এক-এগারোর পর বাংলাদেশে ‘সংস্কারপন্থী’ শব্দটি নেতিবাচক মাত্রা পেলেও, এদেশে শিগগির রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দ্বিমত নেই কারো। মানুষের মঙ্গলের জন্য এই মুহূর্তে যা করা দরকার, তার মধ্যে প্রথম হলো রাজনৈতিক সংস্কার। আর এই সংস্কার শুরু করতে হবে খোদ ‘রাজনীতি’ শব্দটি সংস্কারের মধ্য দিয়ে।
একদা মানুষ বনে জঙ্গলে বাস করত, তখন ছিল আদিম যুগ। নিরাপত্তার প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ হয়েছিল মানুষ। বিশেষ করে বন্য পশু ও পরবর্তীকালে দস্যুদের হাত থেকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে। অর্থাৎ প্রথমে পশুর হাত থেকে রক্ষা, পরে মানুষকে নিতে হয়েছিল মানুষের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং তা আজও চলমান। মানুষই মানুষের শত্রু হিসেবে সমাজে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, পশু হয়ে গেল নগণ্য। মানুষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নানাবিধ প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, জীবনযাপন ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল সমাজে। সেই এই নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাসহ অন্যান্য অপরিহার্য বিষয়াদি নিশ্চিত ও ব্যবস্থাপনার জন্যে প্রথমে গোত্র বা ছোট ছোট দল, পরে সম্প্রদায় ইত্যাদি হয়ে রাজ্য কায়েম হলো। পরবর্তীতে দলপতি থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে আবির্ভূত হলো ‘রাজা’। সে-সময় হতেই মানব সমাজের ব্যবস্থাপনার জন্যে রীতি-নীতি বা নীতিমালার প্রয়োজন দেখা দিল। যার নাম চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে হলো ‘রাজনীতি’ অর্থাৎ রাজার নীতি।
‘রাজা’ থাকলে রাজার নীতি থাকবে। আর রাজার দায়িত্ব-কর্তব্য-কার্যক্রমের নাম ‘রাজনীতি’ হবে এটাই যথার্থ। কিন্তু পরবর্তীকালে ‘রাজার শাসন’ দূর হয়ে ‘জনশাসনে’র যুগ এলেও, ভারতবর্ষে Politics শব্দের অর্থ এখনো ‘রাজনীতি’ই রয়ে গেছে। শব্দটি থেকে আমরা বের হতে পারিনি।
আধুনিক সমাজে দেশকে ‘রাজ্য’ নয় ‘রাষ্ট্র’ বলা হয়।। এখন রাজ্য, রাজা প্রজা শব্দগুলো ইতিহাসের স্মৃতি মাত্র। ইংরেজি Politics শব্দটিতে King বা রাজার প্রতিনিধিত্ব নেই। কিন্তু Politics শব্দের বাংলা কীভাবে ‘জননীতি’ না হয়ে ‘রাজনীতি’ হলো, তা এক বিরাট আশ্চর্যের ঘটনা। তথাকথিত ‘রাজনীতি’ও আজ আর শুধু অর্থহীনই নয় বরং ক্ষতিকরও বটে। যত তাড়াতাড়ি এ অর্থহীন শব্দটির বিলুপ্তি ঘটবে কিংবা তা বাজেয়াপ্ত করা হবে, ততই মঙ্গল।
অর্থহীন শব্দ ব্যবহারে সমাজ তথা মানুষের মানসিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ আধুনিক সময়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবক্ষয় ও পচনের কালে, ‘রাজনীতি’ শব্দটি ত্যাগ করাই উচিত। কারণ ‘রাজনীতি’ হারিয়েছে তার অর্থ। শুধু তাই নয়, এর চরিত্রও হয়ে গেছে বিনষ্ট। মিথ্যা, অনাচার, সন্ত্রাস, রাহাজানি, ক্যাডার ইত্যাদি ভর করেছে রাজনীতির ঘাড়ে। আর তাই, আজ আর মানুষ রাজনীতিতে আসতে চায় না। রাজনীতির আহ্বানে মানুষ প্রথমেই আঁতকে ওঠে ভয়ে। এরপর নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক ঘৃণা, ইত্যাদি নানাবিধ মানসিক চাপে ভুগতে থাকে মানুষটি। তাই সে আর স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না। এক ধরনের মানসিক রোগে সে হয় প্রায় রোগাগ্রস্ত। এ কথাটি না বলে পারা যাচ্ছে না যে, এখন চতুরতা, মিথ্যা ইত্যাদির প্রতিশব্দ হয়ে গেছে ‘রাজনীতি’। যেমন, কেউ যদি কোনো কথা মূল্যায়ন করতে চায়, কথাটির সত্যতা কিংবা যৌক্তিকতা যাচাই করতে চায়, কথাটির বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ জানতে চায়, তখন প্রায়শই শোনা যায়- আরে ওটা তো ছিল ‘রাজনৈতিক কথা’। অর্থাৎ বিষয়টা এমন, রাজনীতি যেন চাতুর্য বা মিথ্যার প্রতিশব্দ। তাহলে কি ‘রাজনীতি’ শব্দটি বাজেয়াপ্ত করা সমাজের জন্যে মঙ্গলজনক নয়! আমার মনে হয় ‘রাজনীতি’ শব্দটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজেয়াপ্ত করে এর বিকল্প, অর্থবহ প্রতিশব্দ ব্যবহার করে বিপদগ্রস্ত সমাজকে মুক্ত করার এখনই সময়।
কী হওয়া উচিত ‘রাজনীতি’ শব্দটির প্রতিশব্দ, তা নির্ধারণ করতে হলে রাজনীতির নামে প্রকৃত পক্ষে আমরা কী করছি, কী দেখছি এবং কী করা উচিত তা ভেবে দেখা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির অবক্ষয়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরে লেখা ভারাক্রান্ত করতে চাই না। কারণ তা প্রায় সকলেরই জানা। শুধু তাই নয়, রাজনীতির জাঁতাকলে আজ নিষ্পেষিত মানুষ।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা চিরকালই প্রজাদের ঘাড়ে পা রেখে সিংহাসনে আরোহণ করে ‘রাজা’ হয়েছেন। অনেকে বলবেন, না, তারা কেউ ছিলেন প্রেসিডেন্ট কেউ বা প্রধানমন্ত্রী, রাজা নন। কিন্তু আমাদের সাধারণ চোখ তাদেরকে ‘রাজা’ হিসেবেই দেখছে। এটা আমাদের ব্যর্থতা কিনা জানি না। প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্টের গাড়ির বহরের সামনে মোটরসাইকেলগুলোকে আমরা সেই রাজাদের অশ্বারোহী সিপাইদের ঘোড়ার মতোই দেখি। তাদের বিশাল গাড়িকে রাজার হাতিশালের হাতি হিসেবেই দেখি। তাদের রক্তচক্ষুকে সেই অত্যাচারী রাজার চোখের মতোই দেখি। তাদের মূল্যবান ভাষণে সেই তথাকথিত রাজাদের প্রতারণা কিংবা প্রলাপ আর মিথ্যা প্রলোভন হিসেবেই শুনি। ভ্যাট ও রাজস্ব আদায়ের কৌশলকে সেই অত্যাচারী রাজাদের খাজনা আদায়ের কথাকেই শুধু মনে করিয়ে দেয় আমাদের। চাষিদেরকে সারের জন্যে গুলি, জনগণকে প্রজা ভেবে পানির জন্যে, বিদ্যুতের জন্যে নির্যাতনকে আমি নীল চাষিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিচ্ছবি হিসেবেই শুধু দেখি! পুলিশকে মনে হয় ব্রিটিশ কিংবা পাক পেটোয়া বাহিনী। কিন্তু কেন? এটা কি আমাদের অপরাধ?
এটা কোনো নির্দিষ্ট সরকারের চেহারা নয়। যে কোনো দলের সরকারই আসুক না কেন, একই চিত্র আমরা দেখব। কিন্তু আমরা কেউ তা দেখতে চাই না। প্রায় ৫০ বছর বয়সের একটি স্বাধীন দেশে চলছে পরাধীনতার এই ‘রাজনীতি’! একটি অফিসে কর্মকর্তার পরিবর্তন হলে সে অফিসের কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু একটা দেশ স্বাধীন হলো এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিমিয়ে, সে স্বাধীন ও মুক্ত দেশটিতে রাজনীতির কোনো পরিবর্তন হলো না!
‘রাজনীতি’ শব্দটিকে বাজেয়াপ্ত করা হোক এই স্বাধীন দেশে। এ মহতি কর্মকাণ্ডের নাম হোক ‘জননীতি’। জনগণের কল্যাণে যে নীতি, যে নীতিতে জন-মানুষের কল্যাণ করা হবে, যে পদ্ধতি বা ব্যবস্থাপনায় জন-মানুষের ভালো-মন্দ সার্বিক বিষয়াদি বিবেচনায় আনা হবে, তার নাম তো ‘জননীতি’-ই হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা রাজতন্ত্র চাই না, তবে কেন ‘রাজনীতি’ চাইব। দেশে রাজা নেই, রাজ্য নেই। তবু আছে রাজধানী, আছে প্রজা, আছে রাজনীতি শব্দমালা। আজও আমাদের দেশের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশ। কেন ‘গণজনতন্ত্রী’ বাংলাদেশ করা হয়নি? কেনই বা ‘রাজনীতি’ হবে না ‘জননীতি’?
মেজর (অব.) আমীন আহমেদ আফসারী: কলাম লেখক ও বিশ্লেষক