ভিকটিম ব্লেইমিং একটি পুরানো কায়দা যার বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে মানুষের বিবেক। নারীকে কেন্দ্র করে কোনো ঘটনা ঘটলেই সকল আলোচনাকে ছাপিয়ে সামনে চলে আসে সেই নারীর চরিত্রের বিশ্লেষণ। নারী নির্যাতনের ইস্যুতে সবার আগে প্রশ্ন আসে, কেন নারীটি নির্যাতিত হলো? কী সমস্যা ছিল নারীটির? আলোচনায় আসে না নারীকে যারা নির্যাতন করে তারা কারা। কী তাদের পরিচয় বা কোন মানসিকতা থেকে তারা নারীনির্যাতন ঘটায়? যেকোনো অপরাধেরই শাস্তির দাবিটি থাকা উচিত সবার আগে, অথচ ঘুরেফিরে আলোচনা চলে যায় ভিন্ন খাতে।
সম্প্রতি দেশব্যাপী চলতে থাকা নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনায় যখন সাধারণ নাগরিকের উদ্বেগ বেড়েই চলেছে, তখন আমাদের বাংলা সিনেমা জগতের একজন প্রথম সারির নায়ক অনন্ত জলিলসহ অনেকেই হাজির হয়েছেন অদ্ভুত সব তত্ত্ব নিয়ে। যদিও সমালোচনার মুখে অনন্ত জলিল ক্ষমা প্রার্থনা করে বক্তব্যের কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন, কিন্তু মগজের মধ্যে ঢুকে থাকা পুরুষতান্ত্রিক যে চিন্তা, তা থেকে তিনি আদৌ মুক্ত হয়েছেন কি?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস যিনি ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করেন তিনি কোনোভাবেই একজন সচেতন মানুষ নন। তাদের কাছে ধর্ষণের কোনো পরিসংখ্যান আছে বলে মনে হয় না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে মোট ৮৮৯ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর মধ্যে মোট ৬৮ জনের বয়স ছয় বছরের নিচে। আরেকটি সংবাদ বলছে ৭৮ বছরের একজন বৃদ্ধা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই ৬৮ শিশুকে ধর্ষণের কারণ কী বলে মনে করেন?
কুমিল্লার তনু ধর্ষণ ও হত্যা, ফেনীর নুসরাত হত্যার ঘটনা কি অনন্ত জলিলরা জানেন? তনু একজন হিজাব পরিহিত ছাত্রী ছিলেন। নুসরাত মাদ্রাসায় পড়তেন, যেখানে শরীর আবৃত পোশাকের বাইরে অন্য পোশাক পরা যায় না বা নুসরাত পরতেন বলে জানা যায়নি। সম্প্রতি নির্যাতনের শিকার বেগমগঞ্জের সেই গৃহবধূর পোশাকের কোনো সমস্যার কথাও জানা যায়নি।
মাদ্রাসাগুলোতে যে ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে সেখানে কোন পোশাকের সমস্যা? একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ধর্মীয় শিক্ষক যখন তার সন্তানসম শিশুকে ধর্ষণ করেন, তখন তার মগজে কী কাজ করে সেটি কি ভেবেছেন কখনও? যে মাদ্রাসার শিক্ষকটি দিনের পর দিন শিশুদের ধর্ষণ করে যাচ্ছেন ধর্মের ভয় দেখিয়ে, সেখানে পোশাকের কোন সমস্যা দেখছেন আপনারা? কেন একজন পুরুষ শিক্ষক একজন ছেলে শিশুকে ধর্ষণ করছেন? আছে কোনো যৌক্তিক জবাব আপনাদের কাছে?
জানি, নেই। তাহলে ধর্ষণের জন্য কেন কেবল নারীর পোশাককেই দায়ী করছেন আপনি বা আপনারা? আপনাদের বক্তব্যের সাথে আমাদের সমাজের পিছিয়ে পড়া ধর্মান্ধ, কুশিক্ষিত মানুষের মিল পাওয়া যাচ্ছে। ধর্মীয় মৌলবাদের ধারক বাহকেরা নারীকে আক্রমণের বিষয় হিসাবে বেছে নেয় নারীর পোশাককে। ওয়েস্টার্ন পোশাকের মধ্যে আপনি কেন সমস্যা দেখছেন? যদি সত্যি পোশাক সমস্যা হতো, তাহলে তো পশ্চিমা সমাজে ধর্ষণ ডাল-ভাত হওয়ার কথা ছিল।
এখানে স্পষ্ট বলতে চাই, ধর্ষণ একটি অপরাধ এবং এই অপরাধের পিছনে নারীর পোশাক দায়ী বলার মাধ্যমে আপনারা মূলত ধর্ষকদেরকেই কাছে টেনে নিলেন। তাদের অপরাধকে জায়েজ করতে চাইলেন। আপনাদের মগজ যদি পরিষ্কার থাকত তাহলে ছবক হওয়া উচিত ছিল ধর্ষকদের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে। যাদের মগজে সমস্যা তারা ঘুরেফিরে কেবল নারীর মধ্যেই সমস্যা দেখতে পায়। বাস্তবে এই সমস্যা নারীর না, আপনাদের মতো অন্ধ ও কূপমণ্ডুক পুরুষদের।
এমন ভিকটিম ব্লেইমিং যারা করে তাদের জেনে রাখা উচিত, নারীরা এদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী এবং নিজের অধিকারকে বুঝে নেওয়ার অধিকার এদেশের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। নারী কেমনভাবে চলবে বা কী পরবে, সেটি একান্তই তার নিজের বিবেচনা বা পছন্দের বিষয়। নারী একজন স্বাধীন মানুষ। যেমন স্বাধীন মানুষ হিসাবে একজন পুরুষ তার জীবনধারাকে বেছে নিয়েছে, তেমনি নারীরাও স্বাধীন মানুষ হিসাবে নিজের পছন্দের জীবনাচরণ বেছে নেওয়ার অধিকার রাখে। আমি কী পরবো, সে বিষয়ে নীতিকথা বলার আপনি আসলে কেউ না। অন্যের জীবনে অনধিকার চর্চা করার আগে আরেকটু চিন্তায় শিক্ষিত হয়ে আসা উচিত। ধর্ষক বাস করে একজনের মগজে, মননে, চিন্তায় ও মানস কাঠামোতে। কারও পোশাক দেখে যদি আপনার শরীরে উত্তেজনা আসে, তবে সেটি আপনার মগজের সমস্যা, অন্যের নয়।
লীনা পারভীন: কলাম লেখক