বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না

  • প্রভাষ আমিন   
  • ২৫ অক্টোবর, ২০২০ ১১:২৫

সিলেটের এমসি কলেজের মতো অনেক জায়গায়ই ধর্ষকদের রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সরকার কাউকে ছাড় দেয়নি। এরপরেও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপারে সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হয়েছি। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রযন্ত্রের নানান কূটকৌশল আমাদের ব্যথিত করেছে।

সিলেটের এমসি কলেজ এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনার পর দেশজুড়ে অসাধারণ এক স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সে আন্দোলনের মূল চেতনার সাথে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ কারো ছিল না। কারণ মনে যাই থাক কেউ তো প্রকাশ্যে ধর্ষণের পক্ষে বলবে না। সরকারও দ্রুততম সময়ে মূল দাবি মেনে নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ প্রশমিত করার চেষ্টা করেছে। আন্দোলন শুরুর পরের সোমবারের মন্ত্রিসভার বৈঠকেই ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে আইন সংশোধন করা হয়। পরদিনই অধ্যাদেশ করে তা কার্যকর করা হয়।

তবে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করলেই ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটা অনেকেই মনে করেন না। আমি ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাই। তবে এও মনে করি, শুধু আইনে মৃত্যুদণ্ড লিখলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে না। ধর্ষণ বন্ধে আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে, নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তারচেয়ে বড় কথা হলো সকল ধর্ষককে আইনের আওতায় আনা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণের শিকার নারী, শিশু, ছেলে শিশু সবাই যেন ন্যায়বিচার পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। আমার ধারণা বাংলাদেশে আশি ভাগ ধর্ষণের ঘটনাই থানা-পুলিশ পর্যন্ত যায় না। যে ঘটনাগুলো থানা-পুলিশ পর্যন্ত যায়, তারও মাত্র ৩ ভাগ আদালতের রায় পায়। তার মানে শেষ পর্যন্ত ধর্ষকদের দশমিকের ভগ্নাংশ আদালতের দণ্ডিতত হন। তাই দণ্ড যাবজ্জীবন না মৃত্যুদণ্ড, সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। সবার বিচার নিশ্চিত করাটাই আগে জরুরি।

তবে আজকের লেখার বিষয় সেটা নয়। আজকে আমি স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন নিয়ে লিখতে চাই। এই আন্দোলনটা আমাকে দারুণ স্বস্তি দিয়েছে। প্রমাণ হয়েছে, মানুষ প্রতিবাদ করতে ভুলে যায়নি। এটা অবশ্য বারবার প্রমাণ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ভ্যাট, নিরাপদ সড়কসহ নানা ইস্যুতে বিভিন্ন সময়ে মানুষ রাস্তায় নেমেছে, প্রতিবাদ করেছে। তার মানে মানুষ সংক্ষুব্ধ হলে কোনো না কোনো উপায়ে প্রতিবাদ করবেই। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা যে তারা মানুষের ক্ষোভকে যৌক্তিকভাবে সংগঠিত করতে এবং নিজেদের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতে ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজ কিন্তু ঠিকই সময়ের দাবি মিটিয়েছে, রাস্তায় নেমেছে। এটা আমাকে আশাবাদী করেছে। প্রশ্নহীন, প্রতিবাদহীন সমাজ একটা বন্ধ্যা সমাজ। সরকার তো আর ফেরেশতারা চালায় না। তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশে সরকার ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ভুল করবেই। বিরোধী দলের উচিত সেটা ধরিয়ে দেওয়া। বিরোধী দল পারছে না বলে সাধারণ মানুষকে, তরুণ সমাজকে রাস্তায় নামতে হচ্ছে। আশার আলোটা তারাই জ্বালিয়ে রাখছেন।

আগেই বলেছি, স্বতস্ফূর্ত এই আন্দোলনের সাথে সরকারেরও দ্বিমত ছিল না। বরং দ্রুততম সময়ে তারা মূল দাবি মেনে নিয়েছে। সিলেটের এমসি কলেজের মতো অনেক জায়গায়ই ধর্ষকদের রাজনৈতিক পরিচয়টাই মুখ্য ছিল। কিন্তু সরকার কাউকে ছাড় দিয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু তারপরও আন্দোলনের ব্যাপারে সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে আমি অবাক হয়েছি। এ আন্দোলনের বিরোধিতা করার কোনো সুযোগ ছিল না, করেওনি। কিন্তু আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রযন্ত্রের নানান কূটকৌশল আমাদের ব্যথিত করেছে। মাঝে মাঝে মানুষের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য সময় দিতে হয়। কিন্তু সরকারের মধ্যে খুব তাড়াহুড়ো দেখা গেছে। দাবি মেনে নিচ্ছি, দ্রুত রাস্তা ছাড়ো। এই তাড়াহুড়োর মধ্যে দুটি ব্যাপার ছিল। একটা হলো- চোরের মন পুলিশ পুলিশ। সরকারের নীতি নির্ধারকরা তো ভালো করেই জানেন, তাদের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক ভিত্তিটা খুব শক্ত নয়। তাই আন্দোলনের ডাক শুনলেই তারা ভয় পেয়ে যায়। তারচেয়ে বড় কথা হলো, অতীতের কয়েকটা আন্দোলনে সরকার দেখেছে, রাস্তায় একটু ছাড় দিলেই নানান মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টায় নেমে পড়ে। এবারের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনেও ষড়যন্ত্রের চেষ্টা হয়েছে। ধর্ষণের বিচারের আগে শেখ হাসিনার পতন চাওয়া হয়েছে। রাজপথে শেখ হাসিনার পতন চাওয়া যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে সরকার পতনের স্লোগান আন্দোলনকেই বেপথু করে। তবে মানুষের মতপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষাকে রুদ্ধ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের নানান কূটকৌশল ছিল দুষ্টিকটু। ডাণ্ডা মেরে রাজপথ ঠাণ্ডা করা গেছে অনেক আগেই।

এখন বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল আছে কার্যত ফেসবুকে। সরকারের লক্ষ্যই তাই ফেসবুককে ঢোড়া সাপ বানানো; ‘যে সাপের চোখ নেই, শিং নেই, নখ নেই, ছোটে নাকি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না, করে নাকো ফোঁসফাঁস, মারে নাকো ঢুঁশঢাঁশ…’। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গ তো আছেই, আছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তৈরি করা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের গাইডলাইন। তারপরও গত ৭ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক সরকারি কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য ‘সামাজি যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশনা’ জারি করেন। যথারীতি এ নির্দেশনাও ফেসবুককে ঢোড়া সাপ বানানোর বৃহৎ প্রকল্পেরই অংশ। সরকারি কলেজের শিক্ষকরা না হয় চাকরির ভয়ে মহাপরিচালকের নির্দেশনা মানলো। কিন্তু মাননীয় মহাপরিচালক মহোদয়, ছাত্ররা ক্ষেপলে কিন্তু আপনার এইসব নির্দেশনা ছাইয়ের মতো উড়ে যাবে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশনার এক সপ্তাহ পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস রিলিজ আরো কড়া। তারও লক্ষ্য সেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। প্রেস রিলিজে অভিযোগ করা হয়, ‘দেশ ও বিদেশ হতে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকার, জনপ্রতিনিধি, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে অসত্য, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে।… এতে করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা, জনমনে উদ্বেগ, বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ প্রেস রিলিজে ‘অপপ্রচারে বিরত না থাকলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার’ হুমকি দেয়া হয়। আমরাও চাই দেশে স্থিতিশীলতা থাকুক, শৃঙ্খলা থাকুক। কিন্তু কোন বক্তব্যটা ‘অসত্য, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও উস্কানিমূলক’ তা প্রেস রিলিজে তা পরিস্কার করা হয়নি। সাধারণ মানুষ তাহলে বুঝবে কীভাবে? যদি সত্যিই কেউ ‘অসত্য, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও উস্কানিমূলক’ বক্তব্য প্রচার করে এবং বেআইনি কিছু করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তো বাধা নেই। বিদেশে বসে কারা কী করছে, তার জন্য সবাইকে ভয় দেখাতে হবে কেন?

তবে তারচেয়ে কঠিন ছিল এর আগে ১০ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তরের প্রেস রিলিজ। সেখানে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দেোলনের নামে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিহার করতে বলেছে পুলিশ। এটা ঠিক ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছে, সরকারের পতন চাওয়া হয়েছে। আর গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের পতন চাওয়া বা সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া অপরাধ নয়। তারচেয়ে বড় কথা হলো সরকার বিরোধিতা আর রাষ্ট্রবিরোধিতা এক নয়। আশা করি পুলিশ সদর দপ্তরের কর্তা ব্যক্তিরা রাষ্ট্র আর সরকারের পার্থক্যটা বুঝবেন। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে সরকারবিরোধী অনেক কিছু দেখেছি। কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী কিছু চোখে পড়েনি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সত্যিকারের রাষ্ট্রবিরোধী কিছু যদি হয়ে থাকে, তবে সেটা হয়েছে কুমিল্লার এক মাদ্রাসায়। সেখানে জাতীয় সংগীতের প্যারোডি করে নিজের মতো কথা বসিয়ে গাওয়া হচ্ছিল। সেখানে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তাদের অনেক নমনীয় মনে হয়েছে।

সরকার ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে না থাকলেও সব মিলিয়ে ভয় দেখিয়ে বিক্ষুব্ধ মানুষকে ঘরে পাঠাতে চেয়েছে। কিন্তু সরকারের বোঝা উচিত ভয় দেখিয়ে জয় করা যায় না। এর আগে কোটা সংস্কার, নিরাপদ সড়কসহ বিভিন্ন আন্দোলনে সরকার দাবি মেনে নিয়েও বিক্ষুব্ধদের হৃদয় জয় করতে পারেনি। কখনও পুলিশের, কখনও ছাত্রলীগের, কখনও হেলমেট বাহিনীর হামলা বিক্ষুব্ধদের বেদনা আরো বাড়িয়েছে শুধু। কোথাও কোনো অন্যায় হলে মানুষ প্রতিবাদ করবে, বিক্ষোভ করবে, সরকারের পতন চাইবে। কিন্তু সরকার কথায় কথায় নির্দেশনা, প্রেস রিলিজ, হুমকি দিলে চলবে কেন। সরকার সংবেদনশীলতা নিয়ে মানুষের ক্ষোভটা অনুভব করবে। প্রয়োজনে তাদের পাশে দাড়াবে, যৌক্তিক হলে দাবি মেনে নেবে। ভয় দেখিয়ে তাদের ঘরে আটকে রাখার চেয়ে ভালবেসে তাদের হৃদয় জয় করা বরং সহজ।

 

প্রভাষ আমিন: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

এ বিভাগের আরো খবর