চীনের বিরুদ্ধে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে আমেরিকা যে কোয়াড গড়ে তুলছে, বিগান এই কোয়াড গঠনের একজন প্লেয়ার। বিগানের বাংলাদেশ সফরে আসার আগের সপ্তাহে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পে জাপানে এসেছিলেন। জাপান কোয়াডের অন্যতম শক্তি। তাই সেখানে পম্পে ও জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনা শেষে যৌথ বিবৃতি ছিল স্পষ্ট। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, জাপান ও আমেরিকা একমত, তারা ভবিষ্যতে কোয়াডকে আরো শক্তিশালী করবে। অর্থাৎ পম্পের জাপান সফরেই পরিস্কার হয়ে যায়, আমেরিকা ও জাপানের উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে চার দেশীয় ইন্দো-প্যাসিফিক কোয়াড জোটে ভারত মহাসাগর ও প্যাসিফিক মহাসাগর সংশ্লিষ্ট আরও অনেক দেশকে তারা অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। তারা যে এটা করতে চায় তার প্রমাণ মিললো ২১ তারিখ জাপান ও ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে। এটা ছিল জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কোনো বিদেশি সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক। সেখানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ভিয়েতনামকে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে যোগ দিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকার শান্তি রক্ষার জন্যে আহ্বান জানান। অন্যদিকে ওই একই দিনে বিগান টেলিফোনে কথা বলেন দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। তিনিও দক্ষিণ কোরিয়াকে চীনের বিপরীতে কোয়াডে আসার জন্যে অনুরোধ করেন।
এর থেকে এটা স্পষ্ট, আমেরিকার এ মুহূর্তের পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য ইন্দো-প্যাসিফিকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট এশিয়ার যত বেশি দেশকে কোয়াডের সঙ্গে সংযুক্ত করা। ইউরোপীয় দেশগুলো নিয়ে গড়ে তোলা ন্যাটোর আদলে তারা এশিয়াতে কোয়াডের নামে নতুন একটি এশিয়ান ন্যাটো গড়ে তুলতে চায়। যেটা মূলত চীনের বিরুদ্ধে কাজ করবে। চীনকে শুধু ইন্দো-প্যাসিফিক থেকে দূরে রাখা তাদের উদ্দেশ্য নয়, সাউথ চায়না সিতেও চীন যাতে একক আধিপত্য গড়ে তুলতে না পারে সেটাও তাদের লক্ষ্য। আর এ কাজের জন্যে তারা ভারত, জাপান ও প্যাসিফিকের পাশের ওশেনিয়ান অস্ট্রেলিয়ার নৌ বাহিনীকেও ওবামার আমল থেকে শক্তিশালী করার জন্যে কাজ করে যাচ্ছে।
আমেরিকা যে সময়ে চীনের বিপরীতে এশিয়ান এই ন্যাটো গড়তে শতভাগ তৎপর, সেই সময়ে আমেরিকার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগান ভারত হয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ভারতকে তো আর তাদের কোয়াডে যোগ দেবার জন্যে অনুরোধ করার কিছু নেই। বরং ভারত কোয়াডের এক উদ্যোক্তা। তাই স্বাভাবিকই ভারতের সঙ্গে বিগানের আলোচনার বিষয় ছিল দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো ও মিয়ানমারকে কীভাবে চীনের বিরুদ্ধে ইন্দো-প্যাসিফিকের এই কোয়াডে টানা যেতে পারে।
ভারত মহাসাগরীয় দেশ হিসেবে শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপ কোয়াডের নতুন রূপ অর্থাৎ এক ধরনের এশীয় ন্যাটো গড়ে তোলার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। মালদ্বীপের এ মুহূর্তে যে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আছে তারা ভারতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেই থাকবে। অন্যদিকে শ্রীলংকার বর্তমানের দুই ভাইয়ের সরকার চীন ঘেঁষা হলেও তাদের ভারত ও আমেরিকার বাইরে যাওয়ার খুব বেশি উপায় নেই। কারণ, তারা ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র। আর নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের কাঠামোগত সম্পর্ক ভিন্ন। নেপাল ও ভুটানের নাগরিকরা ভারতীয় নাগরিকের মতোই ভারতে সরকারি চাকরিতে সুযোগ পায়। শুধু তাই নয়, তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও চাকরি করে। অন্যদিকে ইমরান খানের পাকিস্তান এখন চীনের একটি করদ রাজ্য। তাই দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারতের বাইরে স্বতন্ত্র মাথা উঁচু করে আছে বাংলাদেশ। এ কারণে ভারতের পরেই বিগানের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশ সফর। এটা ভারতের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই বিগানের সঙ্গে আলোচনায় ভারত শুধু নিজেদের বিষয়ের ভিতর সীমাবদ্ধ রাখেনি। তারা বাংলাদেশের বিষয়ও এনেছিল। আর সেটা ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা। দুই বছর আগে রোহিঙ্গা নিয়ে ভারত ও আমেরিকার যে অবস্থান থাকুক না কেন, এখন তারা দেখছে চীনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের ‘রোহিঙ্গা’ একটি বড় অস্ত্র। কারণ, মিয়ানমার যে সিটওয়ে সমুদ্র বন্দর ও ক্যায়াকপু গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্যে চীনের সহায়তায় রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করেছে- এই দুই বন্দরেই বিনিয়োগ করেছে চীন। তাই ওই দুই বন্দর রক্ষায় চীনের সেনাবাহিনী সেখানে আসবেই। এর ফলে ভারত ও বাংলাদেশের নাকের ডগায় শুধু চীনের সেনাবাহিনী আসবে না, বঙ্গোপসাগরের পাড়েও আসবে। বঙ্গোপসাগর ইন্দো-প্যাসিফিকের সঙ্গেই সংযুক্ত। আর চীনের সেনাবাহিনী ভারতের যে নাকগুলোর ডগায় আছে তার বাস্তবতা ভারত ইতোমধ্যে লাদাখ ও নেপাল সীমান্তে বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে আমেরিকাও। এই কারণে দুই বছর আগের রোহিঙ্গা সমস্যা আর বর্তমান রোহিঙ্গা সমস্যা এ দুই দেশের কাছে এক নয়। তাদেরকে এখন রোহিঙ্গাদেরকে সেফ জোন তৈরি করে ফেরত পাঠিয়ে সেখানে যদি পারে তাহলে জাতিসংঘ বাহিনী নিয়োগ করতে হবে। তাহলেই কেবলমাত্র চীনের সেনা সদস্যদের বিপরীতে একটি ব্যালান্স আসবে। আর এ কাজেরই শুরু হিসেবে বিগানের সফরের আগেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও সেনাপ্রধান মিয়ানমার সফর করেন। ওই সফরে তারা মিয়ানমারকে শুধু সাবমেরিন উপহার দেওয়ার কথা বলেনি। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্যে কাজ শুরু করার তাগিদও দেয়। তাই বিগান ভারতে এলে স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টি সেখানে আলোচনায় উঠেছিল।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মুহূর্তে পৃথিবীতে সব থেকে অভিজ্ঞ সরকার প্রধান। তিনি এই রাজনীতি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ২০১৯-এর ইন্ডিয়ান ওশান কান্ট্রিজ সেমিনারের প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি তার অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতে মহাসাগরের সঙ্গে নানানভাবে সংযুক্ত এশীয় দেশগুলোতে পৃথিবীর ৩৫ ভাগ মানুষ বাস করেন। এই ৩৫ ভাগ মানুষ যাতে শান্তিতে থাকতে পারে সেটাই তার অবস্থান। এ কারণে বিগান যখন বাংলাদেশে সফর করেন তখন তার কাছে শেখ হাসিনার অবস্থান ছিল পরিস্কার। বরং তার দিক থেকে পরিস্কার করা দরকার ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাদের বর্তমান অবস্থান কী। সে কাজ বিগান করে গেছেন। অন্যদিকে এই প্রথমবারের মতো আমেরিকার একজন উপপররাষ্ট্র মন্ত্রী ও কোয়াডের অন্যতম প্লেয়ার তার সফরের মাধ্যমে বুঝিয়ে গেছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে ভারত বা অনান্য দেশের বাইরে এসে বাংলাদেশের রয়েছে স্বতন্ত্র গুরুত্ব। আমেরিকা সেই গুরুত্বকে স্বীকার করে। যে কারণে শেখ হাসিনাকে তাদের নির্বাচনের পরে নতুন সরকার এলে আমেরিকা সফরে আমন্ত্রণ জানাবে এটাও তিনি জানিয়ে গেছেন। কারণ, তাদের সরকার পরিবর্তন হয় কিন্তু নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না। আর শেখ হাসিনার ওই আমেরিকা সফরের পরে আরো পূর্ণতা পাবে বিগানের সফর।
তবে এটাও ঠিক, বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিকের শতভাগ শান্তির পক্ষে থাকলেও তার অবস্থা খানিকটা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো। কারণ, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও সাহায্যের কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে সক্রিয়ভাবে কোয়াডে যাওয়া সম্ভব নয় বলে সে দেশের থিঙ্ক ট্যাঙ্করা মনে করেন। বাংলাদেশের সঙ্গেও চীনের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সেটাকে অস্বীকার করা কষ্টকর। তবে শেখ হাসিনার ওই সফরের পরে বাংলাদেশের মূল শিল্প গার্মেন্টেসের বাজার যদি ইউরোপের মতো আমেরিকাতেও উম্মুক্ত হয় তখনকার পরিস্থিতি অনুয়ায়ী আবার নতুন অঙ্ক কষা হবে।