বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ধর্ষণের দায় ও সামাজিক আয়োজন

  • সাদিয়া আফরিন   
  • ১৩ অক্টোবর, ২০২০ ১০:৪৪

ভিকটিম ব্লেমিং থেকে কখনও নারীর পোশাক, কখনও চরিত্র, কখনও বিচরণের পরিধি বা কাজের পরিসর প্রভৃতিকে দায়ী করা হয় ধর্ষণের শিকার হওয়ার কারণ হিসাবে। অর্থাৎ সমাজ নির্মিত অবয়বের বাইরে গেলেই নারীকে ধর্ষণ জায়েজ হয়ে যায়।

প্রচলিত ধারণায় কারো সম্মতি ব্যতিরেকে জোরপূর্বক যৌনসম্পর্ক স্থাপন করাকে ধর্ষণ বোঝানো হয়। কিন্তু বিষয়টি শুধু যৌনসম্পর্ক স্থাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। একটি ধর্ষণ সংঘটিত হওয়ার পেছনে থাকে মূলত ক্ষমতা প্রয়োগের ধারণা। এই ক্ষমতা প্রয়োগ বা চর্চা সমাজের উপর থেকে নিচ সর্বত্র বিরাজমান। সামাজিক মানদণ্ডে যিনি ‘সবল’ তিনিই অপেক্ষাকৃত দুর্বলের ওপর ক্ষমতা আরোপ করে। পুরুষ নারীর ওপর, নারী নারীর ওপর, বড় ছোটর ওপর, চাকরিজীবী রিকশাশ্রমিকের ওপর, ব্যবসায়ী খদ্দেরের ওপর, পুঁজিপতি মজুরের ওপর ক্ষমতা চর্চা করে এবং এভাবে সকলের চর্চার মাধ্যমে এটি বিস্তৃতি লাভ করে। বাংলাদেশের মতো পুরুষতান্ত্রিক ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ক্ষমতা প্রয়োগ মোটামুটি সাধারণ একটি ঘটনা এবং এই ক্ষমতা প্রয়োগের একটি নির্দিষ্ট ধরণ হচ্ছে ধর্ষণ।

ধর্ষণকে নারীর প্রতি পুরুষের নৃশংস আচরণ হিসাবে দেখা হয় ঠিকই, কিন্তু যে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে নারীর প্রতি অবমাননা নৈমিত্তিক ঘটনা এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে নারীর প্রতি যে নৃশংসতা চর্চিত হয়, সেসব বিষয় তারা পাশ কাটিয়ে যান। ধর্ষণকে যৌন আক্রমণ হিসাবে পাঠ করলে ধর্ষণের আওতা সীমিত হয়ে পড়ে এবং কাঠামোগত লৈঙ্গিক বৈষম্য এবং ধর্ষণের ক্ষেত্রে এর প্রভাব- ইত্যাদি বিষয় ঢাকা পড়ে যায়। ধর্ষণের আলোচনায় নারীর ওপর পুরুষের যৌন আক্রমণ যতটা প্রাধান্য পায়, অল্পবয়সী ছেলেশিশুর ওপর যৌন আক্রমণ ততটা পায় না। এক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহারও বদলে যায়, ধর্ষণ হয়ে যায় বলাৎকার।

ধর্ষক সম্পর্কে একটি জনপ্রিয় সামাজিক নির্মিতি হলো- যারা ধর্ষণকারীরা ‘বিকৃত রুচিসম্পন্ন’, ‘অসুস্থ’, ‘কাপুরুষ’ এবং ‘বখাটে’। ধর্ষণকারীকে বিকৃত রুচির, অসুস্থ, বা বখাটে বলার মাধ্যমে মূলত বোঝানো হয় ধর্ষক হলো ‘খারাপ পুরুষ’ বা ‘পুরুষ’ হয়ে উঠতে পারেনি। এই ভাবনার বিপরীতে থাকে ‘ভালো পুরুষ’-এর ধারণা, অর্থাৎ যিনি ‘ভালো পুরুষ’ তিনি কখনই ধর্ষণ করতে পারে না। সে হিসাবে ধর্ষণ একভাবে ‘পৌরুষের বিচ্যুতি’। কিন্তু পুরুষ হয়ে ওঠা বা পৌরুষ বলতে যেসব আচরণগত বৈশিষ্ট্য ও কাঠামোগত নির্মাণ সমাজে চর্চিত, মূলত এসবই ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব তৈরি করে।

ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব তৈরি হয় নারীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। যেমন, বলা হয় পুরুষ হবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, গুরুগম্ভীর বা রাশভারী। নারী হবে সরল, কোমল, সাত চড়েও রা করবে না, হবে পুরুষের আজ্ঞাবহ। নারীর প্রতি সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে যৌনবস্তু ও ভোগের উপাদান হিসাবে দেখবার প্রণোদনা দেয়। পুরুষ চায় নারীর শরীর ও যৌনতার নিয়ন্ত্রক হতে। ফলে পুরুষ ঠিক করে দেয় নারী কী পোশাক পরবে, কার সাথে, কখন যৌন সম্পর্ক স্থাপন করবে, কখন মা হবে ইত্যাদি। একজন পুরুষ জন্মাবার পর থেকেই তার শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও সামাজিক আরোপণের মধ্য দিয়ে পুরুষ হয়ে ওঠে। এবং এক সময় এসবই তাকে ‘দুর্বল’ নারীর ওপর জোর ও যৌন আক্রমণ করতে উৎসাহিত করে।

অনেকে খেদ মেটাতে বলে থাকে, ধর্ষণকারীর মা-বোনকে ধর্ষণ করা হলে বুঝতে পারবে ধর্ষণ কতটা নৃশংস ঘটনা! এটিও ধর্ষণ সম্পর্কিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নির্মিতি, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রতিশোধ প্রবণতা, ধর্ষণাকাঙ্ক্ষা এবং ধর্ষণের অনুমোদন। এতে ধরেই নেওয়া হয় ধর্ষণ একপ্রকার শাস্তি, যে শাস্তি নারী একা ভোগ করে না বরং নারীর মাধ্যমে তার পরিবার ও সমাজও শাস্তি ভোগ করে। এই ধারণার পেছনে সূক্ষ্ম যে ভাবনাটি প্রোথিত আছে, তা হলো নারীর শরীরের সাথে পারিবারিক ও সামাজিক সম্মানের ধারণাকে যুক্ত করে দেখা।

আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধে ‘ভালো মেয়ে’-এর যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত, তাতে বিবাহ ও যৌনসম্পর্ক বিষয়ের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। যাতে বোঝানো হয়, যে মেয়ে বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে সে ‘খারাপ’। এটি আবার ভালো ও খারাপ বাবা-মার ধারণার সঙ্গেও যুক্ত। ফলে যে পরিবারের মেয়ে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিয়ে অবধি অপেক্ষা করে না, তার বাবা-মাও অভিযুক্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ বাবা-মার অনুশাসনের অভাব থাকে বলেই মেয়েরা এমন গর্হিত কাজ করতে পারে। ফলে বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে যৌনসম্পর্ক এবং ধর্ষণের ঘটনায় নারীর সাথে সাথে তার পরিবারের জন্যও অসম্মান, লজ্জা ও শাস্তি হিসাবে বিবেচিত হয়।

আরও একটি কথা আমরা প্রায়ই শুনি, বন্ধু বা প্রেমিকের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া মেয়েদের ধর্ষণ হওয়াই উচিত। অর্থাৎ নারী সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত ধারণা হলো- নারী তার নিজের দোষেই ধর্ষণের মুখোমুখি হয়। এটি ভিকটিম ব্লেইমিং। এক্ষেত্রে কখনও নারীর পোশাক, কখনও বিচরণের পরিধি, কখনও তার কাজের ধরণ ও পরিসর প্রভৃতিকে দায়ী করা হয় ধর্ষণের মুখোমুখি হওয়ার কারণ হিসাবে। এই ব্যাখ্যায় সমাজ নির্মিত অবয়বের বাইরে গেলেই নারীকে ধর্ষণ জায়েজ হয়ে যায়।

যৌনকর্মীকে ধর্ষণের ঘটনা তাই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় না আমাদের সমাজে। নিম্নবর্ণের নারী মানেই ‘সস্তা’। এরই ধারাবাহিকতায় আসে স্বামীহীন নারী। গ্রামাঞ্চলে যেমন বলে, ‘যে কারও স্ত্রী নয় সে আসলে সবার স্ত্রী’। অর্থাৎ স্বামীহীন নারী মানেই যেকোনো পুরুষ চাইলেই তাকে আয়ত্ত করতে সক্ষম।

একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সমাজে হাহুতাশ শুরু হয়, ‘আহারে মেয়েটার জীবন শেষ বা নষ্ট হয়ে গেল!’ লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এসব আহাজারি মূলত নারীর সম্মান ও গন্তব্যকে যথাক্রমে যৌনাঙ্গ ও বিয়ের সাথে সম্পর্কিত করে দেখার প্রবণতার ফল। কেননা ধর্ষণের মুখোমুখি নারীকে কেউ বিয়ে করবে না। কেননা পুরুষের চাই অক্ষত যোনী। যার যোনী অক্ষত নয় তার জীবনও নেই। তার মৃত্যুই শ্রেয়। তাই ধর্ষণের মুখোমুখি নারীর সামাজিক পুনর্বাসনের একটা উপায় বাতলে দেওয়া হয়, তা হলো ধর্ষকের সাথে বিয়ে। অর্থাৎ ধর্ষণের মাধ্যমে একজন নারীর যে ‘ইজ্জতহরণ’ বা মানহানি হয় ধর্ষককে বিয়ে করে তা পুষিয়ে নেওয়া।

ফলে সমাজে ধর্ষকের সামজিক রূপান্তরণ ঘটে ‘মেয়েজামাই’ হিসাবে। যে সমাজে বিয়ে ধর্ষণের একটা সুষ্ঠু সমাধান, সে-সমাজে বৈবাহিক ধর্ষণকে ধর্ষণ হিসাবে স্বীকৃতি অরণ্যে রোদন!

এছাড়া আমাদের সামাজিক চর্চার মাধ্যমেও বৈবাহিক ধর্ষণকে জারি রাখা হয়েছে। যেমন বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহের মাধ্যমে ১৮ বছরের আগে পরিবার ও সমাজের সম্মতিতে মেয়েদের যৌনসম্পর্কে যেতে বাধ্য করা যে এক ধরণের যৌন নির্যাতন, এ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের কোনো ধারণা নেই।

পরিবার ও সমাজের জ্ঞাতসারে নিকটাত্মীয়ের (মামা/চাচা/ফুপা/নানা/দাদা) দ্বারা যৌন হয়রানি বা ধর্ষণও তাই পার পেয়ে যায়। পারিবারিক সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে কন্যাশিশুর নিকটাত্মীয়ের দ্বারা যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্চ্য করা হয় না অথবা বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা পেতে দেওয়া হয়না, বরং এক ধরণের অস্বীকৃতিই প্রদান চলতে থাকে। যেমন, আমার ভাই/বাবা/চাচা/মামা এরকম করতে পারে না, মেয়ের বয়স কম, কী বুঝতে কী বুঝেছে। জানাজানি হলে পরিবারেরই অসম্মান, চুপ করে থাকো ইত্যাদি। লক্ষণীয় হলো বয়স্ক পুরুষ কমবয়সী মেয়েদের যৌন হয়রানি করে এটা জেনেই যে ক্ষমতার দাঁড়িপাল্লায় তার ওজন মেয়েটির তুলনায় অনেক বেশি।

শুরু করেছিলাম ক্ষমতার প্রসঙ্গ টেনে, শেষও করতে চাই এটি বলে যে ধর্ষণের মূলে রয়েছে ক্ষমতার সম্পর্ক। নারীকে যৌনবস্তুর বাইরে ভাবতে না পারা, অল্পবয়সী কন্যা ও ছেলেশিশুদের ধর্ষণ করা, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ এড়ানো কিংবা ধর্ষকের শাস্তি না হওয়া, আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে যাওয়া এসবই একটি ধর্ষণ সংঘঠনের ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসাবে কাজ করে।

শব্দ চয়নের ক্ষেত্রেও সাবধানী হতে হবে, কেননা শব্দ কেবল বর্ণের ব্যবহার নয় এটি মানসিকতা গড়ে তুলতে বিরাট ভূমিকা রাখে। ‘ধর্ষণের শিকার’ বলি আমরা কিন্তু সেটিও এক ধরণের লিঙ্গবাদী ধারণা থেকে উদ্ভূত যার অন্তর্নিহিত অর্থ হলো- ‘দুর্বল’ নারী ‘সবল’ পুরুষের আক্রমণের শিকার হয়েছে। নারীকে দুর্বল ও পুরুষকে শক্তিশালী করে দেখার এই ভাবনাই এতে করে পুনরুৎপাদিত হয়। পত্রপত্রিকায় লেখা হয়- ধর্ষণের ‘উৎসব’– এটিও একভাবে ধর্ষণকে উদযাপন হিসাবে দেখতে উৎসাহিত করে। ফলে ধর্ষণের যে সামগ্রিক পরিস্থিতি তাতে করে ‘বখাটে’দের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ধর্ষণের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই কারোরই। কেননা ধর্ষণ কেবল শারীরিক/যৌনতার ইস্যু নয়, এর শেকড় আরও বিস্তৃত- আমাদের মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলেই সযত্নে লালিত হয় ধর্ষকাম।

সাদিয়া আফরিন: নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক

এ বিভাগের আরো খবর