ‘আম জনতা’ অবাক হয়ে ভাবতে থাকি, যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এত ক্ষমতাধর একজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে দণ্ড দিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারে কারগারে; সেই বাহিনীর কাছে বাপ-বেটার ‘লাঠিয়াল বাহিনী’, তাদের ব্যবহৃত ওয়াকিটকি এবং নির্যাতন কেন্দ্রের হদিস মাসের পর মাস কী করে বেখবর থাকে?
কী এক আজব দেশে বাস করছি আমরা! সাহেদ গ্রেফতার হওয়ার পরে জানা যায় যে, তিনি একটি বড় রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং এই পরিচয়কে পুঁজি করে তিনি প্রতারণাকে শিল্পে পরিণত করেছিলেন। পাপিয়া গ্রেফতার হওয়ার পরে জানা যায় যে এই অভিজাত ‘মক্ষিরাণী’ পাঁচতারা হোটেলে ঘাঁটি গেড়ে ব্যবসায়ী-রাজনীতিক ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করতেন এবং তিনিও ছিলেন বড় রাজনৈতিক দলের মহিলা দলের সদস্য। সম্রাট ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা গ্রেফতার হওয়ার পরে বেরিয়ে আসে যে, পুলিশের নাকের ডগায় বছরের পর বছর চলছিল হাজার হাজার কোটি টাকার ক্যাসিনো বাণিজ্য।
যে ঘটনা উপলক্ষে এ লেখার অবতারণা সেটির সংক্ষিপ্ত বয়ান হচ্ছে- বিদেশি মদ ও অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার দায়ে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের ছেলে ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরে, তাকে কাউন্সিলর পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
সোমবার (২৬ অক্টোবর) দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজি সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ওই দুজনকে গ্রেফতারের পর এই দণ্ড দেওয়া হয়। সোমবার সন্ধ্যায় র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের এই দণ্ডের পাশাপাশি দুজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা করা হবে। এর আগে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, রাজধানীর সোয়ারিঘাটের দেবদাস লেনে হাজি সেলিমের সাদা রঙের নয়তলা ওই ভবন থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, গুলি, একটি এয়ারগান, ৩৮টি ওয়াকিটকি, একটি হাতকড়া এবং বিদেশি মদ ও বিয়ার পাওয়া যায়। এরপর মঙ্গলবার (২৭ অক্টোবর) ইরফান ও তার সহযোগী জাহিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে ৪টি মামলা দায়ের করে র্যাব।
ঘটনার হেতু এবং প্রেক্ষিত সম্পর্কে পত্রিকায় ছাপা খবর থেকে আরও জানা গেছে যে, গত রোববার (২৫ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ মিনিটে রাজধানীর মিরপুর সড়কের কলাবাগান ক্রসিংয়ের কাছে মারধরের শিকার হন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খান। তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয় সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো হাজি সেলিমের সরকারি গাড়ি। এরপর গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমে ওই কর্মকর্তাকে মারধর করেন। এ ঘটনায় সোমবার সকাল পৌনে আটটার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি থানার একটি মামলা হয়। হাজি সেলিমের ছেলে ইরফানসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে মামলাটি করেন মারধরের শিকার নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ।
২৫ অক্টোব রাত প্রায় ৮টা থেকে ২৬ অক্টোব সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে নানা দৃশ্যপটের মধ্য দিয়ে যে জমজমাট ঘটনাপ্রবাহের সংস্থান হলো, তার প্রেক্ষিতে নিচের কয়েকটি মন্তব্য করা যেতে পারে এবং কিছু আপাত-উপসংহার টানা যেতে পারে–
এক. অগাধ সম্পদের মালিক না হলে সংসদ সদস্য পদে বড় দলের মনোনয়ন পাওয়া যায় না এবং সংসদ সদস্য হওয়ার পরে অনেকে জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকেন। আইন প্রণেতা হিসেবে তাদের যে মূল কাজ সেটি তারা বোঝেনও না, তার ধারও ধারেন না। বৈধ কিছু আয়ের উৎসের পাশাপাশি তাদের অধিকাংশ আয়ের উৎস হচ্ছে অবৈধ। হাজি সেলিম ও তার ছেলের মাস্তানির জের ধরে র্যািবের অভিযানের সুবাদে যেটুকু জানা গেল, শুধুমাত্র তার ভিত্তিতে নয়, সংসদ সদস্যদের কর্মকাণ্ড নিয়ে হামেশা যেসব খবর পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয়, তার ভিত্তিতেই সন্দহাতীতভাবে কয়েক ডজন সংসদ সদস্য সম্পর্কে এমন মন্তব্য করা চলে।
দুই. এমন একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে আরেকজনের মোটরযানে ধাক্কা দেওয়ার কারণে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মোবাইলকোর্ট বসিয়ে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো কারাগারে! এ ধরণের মাস্তানির ঘটনা আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে তো হামেশাই ঘটছে। আর যারা ক্ষমতাবান, রাজনীতিকভাবে, প্রশাসনিকভাবে, বাহিনীগতভাবে অথবা পেশাগতভাবে, তারা তো প্রতিনিয়ত এ ধরণের ঘটনা ঘটাচ্ছেন। এর কয়টা ঘটনার প্রতিকার হচ্ছে? তাহলে কি যাকে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে, তিনি নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট বলে এত ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো?
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, এ প্রশ্নটি সাংবাদিক, শিক্ষক, উকিল, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সুশীল সমাজসহ সচেতন প্রত্যেকটি মানুষের মনে উদয় হয়েছে। শুধু মোটরযানে ধাক্কা ও মারধর নয়, আরও কিছু অপরাধ করলেও ইরফান সেলিমের কিছু হতো না। হয়তো ভুক্তভোগী ব্যক্তি মামলাই করতে যেতেন না অথবা মামলা করতে গেলে পুলিশ সেটি নিত না। কিন্তু ভুক্তভোগী ব্যক্তি যেহেতু একটি বাহিনীর কর্মকর্তা, সেজন্যে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ইরফান সেলিমকে কারাগারে যেতে হলো। এটাকে কি আইনের শাসন বলা যাবে? আর মানুষ কেনই বা এটাকে আইনের শাসন বলে মানবে?
আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই যে, নৌবাহিনীর একজন সম্মানিত কর্মকর্তা যেভাবে ইরফান সেলিমের সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন, সেটি সুস্পষ্ট অপরাধ। নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদের যেমন ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে, তেমনি সরকারেরও দায়িত্ব হচ্ছে সন্ত্রাসী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া, এবং সেই কাজটি করে সরকার যথার্থ কাজটিই করেছে। এখানে আপত্তির জায়গাটি হচ্ছে, একদিকে প্রভাবশালীদের অনেক অপরাধের কোনো বিচার না হওয়া এবং সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত যে নিগ্রহ, হেনস্তা ও সন্ত্রাসের শিকার হন, সেই ব্যাপারে প্রায় প্রতিকারহীন নীরবতা। অন্যদিকে, বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অতি ত্বরিৎ বিচার- দুটোই আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তিন. ইরফান সেলিম ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন এবং অপরাধ করেছেন। সেজন্যে শুধু শাস্তি নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তার প্রাপ্য। কিন্তু বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আইনের বেশ কিছু প্রক্রিয়াগত বিষয়ের ব্যত্যয় হয়েছে বলে প্রতীয়মান হলো। প্রথমত, যে ভ্রাম্যমাণ আদালত এই কারাদণ্ড দিয়েছে, সেটি যে আইন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত, সেটি একটি দুর্বল আইন। ২০১৭ সালের মে মাসে হাইকোর্ট ২০০৯ সালের মোবাইলকোর্ট আইনের ১১টি ধারাকে অসাংবিধানিক ও অবৈধ বলে রায় প্রদান করেন। হাইকোর্ট মাসদার হোসেন মামলার উল্লেখ করে ২০০৯ সালের আইনটিকে বাতিল করেছিলেন। পরে সরকারের আপিলের প্রেক্ষিতে ওই রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের পরিচালনায় এখনও ভ্রাম্যমাণ আদালত চলছে। কিন্তু আইনের একজন ছাত্র হিসেবে এটুকু জানি যে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্বারা পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত সংবিধানের মৌল কাঠামো নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আইনে ইরফান সেলিমকে কারাগারে পাঠানো ভালো দৃষ্টান্ত হয়নি। আর ইরফান সেলিমকে আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগও দেওয়া হয়নি বলে আমার আশঙ্কা। ইরফান সেলিম যত বড় দুর্বৃত্তই হোক না কেন, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া না হলে চূড়ান্ত বিচারে ওই দণ্ড টিকবে না।
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন: অপরাধবিজ্ঞান এবং সাংবিধানিক ও মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক