দেশরত্ন শেখ হাসিনা তৃতীয় বিশ্বের একজন মানবিক নেতা হিসেবে নিজেকে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করছেন। বিশ্বের অসহায়, অধিকার বঞ্চিত মানুষের তিনিই বিশ্বস্ত কণ্ঠস্বর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পর আর কোনো বাঙালি রাষ্ট্রপ্রধান এভাবে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু কন্যার সঠিক ও সময়োপযোগী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের গর্ব, অহংকার। তিনি নিজেকে অসহায়, বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বসভায় তুলে ধরেছেন।
কনোনা মহামারীর সময় মানুষ যখন কর্মহীন হয়ে পড়ে, একদিকে জীবন, অন্যদিকে জীবিকা। আমাদের প্রধানমন্ত্রীই বিশ্বে একমাত্র নেতা যিনি দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে শুরু থেকেই কাজ করেছেন। পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন। তিনি শুরু থেকেই বলেছেন, একটি লোককেও না খেয়ে থাকতে হবে না। যতদিন মানুষের সংকট থাকবে, ততদিন খাদ্য সহায়তা দেবে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর এমন সিন্ধান্তের ফলে খুব সফলভাবে খাদ্যসংকট মোকাবিলা করেছে সরকার, একটি লোকও না খেয়ে থাকেনি। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশকে নিয়ে সংশয়ে ছিল যে এত বিশাল জনসংখ্যা, স্বল্প আয়ের মানুষ নিয়ে কীভাবে শেখ হাসিনার সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে? কিন্তু শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দুর্দশিতার কারণে শুধু পরিস্থিতি উত্তরণ নয়, বিশ্বে করোনা মহামারী মোকাবিলায় রোল মডেলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। করোনা পরিস্থিতিতে একাধিক ভার্চুয়াল মিটিংয়ে একসঙ্গে কাজ করার জন্য বিশ্ব নেতাদের বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে লিখেছেন একাধিক নিবন্ধ। ভ্যাকসিন যেন প্রান্তিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠী পায়, সেজন্য তহবিল গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন। ভ্যাকসিন বৈষম্য যাতে না তৈরি হয় তা নিশ্চিত করতে বিশ্ব নেতাদের কাছে বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বে তিনিই প্রথম সরকারপ্রধান যিনি এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরছেন।
করোনা মহামারীর কারণে এবারের জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের এবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে স্বশরীরে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। সব রাষ্ট্রপ্রধানকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভার্চুয়াল অধিবেশনে অংশ নিতে হয়েছে। ভার্চুয়ালি হলেও সব রাষ্ট্রই অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছে। জাতিসংঘের ৭৫ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা এটাই প্রথম।
বিশ্বের সব মানুষের প্রধান চিন্তা এখন করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে। কবে, কখন ভ্যাকসিন আসবে। ভ্যাকসিন তৈরির পর কারা, কীভাবে তা পাবে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় আছে।
সঙ্গত কারণেই বিশ্বমানবতার কণ্ঠস্বর হয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির বিষয়ে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেছেন জাতিসংঘে। ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের বক্তব্যে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ভ্যাকসিনকে বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সব দেশ যাতে সময়মতো ও একই সঙ্গে পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কারিগরি জ্ঞান ও মেধাস্বত্ব দেওয় হলে এই ভ্যাকসিন বিপুল উৎপাদনের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিশ্বের ধনী দেশগুলো ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে তাতে সবার একসাথে ভ্যাকসিন পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সংশয় প্রকাশ করে সব দেশ যাতে সমভাবে ভ্যাকসিন পায় তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
মহামারী নিরসনে বাংলাদেশের উদ্যোগ এবং এজেন্ডা-২০৩০ অর্জনে কর্মপন্থাও তুলে ধরেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের প্রচেষ্টা সমানতালে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ভলান্টারি ন্যাশনাল রিভিউ রিপোর্ট উপস্থাপন প্রমাণ করে যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে আমরা যথাযথভাবে এগিয়ে চলেছি। বাংলাদেশকে আমরা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ এবং ২১০০ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ ব-দ্বীপে পরিণত করতে কাজ করে যাচ্ছি।’
স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল এবং সদ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আপদকালীন, উত্তরণকাল ও উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে বর্ধিত আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং প্রণোদনা প্যাকেজ নিশ্চিত করার ওপরও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বিশ্বকে করোনা মোবাবিলায় ঐক্যবন্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এটা কোনো একক দেশ বা অঞ্চলের সমস্যা নয়। এটা বৈশ্বিক সমস্যা, সকলকে এক সাথে লড়াই করে সংকট মোকাবিলা করতে হবে।
বিশ্বে দ্বিতীয় যে সমস্যা সবচেয়ে বেশি তা হলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির বিরূপ প্রভাব। বরাবরের মতো এবারও বিষয়টি বিশ্ব নেতাদের কাছে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর বিদ্যমান সমস্যাগুলো প্রতিনিয়ত প্রকট হচ্ছে। এই সংকটকালেও আমাদের বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। CVF I V-20 Group of Ministers of finance–Gi-এর সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু সমস্যা উত্তরণে একটি টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়নের নেতৃত্ব দেবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষায় তিনি ৫ দফা দাবি পেশ করেন। ১. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরও বাড়াতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অগ্রণী ভূমিকা প্রয়োজন। ২. বৈশ্বিক উষ্ণতা অবশ্যই এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। ৩. ভুক্তভোগী দেশগুলোর প্রতিশ্রুত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ৪. দূষণে দায়ী দেশগুলোর সংকট নিরসনে নিজস্ব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। ৫. জলবায়ু প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অধিবাসীদের পুনর্বাসন ইস্যুর কার্যকর সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে বাংলাদেশের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তিনি তুলে ধরে বলেন, পানি ব্যবস্থাপনাসহ জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদি অভিযোজন সামাল দিতে ডেলটা প্ল্যান- ২১০০ প্রণয়ন করা হয়েছে। বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আকস্মিকতা থেকে বাঁচতে দেশে চার হাজার দুইশ একানব্বইটি সাইক্লোন শেল্টার এবং পাঁচশ তেইশটি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণসহ সংকট মোকাবিলায় ছাপান্ন হাজার স্বেচ্ছাসেবীর সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকার কথা উল্লেখ করেন।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আবারও বিশ্ব নেতাদের স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ১১ লাখেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছে। তিন বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। এই সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি এবং এর সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ ব্যাপারে আরও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।’
মহামারীকালে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা,বিদ্বেষ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের মতো বিষয়গুলো যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেসব মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা বাহিনী বিভিন্ন দেশে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে তাদের সুরক্ষার জন্য শেখ হাসিনা বলেন, ‘শান্তিরক্ষী প্রেরণে বাংলাদেশে অবস্থান এখন শীর্ষে। সংঘাত প্রবণ দেশগুলোর শান্তি বজায় রাখতে আমাদের শান্তিরক্ষীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্যতম দায়িত্ব। এ বছর আমরা women, peace and security এজেন্ডার ২০ বছর পূর্তি উদযাপন করছি। এ পরিষদের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে আমরা শান্তি-নিরাপত্তায় নারীর ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করি। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে এ বিষয়ে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে।
শান্তির পথে অবিচল থেকে আমরা সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছি। মহামারীর ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতীয় উদ্যোগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত পৃথিবী বিনির্মাণে বৈশ্বিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি আমাদের সমর্থন অবিচল। সে বিবেচনা থেকে পরমাণু প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের বিষয়ে উন্নয়নশীল দেশসমূহের কার্যক্রমকে আমরা জোর সমর্থন জানাই।’
এছাড়াও সাধারণ পরিষদের সাইড লাইনের বৈঠকে ‘কোভিড-১৯ এর পরবর্তী সময়ে উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন' শীর্ষক একটি উচ্চপর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠকে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ছয় দফা প্রস্তাব ও জীববৈচিত্র রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর চার দফা প্রস্তাব বিশ্ব নেতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
জাতিসংঘকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতিসংঘকে দুর্বল করে এমন ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়। আমরা এটা পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে পেয়েছি। এজন্য তাদের কাছে আমরা ঋণী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদেরও জাতিসংঘকে একটি সত্যিকার অর্থে সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিক কার্যকরী সংস্থায় পরিণত করতে হবে’।
একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবারের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলেও অধিবেশনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে এটি ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৭তম ভাষণ। প্রতিটি ভাষণেই তিনি বিশ্বমানবতার কথা তুলে ধরেছেন। এবারের ভাষণেও তিনি বিশ্বমানবতার সংকট ও সমাধানের কথা তুলে ধরেছেন। শেখ হাসিনা এখন কেবল বাংলাদেশের নেতা নন তৃতীয় বিশ্বের একজন মানবতাবাদী নেতা হিসেবে বিশ্বনেতায় পরিণত হয়েছেন। তিনি এখন বিশ্বমঞ্চের একজন প্রভাবশালী নেতা। নানা কারণে বিশ্ব সম্প্রদায় শেখ হাসিনার কথার গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বিশ্বের অসহায়, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের তিনিই এখন বিশ্বস্ত কণ্ঠস্বর।
তাপস হালদার: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা
ই-মেইল: haldertapas80@gmail.com