বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে ঢাকার ভারসাম্য নীতি

  • মো. তৌহিদ হোসেন   
  • ২১ অক্টোবর, ২০২০ ১১:৫৭

চীনের সাথে বাংলাদেশের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে যে বিনিয়োগ দরকার তার বড় অংশ দিতে পারে শুধুই চীন। এরূপ পরিস্থিতিতে একটি আপাত চীনবিরোধী জোটে যোগ দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে বাস্তবসম্মত নয়।

তিনদিনের এক সরকারি সফরে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান। ভারত সফর শেষে ১৪ অক্টোবর ঢাকায় আসেন তিনি। ঐদিনই আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সাথে। বৃহস্পতিবার ১৫ অক্টোবর সকালে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। কিছু গণমাধ্যম কর্মীর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন ঐদিনই বিকেলে। শুক্রবার ১৬ অক্টোবর সকালে দেশের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যান জনাব বিগান।

স্টিফেন বিগানের এই সফর বিভিন্ন কারণেই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। চার বছর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি’র সফরের পর, স্টিফেন বিগানই বাংলাদেশে আসা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সর্বজ্যেষ্ঠ পদাধিকারী। আর এই সফর এমন এক সময়ে ঘটল যখন চীন-ভারত সংঘাত রক্তাক্ত রূপ নিয়েছে। সেইসাথে আঞ্চলিক দেশগুলোর ওপর চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের প্রভাবের লাগাম টেনে ধরতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) উদ্ভাবন করেছে যেখানে ভারত ছাড়াও জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া শামিল হয়েছে। এই চারটি দেশ একত্রে অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘কোয়াড’ নামে অভিহিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় তার এই কৌশলগত বিন্যাসে অন্যান্য আঞ্চলিক দেশও শামিল হোক, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ ব্যাপারে ২০১৮ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে।

সভা-সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দুজনেই বলেছেন যে আইপিএস নিয়ে মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কোনো আলোচনা হয়নি। আলাপ হয়েছে আইনের শাসন, রোহিঙ্গা সমস্যা, বিনিয়োগ এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরত পাঠানো নিয়ে। তবে বিকালে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়ে মার্কিন উপমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন যে আইপিএস নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে তার আলোচনা হয়েছে এবং তার দেশ আইপিএসে বাংলাদেশকে সক্রিয় দেখতে চায়। তার মতে এটি এ অঞ্চলের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর একটি সহযোগিতা মোর্চা, আর এতে নিরাপত্তা সহযোগিতা ছাড়াও অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয় রয়েছে। এই উদ্যোগ যদিও স্পষ্টতই চীনের প্রভাব খর্ব করার উদ্দেশেই নেওয়া, কিন্তু তিনি দাবি করেছেন যে এটা কোনো বিশেষ দেশের বিরুদ্ধে গঠিত জোট নয়।

দু’পক্ষের বক্তব্যে এই পরস্পরবিরোধিতা এবং বাংলাদেশের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর উচ্চারিত ‘বিকল্প সত্যে’ অনুমান করা যায় যে আইপিএস নিয়ে মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বোঝা যাচ্ছে এ উদ্যোগে অংশ নিতে বাংলাদেশ এখনো রাজি হয়নি। চীনের উদ্যোগে গঠিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে আইপিএস প্রকল্পে নয় কেন। বিআরআই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে চীনের বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধির উদ্দেশেই নেওয়া। কিন্তু এটি দৃশ্যত একটি যোগাযোগ উন্নয়নের প্রকল্প যা অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। এতে সরাসরি কোনো নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় জড়িত নেই। পক্ষান্তরে আইপিএসের প্রাথমিক লক্ষ‍্য হচ্ছে নিরাপত্তা সহযোগিতা, অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয় থাকলেও তা তেমন দৃশ্যমান নয়। বিশেষত, যদিও মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে এটি বিশেষ কোনো দেশের বিরুদ্ধে গঠিত জোট নয়, কিন্তু এটি যে চীনের প্রভাবে লাগাম টানতেই সৃষ্টি করা হয়েছে তা খুবই স্পষ্ট। নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে তিনি গালওয়ান উপত্যকা, সেনকাকু দ্বীপ, তাইওয়ান, হংকং, শিনজিয়াংয়ের উল্লেখ করেছেন, যার সব কটিতেই চীন হচ্ছে প্রতিপক্ষ।

চীনের সাথে বাংলাদেশের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে যে বিনিয়োগ দরকার তার বড় অংশ দিতে পারে শুধুই চীন। এরূপ পরিস্থিতিতে একটি আপাত চীনবিরোধী জোটে যোগ দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে বাস্তবসম্মত নয়। এই প্রকল্পে ভারতের যোগদান যৌক্তিক, কেননা চীনের সাথে ভারতের সংঘাতপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান এবং এ সংঘাতে মার্কিন সমর্থন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য আইপিএস প্রকল্পে যোগদান চীন-ভারত দ্বন্দ্বে ভারতের পক্ষাবলম্বনের সমার্থক হবে। সেক্ষেত্রে যে নিরপেক্ষতার নীতি বাংলাদেশ অবলম্বন করছে, তারও ব্যত্যয় ঘটবে এতে। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ তাই এ প্রস্তাবের বিষয়ে শীতল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে দেশের স্বার্থ। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে রোহিঙ্গাসংকট। তিন বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অবস্থানরত এই বিপুল শরণার্থী জনগোষ্ঠীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। একদিকে চীন ও ভারতের মধ্যে প্রায় যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। আবার অন্যদিকে দুই দেশই রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমর্থন প্রদান ছাড়াও, গণহত্যাকারী মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করছে দুই দেশই। বঙ্গোপসাগরে পৌঁছুতে চীনের জন্য মিয়ানমার দেশটির গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশের লক্ষ্য এর বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। আর এ কারণেই মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন সত্ত্বেও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান নেয়নি কেউ। মার্কিন নেতৃত্বে আইপিএস প্রকল্পে যোগদান এ সংকট নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা তা বিবেচনা করা যেতে পারে। অথবা এ বিষয়টিকে দরকষাকষির হাতিয়ার করা সম্ভব কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখা যায়। তড়িঘড়ি নয়, সিদ্ধান্ত নিতে হবে ধীরে-সুস্থে, সবদিক বিবেচনা করে।

এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনাও লক্ষণীয়। গত ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হলো মিয়ানমার এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মাঝে দ্বিপাক্ষিক সংলাপ। সংলাপ অন্তে দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর স্বদেশে প্রত্যাবাসনের কোনো কথা নেই, রোহিঙ্গা শব্দটিও ব্যবহার করা হয়নি। গণতান্ত্রিক রূপান্তর, অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থসামাজিক উন্নয়ন ইত্যাদি উচ্চমার্গের বায়বীয় শব্দাবলী স্থান পেয়েছে বিবৃতিতে। গত তিন বছরে রোহিঙ্গা প্রশ্নে খানিকটা সমর্থন সহানুভূতির প্রকাশ দেখা গেছে শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নেই। ইউরোপের এই সমর্থন ধরে রাখা বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। আগামী কিছুদিন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ব্রাসেলসে অবস্থিত দূতাবাসকে এ ব্যাপারে আরো সক্রিয় ভুমিকা পালন করতে হবে।

 

মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব

এ বিভাগের আরো খবর