দীর্ঘ ২০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। ঠিক এ সময় সংঘাতপ্রবণ দেশটিতে নতুন করে বিপুল শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে সশস্ত্র সংগঠন তালেবান।
যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোটের সেনারা আফগানিস্তান ছাড়তে থাকার মধ্যে গত কয়েক সপ্তাহে দেশটির বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। সেখান থেকে পিছু হটেছে আফগান সেনা।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারসহ যুক্তরাষ্ট্রে একযোগে কয়েকটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়, যাতে প্রাণ যায় প্রাণ তিন হাজার মানুষের। সে সময় আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল তালেবান। নাইন-ইলেভেন নামে পরিচিত ওই হামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে সে সময় আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, ক্ষমতাচ্যুত করে তালেবানদের।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, এখন দেখা যাচ্ছে, আসলে গত দুই দশকে ধীরে ধীরে নতুন করে শক্তি অর্জন করেছে তালেবান। চালিয়েছে একের পর এক হামলা। বেসামরিক মানুষের পাশাপাশি আফগান, এমনকি বিদেশি সেনাদের ওপরেও হামলা চালিয়েছে গোষ্ঠীটি।
গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি তালেবানের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তিতে সই করেন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। ওই চুক্তিতে আফগানিস্তানে নিরাপত্তা নিশ্চিতের শর্তে তালেবানবিরোধী সেনা অভিযান বন্ধ ও সেনা প্রত্যাহারের নিশ্চয়তা দেয় আন্তর্জাতিক জোট। চুক্তিটির মাধ্যমে সে সময় আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা বৈধতা অর্জন করতে সক্ষম হয় তালেবান।
ট্রাম্পের উত্তরসূরী জো বাইডেনও ক্ষমতায় এসে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বদলাননি। তবে চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের ১ মে’র মধ্যে বিদেশি সেনা পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাহারের কথা থাকলেও তারিখ কিছুটা পিছিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর নেয় বাইডেন প্রশাসন। নাইন-ইলেভেন হামলার ২০তম বার্ষিকীর সঙ্গে মিলিয়ে তারিখটি নির্ধারণ করা হয়েছিল।
তবে গত মাসে আবারও তারিখ পাল্টান বাইডেন। সময় কিছুটা এগিয়ে চূড়ান্ত সেনা প্রত্যাহারের নতুন তারিখ হিসেবে ৩১ আগস্ট নির্ধারণ করেন তিনি।
এর মধ্যে সেনা প্রত্যাহারের তারিখ পেছানো নিয়ে ক্ষুব্ধ তালেবান মে মাসেই আগ্রাসন শুরু করে। চুক্তি অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা অবকাঠামো লক্ষ্য করে কোনো ধরনের হামলা না চালালেও আফগান সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের ওপর একের পর এক প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে গোষ্ঠীটি।
ব্যাখ্যা হিসেবে তালেবান জানিয়েছে, কাতারের রাজধানী দোহায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে কোনো অবদান ছিল না পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত আফগান সরকারের।
অথচ যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান চুক্তির মাধ্যমে আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানের শান্তি আলোচনার পথ খুলে যাবে বলে মনে করা হচ্ছিল। মূলত আফগান ভূখণ্ডে দেশটির সেনাবাহিনী ও তালেবান যোদ্ধাদের মধ্যে তীব্র সহিংসতা চলতে থাকার কারণেই দোহায় আলোচনা ভেস্তে যায়।
এরপরই মে মাসে আফগান সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস অভিযান শুরু করে তালেবান। দখলে নেয় প্রতিবেশী দেশ ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো।
আফগানিস্তানজুড়ে তালেবানের পূর্ণকালীন যোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ৮৫ হাজার। আরও রয়েছে অগুণতি সমর্থক ও সহযোগী।
আফগানিস্তানের ৪১৯টি জেলার অর্ধেকের বেশি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার দাবি করেছে ধর্মভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। তালেবানের এ দাবির সত্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি গোয়েন্দারা।
জোরালো হচ্ছে গৃহযুদ্ধের শঙ্কা
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা, জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মাইলি গত বুধবার সতর্ক করে বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে ‘কৌশলগত বিজয়’ অর্জনের পথে আছে তালেবান।
প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘অচিরেই আফগান জনতা, সেনাবাহিনী ও সরকারকে সদিচ্ছা আর নেতৃত্বের প্রমাণ দিতে হবে।’
সহিংসতায় কয়েক শ মানুষ নিহত হয়েছে। গৃহহীনের সংখ্যা লাখের ঘরে। এমন পরিস্থিতিতে শান্তি আলোচনায় অচলাবস্থা আফগানিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে শংকা জোরালো হচ্ছে।
এরই মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে কট্টরপন্থি তালেবানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছে স্থানীয় বেসামরিক আফগানরা। তাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করছে আফগান সরকার।
তালেবানের মুখপাত্র সোহেল শাহীন শুক্রবার জানান, গৃহযুদ্ধ চায় না তার দল। দোহায় শান্তি আলোচনা ফের শুরু করতে হলে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিকে পদত্যাগ করতে হবে বলে শর্ত বেঁধে দেন তিনি।
বার্তা সংস্থা এপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শাহীন বলেন, ‘একচেটিয়া ক্ষমতায় তালেবান বিশ্বাসী নয় বলে আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিতে চাই। তালেবান যোদ্ধারা অস্ত্র নামিয়ে রাখবে।
‘কিন্তু এটা তখনই সম্ভব, যখন আলোচনার ভিত্তিতে সর্বসম্মত কোনো সরকার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসবে।’
তালেবানের প্রধান হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা গত সপ্তাহে ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’র আহ্বান জানান। কিন্তু সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান অব্যাহত রাখতে নিজ দলের যোদ্ধাদের মধ্যেই চাপের মুখে তিনি।
তালেবানের জন্ম
আরবি ভাষায় তালেবান শব্দটির অর্থ হলো জ্ঞান অর্জনকারী বা শিক্ষার্থী।
সাবেক সোভিয়েত আমলে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় বছরের লড়াই করে আফগান স্বাধীনতাকামীরা। ‘মুজাহিদিন’ হিসেবে পরিচিত স্বাধীনতাকামীদের একটি অংশ ছিল তালেবানও।
মূলত ১৯৭৮ সালে এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে আফগানিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়া থেকে এ লড়াইয়ের শুরু। ওই অভ্যুত্থান ঘটাতে সমাজতান্ত্রিক নেতাদের মদদ দিয়েছিল তখনকার সোভিয়েত সরকার।
এরপরই, ১৯৭৯ সাল থেকে সোভিয়েত উপনিবেশের বিরুদ্ধ সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে মুজাহিদিনরা। আশির দশকজুড়ে এ বিপ্লবে মুজাহিদিনদের অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সোভিয়েতবিরোধী নীতির আওতায় ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী মুজাহিদিনদের সহযোগিতার দায়িত্ব নিয়েছিল ওয়াশিংটন। কারণ সে সময় স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ ছিল তখনকার সোভিয়েত সরকার বা ‘ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস’, সংক্ষেপে ইউএসএসআর, অর্থাৎ বর্তমান রাশিয়া।
তুমুল গোলমেলে পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৮৯ সালে আফগান ভূখণ্ড ছাড়ে সোভিয়েত সেনারা। নেতৃত্ব সংকটে সে সময় চরম অস্থিতিশীলতার মুখে পড়ে আফগানিস্তান। ১৯৯২ সালে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লড়াইয়ে জড়ায় খোদ মুজাহিদিন কমান্ডাররাই।
বিভক্ত হয় কাবুল। প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েক শ রকেট এসে পড়ত রাজধানী নগরীটিতে।
তবে গৃহযুদ্ধে শক্তিশালী ভূমিকায় তালেবান অবতীর্ণ হয় মূলত ১৯৯৪ সালে। তৎকালীন তালেবান যোদ্ধাদের বেশিরভাগই শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের আফগান সীমান্ত এলাকার রক্ষণশীল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।
কাবুলের পর আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বড় শহর কান্দাহার দখল থেকে নব্বইয়ের দশকে উত্থান শুরু তালেবানের।
পশতুন অধ্যুষিত কান্দাহারের পর একে একে দেশের অন্যান্য শহরেও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে গোষ্ঠীটি। জনসাধারণকে আশ্বাস দেয় নিরাপদ নাগরিক জীবনের।
বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধে অতীষ্ঠ আফগান জনতাও স্বাভাবিকভাবেই নতুন জীবনের আশায় স্বাগত জানায় তালেবান যোদ্ধাদের।
সে সময় ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় তালেবানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মুজাহিদিন কমান্ডার ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
১৯৯৬ সালে রাজধানী কাবুল দখল করে তালেবান। কাবুল স্কয়ারে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলায় আফগানিস্তানের শেষ বামপন্থি প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহ আহমাদজাইকে।
এরপরই আফগানিস্তানকে ইসলামিক আমিরাত ঘোষণা করে তালেবান। শুরু হয় তালেবানের নিজস্ব ব্যাখ্যায় দাঁড় করানো কট্টর শরিয়াহ আইনের বাস্তবায়ন।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পাকিস্তানসহ মোট তিনটি দেশ আফগানিস্তানের শাসক দল হিসেবে সে সময় তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়।
আপাতদৃষ্টিতে স্থিতিশীল আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠায় তা সক্ষমও হয়েছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শুরুর দিকে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে গোষ্ঠীটি।
ছয় বছরের শাসন
শুরুর দিকে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের যুক্তি হিসেবে গৃহযুদ্ধকালীন অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর কথা বলেছিল তালেবান। কিন্তু পরে সেসব বিধিনিষেধ আর প্রত্যাহার করেনি।
এসব বিধিনিষেধের মধ্যে ছিল নারীদের শিক্ষাগ্রহণ ও চিকিৎসা বাদে অন্য সব ধরনের পেশায় তাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি।
ধর্মীয় রীতির নামে নিষিদ্ধ ছিল গান শোনা, টেলিভিশন দেখাসহ বিনোদন ও অবসর সময় কাটানোর নির্দোষ নানা মাধ্যমের ব্যবহার। খেলাধুলাও নিয়ন্ত্রণ করা হতো কঠোরভাবে। শুধু পুরুষরাই খেলাধুলায় অংশ নিতে পারতো, কিন্তু তাদের রক্ষণশীল পোশাক পরে খেলতো হতো এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় বিরতি বাধ্যতামূলক ছিল।
তালেবানের শাসনামলে এসব কঠোর বিধিনিষেধ কেউ না মানলে তাকে প্রকাশ্যে পেটানো হতো বা কারাদণ্ড দেয়া হতো।
ছয় বছরের শাসনজুড়ে আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরেও চরম নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে।
২০০১ সালে বামিয়ান প্রদেশে গৌতম বুদ্ধের ঐতিহাসিক ভাস্কর্য ধ্বংসে তালেবানের সিদ্ধান্ত সমালোচিত হয়েছিল বিশ্বজুড়ে।
যেভাবে তালেবানের বিরুদ্ধে তৎপর বিশ্ব সম্প্রদায়
সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে কালোতালিকাভুক্ত আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ১৯৯৯ সালে তালেবানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় জাতিসংঘ।
নাইন-ইলেভেন হামলার পর আফগানিস্তানে লুকিয়ে থাকা হস্তান্তরে তালেবানকে অনুরোধ করে যুক্তরাষ্ট্র।
সাবেক মুজাহিদিন কমান্ডার আব্দুল রব রসুল সায়াফের আমন্ত্রণে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন আল-কায়েদা নেতা সৌদি নাগরিক ওসামা বিন লাদেন। তখন থেকে সেখানেই আত্মগোপনে ছিলেন লাদেন।
লাদেনকে হস্তান্তরের অনুরোধটি প্রত্যাখ্যান করে তালেবান। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের কাছে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলায় লাদেনের ভূমিকার প্রমাণ চায় গোষ্ঠীটি। পাশাপাশি, ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনারও প্রস্তাব দেয়।
দুটি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করে বুশ প্রশাসন। লাদেনকে হস্তান্তর না করায় ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে সেনা অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র।
এর ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের জোটবদ্ধ বিমান হামলার মুখে কয়েক মাসের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয় তালেবান।
তালেবানপরবর্তী আফগানিস্তান ও তালেবানের পুনরুত্থান
২০০১ সালের ডিসেম্বরে হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে গঠিত হয় একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার।
এর তিন বছর পর প্রণীত হয় নতুন সংবিধান। ষাটের দশকের সংশোধিত সংবিধানের আলোকে তৈরি নতুন সংবিধানে নারী ও আদিবাসী সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হয়।
১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৭৩ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ৪৩ বছর আফগানিস্তান শাসন করেছিলেন বাদশাহ মোহাম্মদ জহির শাহ। দুররানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দেশ শাসন করা জহির শাহ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রথমবার আফগান নারী ও আদিবাসী সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকারে অনুমোদন দিয়েছিলেন।
এদিকে প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের শাসনামলেই ২০০৬ সাল নাগাদ আবারও সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে তালেবান। বিদেশি সেনা ও তাদের আফগান সহযোগীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুরু হয় যোদ্ধাদের এক ছাদের নিচে আনা।
আফগান সরকার ও তালেবানের মুখোমুখি শান্তি আলোচনার উদ্যোগ
গত ২০ বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোটের হামলায় প্রাণ গেছে ৪০ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষের। নিহত হয়েছে আফগান সেনা ও পুলিশের কমপক্ষে ৬৪ হাজার সদস্য আর আন্তর্জাতিক জোটের সাড়ে তিন হাজারের বেশি সেনা।
বিদেশি ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম এই যুদ্ধ আর অবকাঠামো পুনঃনির্মাণে আমেরিকান সরকারের খরচ হয়েছে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু এখনও আফগানিস্তানে দারিদ্র প্রকট, ভঙ্গুর অবকাঠামো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সব খাতে।
যুদ্ধের খরচ বেড়ে চলায় আর রাজনৈতিক সমাধান না আসায় ২০১১ সালে কাতারের দোহায় তালেবানের একাংশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের সরকারের সঙ্গে তালেবানকে মুখোমুখি আলোচনায় বসানোর লক্ষ্যে হয় ওই আলোচনা।
এর ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে দোহায় তালেবানের একটি কার্যালয় স্থাপন চালু হয়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের নেতৃত্বে বর্তমান আফগান সরকারের সঙ্গে প্রথমবার আনুষ্ঠানিক ও সরাসরি আলোচনায় বসে তালেবান।
তালেবানের ‘সমান্তরাল সরকার’
ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তান নামে একটি স্বঘোষিত সমান্তরাল রাষ্ট্র কায়েম করেছে তালেবান। নিজস্ব একটি সাদা পতাকাও আছে তাদের। আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশে নিজেদের ছায়া সরকারের প্রশাসনকে নেতৃত্ব দিতে ছায়া গভর্নরও নিয়োগ দিয়েছে গোষ্ঠীটি।
তালেবানপ্রধান একটি পরিষদে নেতৃত্ব দেন। পরিষদটি অর্থ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ ১২টির বেশি কমিশন দেখভালের দায়িত্ব পালন করে। তাদের নিজস্ব আদালত ব্যবস্থাও আছে।
তালেবান সদস্য ও জাতিসংঘের একটি কমিটির তথ্য অনুযায়ী, তালেবানের এই ছায়া সরকারের বার্ষিক আয় প্রায় দেড় শ কোটি ডলার।
আঞ্চলিক মাদক ব্যবসায় জড়িত স্থানীয় ও আঞ্চলিক বিভিন্ন অপরাধী চক্রের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেও রাজস্ব পায় তালেবান। মেথামফেটামাইনধর্মী এক ধরনের মাদক উৎপাদনও করে গোষ্ঠীটি। গত বছর খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও বিক্রি থেকেও শত-কোটি ডলার আয় করেছে তারা।
তালেবানের নিজস্ব কর সংগ্রহ ব্যবস্থা আছে। বিদেশ থেকেও বিপুল অঙ্কের অনুদান পায় তারা। ধারণা করা হয়, ইরান ও পাকিস্তানে তালেবানের অনেক আর্থিক পৃষ্ঠপোষক আছে। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করে গোষ্ঠীটি।
জনজীবনে শান্তির সম্ভাবনা
বিদেশি সেনা প্রত্যাহার পুরোদমে শুরুর আগেই এবং শান্তি আলোচনা চলাকালীনই চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সহিংসতায় হতাহত হয়েছে এক হাজার ৮০০ বেসামরিক আফগান। গত বছরের তুলনায় এ সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
গুপ্তহত্যার শিকার অনেক সংবাদকর্মী ও অধিকারকর্মীর মৃত্যুর জন্যও তালেবানের দিকে সন্দেহের তীর। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে গোষ্ঠীটি।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে- যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জোটের সেনারা পূর্ণরূপে আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর কী ঘটবে? আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকার কি আদৌ টিকতে পারবে?
২০১৯ সালের উল্লেখযোগ্য একটি জনমত জরিপে উঠে এসেছে, বর্তমানে তালেবানের প্রতি কোনোরকম সহানুভূতি রাখেন না আফগানিস্তানের ৮৫ শতাংশ মানুষ।
আফগানিস্তানে আবারও তালেবান পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলে দেশটিতে জনজীবনের কী হাল হবে, তা নিয়ে শঙ্কিত আফগানরা।
এমনকি সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা সংবিধানটি তালেবান ছুড়ে ফেলে দেবে কি না, ঘনিয়ে উঠছে সে শঙ্কাও।
নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি উপসম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে মোটামুটি স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে রেখেছে তালেবান। তারা জানিয়েছে যে ইসলামিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা। সে ব্যবস্থায় শিক্ষা থেকে শুরু করে পেশাগত বিষয় পর্যন্ত সবকিছুতে নারীরা কেবল ততটুকু অধিকারই পাবেন, যতটুকু ইসলাম ধর্মে তাদের দেয়া হয়েছে।
যদিও তালেবান মুখপাত্র শাহীন চলতি সপ্তাহের শুরুতে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘হিজাব বা মাথা ঢাকা পোশাক পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রে যাওয়া, এমনকি রাজনীতিতেও অংশ নিতে পারবেন নারীরা।’
বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত দেশে আগে থেকেই এ চর্চা বিদ্যমান।
আরও পড়ুন:পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দেশের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার ‘সমন্বিত ষড়যন্ত্র’ চলছে বলে অভিযোগ করেছে দলটি। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তার নিজ দলের অনেকই জড়িত বলে জানা গেছে। তবে এ ধরনের তৎপরতা মেনে নেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন পিটিআইয়ের অন্য নেতারা।
পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আলি আমিন গানদাপুর অভিযোগ করেছেন, গভর্নরের শাসন জারি ও ইমরান খানকে রাজনীতি থেকে ছিটকে দেওয়ার একটি পরিকল্পনা চলছে। তিনি এ ধরনের উদ্যোগকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন।
পিটিআইয়ের অভ্যন্তরে বিভাজনের অভিযোগ
পিটিআইয়ের অভ্যন্তরে ভাঙন ধরানোর ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ উঠেছে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) নেত্রী আজমা বুখারি ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আজমা’র দাবি, ইমরানকে তার নিজের বোন আলিমা খান ও দলের সদস্যরাই কোণঠাসা করে ফেলেছেন। আলিমার সঙ্গে পিটিআইয়ের সোশ্যাল মিডিয়া ইউনিটও নাকি ইমরান খানের বিরুদ্ধ একই অভিযানে যুক্ত।
আজমা বুখারি বলেন, যিনি (ইমরান) একদিন নওয়াজ শরিফকে ‘সাইডলাইন’ করার চেষ্টা করেছিলেন, আজ তিনি নিজেই তার ঘরে ও দলে অবাঞ্ছিত হয়ে গেছেন।
আজমা আরও দাবি করেন, পিটিআই এখন কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তিনটি ও প্রাদেশিক পর্যায়ে আরও তিনটি ভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত। খাইবার পাখতুনখোয়ায় একদিকে জুনায়েদ আকবর, অন্যদিকে আতিফ খান ও আরেকটি গ্রুপ বিদ্রোহী সদস্যদের নিয়ে গঠিত।
পিটিআইয়ের তীব্র প্রতিক্রিয়া
আজমার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় পিটিআই মুখপাত্র শেখ ওয়াকাস আকরাম বলেন, ইমরান খানকে বাদ দেওয়ার এই ষড়যন্ত্রে সরকার নিজেই অপমানিত ও নগ্ন হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রহমতে ইমরান খানকে মাইনাস নয়, বরং তার অবস্থান আরও কয়েকগুন শক্তিশালী করা হয়েছে। জাতি তাকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছে।
ওয়াকাস আকরাম দাবি করেন, গত তিন বছরে একাধিকবার পিটিআইকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র হয়েছে, কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়েছে। ‘ইমরান শুধু পিটিআইয়ের নেতা নন, তিনি জাতির নেতা। তার জনপ্রিয়তা, দমন-পীড়নের মধ্যেও বেড়েই চলেছে।
পাঞ্জাব সরকারকে দুর্নীতির অভিযোগে একহাত নিয়ে তিনি বলেন, পাঞ্জাবের এই ‘চুরি করা ম্যান্ডেট’ এখন এক লাখ কোটি রুপি লোপাটের কলঙ্কে কলুষিত। আজমা বুখারিকে বলা উচিত, ‘পানামা কুইনের’ অধীনে কীভাবে জনগণের সম্পদ লুট হচ্ছে।
এদিকে, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে খাইবার পাখতুনখোয়ার মুখ্যমন্ত্রী গানদাপুর বলেন, ইমরান খানই দলের নেতা। যদি তিনি বলেন, আমি এক মিনিটেই এই সরকার ছেড়ে দেব। সরকারটি তারই। তাকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা মানে দলের অস্তিত্বের ওপর আঘাত হানা।
তিনি অভিযোগ করেন, ইমরানের পরামর্শ ছাড়াই বাজেট পাশ করানো হয়েছিল ও পরিকল্পিতভাবে দলের ভেতরের আলোচনা বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। আলোচনা বাধাগ্রস্ত করে সরকার হাইজ্যাক করার একটি প্রচেষ্টা ছিল, যা ব্যর্থ হয়েছে।
গানদাপুর বলেন, খাইবার পাখতুনখোয়ায় অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করে গভর্নরের শাসন চাপিয়ে দেওয়ার একটি ষড়যন্ত্র চলছে। এটি মূলত ইমরান খানকে বাজেট প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার কৌশল।
তিনি আরও জানান, ইমরান খান মুক্তি পেলেই দলের ভেতরের ষড়যন্ত্রকারীরা জনসম্মুখে উন্মোচিত হবেন। দেখা যাবে কারা ইমরানকে দুর্বল করতে চাইছে, আর জনতা তাদের বিচার করবে।
পিটিআই কি বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে?
এই মুহূর্তে পিটিআই যে একাধিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে- তা খোদ ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই বলছেন। দলটির কৌশলগত সংকট স্পষ্ট হয়ে উঠছে কেন্দ্রে ও প্রাদেশিক পর্যায়ে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পিটিআইয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বহিরাগত চাপ- উভয়ই একত্রে কাজ করছে। ইমরান খানের অনুপস্থিতিতে দল নেতৃত্বহীন অবস্থায় নানা চাপ মোকাবিলা করছে এবং তার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
চলতি সপ্তাহে মালয়েশিয়ার পুলিশ এক অভিযানে ৩৬ বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করেছে। সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযোগ, তাদের চরমপন্থি মতাদর্শ ও সহিংস চিন্তাধারায় পরিচালিত একটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত বলে শনাক্ত করা হয়েছে।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল জানান, ২৪ এপ্রিল শুরু হওয়া অভিযানটি সেলাঙ্গর ও জোহর অঞ্চলে তিন ধাপে পরিচালিত হয়। তাদের মধ্যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে শাহ আলম ও জোহর বারুর সেশন আদালতে সন্ত্রাসবাদ সংশ্লিষ্ট অপরাধের ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৫ জনের বিরুদ্ধে দেশে ফেরত পাঠানোর (ডিপোর্টেশন) আদেশ জারি করা হয়েছে এবং ১৬ জনের বিরুদ্ধে এখনো তদন্ত চলছে। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, দলটি মালয়েশিয়ায় আইএসের মতাদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং নিজেদের কমিউনিটির ভেতরেই নিয়োগ সেল গঠন করেছিল।
সাইফুদ্দিন ইসমাইল বলেন, সেলগুলোর উদ্দেশ্য ছিল উগ্র মতাদর্শ প্রচার, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং শেষ পর্যন্ত নিজ দেশের বৈধ সরকার উৎখাত করা। মালয়েশিয়া কখনো কোনো বিদেশি উগ্রবাদী আন্দোলনের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবে না।
মন্ত্রী বলেন, আমরা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করব, যেন মালয়েশিয়া শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল এবং সন্ত্রাসী হুমকি থেকে মুক্ত থাকে। এই দেশকে কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের অপারেশনাল ঘাঁটি বা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করলে কঠোর, দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার খবর প্রচারের জন্য ট্রাম্প প্রশাসন বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে।
তারা জোর দিয়ে বলেছে, অভিযানটি সম্পূর্ণ সফল।
তারা সন্দেহ জাগিয়ে তোলা একটি গোয়েন্দা মূল্যায়নের প্রতিবেদনের জন্য সাংবাদিকদের তিরস্কার করেছে।
ওয়াশিংটন থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়।
গত সপ্তাহান্তে আমেরিকান বি-২ বোমারু বিমান দুটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় বিশাল জিবিইউ-৫৭ বাঙ্কার-বাস্টার বোমা হামলা চালিয়েছে। অন্যদিকে একটি গাইডেড মিসাইল সাবমেরিন টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তৃতীয় স্থানে আঘাত করেছে।
পেন্টাগনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ ইসরামফল ও ইরানের মধ্যে ১২ দিনের সংঘাতের কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘যুদ্ধ শেষ করার জন্য পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করে করে দিয়েছেন।’
ট্রাম্প নিজেই এই হামলাগুলোকে ‘অসাধারণ সামরিক সাফল্য’ বলে অভিহিত করে বারবার বলেছেন, তারা পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করেছে।
‘কিন্তু মার্কিন গণমাধ্যম এই সপ্তাহের শুরুতে একটি প্রাথমিক আমেরিকান গোয়েন্দা মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে যে, এই হামলাগুলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে।
হেগসেথ ও অন্যান্যরা এই প্রতিবেদনের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
হগসেথ বলেন, সিএনএন, এমএসএনবিসি বা নিউ ইয়র্ক টাইমস, যাই হোক না কেন, প্রাথমিক মূল্যায়নের ভুয়া খবর প্রচার করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই নথিটি ফাঁস হয়েছে, কারণ কারোর উদ্দেশ্য ছিল জল ঘোলা করা এবং এই ঐতিহাসিক হামলা সফল হয়নি বলে দেখানো’।
ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কভারেজের নিন্দা করেছেন। সাংবাদিকদের চাকরি হারানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবার ডেমোক্র্যাটদের মূল্যায়ন ফাঁস করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন এবং বলেছেন যে, তাদের বিচার করা উচিত।
রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে লক্ষ্যবস্তু স্থাপনার কাছে ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় চীনা টিভি সাংবাদিক আহত হয়েছেন।
তিনি তখন ওই এলাকায় প্রতিবেদনের কাজে নিয়াজিত ছিলেন।
শুক্রবার তার নিয়োগকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি এ তথ্য জানিয়েছেন।
সম্প্রচারকটি জানায়, রাষ্ট্র-অধিভুক্ত ফিনিক্স টিভির এক প্রতিবেদক লু ইউগুয়াং বৃহস্পতিবার বিকেলে আহত হন এবং তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শুক্রবার রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত একটি ভিডিওতে লুকে মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলার সময় লু কোরেনেভো গ্রামে এক চলচ্চিত্র কর্মীর সঙ্গে ছিলেন।
রাশিয়া কিয়েভকে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ’ করার অভিযোগ করেছে এবং ‘দায়িত্বশীল সরকারগুলোকে এই ঘটনার নিন্দা’ করার আহ্বান জানিয়েছে।
তবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনে মন্তব্য করেনি।
ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে চীন নিজেকে একটি নিরপেক্ষ পক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
কিন্তু পশ্চিমা সরকারগুলো বলেছে, বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মস্কোকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছে।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে ১২ দিনের যুদ্ধের অবসানের পর তিনি ‘শান্তি চুক্তি সম্প্রসারণের একটি সুযোগ দেখছেন’।
জেরুজালেম থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়।
তিনি এক ভিডিও বক্তৃতায় বলেন, ‘আমরা ইরানের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে লড়াই করেছি এবং একটি দুর্দান্ত বিজয় অর্জন করেছি। এই বিজয় শান্তি চুক্তিগুলোকে নাটকীয়ভাবে সম্প্রসারিত করার পথ খুলে দিয়েছে’।
তার মন্তব্য মূলত আব্রাহাম চুক্তির প্রতি ইঙ্গিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো।
ইসরাইল ও ইরান উভয়েই ১২ দিনের যুদ্ধে বিজয় দাবি করে। যা গত ২৪ জুন যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হয়েছে।
সংঘাত থামার পর ইসরাইল জানায়, তারা গাজায় হামাসবিরোধী অভিযানকে আবারও অগ্রাধিকার দেবে। সেখানে হামাস যোদ্ধারা এখনো ইসরাইলি জিম্মিদের আটকে রেখেছে।
নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমাদের জিম্মিদের মুক্তি এবং হামাসের বিরুদ্ধে বিজয়ের পাশাপাশি, এখন একটি বড় পরিসরের শান্তি চুক্তির জন্য জানালা খুলেছে। আমরা যেন এই সুযোগ হাতছাড়া না করি। একদিনও যেন নষ্ট না হয়।’
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর সৌদি আরবও ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে।
গত ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের ভয়াবহ হামলার জবাবে ইসরাইল গাজায় তাদের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ শুরু করে।
তেহরান যদি বিশ্বব্যাপী পরমাণু বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়, তবে ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’ হবে বলে জানিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।
তিনি বৃহস্পতিবার বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে মার্কিন হামলা ‘সত্যিকার অর্থেই কার্যকর’ ছিল।
ব্রাসেলস থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানিয়েছে।
ব্রাসেলসে ইইউ শীর্ষ সম্মেলনের পর সাংবাদিকদের ম্যাক্রোঁ বলেন, ইরানের পরমাণু বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া হবে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি।
চুক্তিটি বজায় রাখার জন্য ও পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার সীমিত করার উদ্দেশ্যে তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের সঙ্গেও কথা বলবেন।
বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এক ফোনালাপের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই এই আলোচনা শুরু হয়েছে।
আলোচনায় ম্যাক্রোঁ জানান, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেকে গত কয়েক দিন ধরে তেহরানের সঙ্গে প্যারিসের যোগাযোগের কথা জানিয়েছেন।
ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘আমাদের আশা, দৃষ্টিভঙ্গির সত্যিকারের মিলন ঘটবে, লক্ষ্য ছিল ইরান কর্তৃক ‘পুনরায় পারমাণবিক নির্মাণের কোনও প্রচেষ্টা’ না করা।
ইরান ১৯৭০ সালে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) অনুমোদন করে এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার কাছে তার পারমাণবিক উপাদান ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
কিন্তু সম্প্রতি তারা চুক্তি থেকে সম্ভাব্য প্রত্যাহারের জন্য ভিত্তি প্রস্তুত করতে শুরু করেছে। সংস্থাটিকে ইসরাইলের ‘আগ্রাসন যুদ্ধে’ ‘অংশীদার’ হিসেবে কাজ করার অভিযোগ এনেছে।
আমেরিকান বি-২ বোমারু বিমান গত সপ্তাহান্তে বিশাল জিবিইউ-৫৭ বাঙ্কার-বাস্টার বোমা দিয়ে দুটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত করেছে, যখন একটি গাইডেড মিসাইল সাবমেরিন টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তৃতীয় স্থানে আঘাত করেছে।
ট্রাম্প নিজেই এই হামলাগুলোকে ‘চমৎকার সামরিক সাফল্য’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বারবার বলেছেন যে, তারা পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করেছে।
কিন্তু মার্কিন সংবাদমাধ্যম এই সপ্তাহের শুরুতে একটি প্রাথমিক আমেরিকার গোয়েন্দা মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, এই হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেবল কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ ও অন্যরা এই প্রতিবেদনের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
ডলারের মূল্য বৃহস্পতিবার তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছ, কারণ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান জেরোম পাওয়েলের উত্তরসূরি খোঁজা শুরু করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেছে।
তবে ওয়াল স্ট্রিটে ছিল চাঙাভাব। চিপ নির্মাতা মাইক্রনের ভালো আয় ও হোয়াইট হাউসের সম্ভাব্য শুল্ক সময়সীমা বৃদ্ধির ইঙ্গিতের কারণে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ প্রায় রেকর্ড ছোঁয়া অবস্থানে পৌঁছে যায়।
নিউইয়র্ক থেকে এএফপি জানিয়েছে, বুধবার ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন, ২০২৬ সালে পাওয়েলের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁর বিকল্প তৈরির বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন।
হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা এএফপি’কে জানিয়েছেন, ‘চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। তবে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা বদলানোর অধিকার রয়েছে।’
ডলার ইনডেক্স, যা ডলারকে ছয়টি প্রধান মুদ্রার সঙ্গে তুলনা করে, তা বৃহস্পতিবার নেমে আসে ৯৬,৯৯৭ পয়েন্টে, যা মার্চ ২০২২-এর পর সর্বনিম্ন।
অন্যদিকে, পাউন্ড ডলারের তুলনায় অক্টোবর ২০২১ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে।
বিনিময় প্ল্যাটফর্ম নেগা.কম মিডল ইস্টের মহাব্যবস্থাপক জর্জ পাভেল বলেন, ‘ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ এবং মুদ্রানীতি শিথিলের বাড়তে থাকা প্রত্যাশা ডলারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। যদি ফেড চেয়ারম্যান পরিবর্তনের বিষয়টি সত্য হয়, তবে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলবে, যা ডলারের জন্য নেতিবাচক ইঙ্গিত।’
হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর থেকে, ট্রাম্প ক্রমাগত মার্কিন সুদের হার না কমানোর জন্য পাওয়েলের সমালোচনা করে আসছেন ও তার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং ব্যাংকের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ট্রাম্প ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি তিন বা চারজন লোককে জানি যাদের আমি বেছে নিতে যাচ্ছি।’
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বরেই ট্রাম্প নতুন চেয়ারম্যানের নাম ঘোষণা করতে পারেন। সম্ভাব্যদের মধ্যে রয়েছেন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কেভিন হ্যাসেট ও সাবেক ফেড গভর্নর কেভিন ওয়ার্শ।
সপ্তাহের শুরুতে জেরোম পাওয়েল কংগ্রেসে জানান, ট্রাম্পের শুল্কনীতি অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলছে, তা মূল্যায়নের পরই ফেড সুদের হারে সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে তথ্য অনুযায়ী প্রথম তিন মাসে মার্কিন অর্থনীতি বার্ষিক ০.৫ শতাংশ হারে কমেছে, যা পূর্বের অনুমানের চেয়ে কম।
তবে বাজার সাধারণত এই ধরনের তথ্যকে বেশি গুরুত্ব দেয় না, কারণ তা অতীতের ঘটনা এবং এখন সময় চলেছে দ্বিতীয় প্রান্তিকের শেষ দিকে।
ইতিবাচক দিক হলো, মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের টেকসই পণ্যের অর্ডার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হয়েছে, যদিও শ্রমবাজারের তথ্য ছিল মিশ্র।
ওইদিন ইউরোপ ও এশিয়ার শেয়ারবাজারে ওঠানামা দেখা যায়। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমে আসায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আলোচনায় মনোযোগ ফিরতে থাকায় তেলের দাম ছিল স্থিতিশীল।
ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো সামরিক বাজেট বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পর ইউরোপের প্রতিরক্ষা খাতের শেয়ারের দামে চোখে পড়ার মতো বৃদ্ধি দেখা যায়। ফ্রাঙ্কফুর্টে রাইনমেটালের শেয়ার ৭ শতাংশের বেশি বেড়ে এরপর থেমে যায়, ফ্রান্সের থ্যালেসের শেয়ার বাড়ে ৩ শতাংশ, আর যুক্তরাজ্যের বিএই সিস্টেমসের শেয়ার বেড়ে ৩.৮ শতাংশে পৌঁছায়।
দিনের শেষভাগে এশিয়ার প্রধান শেয়ার বাজারগুলো মিশ্র ধারায় লেনদেন শেষ করে।
মন্তব্য