কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে বিস্ময়কর জয় পেয়েছে সৌদি আরব। এটি ছিল গ্রুপ সি-এর প্রথম ম্যাচ। একই সঙ্গে এটি ছিল মাঠের বাইরে একটি যুদ্ধের পটভূমি, যা আগামী বেশ কয়েক বছর ধরে চলবে।
সৌদি আরবের ভাবমূর্তি উন্নয়নের মিশনে আর্জেন্টাইন ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি যোগ দেন চলতি বছর। আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তির লক্ষ্য সৌদি পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন।
তবে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কোম্পানির মালিকানাধীন স্পোর্টস ওয়েবসাইট দ্য অ্যাথলেটিকের নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, রিয়াদের সঙ্গে মেসির গাঁটছড়া ২০৩০ সালে বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হতে সৌদি আরবের প্রচেষ্টাকে শক্তি জোগাবে। আর সে ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে পারে তার নিজের দেশ আর্জেন্টিনা। প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকের জন্য।
২০২৬ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে। এরপর ২০৩০ সালের আয়োজক দেশ ঠিক করতে চলতি বছরের জুনেই বিডিং উন্মুক্ত হয়েছে। আয়োজক দেশের নাম চূড়ান্ত হবে ২০২৪ সালে ফিফার ৭৪তম কংগ্রেসে।
এখন পর্যন্ত স্পেন, পর্তুগাল ও ইউক্রেনের যৌথ উদ্যোগের বিডিং নিশ্চিত হয়েছে। এ বছরের শুরুতেই দেশ তিনটি এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়। তবে আরও দুটি প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে জমা পড়ার কথা।
এর একটি হলো দক্ষিণ আমেরিকান দেশ আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে ও চিলির যৌথ উদ্যোগ। অন্যটি সৌদি আরব, মিশর ও গ্রিসের। একাধিক দেশের যৌথ আয়োজক হিসেবে বিডে অংশগ্রহণের ফলে ২০২৬ সাল থেকে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্ব ৪৮ দলের প্রতিযোগিতায় পরিণত হচ্ছে।
২০৩০ সালের জন্য দক্ষিণ আমেরিকান বিড খুব শক্ত প্রতিপক্ষ হবে বলে মনে করছেন এর কো-অর্ডিনেটর ফার্নান্দো মারিন। দ্য অ্যাথলেটিককে তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলটি অজস্র প্রতিভার জন্ম দিয়েছে, যারা সারা বিশ্বে সুপরিচিত। এ ছাড়া ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়। এর ১০০তম বার্ষিকীতে ২০৩০ সালে দক্ষিণ আমেরিকাই হবে বিশ্বকাপের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান।’
১৯৩০ সালে স্বাগতিক উরুগুয়ে ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে হারিয়ে টুর্নামেন্ট জিতেছিল।
দক্ষিণ আমেরিকার যৌথ বিডের বিষয়টি ২০১৭ সালে প্রথম জনসমক্ষে আসে, যখন বার্সেলোনার সতীর্থ উরুগুয়ের লুইস সুয়ারেজ এবং আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি তাদের দেশের পক্ষে প্রচারে যুক্ত হন। দুই দেশের মধ্যে একটি ম্যাচের আগে সুয়ারেজ যে জার্সি পরেন তার সামনে ২০ এবং মেসির জার্সিতে ৩০ সংখ্যাটি লেখা ছিল।
পরের বছর ফার্নান্দো মারিন বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘আমাদের প্রচেষ্টার সঙ্গে মেসি যোগ দেবেন এবং সুয়ারেজ তো অবশ্যই। আমরা তাকে (মেসি) আমাদের লক্ষ্য সম্পর্কে জানিয়েছি এবং তিনি মনে করেন এটা সম্ভব। তিনি আমাদের সাহায্য করতে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি অবশ্যই আমাদের জন্য বিশ্বকাপের পতাকাবাহী হবেন।’
তবে গত মে মাসে ঘটনার নতুন বাঁক তৈরি হয়। বর্তমানে এই গ্রহের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে বিখ্যাত ফুটবলার সৌদি আরবের প্রচারের দায়িত্ব নিতে একটি আকর্ষণীয় চুক্তিতে সই করেন।
প্রথম কথাটি হলো, চুক্তিটি হয়েছে সৌদির পর্যটন-সংক্রান্ত প্রচারের জন্য, ২০৩০ সালের বিশ্বকাপের বিডের প্রসঙ্গ সেখানে নেই।
তবে সৌদি আরবের জাতীয় লক্ষ্যগুলো দেশটির ‘ভিশন ২০৩০’-এর সঙ্গে যুক্ত। সরকারি ভাষ্যগুলোতে একে ‘সৌদি আরবকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করার একটি অনন্য রূপান্তরমূলক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের নীলনকশা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
তাই ২০৩০ সালের বিশ্বকাপের বিড সৌদি আরবের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে প্রবলভাবে যুক্ত বলে মনে হয় এবং পর্যটনের প্রচার সেই লক্ষ্যটি অর্জনে অনেকভাবে সাহায্য করবে।
অন্য উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম সম্পদ তহবিল- পিআইএফের মাধ্যমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব নিউকাসল ইউনাইটেডকে অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত, সেই সঙ্গে এলআইভি গলফ ব্রেকওয়ে ট্যুরকে সহায়তাদান। এ ছাড়া ১০ বছরের জন্য ফর্মুলা ওয়ান রেসের পৃষ্ঠপোষকতা এবং ২০১৯ সালে অ্যান্টনি জশুয়া এবং অ্যান্ডি রুইজের হেভিওয়েট বক্সিং আয়োজনের জন্য ৬৫ কোটি ডলারের চুক্তি।
সৌদিতে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কানাডার রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলেন ডেনিস হোরাক। তিনি বলেন, ‘বিনোদন ও ক্রীড়ায় এই বিপুল অংশগ্রহণ সৌদির ভিশন ২০৩০-এর একটি বড় অংশ। এলআইভি গলফ (সৌদি আরবের অর্থায়নে) এবং এখন এগুলোর সঙ্গে মেসির মতো তারকাদের উচ্চমূল্যে যুক্ত করার মাধ্যমে তারা বিষয়টিকে নতুন স্তরে নিয়ে যাওয়ার এবং আরও বৈশ্বিক করার চেষ্টা করছে। বিশ্বব্যাপী সৌদির সুনাম বাড়াতে হবে এবং এসবের মাধ্যমে দেশটি নিজেদের নতুন ব্র্যান্ড তৈরির চেষ্টা করছে।’
মেসির চুক্তির মেয়াদ এবং শর্ত কোনো পক্ষই প্রকাশ করেনি।
যুক্তরাজ্যের ডেইলি টেলিগ্রাফ আগে এক প্রতিবেদনে জানায়, ক্রিস্টিয়ানো রোনালডো সৌদি পর্যটনের প্রচারে কাজ করার জন্য প্রতিবছর ৫০ লাখ পাউন্ডের বেশি অর্থের একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই আলোচনায় যুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘনিষ্ঠ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
উপসাগরীয় অঞ্চলে রাষ্ট্রদূতদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র দ্য অ্যাথলেটিককে বলেছে, মেসির সঙ্গে সৌদির চুক্তিটির আর্থিক মূল্য রোনালদোকে দেয়া প্রস্তাবের চেয়ে ৫ গুণ বেশি হতে পারে।
সৌদি এজেন্সিগুলোর তৎপরতার বিভিন্ন উদাহরণ পর্যালোচনা করলে বিষয়টি আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। যেমন এলআইভি গলফ ট্যুরে টাইগার উডসকে ভেড়াতে ৭০-৮০ কোটি ডলারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, তবে তিনি সেটি প্রত্যাখ্যান করেন৷
মেসির প্রতিনিধিরা বলেছেন, গোপনীয়তার শর্তের কারণে তারা চুক্তির পরিসংখ্যানগত দিকগুলো প্রকাশ করতে পারবেন না। অন্যদিকে এ-সংক্রান্ত ই-মেইলের কোনো জবাব দেয়নি সৌদি সরকার।
I am pleased to welcome Lionel Messi to Saudi Arabia We are excited for you to explore the treasures of the Red Sea, the Jeddah Season and our ancient history.
— Ahmed Al Khateeb أحمد الخطيب (@AhmedAlKhateeb) May 9, 2022
This is not his first visit to the Kingdom and it will not be the last! @VisitSaudiNow pic.twitter.com/RDfxFIRjrt
মেসি গত মে মাসে লোহিত সাগরের তীরের রিসোর্ট শহর জেদ্দায় ভ্রমণের সময় প্রথমবার তাকে সৌদির পর্যটনদূত হিসেবে প্রচার করে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
কিং আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মেসিকে স্বাগত জানিয়ে সৌদি পর্যটনমন্ত্রী আহমেদ আল-খতিব এক টুইটে লেখেন, ‘সৌদি আরবে এটি তার প্রথম সফর নয় এবং এটি শেষও হবে না।’
পরে ইয়টে সূর্যাস্ত দেখার সময়কার নিজের একটি ছবি প্রকাশ করেন মেসি।
ইনস্টাগ্রামে ছবির শিরোনামে তিনি লেখেন, ‘লোহিত সাগরের বুকে #ভিজিটসৌদি’। ইনস্টাগ্রামে মেসির ফলোয়ারের সংখ্যা ৩৭ কোটি। পোস্টটিতে সৌদি পর্যটন কর্তৃপক্ষের সহায়ক সংস্থা ভিজিট সৌদির ‘পেইড পার্টনারশিপ’ লেবেল যুক্ত ছিল।
মেসি পরে সৌদির সহকারী পর্যটনমন্ত্রীর প্রিন্সেস হাইফা আল-সৌদের সঙ্গে পুরোনো জেদ্দা সফরে যোগ দেন।
প্রিন্সেস হাইফা পরে টুইটারে লেখেন, ‘এই শহরের অন্তর্নিহিত রূপ, ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের প্রতি তার (মেসি) মুগ্ধতা দেখে আমি আনন্দিত।’
ভিজিট সৌদির ওয়েবসাইটে এখন মেসির একটি ল্যান্ডিং পেজ রয়েছে। এর শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘লিওনেল মেসি চান আপনি নিজের ভেতরের রোমাঞ্চ-সন্ধানী সত্তাকে উন্মোচন করুন এবং অকল্পনীয় দিকগুলো উদ্ঘাটন করুন।
‘আপনি নতুন বা পুরোনো কিছু আবিষ্কার করতে অথবা শুধু নিজের ভেতরে নতুন কিছু জাগানো- যে উদ্দেশ্যেই ভ্রমণ করুন না কেন, সৌদি প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনাকে সন্তুষ্টি জোগাবে। তাহলে আর কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন? এখনই আপনার অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলুন।’
সৌদি আরবের প্রচারে মেসির এই অবস্থান ২০৩০ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনে তার নিজের দেশের প্রচেষ্টার সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ হতে পারে কি না, এমন প্রশ্নে মেসির সাপোর্ট টিম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। একইভাবে পর্যটন প্রচারের চুক্তির অংশ হিসেবে তিনি কতবার সৌদি সফরে যাবেন, সে বিষয়ে তথ্য দিতেও অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে।
আরও তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, তারা এমন একটি দেশের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের চেক নেয়ার বিষয়ে মেসির প্রস্তুতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি, যে দেশটির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগের মধ্যে আছে ভিন্নমতাবলম্বী ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগজি হত্যা, নারী অধিকারকর্মী ও এলজিবিটি গোষ্ঠী এবং ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) শাসনের বিরুদ্ধাচরণকারীদের ওপর ক্র্যাকডাউন।
মানবাধিকার সংস্থা ইউনিসেফ গত বছর জানায়, প্রতিবেশী ইয়েমেনে সংঘাতে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট জড়িয়ে পড়ার পর থেকে ১০ হাজারেরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে। মেসি ২০১০ সাল থেকে ইউনিসেফের একজন ‘শুভেচ্ছাদূত’।
মেসির প্রতিনিধিরা ইয়েমেন বিরোধের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি, একই সঙ্গে ইউনিসেফও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
মেসির অগণিত অংশীদারত্বের মধ্যে একটি হলো ফরাসি চ্যাম্পিয়ন প্যারিস সেন্ট-জার্মেইনের হয়ে খেলা, যেখানে তিনি ৩ কোটি ইউরোর বেশি আয় করেন। এটি কাতারের সঙ্গে যুক্ত একটি তহবিলের মালিকানাধীন ক্লাব, যে দেশটির বিরুদ্ধেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।
মেসি সম্প্রতি ক্রিপ্টো ফ্যান টোকেন ফার্ম সোসিওস-এর প্রচারের জন্য ২ লাখ ডলারের চুক্তি করেছেন, পাশাপাশি তিনি এনএফটিভিত্তিক গেম সোরারেও একজন বিজ্ঞাপনী মুখ। এ ছাড়া তিনি আডিডাস, পেপসি, বাডওয়াইজার, ওরেডু, প্রো অ্যাভ্যুলিউশন সকার, লুই ভ্যুইতন, ইসরায়েলি কোম্পানি ওরক্যাম, দ্য দুবাই এক্সপো-২০২০, তার নিজস্ব শো সার্ক দ্যু সোলেইল এবং চীনা দুগ্ধ কোম্পানি মেংনিউ-এর সঙ্গে স্পনসরশিপ চুক্তি করেছেন।
ফোর্বস ম্যাগাজিন গত মে মাসে যে অনুমান প্রকাশ করে সে অনুযায়ী, গত বছর মেসি ১২ কোটি ডলারের বেশি আয় করেছেন।
সৌদি নাগরিক খালিদ আল-জাবরির বোন সারা এবং ভাই ওমর বর্তমানে দেশটির একটি কারাগারে বন্দি। খালিদ আল-জাবরির বাবা সৌদি আরবের একজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
দ্য অ্যাথলেটিক-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে খালিদ অভিযোগ করেন, তার বাবা ড. সাদ আলজাবরির ওপর চাপ দেয়ার জন্য কারাবন্দি দুই ভাইবোনকে ‘দর-কষাকষির হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছে সৌদি সরকার।
খালিদ বলছেন, ‘সৌদি ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান দেশকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছেন এবং মেসির দূতের ভূমিকা এতে অবদান রাখছে।
‘মেডিক্যাল স্কুলে পড়ার সময় তাকে (মেসি) দেখতে আমরা একসঙ্গে জড়ো হতাম। তিনি বিশ্বে সুপরিচিত এটাই একমাত্র কারণ নয়, দেশের ভেতরেও সবাই তাকে ভালোবাসে। ফুটবলের ক্ষেত্রে তার অবস্থান ঈশ্বরের ঠিক পরেই। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা (সৌদি সরকার) সেই কেন্দ্রবিন্দুটিতে আঘাত করেছে।’
...
মেসি ২০১২ সালে প্রথম সৌদি আরব সফর করেন।
তার ফ্লাইট অবতরণের পর ভক্তদের হুড়োহুড়ি লেগে যায়। নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কঠোর। ভিড়ের চাপ সামলাতে ব্যতিব্যস্ত সশস্ত্র রক্ষীদের একজনের বন্দুকের নল ঘটনাক্রমে মেসির মুখের দিকে ঘুরে গিয়েছিল।
তারপর থেকে সম্পর্কটি ক্রমশ উষ্ণ হয়েছে। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন তুর্কি আল-শেখ নামের এক ব্যক্তি। তিনি সৌদি জেনারেল এন্টারটেইনমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যান। এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটানো।
বিশিষ্ট সৌদি রাজনীতিক ও স্প্যানিশ লা লিগা ফুটবল ক্লাব আলমেরিয়ার মালিক আল-শেখকে ২০২০ সালের মে মাসে অনলাইনে একটি শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান মেসি।
উপলক্ষটি ছিল সৌদি ফুটবল ক্লাব আল-নাসর এফসির সাবেক সভাপতি সৌদ আল-সুওয়াইলেমের বিপক্ষে একটি চ্যারিটি প্লেস্টেশন ফুটবল ম্যাচে আল-শেখের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
সৌদি আরবের অভাবী মানুষের জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে ম্যাচটি আয়োজন করা হয়। সেখানে মেসি ছাড়াও ডিয়েগো ম্যারাডোনা, সাবেক ব্রাজিল তারকা কাফু, রবার্তো কার্লোস এবং রোনালদিনহো, ইতালীয় ডিফেন্ডার লিওনার্দো বোনুচ্চিও শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। চার্লি শিনের মতো বিখ্যাত অভিনেতা এবং র্যাপার স্নুপ ডগও বার্তা দিয়েছিলেন।
A video of unstable #MBS aid @turki_alshikh breaking a TV with video game controller. This is how #Saudi Monarchy conducts its policy with support of unstable @SecPompeo pic.twitter.com/NI1w5TSu7t
— Ali AlAhmed (@AliAlAhmed_en) May 23, 2020
ওপরের ভিডিওতে টেলিভিশন উল্টে ফেলার দৃশ্য দেখলে আল-শেখ একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুর মতো আচরণ করছেন বলে ভ্রম হতে পারে। তবে সৌদি আরবের অনেক পর্যবেক্ষকের মতে তিনি দেশটির অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব।
সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী খাশোগজিকে ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমেরিকান গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুসারে ওই হত্যায় ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের অনুমোদন ছিল।
খাশোগজির মৃত্যুর আগে রেকর্ড করা একটি সাক্ষাৎকার পরে নিউজউইকে প্রকাশ হয়। সেখানে খাশোগজি বলেন, ‘তুর্কি আল-শেখ এবং সৌদ আল-কাহতানি ছাড়া মোহাম্মদ বিন সালমানের আর কোনো রাজনৈতিক উপদেষ্টা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরা গুণ্ডা প্রকৃতির। মানুষ তাদের ভয় পায়। তুর্কি আল-শেখ খেলাধুলার দায়িত্বে আছেন। গুজব রয়েছে খেলাধুলার পেছনে ব্যয় এবং তরুণদের এতে ব্যস্ত রাখতে তার হাতে কয়েক বিলিয়ন ডলার রয়েছে।’
মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য মিডিয়া অপারেশন এবং প্রচারের দায়িত্ব সামলাতেন সৌদ আল-কাহতানি। আমেরিকান গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তাকে খাশোগজি হত্যার চক্রান্তে যুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। তবে সৌদি আদালত ২০১৯ সালে তাকে এই অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়।
আল-শেখ ছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমানের সাবেক নিরাপত্তাকর্মী। ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে ধীরে ধীরে তার প্রচণ্ড বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার হাতে তুলে দেয়া হয় সৌদি স্পোর্টস কমিশন চালানোর দায়িত্ব।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মোহাম্মদ বিন সালমান তার ক্ষমতা সংহত করতে সৌদি আরবের শত শত ধনী ব্যবসায়ীকে রিটজ-কার্লটন হোটেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছিলেন। ওই সময়ে আল-শেখ অত্যন্ত তৎপর ভূমিকা পালন করেন। পরে ঘটনাটিকে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখানো হয়।
সৌদি স্পোর্টস কমিশন পরিচালনার সময় আল-শেখ ক্রীড়ায় অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহীদের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হন। তিনি ২০১৯ সালে সৌদিতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার একটি ম্যাচ আয়োজন করেন।
ওই ম্যাচের আগে তার ফুটবল ক্লাব আলমেরিয়া ভেন্যুর টানেলে মেসি ও আল-শেখের আলিঙ্গনের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘দুই সিংহ’।
মেসিও প্রকাশ্যে ৪০তম জন্মদিনে আল-শেখকে শুভেচ্ছা জানান। এর আগে তিনি আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের নিয়ে রিয়াদে তার বাড়িতে ঘুরতে যান।
জেনারেল এন্টারটেইনমেন্ট অথরিটির চেয়ারম্যান হিসেবে আল-শেখ ২০২২ সালের রিয়াদ সিজনের (একটি বিনোদন উৎসব) বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে মেসির ছবি ব্যবহার করেন। এসব বিলবোর্ড লন্ডন, দুবাই ও নিউকাসলে স্থাপন করা হয়।
পিএসজির জার্সি পরে রিয়াদ সিজনের প্রচার চালানোর একটি ভিডিওতেও দেখা যায় মেসিকে।
এটি বিশেষ এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। পিএসজির সঙ্গে যুক্ত দেশ কাতারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আল-শেখ কাতারের উপর সৌদি অবরোধের কেন্দ্রীয় শক্তির অংশ ছিলেন। এমনকি টুইটারে তিনি বলেছিলেন, কাতার নৈতিকতা লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে ফিফা বিশ্বকাপের আয়োজন ইংল্যান্ড বা যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নেয়া উচিত।
অবশ্য পিএসজির সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মেসির অন্য কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি করায় বাধা নেই। পাশাপাশি গত বছর থেকে সৌদি ও কাতারের সম্পর্কের শীতলতা কাটতে শুরু করেছে। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচের দিন রোববার ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর দুই পাশে বিন সালমান ও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে বসতে দেখা গেছে।
মানবাধিকার কর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে অটোয়ার বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় ২০১৮ সালে কানাডার রাষ্ট্রদূত হোরাক সৌদি আরব থেকে বহিষ্কৃত হন। তিনি তার মূল্যায়নে সৌদির নেতৃত্ব সম্পর্কে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দেন।
হোরাক বলেন, বিন সালমান সৌদির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে পশ্চিমা রাজনীতিকদের মনে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন। তবে খাশোগজির হত্যা, নারী অধিকার কর্মীদের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গীকে তার শাসনের বিরুদ্ধে নিয়ে যায়।
আল-শেখ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি তার প্রভাবের কথা শুনেছি। তাকে নিশ্চিতভাবে রাজকীয় ব্যবস্থায় মোহাম্মদ বিন সালমানের অতি ঘনিষ্ঠদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
‘তিনি (আল-শেখ) অবশ্যই ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত এবং মেসিকে যুক্ত করার বিষয়টি বিন সালমান অবশ্যই পছন্দ করবেন। তার (মোহাম্মদ বিন সালমান) চোখে বিশ্বে সৌদি আরবের অবস্থান উপলব্ধির আরেকটি সুযোগ ঘটাবে এই বিষয়টি। তিনি বুঝবেন সৌদি বিচ্ছিন্ন কোনো মরুরাজ্য নয়।
‘আন্তর্জাতিকভাবে মেসির যে প্রোফাইল রয়েছে, সেটি সৌদিকে স্বাভাবিকতার একটি বৃহত্তর অনুভূতি দেবে। তাই আমি মনে করি এ বিষয়টি ২০৩০ সালে তাদের বিশ্বকাপ বিডের ক্ষেত্রেও সহায়তা করবে।’
হোরাক বলেন, ‘খাশোগজি হত্যার কারণে মোহাম্মদ বিন সালমান ব্র্যান্ডটির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। একইসঙ্গে সৌদি আরবের ব্র্যান্ডও কলঙ্কিত হয়েছে। এমন অবস্থায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বের সেলিব্রিটিদের কাছে যত বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ তৈরি করা যাবে এবং সে অনুযায়ী সৌদি আরবের ব্র্যান্ডটিকে আবারও ঝকঝকে করে তোলা সম্ভব হবে।’
সৌদি কারাগারে বন্দি দুই স্বজনের ভাই খালিদ আল-জাবরি বলেন, ‘মেসির মতো খেলোয়াড়দের একটি দলের অংশ হিসেবে সৌদিতে খেলতে যাওয়া নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কারণ দেশের শাসকদের নৃশংসতার কারণ দেখিয়ে সৌদি ভক্তদের তাদের প্রিয় দলের খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। আমার সমস্যা হলো মেসি নিজেকে সৌদি স্পোর্টস ওয়াশিংয়ের হাতিয়ারে পরিণত করেছেন।
‘তিনি নিজেকে শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।’
...
এবারের বিশ্বকাপে গ্রুপ সি ম্যাচের আগে সোমবার সন্ধ্যায় দোহায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন মেসি। মাঠে যে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের হয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। আর প্রতিপক্ষ দেশটি ছিল তারা, যারা তাদের প্রচারে ব্যবহার করছে মেসির ছবি।
কাতারের টেলিভিশনে সম্প্রচার হচ্ছে সৌদি আরবে মেসির সফর নিয়ে তৈরি বিজ্ঞাপন।
সেই সংবাদ সম্মেলনে মেসির আগমনকে ওহ, আহা ধ্বনি এবং ফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলে স্বাগত জানানো হয়। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে কয়েকজন করতালি দিচ্ছিলেন।
ব্যস্ত ওই মিডিয়া সেশনে দ্য অ্যাথলেটিক কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি। মেসি এক ডজনেরও বেশি প্রশ্ন নিয়েছিলেন, তবে তার একটিও সৌদি আরবকে নিয়ে প্রচার চালানো বিষয়ক চুক্তি সংক্রান্ত ছিল না। দক্ষিণ আমেরিকান বা আরব মিডিয়া থেকে এসব প্রশ্ন করা হয়েছিল।
চলমান বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে রোববার সন্ধ্যায় ইনফান্তিনোর পাশে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের বসার দৃশ্য সৌদির সামনে আরও একবার আশা জাগিয়ে তুলেছে। এই জুটিকে গত সপ্তাহে জি টোয়েন্টি সম্মেলনে বালিতেও একসঙ্গে দেখা গেছে। এর আগেও তারা একসঙ্গে বক্সিং ম্যাচ দেখেছেন।
সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, ২০৩০ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য মিশর ও গ্রিসের সঙ্গে যৌথভাবে সৌদি আরবের বিডকে ফিফা গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করবে বলে রিয়াদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। সৌদিরা ২০৩০ সালের ওয়ার্ল্ড এক্সপোর আয়োজক দেশ হতেও একটি বিড জমা দিয়েছে, এটিও ভিশন ২০৩০ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ।
বিশিষ্ট আর্জেন্টাইন ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কথোপকথনে মেসিকে ঘিরে সমালোচনায় অস্বস্তি মৃদু আকারে হলেও বোঝা যায়।
বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হতে আর্জেন্টিনার আগ্রহের বিপরীতে প্রতিপক্ষের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলে মেসি সাহায্য করছেন, এটি অদ্ভুত লাগছে কিনা- এমন প্রশ্নে তার সাবেক আন্তর্জাতিক সতীর্থ ম্যাক্সি রদ্রিগেজ বলেন, ‘সত্যি বলতে কি এটা ঠিক, তবে… আপনি জানেন না শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে যাচ্ছে।
‘আপনি নিজ দেশে বিশ্বকাপ দেখতে চান, তবে এ জন্য অনেক কিছু করতে হবে। কারণ, বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়া সহজ নয়। টুর্নামেন্টের আয়োজক নির্বাচনের সময় কী ঘটছে আমরা দেখতে পাব। আর্জেন্টাইন হিসেবে আমরা আবারও আমাদের দেশে এই আয়োজন দেখতে চাই।’
দক্ষিণ আমেরিকার যৌথ বিডের কো-অর্ডিনেটর ফার্নান্দো মারিন বলেন, ‘মাঠে এবং মাঠের বাইরে মেসির এক অনন্য ক্ষমতা রয়েছে। তিনি একটি সুউচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছেন। মেসি নিজেই একটি ব্র্যান্ড এবং এটি খুব শক্তিশালী।
‘তিনি সমস্ত ফুটবলের জন্য একটি ব্র্যান্ড, কোনো দেশের নয়। তিনি ২০৩০ সালের জন্য দক্ষিণ আমেরিকান বিডের একটি মৌলিক অংশ হিসেবে থাকবেন।’
তবে একই সঙ্গে মেসিকে দক্ষিণ আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষার একটি মৌলিক অংশ হতেও দেখা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:ব্রাজিলের সাবেক আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলোয়াড় রবিনহোকে ধর্ষণের দায়ে গ্রেপ্তার করেছে ব্রাজিলের ফেডারেল পুলিশ।
ইতালিয়ান ক্লাব এসি মিলানে খেলাকালীন ২০১৩ সালে একটি নাইট ক্লাবে আলবেনিয়ান নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ইতালিতে রবিনহোকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল বলে জানায় বিবিসি।
ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৭ সালে রবিনহোকে ৯ বছরের কারাদণ্ড দেয় ইতালির আদালত। এরপর বৃহস্পতিবার নিজ শহর সান্তোসের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন ৪০ বছর বয়সী এ খেলোয়াড়।
ব্রাজিলের একটি আদালত বুধবার তাকে কারাগারের পাঠানোর আদেশ দেয়।
দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ২০২২ সালে ইতালির সর্বোচ্চ আদালত রবিনহোর শাস্তি বহাল রেখে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
ব্রাজিলের আইন অনুযায়ী, বিদেশে অপরাধ সংঘটিত করে কোনো নাগরিক দেশে ফিরলে বিদেশের বিচারিক কর্তৃপক্ষের কাছে অপরাধীকে হস্তান্তর করে না ব্রাজিল সরকার। রায়ের আগেই রবিনহো ইতালি ছাড়ায় ব্রাজিলেই শাস্তি কার্যকরের অনুরোধ জানায় দেশটির আদালত।
ব্রাজিলের বিচার ব্যবস্থার দ্বারা গৃহীত এ পদক্ষেপ স্থানীয় মিডিয়াতে অনেকের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, রবিনহো তার খ্যাতি এবং সম্পদের কারণে ন্যায়বিচার এড়িয়ে যাবেন।
তবে ম্যানচেস্টার সিটিতে দুই বছর কাটানো এ ফুটবলার বরাবরের মতো এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, নাইট ক্লাবের ঘটনাটি ওই নারীর ‘সম্মতিতে’ হয়েছিল।
আরও পড়ুন:মাত্র ২৫ বছর বয়সেই চলে গেলেন জাতীয় নারী দলের ফুটবলার রাজিয়া। বৃহস্পতিবার পুত্র সন্তান জন্ম দেয়ার পর সাতক্ষীরায় মারা গেছেন এই রাইট উইঙ্গার।
রাজিয়া সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ থানার মৌতলা ইউনিয়নের লক্ষ্মীনাথপুর গ্রামের নূর আলী সরদারের মেয়ে।
জাতীয় ও বয়সভিত্তিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খেলেছেন রাজিয়া। ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্টের চূড়ান্ত পর্বে খেলেন তিনি। ভুটানে ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৮ সাফে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে অংশ নেন রাজিয়া। এছাড়া ২০১৯ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফে জাতীয় দলে সাবিনা খাতুনদের সঙ্গেও খেলেছেন তিনি।
নারী ফুটবল লিগে খেলেছেন নাসরিন স্পোর্টিং ও এএফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জার্সিতে।
তার স্বামী ইয়াম রহমান জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রাজিয়ার মৃত্যু হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমি গাজীপুরে চাকরি করি। ইফতারির সময় বাসায় গিয়ে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু ফোনটা ওর ছোট ভাই রিসিভ করে বলে ব্যস্ত আছি। কেউ আমাকে জানায়নি যে ওর পেইন (প্রসব ব্যথা) উঠেছে। আসলে ওর প্রচুর রক্তক্ষরণে হয়েছে। অথচ কেউ বিষয়টাতে গুরুত্ব দেয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওরা আমাকে গত রাত ১১টার দিকে জানায়, ছেলে ও মা সুস্থ আছে। কিন্তু পরে ওর প্রচুর রক্ত ঝরেছে। অচেতন হয়ে ছিল অনেক সময়। ভোর বেলা হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা গেছে। আমি সিজার করাতে বলেছিলাম, কিন্তু ওরা শোনেনি।’
ইয়াম নিজেও ফুটবলার ছিলেন। খেলেছেন বসুন্ধরা কিংস অনূর্ধ্ব-১৮, সাইফ স্পোর্টিং যুব দলে। তৃতীয় বিভাগেও খেলেছেন। ভালোবেসে ৩ বছর আগে বিয়ে করেছিলেন রাজিয়াকে।
সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে লিগ পর্বে টানা জয়ের পর শিরোপাও জিতেছে বাংলাদেশের মেয়েরা।
রোববার কাঠমান্ডুর অদূরে ললিতপুরে আনফা একাডেমিতে ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। ১-১ সমতার পর টাইব্রেকারে ভারতকে ৩-২ গোলে হারান প্রীতিরা।
খেলার পঞ্চম মিনিটেই এগিয়ে যায়ং ভারত। দ্বিতীয়ার্ধে গিয়ে ম্যাচের ৭১ মিনিটে ফেরে সমতা। এরপর টাইব্রেকারে গোলকিপার ইয়ারজান বেগমের দক্ষতায় কাপ জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয় বাংলাদেশের।
এর আগে ৮ মার্চ লিগ পর্বের শেষ ম্যাচে ভুটানের বিপক্ষে দারুণ জয় পায় বাংলাদেশের মেয়েরা। নেপাল ও ভারতকে হারিয়ে আগেই ফাইনাল নিশ্চিত করা দল সেদিন ভুটানকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দেয়।
সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে লিগ পর্বে শেষ ম্যাচে ভুটানের বিপক্ষে দারুণ জয় পেয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা।
নেপাল ও ভারতকে হারিয়ে আগেই ফাইনাল নিশ্চিত করা বাংলাদেশ শুক্রবার নেপালের কাঠমান্ডুর চেসাল স্টেডিয়ামে ভুটানকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দেয়।
টানা তিন ম্যাচ জিতে শীর্ষে থেকে সাইফুল বারী টিটুর দল খেলার ১৩ মিনিটেই এগিয়ে যায়। এরপর একে একে ৬টি গোল। সুরভী আকন্দ পেয়েছেন জোড়া গোল। বাকি ৪টি গোল করেছেন ফাতেমা, ক্রানুচিং, সাথী মানদা ও থুইনুই মারমার।
আগামী রোববার কাঠমান্ডুর অদূরে ললিতপুরে আনফা একাডেমিতে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টে ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। লিগ পর্বে তাদের ৩-১ গোলে হারিয়েছিলেন প্রীতিরা।
সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে ২-০ গোলে হারিয়ে দারুণ সূচনা করেছে বাংলাদেশের নারীরা।
শুরু থেকেই দাপটের সঙ্গে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। সংঘবদ্ধ এক আক্রমণের প্রদর্শনীতে প্রথমার্ধের ২৪ মিনিটে বাংলাদেশ গোল পায়। সাথী মুন্ডার দারুণ এক মুভে থ্রু বল ঠেলে দেন প্রতিপক্ষের গোল বক্সের ভেতর। নেপালের গোলরক্ষক গোল বাঁচাতে পোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে এসেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি। বাংলাদেশের ফরোয়ার্ড সুরভী আকন্দ প্রীতি দ্রুতগতিতে বক্সে প্রবেশ করে প্লেসিংয়ে গোল করেন।
৫ মিনিট পর গোলের ব্যবধান দ্বিগুণ করেন প্রীতি নিজেই। বক্সের বাম দিকে দিয়ে আক্রমণে ছিলেন বাংলাদেশের আরেক খেলোয়ার আলফি। গোলরক্ষক তাকে থামাতে গিয়ে গিয়ে ফেলে দেন মাটিতে। ফলে পেনাল্টি পায় বাংলাদেশ। স্পট কিক থেকে বাংলাদেশকে ২-০ গোলের লিড এনে দেন প্রীতি। এভাবেই শেষ হয় প্রথমার্ধ।
বিরতির পর স্বাগতিক নেপাল ম্যাচে ফেরার চেষ্টা চালালেও বাংলাদেশের রক্ষণভাগ ভেদ করেতে পারেনি। বারবার তাদের আক্রমণ নস্যাৎ করে দিয়েছে বাংলাদেশের রক্ষণভাগ। খেলার ৬২ মিনিটের মাথায় আরিফার করা ক্রসে সুরভী প্রীতির প্লেসিং করা বল ফিরে আসে জালের পাশে লেগে। এরপর নির্ধারিত নব্বই মিনিটের খেলায় গোল পায়নি আর কোনো দল।
এবারের সাফ-১৬ টুর্নামেন্টে চারটি দল অংশ নিয়েছে। এক ম্যাচ শেষে সমান তিন পয়েন্ট করে অর্জন করেছে ভারত ও বাংলাদেশ। ৫ মার্চ বাংলাদেশের পরবর্তী ম্যাচ ভারতের বিপক্ষে।
নব্বই দশকের ফুটবলে ফিরে যেতে চান উল্লেখ করে ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়নে কাজ করে যাবেন।
তিনি বলেন, ‘আমার যতটুকু সাধ্য, আমি মেম্বার অফ পার্লামেন্ট হিসেবে শুধু আমার এলাকার ফুটবল না, বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়নে কাজ করব। যেভাবে কাজ করলে নব্বই দশকের ফুটবলে ফিরে যাওয়া যায়, যেখানে ফুটবল আমাদের ঐহিত্য ছিল। আমরা সেটাই করব।’
জামালপুর বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবদুল হাকিম স্টেডিয়ামে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
সুমন বলেন, ‘আমি ফুটবলের ব্যাপারে প্রতিবাদ করছি বহুদিন আগে থেকেই, প্রতিবাদ করতে করতেই আমি এখন মেম্বার অফ পার্লামেন্ট। আমি এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে কথা বলতে পারি। আমার একটা বিশ্বাস ফুটবলের এখন গণজাগরণ শুরু হয়েছে।’
ভারতের ফুটবলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেখেন, ইন্ডিয়া অনেক দূর এগিয়ে গেছে, এখন তারা মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। আর আমরা এখনও সাউথ এশিয়াতেই টিকতে পারি না।
‘যেহেতু আমাদের প্রথম প্রেম ফুটবল, এ ফুটবলের প্রেমটা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চাই। আমরা সবাই আবার মাঠে আসতে চাই।’
আরও পড়ুন:গায়ে রঙ-বেরঙের টি-শার্ট, মুখে ভুভুজেলা বাঁশির সুর। শত শত ফুটবল সমর্থক গলা ফাটাচ্ছেন এক নাগাড়ে, সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে হাততালি আর ড্রাম বাজানো তো আছেই। আর যাদের ঘিরে এত এত আবেগের বিস্ফোরণ টার্ফের সবুজ গালিচায়, তারা লড়ছেন বুক চিতিয়ে। এর মাঝে এক ঘণ্টার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে জয় তুলে নেয় এশিয়ান গ্রুপ ফুটবল দল।
এশিয়ান গ্রুপ স্পোর্টস কমপ্লেক্সের ফুটসাল টার্ফের বৃহস্পতিবার রাতের চিত্র এটি। এশিয়ান গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় হওয়া ‘করপোরেট ফুটসাল কাপ’ টুর্নামেন্টের ফাইনাল ছিল এদিন।
ফাইনালে ম্যাফ সুজ ফুটবল দলকে ৬-২ গোলের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে জয় পায় এশিয়ান গ্রুপ ফুটবল দল।
২৪ করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় এই করপোরেট টুর্নামেন্ট। আট গ্রুপে ২৪ করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ফুটবল দল অংশ নেয়। বৃহস্পতিবার ফাইনাল ম্যাচের মধ্যে দিয়ে পর্দা নামল এই টুর্নামেন্টের।
ফাইনাল ম্যাচ শেষে আয়োজন করা হয় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউর করিম চৌধুরী।
মেয়র তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘সুন্দর এই আয়োজনের জন্য এশিয়ান গ্রুপকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই খেলার মধ্যে দিয়ে এশিয়ান গ্রুপ প্রমাণ করেছে মাদক-মোবাইলের নেশা থেকে খেলার নেশায় ফিরিয়ে আনা যায়। এই প্রতিযোগিতা বারবার হোক, তরুণ সমাজও উদ্বুদ্ধ হোক। খেলায় যে উদ্দীপনা দেখছি যেন গণজোয়ার ফিরে আসছে।’
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘এতদিন টেলিভিশনে ফুটবল দেখেছি। আজকে প্রথম সামনে সামনে দেখলাম। সত্যি আমি আনন্দিত। ছেলেমেয়েরা মোবাইল-মাদক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা যদি ভালো সুযোগ পায় তাহলে তারা ভালোভাবে গড়ে উঠবে।
‘যে দেশ খেলাধুলায় উন্নত, সেই দেশ এগিয়েও। সেজন্য আমাদের খেলাধুলায় মনোনিবেশ করতে হবে। এশিয়ান গ্রুপকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্যে এশিয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ সালাম বলেন, ‘এশিয়ান গ্রুপ তরুণদের ভালো উদ্যোগের সঙ্গে, খেলাধুলার সঙ্গে সবসময় আছে। সামনের দিনগুলোতেও থাকবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- এশিয়ান গ্রুপের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিফ সালাম, পরিচালক ওয়াসিফ সালাম, তরুণ উদ্যোক্তা বোরহানুল হাসান চৌধুরী, তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চু, কাউন্সিলর মোরশেদুল আলম প্রমুখ।
মন্তব্য