ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নামে মধ্যরাতে বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের বাসা থেকে আধা বোতল মদ ও গাঁজা উদ্ধার এবং তাকে সাজা দেয়ার বিষয়টি পুরোপুরি সাজানো ছিল বলে উঠে এসেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্তে।
২০২০ সালের মার্চ মাসের আলোচিত ওই ঘটনায় কুড়িগ্রামের তৎকালীন সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমার বিরুদ্ধে করা বিভাগীয় মামলার তদন্তে ক্ষমতার অপব্যবহার করার বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে।
রিন্টু বিকাশ চাকমার বিরুদ্ধে করা বিভাগীয় মামলার তদন্ত প্রতিবদেনটি ২২ পৃষ্ঠার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ১৩ মার্চ রাতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের বাসা থেকে মাদকদ্রব্য উদ্ধারের অভিযোগে শাস্তি দেয়া হলেও তার বাসায় কোনো মাদকই পাওয়া যায়নি। বাসায় কোনো তল্লাশিই চালানো হয়নি, এমনকি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান বলা হলেও সেখানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তাই ছিলেন না।
ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা বলে সাংবাদিক আরিফুলকে তার বাসা থেকে বের করে নিয়ে আসেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সরকারী কমিশনার ও রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন।
ওই ঘটনায় দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনার মুখে সাংবাদিক আরিফুলকে মুক্তি দেয়া হয়। পরে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়। বিভাগীয় মামলার তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় দুই বছরের জন্য তার ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করা হয়েছে। সিনিয়র সহকারী কমিশনার নাজিম উদ্দিনকে পদাবনতি দেয়া হয়।
আর রিন্টু বিকাশ চাকমাকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। যদিও রিন্টু বিকাশ চাকমার বিষয়টির এখনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। তবে অন্যদের প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। তাদের মধ্যে এনডিসি এস এম রাহাতুল ইসলামকে বরিশাল ডিসি অফিসে পোস্টিং দেয়া হয়েছে।
রিন্টু বিকাশ চাকমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার তদন্তে গঠিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তিন সদস্যের কমিটির প্রধান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আমেনা বেগম। অপর দুই সদস্য হলেন উপসচিব মোহাম্মদ কামাল হোসেন ও উপসচিব পি কে এম এনামুল করিম।
এই কমিটি গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগে।
প্রতিবেদনের মতামত অংশে বলা হয়েছে, সাক্ষ্যপ্রমাণ, আইনকানুন ও বিধিবিধান পর্যালোচনায় তদন্ত বোর্ড এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে কুড়িগ্রামের সাবেক সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী বিধিমালা-২০১৮-এর-৩ (খ) বিধি মোতাবেক আনীত অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্ত কমিটি মামলায় সরকারপক্ষের ১১ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে। মামলায় একমাত্র বেসরকারি সাক্ষী সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যান।
তদন্ত বোর্ডের জিজ্ঞাসায় রিন্টু বিকাশ চাকমা বলেন, ২০২০ সালের ১৩ মার্চ শুক্রবার রাত আনুমানিক ১২টায় তিনি কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী ও আরডিসি নাজিম উদ্দিনের নির্দেশে জেলা প্রশাসনের সরকারী কমিশনার ও এনডিসি এস এম রাহাতুল ইসলাম, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বের হন।
রিন্টু বলেন, অভিযানে বের হওয়ার আগে আরডিসি নাজিমের নির্দেশেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের পেশকার সাইফুল ইসলামকে দিয়ে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের পেশকার জাহিদুল ইসলামকে ফোন করা হয়। তখন জাহিদুল জানান তিনি রংপুরে আছেন। অভিযানে আরিফুলের বাসায় তল্লাশি হতে দেখেননি বলে তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেছেন রিন্টু।
তিনি জানান, অভিযানের সময় সাংবাদিক আরিফুলের বাসায় প্রবেশ করেন আরডিসি নাজিম উদ্দিন। ওই সময় তিনি (রিন্টু) বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। নাজিম উদ্দিনের নির্দেশে সাংবাদিক আরিফুলকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে রাত ১২টা ৪০ মিনিটে ডিসি অফিসে নেয়া হয়। রাত ১টা ২০ মিনিটে আরডিসি নাজিম তাকে (রিন্টু) ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাজা পরোয়ানায় সই করতে বলেন।
রিন্টু বলেছেন, তিনি শুধু একজন প্রত্যক্ষকারী হিসেবে উপস্থিত থাকায় এবং প্রসিকিউশন কর্তৃপক্ষ অনুপস্থিত ছিল বিধায় আরডিসি নাজিমকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার অনুরোধ করেন। কিন্তু আরডিসি নাজিমের প্রচণ্ড চাপাচাপিতে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে একপর্যায়ে সাজা পরোয়ানায় সই করতে বাধ্য হন। রাত ১টা ৩০ মিনিটে নাজিম উদ্দিন জোরপূর্বক মোবাইল কোর্টের সাজা পরোয়ানায় তার (রিন্টু) সই করিয়ে নেন। এর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি জানতেন না যে, মোবাইল কোর্টের নথিপত্রে তাকেই সই করতে হবে।
তদন্ত বোর্ডকে রিন্টু বিকাশ চাকমা বলেন, তিনি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার উদ্দেশ্যে গেলে অবশ্যই বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে যেতেন। মোবাইল কোর্টের রিকুইজিশন ফরমে তিনি সই করলেও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় ও ফোর্সের সংখ্যা নির্ধারণ করেন আরডিসি নাজিম উদ্দিন। ফলে সব ঘটনাপ্রবাহে তার কোনো হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টুর দাবি, নাজিম উদ্দিন তৎকালীন জেলা প্রশাসন ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছিলেন ভেবে তিনি তার নির্দেশ পালন করেন। মোবাইল কোর্টের নথিতে উল্লিখিত দুজন সাক্ষীকে তিনি চেনেন না, এমনকি দেখেননি।
রিন্টু বলেন, অভিযানের ১৮ ঘণ্টা পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম প্রসিকিউশন রিপোর্টে সই করেন। এর দ্বারা ক্ষমতার অপব্যবহার ও অভিযানটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এ ঘটনায় সরকারপক্ষের আরেক সাক্ষী কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বেঞ্চ সহকারী সাইফুল ইসলাম।
সাইফুল ইসলাম তদন্ত বোর্ডকে বলেন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন তাকে ডেকে বলেন, রাতে মোবাইল কোর্ট করা হবে। এ জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমার স্বাক্ষরে পুলিশ ও আনসার চেয়ে পত্র দিতে নির্দেশ দেন নাজিম উদ্দিন। এ সময় আরডিসি নাজিমের সঙ্গে সহকারী কমিশনার রাহাতুল ইসলাম ও রিন্টু বিকাশ চাকমাও বসা ছিলেন।
সাইফুল ইসলাম তদন্ত কর্মকর্তাদের আরও বলেন, অভিযানের সময় নাজিম উদ্দিন সাংবাদিকের ঘরে প্রবেশ করেন এবং রিন্টু বিকাশ চাকমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে নাজিম উদ্দিন আরিফুলকে নিয়ে বের হয়ে আসেন। কিন্তু ওখানে কোনো তল্লাশি হয়নি এবং কোনো জব্দ তালিকাও করা হয়নি।
সাইফুল ইসলাম জবানবন্দিতে বলেন, সাংবাদিক আরিফুলকে নিয়ে আরডিসি নাজিম ডিসি অফিসের দোতলায় চলে যান। তিনি নিচতলার কোর্ট রুম খুলে বাকি লোকদের নিয়ে বসেন। কিছুক্ষণ পর আরডিসি নাজিম তাকে একটি প্লাস্টিকের বোতল ও কাগজে প্যাঁচানো কিছু জিনিস দিয়ে সাংবাদিক আরিফুলের কাছ থেকে মদ ও গাঁজা উদ্ধার হয়েছে মর্মে জব্দ তালিকা প্রস্তুতের নির্দেশ দেন।
নাজিম উদ্দিনের নির্দেশে তিনি জব্দ তালিকা ও সাজা পরোয়ানা প্রস্তুত করেন। এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা সাজা পরোয়ানায় সই করেন। রাতে নাজিম উদ্দিনের নির্দেশে তিনি আসামিকে জেলখানায় নিয়ে যান। পরদিন ২০২০ সালের ১৪ মার্চ নাজিম উদ্দিন দুজন লোককে তার কাছে পাঠান জব্দ তালিকায় সই নেয়ার জন্য। একই দিনে আরডিসি নাজিম উদ্দিন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শককে ডেকে এনে প্রসিকিউশন রিপোর্টে সই নেন।
বিভাগী মামলার আরেক সাক্ষী কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সুজাউদ্দৌলার জবানবন্দিও নিয়েছে তদন্তকারী দল।
সুজাউদ্দৌলা তার জবানবন্দিতে বলেন, ঘটনার রাতে এনডিসি রাহাতুল ইসলাম মোবাইল ফোনে তাকে জানান, রাতেই মাদকবিরোধী একটি বিশেষ টাস্কফোর্স পরিচালিত হবে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ বিষয়ে অবগত আছেন। পরবর্তী সময়ে রাহাতুল ইসলামের মোবাইল ফোন থেকে আসা এসএমএসের মাধ্যমে জানতে পারেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একজনকে এক বছরের সাজা দেয়া হয়েছে।
সুজাউদ্দৌলা বলেন, ‘রাহাতুল ইসলামের ফোন ও এসএমএস দেখে মনে হয়, এনডিসি রাহাতুল ইসলামই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন। কিন্তু পরদিন অফিসে এসে জানতে পারি, রিন্টু বিকাশ চাকমা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছিলেন।’
তখন তিনি নথিটি দেখছিলেন এবং তখন পর্যন্ত সাজা পরোয়ানা ছাড়া নথিতে আর কিছু ছিল না বলে দাবি করেছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুজাউদ্দৌলা।
কুড়িগ্রাম জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের সাবেক পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম তদন্ত কমিটির কাছে তার জবানবন্দি দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ২০২০ সালের ১৩ মার্চ রাতের অভিযানটি তার দপ্তরের রিকুইজিশনের পরিপ্রেক্ষিতে হয়নি। ১৪ মার্চ সকাল ১০টা ৪৯ মিনিটে পেশকার সাইফুল ইসলাম ও দুপুর ২টা ৫৩ মিনিটে এনডিসি রাহাতুল ইসলাম তাকে বারবার আসতে বললে বিকেল ৪টা ১১ মিনিটে তিনি কুড়িগ্রাম ডিসি অফিসে আসেন। তখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দিন ও এনডিসি রাহাতুল ইসলাম তাকে জানান যে, গত রাতে একটি মোবাইল কোর্ট হয়েছে এবং আসামিকে রাতেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
তাদের প্রস্তুতকৃত জব্দ তালিকায় সই করতে বললে তিনিসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কোনো স্টাফ অংশগ্রহণ করেননি বলে প্রসিকিউশন রিপোর্টে সই করতে অপারগতা জানান। এ সময় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুজাউদ্দৌলা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দিন তাকে ধমক দিয়ে প্রসিকিউশন রিপোর্ট ও জব্দ তালিকায় সই করতে বলেন। তাদের দ্বারা বাধ্য হয়ে তিনি একপর্যায়ে জব্দ তালিকায় সই করেন এবং প্রসিকিউশন রিপোর্ট দাখিল করেন।
এই তদন্ত কমিটির কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন ডিসি সুলতানা পারভীনও। এতে তিনি দাবি করেন, সেই রাতের মোবাইল কোর্টটি নির্ধারিত শিডিউলবহির্ভূত ছিল। এই কোর্ট পরিচালনার আগে তার অনুমতি নেয়া হয়নি। কুড়িগ্রামের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা এই মোবাইল পরিচালনা করেন। অপর দুই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দিন ও এস এম রাহাতুল ইসলাম এই মোবাইল কোর্টে উপস্থিতি ছিলেন মর্মে মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ মারফত জানতে পারেন।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী তিন কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব আমেনা বেগম, উপসচিব মোহাম্মদ কামাল হোসেন ও উপসচিব পি কে এম এনামুল করিম তাদের সাক্ষ্য পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করেছেন।
এতে তারা বলেছেন, ‘মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯-এর ৭(১) ও ৭(২) ধারার বিধানমতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার সময় কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গৃহীত হওয়ার পরপরই মোবাইল কোর্ট পরিচালনকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট লিখিত অভিযোগ গঠন করে আসামিকে পড়ে শোনাবেন এবং অভিযোগ স্বীকার করেন কি না, তা জানতে চাইবেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি তার অভিযোগ স্বীকার করলে তার স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করে তাতে তার স্বাক্ষর নিয়ে দুজন উপস্থিত সাক্ষীর স্বাক্ষর গ্রহণপূর্বক যথোপযুক্ত দণ্ড প্রদান করবেন ও উক্ত আদেশে সই করবেন।
‘কিন্তু নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা পরিচালিত মোবাইল কোর্টে আসামির অপরাধ তাৎক্ষণিক আমলে গ্রহণ না করে তাকে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে নিয়ে তার বিরুদ্ধে লিখিত কোনো অভিযোগ গঠন না করে, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়ে এবং উপস্থিত কোনো সাক্ষীর স্বাক্ষর না নিয়ে আসামিকে দণ্ড প্রদান করা হয়েছে, যা মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯-এর ৬(১), ৭(১) ও ৭(২) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তা ছাড়া প্রসিকিউশন পক্ষের অনুপস্থিতিতে আসামির বাসায় কোনোরূপ তল্লাশি পরিচালনা কিংবা জব্দ তালিকা প্রস্তুত না করে আসামির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ গঠন ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কিসের ভিত্তিতে রিন্টু বিকাশ চাকমা সাজা পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেছেন, তদন্ত বোর্ডের এ প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।’
সাক্ষ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, অভিযুক্ত কর্মকর্তা রিন্টু বিকাশ চাকমা সঙ্গীয় অপর দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ধৃত ও দণ্ডিত আসামি আরিফুল ইসলামকে ঘটনার রাতে কুড়িগ্রাম জেলা কারাগারে স্থানান্তর করতে যান এবং জেল সুপারের অফিস কক্ষে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মচারী ও মামলার সাক্ষী সাইফুল ইসলাম, সাফিয়ার রহমান ও মোবাইল কার্ট পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমার সাক্ষ্য দ্বারা বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত।
‘কারাগার একটি নিরাপত্তাবেষ্টিত সংরক্ষিত এলাকা এবং অনুমোদিত ব্যতীত মধ্যরাতে এখানে অন্য কারো প্রবেশের সুযোগ নেই। অভিযুক্ত কর্মকর্তার সঙ্গীয় নাজিম উদ্দিন জেল সুপারের দায়িত্বে ছিলেন বিধায় তার ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে মধ্যরাতে লোকজনসহ কারাগারে প্রবেশ করেছেন এবং অবস্থান করেছেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘উপরিউক্ত সাক্ষ্য পর্যালোচনা ও সরকারপক্ষের দাখিলকৃত দালিলিক প্রমাণ বিশ্লেষণে এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, ২০২০ সালের ১৩ মার্চ দিবাগত রাতে অভিযুক্ত কর্মকর্তা রিন্টু বিকাশ চাকমা কর্তৃক পরিচালিত মোবাইল কোর্টে তিনি ছাড়াও কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের আরও দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দিন ও এস এম রাহাতুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
‘আসামির বাসায় কোনো তল্লাশি না হওয়া সত্ত্বেও এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কোনো প্রতিনিধি (প্রসিকিউশন পক্ষ) উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও আধা বোতল মদ ও দেড় শ গ্রাম গাঁজা উদ্ধারের দাবি করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু কুমার চাকমা কর্তৃক পরিচালিত মোবাইল কোর্ট।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘এতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮-এর ১০(১) চ ধারার অপরাধে আসামিকে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়। যা রিন্টু বিকাশ চাকমা ও তার সঙ্গীয় ম্যাজিস্ট্রেটগণের ক্ষমতার অপব্যবহার। এর ফলে প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে তদন্ত বোর্ডের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে।’
আরও পড়ুন:সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা থেকে বিশেষ একটা খাবারের খোঁজে নগরের চাঁদনীঘাট এলাকায় এসেছেন বদরুল আলম। তার চাচি যুক্তরাজ্যে থাকেন।
চাচিকে যুক্তরাজ্যে বিশেষ খাবারটি পাঠাবেন বদরুল। এটি আবার চাঁদনীঘাট এলাকা ছাড়া তেমন কোথাও পাওয়া যায় না। তাই বিয়ানীবাজার থেকে প্রায় ৫২ কিলোমিটার দূরে এসেছেন তিনি।
শুনে আশ্চর্য লাগবে, বিশেষ খাবারটি মাটি দিয়ে তৈরি। বিস্কুটের আদলে তৈরি বলে একে ‘মাটির বিস্কুট’ বলে থাকেন অনেকে, তবে সিলেটে খাবারটি ‘ছিকর’ নামে পারিচিত।
বিস্কুটের মতো কামড়ে কামড়ে খাওয়া হয় ছিকর। সিলেট অঞ্চলে ছিকর খাওয়ার প্রচলন অনেক দিনের।
চাঁদনী ঘাট এলাকায় বুধবার বিকেলে কথা হয় বদরুল আলমের সঙ্গে, যিনি বলেন, ‘আমার চাচি লন্ডন থাকেন। সেখান থেকে চাচি অনেকদিন থেকে ছিকর পাঠাতে বলছেন। তাই এটি এখানে কিনতে এলাম।
‘এক কেজি কিনেছি। আগামী সপ্তাহে এক আত্মীয় লন্ডন যাবেন। তার সাথে এগুলো পাঠিয়ে দেব।’
সুরমা নদীর তীরঘেঁষা চাঁদনীঘাট এলাকায় পাশপাশি সিলেটের কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। কিন ব্রিজ, আলী আমজদের ঘড়ি, সারদা হলের অবস্থান এখানেই।
সারদা হলের সামনের ফুটপাতে মাটির জিনিসপত্র বিক্রি করেন চার থেকে পাঁচজন বিক্রেতা। তাদের সবার কাছেই পাওয়া যায় এ মাটির বিস্কুট।
বিক্রেতারা জানান, তাদের মূল ক্রেতা নারীরা। বিশেষত গর্ভবতী নারীরা ছিকর খেয়ে থাকেন, তবে দেশের চেয়ে বিদেশে বসবাসরত সিলেটের লোকজনই এটির প্রধান ক্রেতা। সিলেট থেকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে যায় এ বিস্কুট।
ছিকর কী
ছিকর হচ্ছে পাহাড়ের এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি এক প্রকার পোড়ামাটির বিস্কুট।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ছিকর তৈরি প্রথম শুরু হয় হবিগঞ্জে। এরপর এটি সিলেটসহ আশপাশের জেলার ছড়িয়ে পড়ে।
ছিকর শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ ‘ছিয়া’ তথা কালো এবং ‘কর’ (মাটি) থেকে। ছিয়াকর শব্দটিই পরে ছিকর হিসেবে পরিচিতি পায়।
ছিকর কেন খাওয়া হয়
চিকর কেন খাওয়া হয় এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে একেকজন একেক তথ্য দিয়েছেন।
সিলেটের প্রবীণ ও মধ্যবয়সী কয়েকজন নারী ও পুরুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, আগে দরিদ্র লোকজন খাবারের বিকল্প হিসেবে পাহাড়ের মাটি পুড়িয়ে তৈরি এ বিস্কুট খেতেন। ছিকরে অনেক খনিজ উপাদান রয়েছে এবং রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে এটি কার্যকর ও শক্তিবর্ধক বলেও জানিয়েছেন তাদের কয়েকজন। তাই খনিজ উপাদানের ঘাটতি কাটাতে গ্রামীণ নারীরা গর্ভাবস্থায় ছিকর খেয়ে থাকেন। এ ছাড়া পান-তামাকের মতো দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশতও অনেক প্রবীণ নারী ও পুরুষ ছিকর খেয়ে থাকেন।
নগরের মদিনা মার্কেট এলাকার গৃহিনী লাইলী বেগম পাঁচ বছর আগে সন্তানের জন্ম দেন। গর্ভবতী অবস্থায় তিনি এই ‘মাটির বিস্কুট’ খেয়েছেন।
কেন খেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গর্ভবতী অবস্থায় এটি খাওয়ার ইচ্ছা হয়। তা ছাড়া মুরব্বিরাও খেতে বলেন। তাই খেয়েছি। তবে এতে কোনো উপকার হয়েছে কি না জানি না।’
স্ত্রী লাইলী বেগমের সঙ্গে তখন তার স্বামী মুরাদ আহমদও ছিকর খেয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘এটি খেতে মজাই লাগে। মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ। তাই একবার খেলে আবার খাওয়ার ইচ্ছা জাগে।’
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার রাখালগঞ্জ এলাকার প্রায় ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধা রেখা রানী দাস বলেন, ‘ছিকর শক্তি বাড়ায় ও রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে বলে শুনেছি। আগে তো মানুষজন তেমন ওষুধপত্র খেত না। ডাক্তারের কাছে যাওয়া বা ওষুধ খাওয়ার সামর্থ্যও তখন ছিল না।
‘সে সময় মানুষজন ছিকর খেত। বিশেষ করে প্রায় সব গর্ভবতী নারী এটি খেতেন, তবে এখন ছিকর খাওয়া অনেক কমে গেছে।’
এ জিনিস কেন খাওয়া হয়, তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি চাঁদনীঘাট এলাকার কোন বিক্রেতাই। প্রায় ২০ বছর ধরে এ এলাকায় মাটির জিনিসপত্র ও ছিকর বিক্রি করেন শহিদ আহমদ।
তিনি বলেন, ‘অনেকেই এটি কিনে নেয়, তবে কেন খায় জানি না। শুনেছি এটি খেলে শক্তি বাড়ে ও খাওয়ার রুচি বাড়ে।
‘এ ছাড়া আয়রন ট্যাবলেটের বিকল্প হিসেবেও ছিকর খাওয়া হয়। তাই গর্ভবতী নারীরা এটি বেশি খায়।’
তিনি বলেন, ‘যারা রক্ত বিক্রি করে তাদের অনেকেও ছিকর কিনে খায়।’
এ ব্যাপারে সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, ‘ছিকরের কোনো উপকারিতা আছে বলে আমার জানা নেই। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিতও নয়।’
তিনি বলেন, ‘গর্ভবতী অবস্থায় নারীদের ক্যালসিয়াম ও আয়রনের সাপ্লিমেন্টারি দেয়া হয়, কিন্তু মাটির মধ্যে এই দুই উপাদান নেই। বরং এর মাঝে অনেক ক্ষতিকারক ব্যকটেরিয়া থাকতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর বা ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া কোনো কিছু খাওয়াই ঠিক নয়।’
কোথায় ও কীভাবে তৈরি হয় ‘মাটির বিস্কুট’
সিলেটের লালাবাজারের সনাতন পাড়ার সজিব মালাকার প্রায় ৪৫ বছর ধরে ছিকর তৈরি করেন। তার বাবা এবং দাদাও এই কাজ করতেন।
ছিকরের প্রস্তুতপ্রণালী সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পাহাড়-টিলার তলদেশের এঁটেল মাটি দিয়ে ছিকর তৈরি করা হয়। প্রথমে গর্ত খুঁড়ে পাহাড়ের তলা থেকে লম্বা বাঁশ দিয়ে মিহি মাটি সংগ্রহ করা হয়। এগুলো সারা রাত ভিজিয়ে রেখে নরম করা হয়। তারপর তা মাখিয়ে খাই বানিয়ে মন্ড তৈরি করা হয়।
‘পরে এগুলো কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করা হয়। এরপর চাকু দিয়ে বিস্কুটের মতো ছোট ছোট করে টুকরা করা হয়। এরপর কাঁচা ছিকরগুলো রোদে দুই-এক দিন শুকানোর পর মাটির চুলায় এগুলো পোড়ানো হয়। ঘণ্টা দুয়েক পর ছিকর কালচে বর্ণ ধারণ করে সুঘ্রাণ ছড়াতে থাকে। এতে গোলাপজলসহ বিভিন্ন সুগন্ধি মেশানো হয়।’
তিনি বলেন, দেশের চেয়ে বিদেশে এটি বেশি বিক্রি হয়। লন্ডনের ক্রেতারা এটি সবচেয়ে বেশি কিনে নেন।
ছিকর এক ধরনের নেশাজাতীয় খাবার উল্লেখ করে সজিব বলেন, ‘সিগারেটের মতো এটিও এক ধরনের নেশাজাতীয় খাবার। দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে অনেকে এটি খান। সবচেয়ে বেশি খান নারীরা।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটের লালাবাজার ও গোয়ালাবাজার, সুনামগঞ্জের ছাতক, হবিগঞ্জের বানিয়াচং, বাহুবল ও মাধবপুর এবং মৌলভীবাজারের কয়েকটি এলাকায় ছিকর তৈরি করা হয়। এসব এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোক বংশ পরম্পরায় ছিকর তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত, তবে এখন বিক্রি কমে যাওয়ায় বেশির ভাগই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
মৌলভীবাজারের জগৎসী এলাকার ব্যবসায়ী বিষ্ণপদ দে বলেন, ‘আগে শহরের পাশের শব্দকর ও কুমার সম্পদায়ের লোকজন ছিকর তৈরি করতেন। আমাদের ছোটবেলায় ওই সম্প্রদায়ের নারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছিকর বিক্রি করতেন, তবে এখন আর কেউ বাড়িতে গিয়ে ফেরি করে ছিকর বিক্রি করে না।’
কেমন ব্যবসা
চাঁদনীঘাট এলাকার ছিকর বিক্রেতা শহিদ আহমদ জানান, প্রতি কেজি ছিকর ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করেন তিনি।
প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ কেজি ছিকর বিক্রি করেন বলে জানান তিনি।
শহিদ আহমদ বলেন, ‘প্রবাসীদের আত্মীয়-স্বজনই বেশির ভাগ ক্রেতা। তারা এগুলো কিনে প্রবাসে তাদের আত্মীয়দের কাছে পাঠান। আবার অনেকে আমাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানিও করেন।
‘রপ্তানির জন্য আমরা বিশেষভাবে তৈরি ছিকর দিয়ে থাকি। এগুলোর দাম একটু বেশি হয়।’
শহিদ আমাদের পাশেরই আরেক বিক্রেতা আল কাইয়ুম রনি বলেন, ‘এখন ছিকরের বিক্রি একেবারে কমে গেছে। বয়স্ক মানুষরা এটি কিছু কিনে নেন, তবে কম বয়সীরা এসব প্রায় কিনেনই না। এখন প্রতিদিন ৪/৫ কেজি ছিকর বিক্রি করি।’
লালাবাজারের ছিকরের কারিগর সজিব মালাকার বলেন, ‘আমরা পাইকারি দরে প্রতি কেজি ছিকর ৪০/৫০ টাকা করে বিক্রি করি।
‘আবার বিদেশে পাঠানোর জন্য তৈরি ছিকর প্রতি কেজি ৮০/৯০ টাকায় বিক্রি করি।’
আরও পড়ুন:হাতে নিয়ে চাপ দিলেই ভেঙে গুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বলভদ্রপুর, কালিখোলা-বালিয়াডাঙ্গা সড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত ইটের খোয়া।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিজি বাংলার হয়ে স্থানীয় সাবেক এক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নিম্নমানের এ খোয়া সরবরাহ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিষয়টি টের পেয়ে প্রতিবাদ করলে ওই ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের মারধরের শিকার হতে হয়েছে। এমন অবস্থায় তাদের (স্থানীয়) তীব্র প্রতিবাদে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবি, স্থানীয় বিএনপি নেতা ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বাবুল শেখ এ খোয়া সরবরাহ করেন।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সড়কের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী মো. মোরশেদ বলেন, ‘সরবরাহকারী বাবুল শেখ ভালো খোয়া দেখিয়ে আমাদের নিম্নমানের খোয়া দিয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা খোয়া অপসারণ শুরু করেছি।
‘ভালো মানের নির্মাণসামগ্রী দিয়েই কাজ করা হবে।’
জায়েদ শেখ নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘খোয়া এত পচা যে, চাপ দিলেই ভেঙে যায়। রাবিশ খোয়া দিয়ে রাস্তা করা যাবে না এটা বললে খোয়া সরবরাহকারী মাহবুবুল হক বাবুল ওরফে বাবুল মেম্বর আমাকে ও আমার ছোট ভাইকে মারধর করে। আমরা তার বিচার চাই।’
স্থানীয় সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হেমায়েত শেখ বলেন, ‘সড়কটি নির্মাণের শুরু থেকেই মাহবুবুল হক বাবুল শেখ নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি নানা জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এখন নিম্নমানের খোয়া দিয়ে রাস্তা করার চেষ্টা করছে।
‘লোকজন বাধা দিলে বিএনপি নেতা পরিচয় দিয়ে তাদের মারধর করে এবং ভয়ভীতি দেখায়। বিএনপি-আওয়ামী লীগ বুঝি না। আমাদের দাবি একটাই–রাস্তা নির্মাণ হবে ভাল খোয়া দিয়ে।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য খোয়া সরবরাহকারী মাহবুবুল হক বাবুল ওরফে বাবুলকে মোবাইল ফোনে কল করে পাওয়া যায়নি।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে ঠিকাদারকে সড়কে ব্যবহার করা নিম্নমানের খোয়া অপসারণ করতে বলা হয়েছে। ঠিকাদার নিম্নমানের খোয়া অপসারণ শুরু করেছেন।
‘ভালো মানের নির্মাণসামগ্রী দিয়েই কাজ করতে হবে। সড়কের কাজে কোনোভাবে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে পারবে না।’
মোরেলগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলীর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কালিখোলা বলভদ্রপুর কালিমন্দির-বালিয়াডাঙ্গা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পিচের সড়ক ও একটি কালভার্ট নির্মাণ করছে। দুই কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ডিজি বাংলা নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি করছে। চলতি বছরের ৩০ জুন কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সময় বৃদ্ধি করেছে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন:ঝালকাঠির নলছিটিতে দুটি স্কুলের পাশে ফসলি জমিতে রয়েছে ‘রিয়াজ ব্রিকস’ নামের একটি ইটভাটা।
এ ভাটা থেকে শব্দ ও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শুধু ইটভাটার চুল্লিই নয়, ভাটায় মাটি ও বিক্রিত ইট সরবারহ করতে ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধ ট্রলি গাড়ি। এসব ট্রলির বেপোরোয়া গতি, উচ্চ শব্দ এবং কালো ধোঁয়ায় অতিষ্ঠ দুই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন-২০১৯ অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক হাজার মিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। এমন আইন থাকলেও সেটা না মেনে নলছিটি উপজেলার সরই গ্রামে দুটি স্কুল ঘেঁষে স্থাপন করা হয় ‘রিয়াজ ব্রিকস’ নামের ইটভাটাটি।
এ ভাটার ৩০০ মিটার দূরত্বে রয়েছে ১৯ নম্বর সরই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর ৫০০ মিটার দূরত্বে রয়েছে মাটিভাঙা মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
ইট পোড়ানোর চুল্লির (ক্লিন) ধোঁয়া, ইট কাটার মাঠের (ফরাস) ধুলা এবং মালামাল আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহৃত বাংলা ট্রলি গাড়ির শব্দে অতিষ্ঠ স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ও কর্মীরা। স্কুলঘেঁষা সড়কে বেপরোয়াভাবে চলাচলরত ইটভাটার ট্রলি (টমটম) গাড়ির শব্দে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান।
প্রাথমিক বিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ বলছে, ইটভাটার দূষণ থেকে পরিবেশ রক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির দিক বিবেচনা করে ভাটার বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা দপ্তরে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে, তবে সেখান থেকে এখনও কোনো প্রতিকার মেলেনি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি ইউনিয়নের সরই গ্রামে দুটি বিদ্যালয়ের মাঝখানে ফসলি জমির মধ্যেই ‘রিয়াজ ব্রিকস’ নামের এ ইটভাটার অবস্থান। সেখানকার স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, দুটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ওই বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের অভিভাবক, আশপাশের ফসলি জমির কৃষকসহ অনেকে সাংবাদিক দেখে নানা অভিযোগ জানালেন।
কীভাবে এখানে অনুমোদনহীন ইটভাটা নির্মাণ করল, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সবাই। একই সঙ্গে স্কুলঘেঁষা অনুমোদনহীন ভাটা চালু করার পর প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এমন বাস্তবতায় প্রশাসনকে উৎকোচ দিয়ে এ ইটভাটাটি চালানো হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন অনেকের মুখে।
স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের শেষের দিকে গড়ে তোলা হয় ‘রিয়াজ ব্রিকস’ নামের এ ইটের ভাটাটি। নানা জটিলতায় গত তিন মৌসুম এটি বন্ধ থাকলেও মালিক রিয়াজ হোসেন ব্যবসা পরিচালনার জন্য চলতি বছর এটি সুমন ফকির নামের অপর একজনের কাছে ভাড়া দিয়েছেন।
সুমনের দাবি, ভাড়া নয়, তিনি রিয়াজের সঙ্গে ব্যবসায় অংশীদার হয়েছেন।
এ বিষয়ে কথা হয় সরই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তাদের একজন বলে, ‘ইটের ভাটার জন্য আমরা গ্রামের সুন্দর পরিবেশ থেকে বঞ্চিত। আর স্কুলের সামনে অনেক জোরে টমটম ট্রলি চলাচল করে।
‘স্কুলে আসা এবং ছুটির সময় বের হওয়ার সময় রাস্তা পাহারা দিতে হয়।’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিরিন আক্তার বলেন, ‘স্কুলের পাশে ইটভাটা বন্ধ এবং শিক্ষার্থীদের চলাচলে ব্যবহৃত সড়কটিতে বেপরোয়া গতিতে ট্রলি চলাচলে নিষেধ করা হয়েছে।
‘ইটভাটা মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় আমরা কিছুই করতে পারছি না, তবুও লিখিত পত্র উপজেলা শিক্ষা অফিসে দিয়েছি।’
রিয়াজ ব্রিকসের সত্বাধিকারী মো. রিয়াজ জানান, তিনি বর্তমানে ভাটাটি সুমন ফকির নামের অন্য একজনের কাছে ভাড়া দিয়েছে।
মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদককে সুমন ফকির বলেন, ‘ভাড়া নয়, আমি রিয়াজের সাথে ব্যবসার পার্টনার হয়েছি।’
অনুমোদন না থাকার কথা স্বীকার করে সুমন বলেন, ‘অনুমোদন চেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করেছি।’
পরিবেশ অধিদপ্তর ঝালকাঠি জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আনজুমান নেছা বলেন, “নলছিটি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ‘রিয়াজ ব্রিকস’ নামের একটি ইটভাটার বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন স্থানে ইটভাটা স্থাপনের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
“এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা স্থাপনের কোনো সুযোগ নেই।”
নলছিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া ইটভাটা পারিচালনার কোনো সুযোগ নেই।
‘নলছিটিতে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে শিগগিরই পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযান চালানো হবে।’
আরও পড়ুন:‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী যখন নিরীহ বাঙালিদের ওপর সামরিক অভিযান চালানো শুরু করে, তখন আমি তৎকালীন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্ব দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলাম। এটি ছিল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমি বলেছিলাম- আমরা বিদ্রোহ করছি।’
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবন্ধে এসব কথা বলেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
১৯৭৪ সালে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাপ্তাহিক বিচিত্রা নিবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করে। সাংবাদিক ও লেখক মাহফুজ উল্লাহ রচিত ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ: এ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’ বইয়ে এই নিবন্ধের উল্লেখ রয়েছে।
সাবেক সেনাপ্রধান এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা মেজর জিয়াউর রহমান তার নিবন্ধে নিজের স্কুলজীবন, পাকিস্তান আমলে সামরিক একাডেমির ক্যাডেট জীবন, পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অস্থির পরিস্থিতি এবং মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
জিয়াউর রহমান লিখেছেন, ‘স্কুলজীবন থেকেই পাকিস্তানিদের মনোভাব আমাকে ব্যথিত করত। আমি জানতাম, তারা আমাদের গভীরভাবে ঘৃণা করে। আমার অনেক বন্ধুর কাছ থেকে আমি এরকম অনেক গল্প শুনেছি। তাদের পরিবারে যা আলোচনা হতো, তারা স্কুলে এসে আমাদের বলত।
‘তখন থেকেই আমি মনে মনে একটি স্বপ্ন লালন করতাম- যদি সুযোগ পাই, একদিন পাকিস্তানিদের অস্তিত্বের ভিত্তিমূলে আঘাত হানব। গভীর যত্ন ও ভালোবাসার সঙ্গে আমি এই চিন্তাটি লালন করতাম।’
পাকিস্তানি মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মচারী, সেনাবাহিনী এবং সাধারণ জনগণ কীভাবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে তাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করেছিল তিনি সে কথাও লিখেছেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের সময়ের উল্লেখ করে জিয়া লিখেছেন, ‘তখন আমি দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্যাডেট ছিলাম। কিছু পাকিস্তানি ক্যাডেট আমাদের জাতীয় নেতাদের নিয়ে কটূক্তি করে। আমরা এর প্রতিবাদ করি এবং এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয় যে তর্কই যথেষ্ট নয়; এটি বক্সিং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।’
‘আমি বাঙালিদের জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বক্সিং গ্লাভস পরি। পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে ক্যাডেট লতিফ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সে শপথ করেছিল আমাকে শিক্ষা দেবে। কিন্তু বক্সিং প্রতিযোগিতা ৩০ সেকেন্ডও স্থায়ী হয়নি। আমার প্রতিপক্ষ মাটিতে পড়ে যায় এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানায়।’
পাকিস্তানি শাসনামলের উল্লেখযোগ্য ও অস্থির ঘটনাগুলো তুলে ধরে জিয়াউর রহমান লিখেন, ‘এরপর এলো সেই কালরাত্রি- ২৫ মার্চ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাত। রাত ১টায় আমার কমান্ডিং অফিসার আমাকে একটি নৌবাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে জেনারেল আনসারির কাছে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেন।
‘আমাকে জানানো হয়েছিল, নৌবাহিনীর একটি প্রহরী দল (পাকিস্তানি) আমাকে সঙ্গ দেবে এবং আমি চাইলে তিনজন লোক সঙ্গে নিতে পারব। তবে আমার ব্যাটালিয়নের একজন পাকিস্তানি অফিসার আমার প্রহরী হিসেবে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বন্দরের দিকে রওনা হলাম। কিন্তু আগ্রাবাদে একটি ব্যারিকেডের কারণে থামতে হলো। হঠাৎ মেজর খালেকুজ্জামান ক্যাপ্টেন অলি আহমদের একটি বার্তা নিয়ে এলেন। তিনি আমাকে একটু দূরে নিয়ে মৃদু স্বরে বললেন, ‘ওরা (পাকিস্তানি সেনারা) ক্যান্টনমেন্ট এবং শহরে সামরিক অভিযান শুরু করেছে। অনেক বাঙালিকে হত্যা করেছে।’
এরপর জিয়াউর রহমান দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমরা বিদ্রোহ করছি’ এবং সহযোদ্ধাদের পাকিস্তানি অফিসারদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। এরপর তিনি নিজেই তার কমান্ডিং অফিসারের বাড়িতে গিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করেন।
জিয়াউর রহমান লিখেছেন, ‘যখন ব্যাটালিয়নে ফিরে আসি, দেখি সব পাকিস্তানি অফিসারকে গ্রেপ্তার করে একটি ঘরে রাখা হয়েছে। আমি অফিসে যাই এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমআর চৌধুরী ও মেজর রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু কোনোভাবেই পারলাম না।
‘পরে আমি বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাকে অনুরোধ করি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, কমিশনার, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের জানাতে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে এবং তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবে।’
সিলেট-ঢাকা মহাসড়ককে দুই লেন থেকে ছয় লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। উন্নয়ন কাজের জন্য সড়ক জুড়েই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যানবাহনের চালক ও যাত্রীদের। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ সিলেট নগরের প্রবেশমুখে।
সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের চণ্ডিপুল থেকে হুমায়ুন রশীদ চত্বর পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার পাড়ি দিতে যানবাহনগুলোর চালকদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। চরম ভোগান্তির শিকার হন যাত্রীরা।
চণ্ডিপুল থেকেই সিলেট নগরের শুরু। আর হুমায়ুন রশীদ চত্বরে এসে বাস থেকে নেমে যাত্রীরা নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যান। এই তিন কিলোমিটার সড়ক পুরোটাই খানা-খন্দে ভরা।
যানজট নিরসনে পুরনো সড়কের বদলে সিলেট নগরে প্রবেশের জন্য এই বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা হয়। তবে ভাঙাচোরা ও খানাখন্দে ভরা সড়কের এই অংশে প্রায় সময়ই লেগে থাকছে যানজট। ঘটছে দুর্ঘটনা।
সরেজমিনে দেখা যায়, চণ্ডিপুল থেকে হুমায়ুন রশীদ চত্বর পর্যন্ত সড়ক জুড়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ায় এসব গর্তে জমে আছে পানি। ফলে গাড়ি চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন চালকরা।
জানা যায়, গত বর্ষায় অতিবৃষ্টিতে সড়কের এমন দুরবস্থার সৃষ্টি হয়। তবে বর্ষা মৌসুম শেষ হলেও এখনও সংস্কার হয়নি সড়ক। ফলে দুর্ভোগের শেষ হচ্ছে না।
এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী সিলেট-হবিগঞ্জ বাস সার্ভিসের চালক লিটন আহমদ বলেন, ‘পুরো সড়কের মধ্যে এখানে এলেই ভয় পেয়ে যাই। এই তিন কিলোমিটার এলাকা পার হতে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। যাত্রীরাও আল্লাহর নাম জপতে থাকেন। দুর্ঘটনাও ঘটে নিয়মিত।’
মোটরসাইকেল চালক কায়সার আহমদ বলেন, ‘ভাঙাচোরা সড়কের কারণে প্রায়ই বাইকের যন্ত্রপাতি ভেঙে যায়। আর সবসময়ই যানজট লেগে থেকে। বৃষ্টি হলে তো অবস্থা আরও খারাপ হয়। সড়কের সব গর্তে ময়লা পানি জমে থাকে। ভিজে একাকার হতে হয়।’
এই সড়ক দিয়ে নিয়মিত যাতায়াতকারী ব্যাংকার হোসেন আহমদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সড়কটির এমন দুরবস্থা। সামান্য জায়গা, অথচ তা সংস্কার করা হচ্ছে না। ফলে আমাদের প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ‘এই সড়কের দুরবস্থা নিয়ে অনেক যাত্রীই অভিযোগ করেন। সড়কটির অবস্থান নগরের ভেতরে হলেও এটি সড়ক ও জনপথের আওতাধীন। তাই তাদেরই সংস্কার করতে হবে।’
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন বলেন, ‘সড়কটি সংস্কারের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হলেই সংস্কার কাজ শুরু হবে।’
ঘুষের টাকা ফেরত চাওয়ায় এক ডিলারকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কিশোরগঞ্জের উপপরিচালকের (বীজ বিপণন) বিরুদ্ধে।
এ ঘটনায় বিএডিসির মহাব্যবস্থাপক (বীজ) বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই ডিলার। অভিযোগের একটি কপি এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে।
অভিযুক্ত কর্মকর্তার নাম একেএম মনিরুজ্জামান। এ ঘটনায় তার সঙ্গে সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) ও গুদাম রক্ষক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণবকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। দুজনই বিএডিসি, কিশোরগঞ্জে কর্মরত।
মহাব্যস্থাপক (বীজ) মো. আবীর হোসেন মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
কী আছে লিখিত অভিযোগে
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ডিলার জানান, গত ৪ নভেম্বর বীজ উত্তোলনের জন্য গুদামে যান তিনি। গুদাম রক্ষক শুভ্রানিয়ামের কাছে গেলে হাতের ইশারায় অতিরিক্ত টাকা নিয়ে উপপরিচালকের (বীজ) কাছে যেতে বলেন। সেখানে গেলে উপপরিচালক জানান, বীজের বরাদ্দের সময় শেষ। এখন বীজ নিতে হলে প্রতি টনে দুই হাজার টাকা এবং মধুপুরের বীজ নিতে হলে প্রতি টনে ৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। ডিলারশিপ টিকিয়ে রাখতে ৫ টন ব্রি ধান-২৯-এর (মধুপুর বীজ ধান) কথা বলেন। তখন কর্মকর্তা হিসাব করে ১৫ হাজার টাকা দিতে বললে দর কষাকষি করে ১২ হাজার টাকা দেন তিনি। ওই সময় ৮ টন ব্রি ধান-২৯ এবং অন্যান্য জাতের ৩.৮ টন ধানের মেমো করে বাড়িতে চলে যান তিনি।
ডিলারের ভাষ্য, পরের দিন গাড়ি পাঠানোর পর মধুপরের বীজ না দিয়ে ভিন্ন বীজ দেয়া হয় তাকে। পরে ১০ নভেম্বর মধুপুরের বীজের জন্য প্রদানকৃত অতিরিক্ত ১২ হাজার টাকা ফেরত নিতে আসেন তিনি। সে সময় উপপরিচালক একেএম মনিরুজ্জামান তাকে গুদাম রক্ষক শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণবের কাছে যেতে বলেন। শুভ্রানিয়াম তখন পাঁচ হাজার টাকা ফেরত দেন ডিলারকে। বাকি টাকা চাওয়ার পর উপপরিচালক একেএম মনিরুজ্জামান ও গুদাম রক্ষক শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব মিলে মারধর করেন তাকে। পরে ২০ নভেম্বর মহাব্যবস্থাপক (বীজ) বরাবর লি়খিত অভিযোগ করেন ওই ডিলার, তবে মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্তরা।
বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ
উপপরিচালক একেএম মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগও উঠেছে। বিশেষ এ টোকেন হাতে থাকলে সিরিয়াল ছাড়া পছন্দমতো বীজ সংগ্রহ করা যায়।
এ কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত এমন একটি বিশেষ টোকেনের ছবি এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে। তাতে দেখা যায়, এক ডিলারকে ১০ টন ডায়মন্ড আলু বীজের একটি বিশেষ টোকেন দিয়েছেন তিনি। একসঙ্গে ১০ টন একজনকে দিলে সমালোচনায় পড়তে পারেন বলে দুইভাগে লিখে দিয়েছেন।
বিশেষ টোকেনপ্রাপ্ত ওই ডিলারের কাছ থেকেও মনিরুজ্জামান ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব টোকেনের মাধ্যমে আলু বীজের কেজিপ্রতি তিন থেকে ১০ টাকাও নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কৃষি অফিসের একটি সূত্র জানায়, এবার কিশোরগঞ্জে ৩৮৯ টন আলুর বরাদ্দ আসে।
কেজিপ্রতি অতিরিক্ত টাকা নিয়ে বীজ কম দেয়ার অভিযোগও রয়েছে মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডিলার জানান, যেখানে তারাই সঠিক দামে বীজ পান না, সেখানে কৃষকরা কীভাবে পাবে।
তাদের ভাষ্য, বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার অন্তরালে এসব কর্মকর্তাই দায়ী।
‘অনিয়ম-দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড’ শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডিলারের অভিযোগ, টাকা ছাড়া কোনো কাজই করেন না সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব।
তারা জানান, এ অফিসে উপপরিচালককে অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার পরও শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণবকে আলাদা ম্যানেজ করতে হয়। তা না হলে সঠিক সময়ে কেউই বীজ পান না। উপপরিচালকের পর এ অফিসে সবচেয়ে প্রভাব বেশি কাটিয়ে চলেন শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব। তার হাতের ইশারা ছাড়া এক কেজি বীজ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণবের হুমকি-ধমকি অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা শিউলী আক্তার, সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নুরুল আমিন, নিরাপত্তা প্রহরী জাকির হোসেন ও খায়রুল ইসলাম সম্মিলিতভাবে বিএডিসির সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
উল্লিখিত অভিযোগগুলো অস্বীকার করে শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব জানান, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিএডিসির সচিব ড. কে এম মামুন উজ্জামানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে খোঁজ নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
‘বিএডিসি একটি দোকান, উপপরিচালক মহাজন’
বিএডিসির সার্বিক বিষয়ে জানতে ভৈরবের এক পুরাতন ডিলারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিএডিসি অফিস তো নয়, যেন একটি দোকান। আর উপপরিচালক (ডিডি) এখানকার মহাজন। মহাজনের মতোই সবকিছু পরিচালনা এবং দরকষাকষি করে বীজ বিক্রি করেন তিনি। দোকানদার যেমন ইচ্ছামতো দোকান খোলেন আবার বন্ধ করেন, বিএডিসি অফিসও বর্তমানেও তেমনই।’
তিনি আরও বলেন, ‘অতিরিক্ত টাকা ছাড়া কোনো বীজ দেন না উপপরিচালক। তার আচরণে বেশির ভাগ ডিলারই ক্ষুদ্ধ। শুধু ডিলারশিপ টিকিয়ে রাখতে মুখ বুজে সহ্য করেন।’
বীজ বিপণন অফিসকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করার অভিযোগ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডিলার অভিযোগ করেন, উপপরিচালক একেএম মনিরুজ্জামান এবং সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) ও গুদাম রক্ষক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব যৌথভাবে বীজ বিপণন অফিসকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। তারা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বীজ ডিলাররা বরাদ্দ অনুযায়ী বীজ বা অবীজ কোনোটাই উত্তোলন করতে পারেন না।
ডিলারদের ভাষ্য, অতিরিক্ত টাকা না পেলে দুই কর্মকর্তা বীজ বিক্রি করেন না। ঘুষ চাওয়ার প্রতিবাদ করলে ডিলারশিপ বাতিল করার হুমকি দেয়া হয়। ঘুষের টাকা ফেরত চাওয়ায় সম্প্রতি এক ডিলারকে মারধর করেছেন তিনি।
তারা জানান, অতিরিক্ত টাকা হাতে পেলে অধিক বীজের গেস্ট হাউসে বসে বিশেষ টোকেন দেন উপপরিচালক। পরে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন গুদামরক্ষক।
বিএডিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ বোরো মৌসুমে কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে মোট বরাদ্দ আসে ৩ হাজার ২০০ টন বীজ। এ মৌসুমে ১ হাজার ৪৫০ টনের মতো বীজ বিক্রি হলেও অবিক্রিত রয়ে গেছে ১ হাজার ৭৫০ টন বীজ।
চলতি বোরো মৌসুমে ১ হাজার ৭৫০ টনের বেশি বীজ অবিক্রিত থাকায় সরকারের ২ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকার লোকসান গোনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। বাধ্য হয়ে এ ধানবীজ এখন অবীজ হিসেবে বিক্রি করতে হবে। আর অবীজ (খাদ্য) হিসেবে বিক্রি করলে সরকারে প্রতি কেজিতে লোকসান হবে ১৫ থেকে ১৭ টাকা।
ডিলারদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত পরিমাণ বীজ থাকা সত্ত্বেও প্রতি টনে তিন থেকে চার হাজার টাকা অতিরিক্ত না দিলে বীজ পান না তারা। এতে মাঠ পর্যায়ে বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিএডিসির বীজের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা। ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার টন বীজ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। এতে প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডিলার জানান, ২০২৪-২৫ মৌসুমে ভিত্তি ধানবীজের প্রতি টনে ৪ হাজার টাকা এবং মধুপুরের ধানবীজে ৩ হাজার টাকা এবং অন্যান্য যেকোনো জাতের বীজ নিতে হলে ১ হাজার টাকা অতিরিক্ত দিতে বাধ্য করেছেন উপপরিচালক একেএম মনিরুজ্জামান ও সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব। তাদের অতিরিক্ত চাহিদার কারণে ডিলাররা প্রয়োজনমতো ধানবীজ উত্তোলন করতে পারেন না। ফলে প্রতি বছর অনেক ধানবীজ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। এই দুই কর্মকর্তা নিজেরা লাখ টাকা উপার্জন করতে গিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান করছেন।
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এবারই প্রথম নয়
বিএডিসি কিশোরগঞ্জ অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২০২৫ মৌসুমে যেমন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তেমন অভিযোগ আগেও পাওয়া গেছে। অতীতেও একইভাবে অনিয়ম করেছেন উপপরিচালক। একইভাবে ২০২৩-২৪ বোরো মৌসুমে মোট বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৪০০ টন। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৬০ টনের মতো বীজ বিক্রি হয়। তখনও ১ হাজার ৭০০ টন বীজ অবিক্রিত থাকায় সরকারের লোকসান হয় ২ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা।
বিএডিসি সূত্র আরও জানায়, ওই সময়ে অবিক্রিত বোরো ধানবীজ পরে অবীজ(খাদ্য) হিসেবে বিক্রিতে ডিলারদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়।
ডিলাররা জানান, ১ হাজার ৭০০ টন অবীজ ধানের মধ্যে ডিলারদের জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত হিসেবে কোনো পরিমাণ ধান উত্তোলন করতে পারেননি। ব্রি ধান-২৮-এর চালের চাহিদা বেশি হওয়ায় প্রতি টনে ৪ হাজার টাকা করে ৩০০ টন ধান বিক্রি করেন। এখান থেকে অতিরিক্ত ১২ লাখ আদায় করেন উপপরিচালক। বাকি ধান প্রতি টনে এক থেকে দুই হাজার টাকা অতিরিক্ত নিয়ে বিক্রি করেন মনিরুজ্জামান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের একটি সূত্র জানায়, অবীজ বিক্রিতে মোটা অঙ্কের অতিরিক্ত টাকা আদায়ের সুযোগ রয়েছে এ কর্মকর্তার। তাই প্রতি বছর ইচ্ছাকৃতভাবেই বীজ অবিক্রিত রেখে দেয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি।
অভিযুক্ত ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ভাষ্য
এ বিষয়ে বিএডিসি কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক (বীজ বিপণন) একে এম মনিরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সব অভিযোগ অস্বীকার বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে বীজ নিয়ে অনেক ডিলারদের চাহিদা থাকে। সবসময় সবার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
‘তাই অনেকে বিভিন্ন অভিযোগ করতে পারে। এসব অভিযোগের সত্যতা নেই।’
বিএডিসির মহাব্যবস্থাপক (বীজ) আবীর হোসেন অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি মোবাইল ফোনে বলেন, ‘কিশোরগঞ্জ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
আরও পড়ুন:কক্সবাজারের টেকনাফে বাবাকে না পেয়ে ১৪ বছরের এক ছাত্রকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
এ ঘটনায় টেকনাফ থানার ওসির অস্ত্র উদ্ধারের স্বীকারোক্তি নেওয়া ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় চলছে। কেউ কেউ ‘টেকনাফে প্রদীপ যুগে ফিরছে’ বলে মন্তব্য করেন ফেসবুকে।
এদিকে গত ২৬ নভেম্বর ভোররাতে বাড়ি থেকে নিরস্ত্র অবস্থায় পুলিশ স্কুলছাত্রকে আটক করলে সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়। এর মধ্যেই পুলিশ শনিবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, স্কুলছাত্রকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত ওই স্কুলছাত্র টেকনাফের হ্নীলার দরগাহপাড়া এলাকায়। সে হ্নীলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। তার বাবা জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা যুবলীগের সদস্য।
পুলিশের দাবি, গত ২৬ নভেম্বর ভোরে টেকনাফেরর হ্নীলার দরগাহপাড়া এলাকার নুরুল আমিনের বাড়ির সামনে টেকনাফ থানার ওসি গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল অভিযান চালায়। ওই সময় পালানোর চেষ্টাকালে স্কুলছাত্রকে আটক করা হয়। সে সময় তার কাছে থাকা নীল রঙের শপিং ব্যাগের ভেতর থেকে বিদেশি অস্ত্র পাওয়া যায়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় আবদুল মোমেন বলেন, ‘একজন স্কুলপড়ুয়া সপ্তম শ্রেণির ছাত্রকে আমাদের চোখের সামনেই আটকের নাটক মঞ্চস্থ করে পুলিশ। আটককৃত শিশুটির বাড়িতে তল্লাশি করে কিছুই পায়নি, কিন্তু বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ মিনিটের দূরত্বে প্রবাসী নুরুল আমিনের বাড়ি থেকে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করে পুলিশ।
‘তখন আমরা বাকরুদ্ধ এবং ১৪ বছরের শিশুটি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। এরপর তার বাবার অস্ত্র বলে জোরপূর্বকভাবে স্বীকারোক্তি নেয় পুলিশ। বাবাকে না পাওয়ার কথা বলে তাকে অস্ত্রসহ ধরে নিয়ে যায় ওসি।’
গত ২৬ নভেম্বর ভোররাত তিনটা ৪০ মিনিটের দিকে পুলিশের কাছে খবর আসে যে, হ্নীলার দরগাহপাড়ার নুরুল আমিনের বাড়ির সামনে রাস্তার ওপর কতিপয় ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্য অবস্থান করছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছলে দুজন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে একজনকে তার হাতে থাকা নীল রঙের শপিং ব্যাগসহ আটক করা হয়।
তার শপিং ব্যাগে কী আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যাগে অস্ত্র ও গুলি আছে। সাক্ষীদের সামনে ব্যাগ তল্লাশি করে পাওয়া যায় একটি কালো রঙের বিদেশি পিস্তল, ছয় রাউন্ড গুলি এবং ৪০ রাউন্ড নীল রঙের কার্তুজ। উক্ত মামলায় তিনজনকে সাক্ষী করা হয়েছে, স্থানীয় নারী ও মৌলভী এবং আরেকজন পুলিশ সদস্য।’
মামলার সাক্ষী প্রবাসী নুরুল আমিনের স্ত্রী সুফাইদা আক্তার বলেন, ‘গত ২৬ নভেম্বর ভোর রাতে আমার বাড়িতে পুলিশ প্রবেশ করে। কোনো কথা না বলে ঘরের আলমারি খুলে তল্লাশি করতে থাকে। একপর্যায়ে আলমারি থেকে অস্ত্র, গুলি ও ইয়াবা উদ্ধার করে পুলিশ।
‘এগুলো উদ্ধারের পর শিশুটিকে তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে একটি কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে চলে যান পুলিশ।’
আরেক সাক্ষী মৌলভী জামাল হোসাইন বলেন, ‘ভোরে মসজিদের ফজর নামাজের যাওয়ার সময় নিজেকে ওসি পরিচয় দিয়ে দাঁড় করান। ওই সময় শিশুটিকে তার বাড়ি থেকে নিরস্ত্র অবস্থায় বের করে আনতে দেখি। এ সময় ওসি অস্ত্রসহ শিশুটিকে আটক করার কথা বলে আমাকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর দেওয়ার কথা বলে, কিন্তু আমি না দিতে অপরাগত জানালে ধমক দেন ওসি।
‘এটা যে মামলার সাক্ষী আমি জানি না। আর অস্ত্রগুলো শিশুর কাছ থেকে পেয়েছে, আমি দেখিনি।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে এক সহপাঠী বলে, ‘ক্লাসের মেধাবী ছাত্র কখনও অস্ত্র বহন করতে পারে না। এটা অস্ত্র অভিযানের নামে নাটক।
‘আইনের চোখে অপরাধী হলে দেশের প্রচলিত আইনে উপযুক্ত বিচারে আমাদের কারও আপত্তি নেই, কিন্তু পুলিশ জোর করে স্বীকারোক্তির ভিডিও নিয়ে ফেসবুকে ছেড়ে দিয়ে কি অপরাধ করেনি? আমরা সাজানো অস্ত্র উদ্ধার মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি।’
শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, ‘মূলত রাজনৈতিক এবং নির্বাচন নিয়ে একটি পক্ষ পরিকল্পিতভাবে আমাকে না পেয়ে আমার শিশু পুত্রকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়েছে। আমার ছেলে খুবই মেধাবী।
‘সে তিনবার বৃত্তি পেয়েছে। চলমান বার্ষিক পরীক্ষায় আমার ছেলে অংশ নিতে পারল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলের কাছ থেকে জোর করে অস্ত্র উদ্ধারের স্বীকারোক্তি নেয় পুলিশ, কিন্তু অপরাধ ঢাকতে পুলিশ আবার সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
‘এ ঘটনায় বর্তমান সরকারের কাছে তদন্তপূর্বক মামলা প্রত্যাহার ও তার মুক্তি দাবি করছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হ্নীলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুস সালাম বলেন, ‘আমার স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীটি একজন নিয়মিত ছাত্র। সে খুব মেধাবী।
‘এখন তার পরীক্ষা চলছে। তাই ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অবিলম্বে তার মুক্তির দাবি জানাচ্ছি।’
টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনের দাবি, ঘটনার দিন ভোরে পালিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তা থেকে ওই শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। পরে তার হাতে থাকা একটি নীল রঙের শপিং ব্যাগের ভেতর একটি বিদেশি পিস্তল, ছয়টি গুলি ও ৪০টি নীল রঙের কার্তুজ পাওয়া যায়। সাক্ষীদের উপস্থিতিতে তা জব্দ করা হয়।
পুলিশের স্বীকারোক্তির ভিডিও কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে, সে বিষয়ে কিছু বলেননি এ কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।’
মন্তব্য