বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রাজনীতিক বনাম আমলা, বিরোধটা কোথায়?

  • মাসুদ কামাল   
  • ২৪ অক্টোবর, ২০২০ ১২:৪৬

এমন ঘটনা তো আগে কম হয়নি, তখন তো কোনো জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে এত সিরিয়াস অ্যাকশনে যেতে দেখা যায়নি নির্বাচন কমিশনকে! তাহলে এবার কেন? তবে কি বিরোধটা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বলেই?

সংসদ সদস্য নিক্সন চৌধুরীর একটা টেলিফোন অডিও ক্লিপ আমি শুনেছি। তার একজন কর্মীকে ধরে নিয়ে যাওয়া নিয়ে ইউএনওর সঙ্গে তার টেলিফোন সংলাপ। এটি ছাড়াও তার আরও গোটাকয়েক অডিও এবং ভিডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়াতে ওড়াওড়ি করছে। তিনি যে ডিসির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন তার প্রমাণ নাকি ওই ক্লিপগুলোতে রয়েছে। তবে নিক্সন চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন, পরের এই অডিও-ভিডিওগুলো নাকি ‘সুপার এডিট’ করা, এগুলো তিনি আদৌ বলেননি। তিনি কেবল ইউএনও’র সঙ্গে টেলিফোন আলাপের কথাই স্বীকার করেছেন।

ঘটনার সূত্রপাত গত ১০ অক্টোবর। সেদিন চরভদ্রাসনে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হচ্ছিল। এটা নিক্সন চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকার মধ্যে। চরভদ্রাসন, সদরপুর ও ভাঙ্গা উপজেলা নিয়ে ফরিদপুর-৪ নির্বাচনী এলাকা। মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী এই এলাকার স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য। তার সহোদর আওয়ামী লীগের বড় নেতা লিটন চৌধুরী পাশের এলাকার সংসদ সদস্য, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ। খুবই প্রভাবশালী এবং বনেদী পরিবার তাদের। পারিবারিকভাবে তারা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এসব তথ্যকে মাথায় রাখলে নিক্সন চৌধুরী আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হবেন- এটাই স্বাভাবিক। তিনি হয়তো চেষ্টাও করেন। কিন্তু দল তাকে মনোনয়ন দেয় না। দল মনোনয়ন দেয় তাদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহকে। নৌকা মার্কা নিয়ে তিনি নির্বাচন করেন, এবং প্রায় প্রতিবারই স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরীর কাছে ভোটে পরাজিত হন। বিজয়ী নিক্সন চৌধুরী কখনও বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ নিয়ে নেতিবাচক কিছু বলেন না। তার যত ক্ষোভ কাজী জাফরউল্লাহ এবং তার নিয়ন্ত্রিত এই তিন উপজেলার দলীয় কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। আবার বিপরীত দিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমান্ডেরও নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে তেমন জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এমন বাস্তবতায় এই এলাকায় যেন দুটি আওয়ামী লীগ- একটি নিক্সন চৌধুরীর আর একটি কাজী জাফরউল্লার। নিক্সন চৌধুরীর প্রতি এলাকার মানুষের সমর্থন আছে কিন্তু দলের প্রকাশ্য সমর্থন নেই। উল্টা দিকে কাজী জাফরউল্লাহর প্রতি রয়েছে কেন্দ্রের অপরিসীম আশীর্বাদ, যদিও এলাকার মানুষের কাছে তিনি ব্রাত্য।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা এমন- এই তিন উপজেলায় রাজনীতি বলে কিছু নেই, আছে দুই নেতার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নেই, আছে নিক্সন বনাম জাফরউল্লাহ। একজন যা কিছুই করুন না কেন, অপরজন তার বিরোধিতা করবেনই। এই টানাটানিতে স্থানীয় প্রশাসনকে প্রতিনিয়ত দিতে হচ্ছে কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। সেই পরীক্ষারই একটি দৃশ্য একটু স্থূলভাবে প্রকাশ্যে চলে এসেছে চরভদ্রাসনের উপজেলা পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আর সেটিকে কেন্দ্র করে বের হয়ে এসেছে প্রশাসনের দাম্ভিক চেহারাটাও।

অভিযোগ উঠেছে এমপি নিক্সন চৌধুরী প্রশাসনের লোকদেরকে গালাগালি করেছেন, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। অবশ্য ছড়িয়ে পড়া রেকর্ডগুলোর মধ্যে একটি ছাড়া বাকিগুলোকে বানোয়াট বলে দাবি করেছেন এমপি সাহেব। সেইসাথে যে অডিও ফাঁস হয়েছে, তা জেলা প্রশাসকের কাছ থেকেই হয়েছে অভিযোগ করে তার বিচার দাবি করেছেন নিক্সন চৌধুরী। আমার দুর্ভাগ্য, যেটিকে তিনি সত্য বলেছেন, সেটিই আমি শুনেছি। সেখানে তিনি ইউএনওকে ফোন করে এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু অভিযোগের যে ভাষা, তা আমার কাছে মোটেই ভদ্রজনোচিত বলে মনে হয়নি। তিনি তো রকের কোনো মাস্তান নন, অথবা নন তামিল মুভির ভিলেন। তিনি একজন এমপি, একজন জনপ্রতিনিধি। তিনি কেন এমন ভাষায় কথা বলবেন!

তবে পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে, বর্তমানে যারা এমপি হচ্ছেন, এদল কিংবা ওদলের, সকলের মানসিকতা এবং সাংস্কৃতিক মান এরচেয়ে তেমন বেশি কিছুও নয়। অনেক ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস মালিক এখন এমপি হয়ে গেছেন। গার্মেন্টসের শ্রমিকদের প্রতি যে ব্যবহার করে তারা অভ্যস্ত, সেটা যেন সাধারণ মানুষ কিংবা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তার সময়ও তারা ভুলতে পারেন না। টাকার গরমে হোক বা অশিক্ষার প্রভাবে হোক, মানুষকে যেন তারা কীটপতঙ্গের চেয়ে বেশি কিছু মনেই করেন না। গালাগাল যেন তাদের জীবনের স্বাভাবিক অনুসঙ্গ।

এমন বাস্তবতায় লোকে কিন্তু বলতেই পারে- এমপি সাহেবদের মুখের ভাষা তো এরকমই, তাহলে এ নিয়ে প্রশাসন এত ক্ষেপলো কেন? আগে নির্বাচনের সময় এমন ঘটনা তো কম হয়নি, কই তখন তো কোনো জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে এত সিরিয়াস অ্যাকশনে যেতে দেখা যায়নি নির্বাচন কমিশনকে! তাহলে এবার কেন? তবে কি বিরোধটা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বলেই?

এরকম একটা প্রশ্ন কিন্তু গত কিছুদিন ধরেই উঠছে। সরকার কি এখন প্রশাসনের লোকজনকে তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এই করোনাকালের শুরুর দিকেও দেখা গিয়েছিল, প্রতি জেলার ত্রাণ তৎপরতার কর্মকাণ্ড মনিটরিংয়ের জন্য একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সচিব কেন? প্রতি জেলায় যেখানে একাধিক এমপি রয়েছেন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রয়েছেন, উপজেলা চেয়ারম্যান রয়েছেন, তখন সচিবদেরকে কেন ত্রাণতৎপরতা মনিটরিং করতে হবে? তাহলে কি সরকার জনপ্রতিনিধিদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না? জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে আমলারা কি সরকারের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে?

কেবল এই একটি উদাহরণই নয়, সরকারের আমলাপ্রীতি নিয়ে আরও বেশ কিছু ঘটনার কথা বলা যায়। যেমন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়ে বিধিনিষেধ। আপনি কোনো কারণে সংক্ষুব্ধ হলে এই দেশে সকলের বিরুদ্ধেই যখন-তখন মামলা করতে পারবেন, কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে পারবেন না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে আপনাকে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে! শুনতে বিস্ময়কর শোনালেও, এটাই সত্য। এরকম একটা আইন আছে এই দেশে। থাকা কি উচিত? এদেশে জনগণের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে, জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে করা যাবে, কিন্তু আমলাদের বিরুদ্ধে করা যাবে না! এমন আইন আছে বলেই হয়তো, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন নিজেদেরকে সাধারণ জনগণের চেয়ে উচ্চতর হিসাবে ভাবতে পছন্দ করেন। তাদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করলে ক্ষিপ্ত হয়ে যান।

ইদানিং ফেসবুক, ইউটিউবের কল্যাণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কিছু কিছু ভাষণ শোনার সৌভাগ্য হয়। সেদিন একটা ভাষণ শুনলাম, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলছেন- এই দেশের সাধারণ মানুষ আপনাদের বেতন দেয়, তাদেরকে সেবা করার জন্য। তাদের সেবা করুন, তাদের প্রভু হওয়ার চেষ্টা করবেন না।

আমাদের সেবা করার জন্য যাদেরকে আমরা বেতন দিয়ে রেখেছি, তাদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা পর্যন্ত করতে পারবো না কেন? সরকারি কর্মচারীদেরকে বলা হয়ে থাকে- ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’। তো সার্ভেন্টকে কেন স্যার ডাকতে হবে?

আমি তো মনে করি, সরকারই দায়ী এর জন্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারকে বলা হয়ে থাকে জনগণের সেবক। সেই সেবক এখন চাকরকে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছে প্রভুর চেয়ারে। ফলে তারা এখন আর কাউকেই মানছে না। তাহলে, কেউ কেউ যে বলে থাকেন- আমলা আর প্রশাসনই এই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে, ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে- সেই বক্তব্যটি কি একেবারেই ভিত্তিহীন?

 

মাসুদ কামাল: সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর