মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর বুধবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার সংক্রান্ত এক নির্দেশনা জারি করেছে। এতে তারা একটা দারুণ ভূমিকার অবতারণা করে বলেছে, ‘যুগোপযোগী ও আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার পাঠদান এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অনেক ভূমিকা পালন করা হয়।’ এটুকু পড়ে অনেকে অবাক হয়ে যেতে পারেন। এতে বলা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অনেক ভূমিকা পালন করে। তো, যে কোনো নীতি প্রণয়ন করতে গেলে বিতর্ক অবশ্যম্ভাবী। তাহলে স্বীকার করে নেওয়া হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক স্বাভাবিক। বিতর্ক মানে বিপরীত মত প্রকাশের সুযোগ থাকা। নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও ঘাটতি-দুর্বলতা নিয়ে তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়। এর মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ কাজটা হচ্ছে। এ পর্যন্ত আলোচনা করলে এত চমৎকার ও গণতান্ত্রিক একটি ফরমানের জন্য বিশ্ব দরবারে আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চা একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের জীবনের আনন্দগুলো বড়ই ক্ষণস্থায়ী। এই আনন্দ আতঙ্কে রূপ নেয় পরের ছয় দফা নির্দেশনা পড়লে। ‘ছাত্র শিক্ষকদের মাঝে সচেতনতা তৈরির জন্য নিম্নে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হলো’- এই বাক্যের পরে যে ছয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা যতটা না সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তার চেয়ে বহুগুণ সতর্কবার্তা প্রদানের, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। আক্কেলজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের জন্য নাকি ইশারাই যথেষ্ট!
এক নম্বর নির্দেশনায় যা বলা হয়েছে এরপর আর কোনো নির্দেশনারই প্রয়োজন ছিল না। সেখানে বলা হয়েছে- ‘সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।’ এই নির্দেশনা থেকে কি মনে হয় এটা শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো নির্দেশনা? রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত মহলের প্রতি তারা কি কোনো ভরসা রাখতে পারছে না? নাকি ফরমান জারির এক প্রচণ্ড আকুলতা কাজ করছে তাদের মধ্যে? আমাদের রাষ্ট্রকে একটা ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান ভেবে তারা কি খুব সাবধানে কথা বলতে বলছে, যাতে কোনোভাবেই ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়? পরের বাক্য আরও সতর্কবাণী দিচ্ছে- ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো সার্ভিস বা পেশাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এমন কোনো পোস্ট দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে’। বুঝে নিন এবার! দুর্নীতি করলে, ভুল সিদ্ধান্ত দিলে তার ব্যাপারে কিছু লিখলে যদি সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হেয় প্রতিপন্ন হন তাহলে কিন্তু বিপদ আছে।
দুই নম্বর নির্দেশনাটাও কম ভয়াবহ নয়। রাষ্ট্র কি ভয় পাচ্ছে যে ছাত্ররা এমন কিছু লিখতে পারে যা জাতীয়ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী? এর জন্য তো আইন আছেই। কিন্তু না, মাউশিকেও বলতে হলো- ‘জাতীয়ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী কোনো রকম তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে’। আচ্ছা, দেশে যে তিন ধারার শিক্ষা চালু আছে, তা কি জাতীয়ঐক্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? তাহলে শিক্ষার্থীর মনে যদি এই প্রশ্ন জাগে এবং সে যদি ফেসবুকে তা নিয়ে লেখে, তাহলে কি তার অপরাধ হবে?
উপরের ফরমানের সঙ্গে ‘কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে বা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিপন্থী কোনো তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করা যাবে না’- এই বাক্যটি পরস্পরবিরোধী হয়ে গেল না? ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও তো দেখি অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তখন কী হবে? ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বা আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে এমন কোনো পোস্ট, ছবি, অডিও, ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।’ এ কথা কে বলছে, কার উদ্দেশে বলছে! এটা দেখার দায়িত্ব কার? সংখ্যালঘুর ধর্মীয় অনুভূতি বলে কিছু নাই, সংখ্যাগুরুরা অনুভূতিতে আঘাত পান এবং আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে এটাই তো দেখে আসছে জনগণ। মিথ্যা প্রচারে আক্রান্ত হয়েছে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বহুবার। কোনো বিহিত হয়েছে? আবার নতুন ফরমান মাউশিকে দিতে হচ্ছে কেন?
তিন নম্বর নির্দেশনা নিয়ে কোনো কথা নেই। ব্রিটিশ, পাকিস্তান আমলেও এই কথা শুনতে হয়েছে, এ ধরণের আইনের প্রয়োগ দেখেছে মানুষ। ‘জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো বিষয় লেখা... তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে।’ অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাবের ব্যাখ্যা কী, তা নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে কথা বললে তা কতখানি প্রীতির সাথে ক্ষমতাসীনরা গ্রহণ করে তা তো আমরা জানি। আর এসব জেনে যদি কেউ বিক্ষুব্ধ হন, তাহলে কী হবে! আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন শাখা এসব নিয়ে ব্যস্ত আছে। তারপরও মাউশির এসব নির্দেশনা দেখে একটা কথাই মনে হয়, কার কাজ কে করে!
এর পর ছয় নম্বর নির্দেশনায় বলা হচ্ছে ‘অন্যথায় অ্যাডমিন ও পোস্ট দাতা উভয়েই সরকারি বিধি অনুযায়ী অভিযুক্ত হবেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’। শিক্ষকরা তো চাকরিবিধি অনুযায়ী একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছেনই, তাহলে এসব নির্দেশনা কথা কার উদ্দেশে বলা হচ্ছে? উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র যারা কেবল ভাবতে শিখছে, বুঝতে শিখছে- তাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে তুমি কতখানি শৃঙ্খলিত। সবশেষে বলা হয়েছে- ‘এমতাবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো ধরণের শৃঙ্খলাপরিপন্থী ও অপ্রীতিকর কার্যকলাপ যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো’। যাক! এখন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরাও পুলিশের দায়িত্ব পালন করবেন। এমনিতেই শিক্ষা দান করা ছাড়া সব কাজই তাদের করতে হতো, এখন সাইবার পুলিশের দায়িত্বও তারা পালন করবেন।
সীমিত গণতন্ত্র আর কর্তা ব্যক্তিদের অসীম ক্ষমতার এই দেশে এমনিতেই বাক স্বাধীনতা নানা আইন ও বিধি-নিষেধের বেড়াজালে আটকে আছে। নতুন নতুন আইন হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে ক্ষমতাসীনদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত হচ্ছে। এই ধারায় এই নির্দেশনা আরেক সংযোজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ঠিক আগে আগে তরুণদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তোমার স্বাধীনতার সীমা কতদূর। শাসকদের ইচ্ছা যতখানি, তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতাও ততখানি। ভাবমূর্তি রক্ষার নামে তোমার মনের ভাব শৃঙ্খলিত হবে, তুমি মূর্তির মতো নিশ্চল থাকতে শেখো। এর সাময়িক সুফল পাওয়া যাবে কিনা তা অনিশ্চিত কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী মানসিক পঙ্গুত্ব অবধারিত।
ময়লায় উপচেপড়া দুর্গন্ধময় ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যেতে নাকে হাত চলে আসে সবার। কিন্তু ময়লা পরিস্কার না করে নাক বন্ধ করাটা কোনো কার্যকর সমাধান নয়। রাষ্ট্র ও সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে ছাত্ররা কথা বলবে, লিখবে তবেই না পরিবর্তনের মনন গড়ে উঠবে! এই নির্দেশনা সেই মনন গড়ে তুলতে এক প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
যারা নিজেদেরকে শক্তিশালী বলে মনে করেন এবং প্রচার করতে ভালবাসেন তাদের মধ্যে অন্যের কষ্টের অর্জন ভোগ করা ও দুর্বলের ওপর শক্তি প্রয়োগ করার অসীম ক্ষমতা রয়েছে। তারা সকল ধরা-ছোঁয়ার উর্ধ্বে, অথচ তারাই সমালোচনায় শুধু বিরক্ত হন তাই নয় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। সমালোচনাকারীকে শাস্তি দিতে ব্যগ্র হয়ে পড়েন। প্রশ্ন ওঠে যদি তারা সঠিক এবং শক্তিশালীই হন তাহলে সমালোচনায় এত বিচলিত হন কেন? ফরমান জারি করে নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা তাদের তৈরি হলো কেন? তবে কি তারা ভয় পাচ্ছেন!
রাজেকুজ্জামান রতন: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাসদ এবং সম্পাদক, ভ্যানগার্ড