বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘সম্মানবোধ’-এর ঘেরাটোপে নারীর বিপন্নতা

  • জিনাত আরা হক   
  • ৬ অক্টোবর, ২০২০ ১৭:৪৪

জেনেভা কনভেনশনে ধর্ষণকে নারীর সম্মানবোধের ওপর হামলা বলা হয়েছে। যদিও নারীবাদী বিশ্লেষণে তা প্রশ্নবোধক। কেননা সম্মানবোধকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নৃশংসতাকে গুরুত্বহীন করা হয়। নারীর যৌনাঙ্গকে নারীর বা পরিবার, এমনকি অনেক সময় রাষ্ট্রেরও সম্মানের সঙ্গেও যুক্ত করা হয় পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। তাই নারীকে শাস্তি দিতে হলে, অসম্মানিত করতে হলে, নারীর পরিবারকে সমাজচ্যুত করতে হলে ধর্ষণ পুরুষের মোক্ষম অস্ত্র, এমনকি হত্যাও না।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের একটি ভিডিও দেখে আমাদের সচেতন মন তো বটে, কিছুটা মানবিক মনও অস্থির হয়ে উঠেছে। আমরা নিপীড়ক, নোয়াখালীর প্রশাসন, সরকার- সবার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি। 

ঘটনাটি গত মাসের কিন্তু আমাদের কাছে এসেছে মাত্র দুই দিন হলো। তারমানে যদি কেউ এই ঘটনা ভিডিও না করতেন বা ভিডিওটি ভাইরাল না হতো তাহলে আমরা (সচেতন ও মানবিক মানুষ) ভাবতাম এমন নৃশংস ঘটনা বোধহয় কখনও ঘটে না বা ঘটেনি। 

তাহলে আসুন মনে করিয়ে দেই, যদিও ভিডিও নেই, ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর পার্বতীপুর উপজেলার জমিরহাট তকেয়া পাড়ায় পাঁচ বছরের পূজা রানী দাসকে ধর্ষণ করেন স্থানীয় যুবদল নেতা সাইফুল ইসলাম। অবাক হচ্ছেন যে, পাঁচ বছরের শিশুর যৌনাঙ্গই তো তৈরি হয়নি! ঠিক তাই, সে কারণে ব্লেড দিয়ে তার যৌনাঙ্গ চিড়ে দেয়া হয়। কেমন আছে পূজা? কেউ কি খবর নিয়েছি? ধর্ষক সাইফুলের কি বিচার হয়েছে? জানা নেই বোধহয় কারও!

শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে সংকলন করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, গত ৮ মাসে (জানুয়ারি থেকে আগস্ট ২০২০) ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৮৯ নারী। কিন্তু আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা বলে ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা পত্রিকায় প্রকাশিত সংখ্যার থেকে কয়েকগুণ বেশি।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের দিবাগত রাত ১১টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন, সোহেল, হানিফসহ বারো-তেরো জন নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ৩৫ বছরের পারুল আক্তারের স্বামী-ছেলে-মেয়েকে পিটিয়ে আহত করে বেঁধে রাখে এবং তাকে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে, সেখানে আরো পাঁচ জনের ধর্ষণের ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারি, যারা কেউই বিচারের জন্য যায়নি। এসব ধর্ষণের কারণ ছিল- রাস্তায় তাদেরকে দেখে নারীটির পরিবার সালাম দেয়নি কেন বা রাস্তার গাছ কাটার কথা মেম্বারকে বলল কেন!

ধর্ষণের শিকার নারী যখন বিচার চায় তখন সমাজ তার চরিত্র নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে, আইনেও তার সচ্চরিত্র প্রমাণ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আবশ্যক। বিচারক পর্যন্ত নারীদের বিপথগামী না হবার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়ে দিচ্ছেন। 

সমাজে নারীর চলাফেরা, পোশাক-আশাক, নারীর যৌনতা নিয়ন্ত্রণের জন্য তো সব চোখ শান দিয়ে তৈরি। জনপ্রিয় ওয়াজ থেকে পণ্যের বিজ্ঞাপন, বাড়ির ধর্মচর্চাকারী থেকে ক্ষমতাহীন সদস্য প্রত্যেকে- পরিবার থেকে রাষ্ট্র সবাই নারীর আচরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাই পরিবারের বয়সে ছোট সদস্যটিও নারীদের চলাফেরা/আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই নিয়ন্ত্রণ ঘরের গণ্ডি থেকে পাড়া বা এলাকা, এলাকা থেকে দেশ, দেশ থেকে ধর্মে গিয়ে ঠেকে। পুরুষের আধিপত্য ক্ষমতার এমন শীর্ষে পৌঁছেছে যে সে অপ্রতিরোধ্যভাবে সমাজে নিয়ম তৈরি করে, নিয়ম দেখভালের দায়িত্ব নেয়। আর ক্ষমতা প্রকাশে তার সহিংসতার সমর্থন সে নেয় রাষ্ট্র থেকে, ধর্ম থেকে, সামাজিক প্রথা থেকে, পুরুষালি প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো থেকে।

জেনেভা কনভেনশনে ধর্ষণকে নারীর সম্মানবোধের ওপর হামলা বলা হয়েছে। যদিও নারীবাদী বিশ্লেষণে তা প্রশ্নবোধক। কেননা সম্মানবোধকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নৃশংসতাকে গুরুত্বহীন করা হয়। নারীর যৌনাঙ্গকে নারীর বা পরিবার, এমনকি অনেক সময় রাষ্ট্রেরও সম্মানের সঙ্গেও যুক্ত করা হয় পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। তাই নারীকে শাস্তি দিতে হলে, অসম্মানিত করতে হলে, নারীর পরিবারকে সমাজচ্যুত করতে হলে ধর্ষণ পুরুষের মোক্ষম অস্ত্র, এমনকি হত্যাও না। 

পুরুষও তাই ধর্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তি নারী, নারীর পরিবার, নারী সমাজকে একটি বার্তা দিতে চায়। পরিষ্কার বার্তা- ‘পুরুষই নারীর যৌনাঙ্গের মালিক।’ কাজেই যারা মনে করে নারীর শরীরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধর্ষণ ঘটে, তারা মূলত ‘ধর্ষণের জন্য নারী দায়ী’ এই বক্তব্যটিকে জনপ্রিয় করতে চায়। বেগমগঞ্জে নির্যাতনের ভিডিওটি নৃশংসতার দলিল হিসেবে যতটা না বিস্তৃত হবে, তারচেয়ে বেশি উত্তেজক ভিডিও হিসেবে ছড়াবে সেটি।

যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন প্রতিনিয়ত তাদেরকেই ঘটনা লুকিয়ে রাখার চাপ নিতে হয়। যে ঘটনায় তিনি দায়ী নন, তাকেই ঘটনার সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং শারীরিক আঘাত বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। এবং আমরা হাস্যকরভাবে মুখ ঢেকে, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঝাপসা করে ঘটনার বর্ণনা দেই। নারীর শরীর নিয়ে যে জড়তা এই সমাজে, সে সমাজে ‘শরীরকে নষ্ট করার’ চেষ্টা চলবে সবসময়।

ধর্ষণের শিকার নারী বিচার চায় না কেন? আমরা কয়জন ছিনতাইয়ের বিচার চাই! কার কাছে বিচার চাইব! যখন ধর্ষক থানার ওসির সঙ্গে চা খায়, যখন পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ হয়- এলাকার এমপি বা জনপ্রতিনিধির পছন্দে এবং তার রেটটাও সবার জানা, তখন ক্ষমতাহীন নারী কোন সাহসে থানার দ্বারস্থ হবেন? বিচার মানে তো শুধু তিনটি অক্ষর না। থানা-পুলিশ, উকিল-মোক্তার, নিম্ন আদালত-উচ্চ আদালত, জজ-হাকিম- এ রকম কত-শত পথ পাড়ি দিতে হয় বিচার চাইতে। তদন্ত থেকে স্বাক্ষী, উকিল থেকে কোর্টের তারিখ প্রতিটি স্তরে টাকা, প্রভাবশালীর ফোন পার হয়ে ঠিকঠাক মতো রায় নিয়ে আসা দিল্লি-দূরঅস্ত! 

ধর্ষণের বিচার চাওয়ার কোনো জায়গা, কোনো প্রক্রিয়া, কোনো আইনি দলিল পরিচ্ছন্নভাবে এদেশে আছে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়নি। আঠারো-বিশ বছর পর ধর্ষণের বিচার দিয়ে নারী আদৌ কী লাভ করবে তা আমার বোধগম্য হয় না। এখন পর্যন্ত তো কুমিল্লার তনু হত্যার তদন্ত রিপোর্টটাই হাতে পাওয়া গেল না।

নারীর প্রতি অসম্মান, শারীরিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ (পশু সমাজে যা প্রচলিত) ও নারীকে প্রতিমুহূর্ত ভোগের বস্তু হিসেবে দেখার বিশ্বাস ও আচরণেই ধর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। তাই যে পুরুষ গোপনে বা প্রকাশ্যে নারীদের অসম্মান করে সে নিজের মধ্যে একটি ধর্ষকামী সত্তা ধারণ করে। সামাজিক সমর্থন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, আইনি দূর্বলতার সুযোগে পুরুষটি ক্রমাগত তার ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, নারীকে ধর্ষণ করে। স্ত্রীর সঙ্গে জোর করে যৌনসম্পর্ক যে ধর্ষণ, এই জানা যেমন জরুরি, তেমনি ধর্ষণ যে নৃশংসতর অপরাধ সেই সিদ্ধান্তও জরুরি। ধর্ষণ বন্ধে ধর্ষণের সঙ্গে নারীর ‘সম্মান’-এর ধারণাও বিযুক্ত করা প্রয়োজন।

তবে চলমান ফ্রাঙ্কেনস্টাইন প্রশাসনিক ব্যবস্থা দিয়ে এদেশে কখনও ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব না। রাজনৈতিক দলের কর্মীদের বহিষ্কার করে, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বদলি করে আর যাই হোক ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না। 

মুখের কথা না, যথার্থ অর্থেই নারীবান্ধব বিচার ব্যবস্থা আজ সময়ের দাবি। দরকার দক্ষ ও জেন্ডার সংবেদনশীল পুলিশ, চিকিৎসক। হঠাৎ একদিন মানববন্ধন নয়, দরকার নিয়মিত ফলোআপ, সচেতন এবং মানবিক মানুষের সংহতি। প্রতিবন্ধী নারী, আদিবাসী নারী, গার্মেন্টসে কর্মরত নারী, যৌনকর্মে যুক্ত নারী ধর্ষণের প্রতিবাদেও যখন আমরা একত্রে বিচার চাইতে পারব, তখন আমাদের আওয়াজ যথার্থ শক্তিশালী হবে।

 

জিনাত আরা হক: মানবাধিকারকর্মী, আমরাই পারি-এর নির্বাহী সমন্বয়কারী

এ বিভাগের আরো খবর