বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

একজন সাকিব আল হাসান

  • এম.এম কায়সার   
  • ২৯ অক্টোবর, ২০২০ ১০:২৮

২০০৬ সালের আগষ্টে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে পা রাখা সাকিবের ক্রিকেট ক্যারিয়ার ২০২০ এর ২৯ অক্টোবর থেকে আরেকটি নতুন টাইম লাইন পাচ্ছে; নিষেধাজ্ঞার আগের সাকিব এবং নিষেধাজ্ঞার পরের সাকিব!

খ্রিষ্টপূর্ব: যীশু খ্রিষ্টের জন্মের আগের সময়। খ্রিষ্টাব্দ: যীশু খ্রিষ্টের জন্মের পরের সময়।

ক্রিশ্চিয়ান ক্যালেন্ডারে সময়ের হিসেব এভাবেই করা হয়। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস এবং পর্যালোচনা পর্বকে আপনি অনায়াসেই ‘সাকিবপূর্ব’ এবং ‘সাকিবীয়’ এই দুইভাগে ভাগ করতে পারেন। সাকিব খেললে তো বটেই এমনকি বছরখানেক নিষিদ্ধ থাকাকালেও যে হরদমই শিরোনামে!

দেশের ক্রিকেটে ব্যক্তিগত অর্জন, সাফল্য, স্বীকৃতি, মর্যাদা তুল্যমুল্যের হিসেবের রেখচিত্র আঁকতে; কিংম্বা বিতর্ক, নিষেধাজ্ঞা, শাস্তি কাটিয়ে প্রত্যাবর্তনের তৈলচিত্র বা জলরং এর বড় অংশ জুড়েই থাকবে একটা নাম, সাকিব আল হাসান!

আনন্দের শীর্ষে সাকিব। বিতর্কেও তাই!মাঠে তো বটেই, মাঠের বাইরের বড় অংশ জুড়েও তার ক্রিকেটীয় প্রভাব এমনই যে সাকিবকে হিসেবের বাইরে রেখে আপনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের কোন অংশই সাজাতে পারবেন না। বেড়ে উঠা, নিজেকে নিজের মতো গড়ে তোলার ক্রিকেটীয় এই পথে সাকিব কখনো সখনো সমস্যা, সঙ্কট নিজেই তৈরি করেছেন। হেঁয়ালির খেয়ালে ভেসেছেন। নিজের ইচ্ছে, আনন্দকে সঙ্গী করে সামনে বেড়েছেন। নিজেকে তৈরির তার এই আনন্দময় পথচলার নিজস্ব সিলেবাস, চিরায়িত এবং প্রথাগত অনেক রুটিন ভেঙ্গেচুরে একাকার করেছে বলেই হয়তো বা রক্ষণশীলতার পাহারাদাররা শালিসী বসিয়েছে; দরজায় তুলেছে খিল! কিন্তু নিজের খেলা প্রথম বলেই ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা হাঁকানোর দাপুটে সাহস যে রাখে তার স্বপ্ন-সীমানাকে মামুলি চৌকাঠে আঁটকে রাখার সাধ্য কি আছে কারো?যে জিততে জানে সে সব পরিস্থিতিতেই জিততে পারে। সাকিব আল হাসান ঠিক তেমনই এক ক্রিকেটার। ২০২০ এর ২৯ অক্টোবর সাকিবের ক্রিকেট ক্যালেন্ডারে তেমনই এক জয়ের দিন।

আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় পেছনের এক বছর সব ধরনের ক্রিকেটে নিষিদ্ধ ছিলেন। সাকিব ভুল করেছিলেন। ক্রিকেট জুয়াড়ি তাকে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছে সেই তথ্য সাকিব যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাননি। আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের বিধি বিধান অনুযায়ী এটি বড় ভুল। আইসিসি সেই ভুলের বিচার করেছে এবং শাস্তি দিয়েছে। গেল বছর ২৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় সাকিবের এই শাস্তি শোনার পর তার ভক্ত-সমর্থকদের একাংশ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিস্কারে নেয়ে উঠেন। শ্লোগান,মিছিল,প্ল্যাকার্ড জমায়েত এবং ফেসবুকে রাতারাতি ‘বিপ্লবী বাহিনী’ গঠনও হয়ে গেল। তবে সাকিব জানতেন এসবের কোনোটাই তাকে ‘ম্যাচ’জেতাবে না। এবারও নিজে একাই লড়লেন। একটু দেরিতে হলেও জিতলেন ঠিকই।

সৃষ্ঠ সমস্যা এবং শাস্তির কারণ সাকিব নিজেই। তাই সমাধানের পথও নিজেই খুঁজে বের করার চেষ্টায় নামলেন। নিষেধাজ্ঞার ৩৬৫ দিনের প্রতিদিনকে সেশন বাই সেশন খেলে জেতার লড়াইয়ে নামলেন। এই পুরোটা সময় লড়লেন ‘ওয়ানম্যান আর্মির’ সেই পুরানো সূত্র মেনে। ২৯ অক্টোবর, ২০২০ সাকিবের সেই লড়াই জেতার দিন।

২০১৯ এর ২৯ অক্টোবর এবং ২০২০ এর ২৯ অক্টোবরের মধ্যে কতই না পার্থক্য! বছর আগে এদিন কষ্টের কান্নায়, বিষন্নতায় মুষড়ে পড়া সাকিবকে দেখেছিলাম বিসিবির বারান্দায়। সামনে একগাদা ক্যামেরা, ফ্লাশলাইটের উজ্জ্বলতা। কিন্তু সেই রাতে সাকিবের দুই চোখে কি ভীষণ শূন্যতা! আমি নিশ্চিত ২০২০ এর ২৯ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে নতুন ইনিংস শুরুর দিনে সাকিব হো হো করে হাসবেন না। সেঞ্চুরির পর আলতো অবহেলায় ব্যাট উঁচিয়ে তোলার মতো করে এদিন শুধু নতুন করে শপথ নেবেন, ‘নতুন ইনিংসটা বড় করতে হবে। নিরাপদ ক্রিকেট খেলতে হবে!’

পরিণতি তৈরি করে পরিমিতিবোধ।নিষেধাজ্ঞা, শাস্তিতে অনেকে মুষড়ে পড়েন। হতাশায় আরও পিছিয়ে পড়েন। কিন্তু সাকিব এখানেও বাকিদের চেয়ে ব্যতিক্রম। তাই তো গেল বছরের অক্টোবরের শেষে নিষেধাজ্ঞার শাস্তি শোনা সাকিব নতুন বছরের জানুয়ারিতেই বলতে পারেন,‘২২ গজই আমার ঠিকানা। কঠিন সময় যাচ্ছে। কিন্তু ফিরব আরও কঠিন হয়ে। চেষ্টা করে চলেছি রাতদিন, অবিরাম। লাল-সবুজের হয়ে মাঠে ফিরতে। আর এই কদিন এগারো জনের দলে না থাকলেও আছি টাইগারদের সাথেই, সবচেয়ে বড় ফ্যান হয়ে। মনে একটাই শ্লোগান- খেলবে টাইগার, জিতবে টাইগার। সাথে আছেন তো?’

অবশ্যই আছে!

সাকিবের সঙ্গেই তো ছিল পুরো বাংলাদেশ। আছে এবং থাকবেও। আর তাই তো তার নিষেধাজ্ঞার সময়েও ক্রিকেটামোদী থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) তার ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অক্টোবর-নভেম্বরের শ্রীলঙ্কা সফরের নিশ্চয়তা তখনো মিলেনি। কিন্তু বিসিবি ঠিকই জানিয়ে দেয়, সাকিব ফিরছেন সেই সিরিজেই। পারফরমেন্স এবং প্রভাব, এই দুইয়ের কল্যানে সাকিব এমনই এক ক্রিকেটার যে তার নামটাই খেলোয়াড় তালিকায় আগে লিখে একাদশ গঠন হয়। একাদশে সাকিবের না থাকা মানেই দলের ক্রিকেটীয় ভারসাম্য বা সমতায় বড় ধরনের হেলদোল হওয়া।

সাকিববিহীন পেছনের একবছরে বাংলাদেশ একমাত্র জিম্বাবুয়ে ছাড়া আর কোন দলের বিরুদ্ধে তেমন ‘শক্তি’ দেখাতেই পারেনি। ভারত ও পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের চরম বাজে সময় কাটে। ভারতে একটি টি- টোয়েন্টি ম্যাচ জেতা ছাড়া আর কোন সুখস্মৃতি নেই। সাকিবের অনুপস্থিতিতে টেস্ট দলের অধিনায়ক হিসেবে মুমিনুল হক দায়িত্ব পান। অধিনায়ক হিসেবে মাঠে এবং মাঠের বাইরের পারফরম্যান্সে মুমিনুল এমনকিছুই করে দেখাতে পারেননি যে তাকে নিয়ে বিসিবি সামনের দিনে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। তাই বলাবলি হচ্ছে সাকিব ফিরলে টেস্ট দলের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড নিয়েই ফিরবেন। কোচ রাসেল ডমিঙ্গো ঘোষণাই দিয়েছেন,‘সাকিব তো সবসময়ের নেতা!’

গেল বছরের ২৯ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞার পরপরই হিসেবটা শুরু হয়ে যায়, এই নিষেধাজ্ঞায় সবমিলিয়ে সাকিব কতগুলো ম্যাচ মিস করবেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দেশে এবং বিদেশে ক্রিকেট সিরিজের হিসেব মিলিয়ে জানা গেল এই সময়ের মধ্যে সাকিব অন্তত ৩৬টি আর্ন্তজাতিক ম্যাচ মিস করবেন। এশিয়া কাপে খেলতে পারবেন না। অস্ট্রেলিয়ায় টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শুরু থেকেও থাকতে পারবেন না।

তবে সাকিবের নিষেধাজ্ঞার বছরের বেশিরভাগ সময় যে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটও যে বাধ্য হয়েই ‘স্থগিত’রইল! করোনাভাইরাস মহামারিতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে বাংলাদেশ আর কোনো আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট ম্যাচই খেললো না। এমনকি নভেম্বরে শ্রীলঙ্কার মাটিতে যে সিরিজে সাকিবের ফেরার কথা ছিল সেই সিরিজও স্থগিত হয়ে গেল কোয়েরাইন্টাইনের ঝামেলায়! এশিয়া কাপও পিছিয়ে গেল বছরখানেক। অক্টোবর-নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ায় টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপও স্থগিত। যা পরিস্থিতি তাতে চলতি বছর বাংলাদেশের কোন আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের সূচিই নেই।সাকিব তাহলে তার নিষেধাজ্ঞার এক বছরে খুব বেশি ম্যাচ মিস করেননি। টেস্ট ম্যাচ মিস করেছেন ৪টি। ওয়ানডে ম্যাচ তিনটি এবং টি- টোয়েন্টি সাতটি। সবমিলিয়ে ১৪টি আর্ন্তজাতিক ম্যাচ। অথচ পূর্বসূচি অনুযায়ী ম্যাচগুলো হলে অন্তত ৩৬টি আর্ন্তজাতিক ম্যাচ মিস করতেন সাকিব আল হাসান।

সাকিবের নিষেধাজ্ঞার বছরে করোনাভাইরাস যে পুরো দুনিয়ায় ক্রিকেটই ‘স্থগিত’ করে দিল। নিষেধাজ্ঞার পরপরই যাতে মাঠে ফেরা যায়, সেই প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন সাকিব। এপ্রিলের শুরু থেকে সাকিব নিউইয়র্কে পরিবারের কাছে ফিরে যান। ক্রিকেটে নিষেধাজ্ঞার এই সময়টায় সাকিব দ্বিতীয় সন্তানের বাবা হলেন। দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে নিউ ইয়র্কেই সময় কাটে তার। সেপ্টেম্বরের শুরুতে সাকিব একা দেশে ফেরেন। ক্রিকেটে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় ফিটনেস ফিরে পাওয়ার পরিকল্পনা নেন। ফিটনেস চর্চা এবং ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য নিজের বাল্যকালের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপিকে বেছে নিলেন। দুই ক্রিকেট মেন্টর নাজমুল আবেদিন ফাহিম ও মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের অধীনে একেবারে ক্লোজড ডোর অনুশীলন চালিয়ে যান। কিন্তু নভেম্বরের শ্রীলঙ্কার মাটিতে টেস্ট সিরিজ যে স্থগিত হয়ে গেল। সাকিবও তার পরিকল্পনায় বদল আনলেন। নিউইয়র্কে পরিবারের কাছে ফিরে গেলেন।আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট না থাকায় বিসিবি এখন পরিকল্পনা নিয়েছে করোনাকালের এই সময়টায় মধ্য নভেম্বরে সীমিত আকারে ঘরোয়া ক্রিকেট আয়োজনের। বিসিবি এবং নির্বাচকদের ঘরোয়া ক্রিকেটের সেই পরিকল্পনায় সাকিব আল হাসানের নামও আছে। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হোসেন পাপন ঘোষণাও দিয়ে ফেলেছেন, সাকিব খেলবেন নভেম্বরের টি-টোয়েন্টির এই ঘরোয়া টুর্নামেন্টে।২০০৬ সালের আগষ্টে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে পা রাখা সাকিবের ক্রিকেট ক্যারিয়ার ২০২০ এর ২৯ অক্টোবর থেকে আরেকটি নতুন টাইম লাইন পাচ্ছে; নিষেধাজ্ঞার আগের সাকিব এবং নিষেধাজ্ঞার পরের সাকিব!

দেখি, কে বেশি স্কোর করতে পারে, আগের সাকিব নাকি পরের সময়ের সাকিব?

এম. এম. কায়সার: ক্রীড়া সম্পাদক, বার্তা২৪

এ বিভাগের আরো খবর