কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে একসঙ্গে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ব্যক্তিগত ফোনে এমন নজরদারি করছে, যার সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার কোনো সম্পর্ক নেই। ইসরায়েলের একটি কোম্পানির তৈরি করা স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে অসংখ্য সংবাদ কর্মীর ওপরের চলছে নজরদারি। ঘটেছে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনাও।
ফ্রান্সের অলাভজনক সংবাদমাধ্যম ফরবিডেন স্টোরিজ এ নিয়ে বিশেষ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য সেটি অনুবাদ করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
বাকুতে খাদিজা ইসমায়িলোভার বাড়ি যেন এক কারাগার। কাস্পিয়ান সাগরের পাশে আজারবাইজানের মতো তেল-সমৃদ্ধ দেশে ২০১৪ সাল থেকে বাক স্বাধীনতা ও ভিন্ন মতের ওপর চাপ বাড়ছে। ক্ষমতাসীন পরিবার নিয়ে অনুসন্ধানের কারণে ইসমায়িলোভা সরকারের অন্যতম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন।
আজারবাইজানের এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক জানতেন, তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। তার বন্ধু ও পরিজনরাও একই কথা তাকে বলেছেন। বন্ধু ও পরিবারের লোকদেরকেও ইসমায়িলোভার ওপর নজর রাখতে বলা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ তার পেছনে ভালোভাবেই লেগেছে। তার বাড়িতে গোপন ক্যামেরা বসিয়ে তার যৌনসম্পর্কের মুহূর্তের ছবি তুলেছে; তার বিরুদ্ধে এক সহকর্মীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগ আনা হয়েছে; শেষ পর্যন্ত ট্যাক্স ফাঁকির দায়ে সাত বছরের জন্য কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছে।
১৮ মাস পর তাকে জামিনে ছাড়া হলেও পাঁচ বছরের জন্য তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
২০২১ সালের মে মাসে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর, যখন ইসমায়িলোভা সবকিছু গুছিয়ে তুরস্কের আঙ্কারা যাওয়ার বিমানে ওঠেন, তিনি ভেবেছিলেন সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে পারবেন।
তবে তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এক গুপ্তচর তার সঙ্গে যাচ্ছে।
প্রায় তিন বছর ইসমায়িলোভার ফোনে পেগাসাস (ফোন হ্যাক করার ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার) ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ফরবিডেন স্টোরিজের সঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাবের পরীক্ষা অনুযায়ী, ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসওর তৈরি এই অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যারটি যে কোনো ফোনের তথ্যের নিয়ন্ত্রণ দিতে পারে, এমনকি দূর থেকে ক্যামেরা ও মাইক্রোফোনের নিয়ন্ত্রণও নেয়াও সম্ভব।
নিজের ফোনের নিরাপত্তা হাতছাড়া হওয়ার বিষয়টি জানতে পারার পরদিন ইসমায়িলোভা আঙ্কারায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি সারারাত ভেবেছি, আমার ফোন দিয়ে কী কী করেছি। যে মেসেজগুলো পাঠিয়েছি ওগুলোর জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। অন্য যারা আমার ফোনটিকে নিরাপদ ভেবে এনক্রিপ্টেড মেসেজ পাঠিয়েছে তাদের জন্যও নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।’
তিনি যোগ করেন, ‘আমার পরিবারের সদস্যরাও এর শিকার। আমার সোর্স, যাদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি, যারা আমাকে তাদের গোপন কথা জানিয়েছে তারাও এর শিকার হয়েছেন।’
দ্য পেগাসাস প্রজেক্ট
ফরবিডেন স্টোরিজের সঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাবের সহযোগিতায় বিশ্বের ১০টি দেশের ১৭টি সংবাদমাধ্যমের ৮০ জন সাংবাদিক মিলে পেগাসাস প্রজেক্ট নামে যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসমায়িলোভার মতো বিশ্ব জুড়ে আরও অন্তত ২০০ সাংবাদিকের ফোনকে নিশানা করেছে এনএসওর ক্লায়েন্ট দেশগুলোর কর্তৃপক্ষ।
এনএসওর ক্লায়েন্টদের নজরদারির জন্য নির্বাচিত ফোন নম্বরের ৫০ হাজার রেকর্ডের একটি ফাঁস হওয়া ডেটাবেস হাতে এসেছে ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের। ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর পার্টনারদের এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে অন্তত ১০টি এনএসও ক্লায়েন্ট ২০ দেশের অন্তত ১৮০ জন সাংবাদিকের ফোনকে বাছাই করছে।
এই ক্লায়েন্ট সরকারগুলোর মধ্যে যেমন স্বৈরাচারী সরকার (বাহরাইন, মরক্কো ও সৌদি আরব) রয়েছে তেমনি গণতান্ত্রিক সরকারও (ভারত ও মেক্সিকো) রয়েছে। এর বিস্তার ইউরোপের হাঙ্গেরি ও আজারবাইজান থেকে আফ্রিকার টোগো আর রুয়ান্ডার মতো বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তে। পেগাসাস প্রজেক্টে দেখা গেছে, এই সরকারগুলোর অনেকেই সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ব্যবসায়ী, এমনকি সরকার প্রধানের বিরুদ্ধেও এই মারাত্মক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে ভয় পায়নি।
ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর পার্টনারদেরকে লেখা এক চিঠিতে ‘চুক্তিভিত্তিক ও জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে’র বিষয়টি উল্লেখ করে এনএসও গ্রুপ জানায়, ‘আমরা আমাদের সরকারি গ্রাহকের নাম ও পরিচয় অস্বীকার বা নিশ্চিত করতে পারছি না’।
ফরবিডেন স্টোরিজ ও মিডিয়া অংশীদাররা এই প্রকল্পে উদ্ধৃত সরকারি ক্লায়েন্টদের প্রত্যেকের কাছে পৌঁছেছে, যাদের প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রশ্নের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে বা এনএসও গ্রুপের ক্লায়েন্ট হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
ফাঁস হওয়া তালিকায় পাওয়া কোনো নির্দিষ্ট ফোন নম্বরকে আক্রমণ করা হয়েছে কিনা সেটা ওই নম্বর ব্যবহারকারীর ডিভাইসের ফরেনসিক পরীক্ষা না করে বের করা সম্ভব নয়। তারপরও ফরবিডেন স্টোরিজের সঙ্গে মিলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাব এক ডজনেরও বেশি সাংবাদিকের মোট ৬৭টি ফোন পরীক্ষা করে দেখেছে, আইফোনে গত মাস পর্যন্ত নিরাপত্তা ত্রুটির সুযোগ নিয়ে সফলভাবে আক্রমণ করা সম্ভব হয়েছে।
এনএসও গ্রুপ যদিও বারবার বলে এসেছে যে, তাদের সফটওয়্যার শুধু অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হচ্ছে, তারপরও বহুদিন ধরে ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর সঙ্গীরা মিলে ফোন নম্বরগুলো বিশ্লেষণ করে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর হতবাক হওয়ার মতো নজরদারির মাত্রা পেয়েছে। এতে করে স্পাইওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখার ভয়টাই সত্য হল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল আগনেস কালামাদ বলেন, ‘এই নম্বরগুলো প্রমাণ করে, এর অপব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছে। এতে করে সাংবাদিক, তাদের পরিবার ও তাদের সংশ্লিষ্টদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে ও সমালোচনামূলক মাধ্যম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
‘মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পাবলিক ন্যারেটিভকে নিয়ন্ত্রণ করা, সমালোচনাকে বাধা দেয়া ও ভিন্নমতকে চাপা দেয়া।’
এই রেকর্ডে নাম থাকা সাংবাদিকরা আইনি হুমকি পেয়েছেন, অনেককেই গ্রেপ্তার ও অপমান করা হয়েছে, জুলুমের কারণে অনেকে দেশ ছেড়ে পালানোর পরও তারা জানতে পারেননি যে, তারা তখনও নজরদারিতে রয়েছেন।
কিছু ক্ষেত্রে টার্গেটে থাকা সাংবাদিককে মেরে ফেলা হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে এটাই পরিষ্কার যে, দমনকারী সরকার ও তাদের সহযোগী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে এটি খুবই প্রয়োজনীয় একটি প্রযুক্তিতে পরিণত হয়েছে।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস এর প্রকল্প প্রধান কার্লোস মার্তিনেস দে লা সেরনা ফরবিডেন স্টোরিজকে বলেন, ‘সাংবাদিকদের নজরদারিতে রাখার একটু ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এটি খুবই বড় একটি সমস্যা। আর সবারই একে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত। শুধু যেসব সাংবাদিক বিপজ্জনক পরিবেশ কাজ করছেন তাদের জন্যই নয়, বরং আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে কাজ করা সাংবাদিকদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য।’
ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর সঙ্গীদেরকে এক লিখিত জবাবে এনএসও গ্রুপ জানায় যে, তাদের প্রতিবেদনটি ‘ভুল অনুমান’ ও ‘অসমর্থিত তত্ত্বের উপর’ ভিত্তি করে তৈরি। তারা আবারও জোর দেয় যে, তাদের কোম্পানি ‘জীবন রক্ষার মিশনে’ নিয়োজিত।
তারা লিখেছে, ‘এনএসও গ্রুপ খুব শক্তভাবে আপনাদের প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে। আপনাদের প্রতিবেদনটি আসলে অনেকগুলো অসমর্থিত তত্ত্বনির্ভর, যেটি আপনাদের তথ্যসূত্র ও আপনাদের গল্পের ভিত্তি নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
‘আপনাদের সূত্র যে তথ্য দিয়েছে তার কোনো সঠিক ভিত্তি নেই, যে কারণে আপনাদের দাবিগুলোকে সমর্থন করার মতো কোনো দলিল নেই।’
এতে আরও বলা হয়, “অভিযোগে উল্লেখিত ‘ফাঁস হওয়া ৫০ হাজার ফোন নম্বরের ডেটা’ পেগাসাস ব্যবহার করে, এতগুলো নম্বর কোনো সরকারের টার্গেটের তালিকা হতে পারে না।’
ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর পার্টনারদেরকে পাঠানো চিঠিতে এনএসও গ্রুপ আরও লিখেছে, ‘এনএসও তার গ্রাহকদের গোয়েন্দা তৎপরতার ভেতরের খবর জানে না। তারপরও গোয়েন্দা তৎপরতা সম্পর্কে একটি সাধারণ ও সামান্য জ্ঞান থেকে এটা সুস্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নজরদারি চালানোর জন্য এই ধরনের সিস্টেম ব্যবহার করা হয় না।’
সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীর মতোই বিপজ্জনক
হাঙ্গেরির ডিরেক্ট থার্টি সিক্সের অনুসন্ধানি সাংবাদিক এসজাবোলটস পানিউই যখন জানতে পারেন তার ফোন পেগাসাস স্পাইওয়্যারে আক্রান্ত, তখন রীতিমতো ভেঙে পড়েছিলেন।
এনক্রিপ্টেড যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে তিনি ফরবিডেন স্টোরিজকে বলেন, ‘এই দেশে এমনও অনেক আছেন, যারা একজন সাধারণ সাংবাদিককে সন্ত্রাসীর মতো একই নজরে দেখেন।’
পানিউই মধ্য তিরিশের এক তরুণ। গোল ফ্রেমের চশমা পড়েন ও মুখে রুক্ষ দাড়ি। পুরস্কার বিজয়ী এই সাংবাদিক প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও অন্যান্য স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের নানা দেশের হাজারো লোকের ফোন নম্বর তার রোলডেস্কে আছে। তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এক বছর ছিলেন, যা তাকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আদর্শ নিশানায় পরিণত করেছে।
২০১৯ সালে যখন তার ফোন আক্রান্ত হয় সেসময় পানিউই দুটো গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে কাজ করছিলেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনের সহযোগিতায় ফরবিডেন স্টোরিজ নিশ্চিত করতে পেরেছে, ওই বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর এই ৯ মাস তার ফোন আক্রান্ত ছিল। তার কাছে আসা আনুষ্ঠানিক মন্তব্য বা সূত্রের সঙ্গে জরুরি দেখা করার অনুরোধের ‘ছদ্মবেশে’ আসত এই আক্রমণগুলো।
২০১৯ সালে বুদাপেস্টে ব্যাংকের শাখা খুলতে চাওয়া রাশিয়ার মদদপুষ্ট ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ওপর প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করছিলেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের এক সাংবাদিক। ওই সাংবাদিকের ফিক্সার হিসেবে নিয়োজিত হাঙ্গেরিয়ান ফটো সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা করার সময় পানিউইয়ের ফোনে ডিজিটাল আক্রমণ হয়।
ফরবিডেন স্টোরিজ যেসব রেকর্ড পেয়েছে সেগুলো অনুযায়ী, একই সময়ে ওই ফটোসাংবাদিকও টার্গেট ছিলেন।
পানিউই বলেন, ‘রাশিয়ান ব্যাংকটি নিয়ে আমেরিকান ও হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিকরা কী লিখতে চাচ্ছেন সে বিষয়ে আগ্রহ থাকার সমূহ সম্ভাবনা আছে যারা ওই সিস্টেমটা চালাচ্ছিল।’
ইসরায়েলি কোম্পানি ব্ল্যাক কিউবের সাবকন্ট্র্যাকটর হিসেবে রোনান ফ্যারো, জোডি ক্যান্টর ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রিপোর্টার ব্র্যাডলি হোপের ওপর নজর রাখা প্রাইভেট গোয়েন্দা ইগর অস্ট্রভস্কি এখন নিজেই সাংবাদিকদের তথ্য নিরাপত্তার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তার মতে, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে পানিউইয়ের মতো সাংবাদিক তথ্য সূত্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, সাংবাদিকদের হাত দিয়ে প্রচুর তথ্য আদান-প্রদান হয়, যে কারণে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তাদের নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর আগ্রহ থাকতে পারে যে, কে সরকারের মধ্যে থেকে তথ্য ফাঁস করছে অথবা সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবসার ভেতরের খবর প্রকাশ করছে। তারা এই ফাঁস হওয়া তথ্যের সোর্স জানতে চেষ্টা করতে পারে।’
ভারতীয় ব্যবসা ও রাজনীতি নিয়ে বেশ কিছু বই লেখা অনুসন্ধানী সাংবাদিক পরাঞ্জয় গুহ ঠাকুরতার ফোন হ্যাক করা হয় ২০১৮ সালে। ফরবিডেন স্টোরিজকে ঠাকুরতা জানান, সোর্সের নাম গোপন রাখার শর্তেই তিনি কাজ করতেন। তিনি বলেন, তাকে যখন টার্গেট করা হয় তখন তিনি ভারতের সাবেক শীর্ষ ধনী ধিরুভাই আম্বানির আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে অনুসন্ধান করছিলেন।
ঠাকুরতা বলেন, ‘তারা জানে কারা আমাদের সোর্স। আমার ফোনে ঢুকে আমি কাদের সঙ্গে কথা বলছি সেটা দেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাকে বা আমার সহকর্মীদেরকে তথ্য কে দিচ্ছে সেটা বের করা।’
ঠাকুরতা অন্তত ৪০ জন ভারতীয় সাংবাদিকের একজন, যাকে এনএসওর একটি ক্লায়েন্টের টার্গেট হিসাবে বাছাই করা হয়েছে। ফরবিডেন স্টোরিজ এবং এর সহযোগীরা ফাঁস হওয়া ডেটা যাচাই করে মনে করছে, এই ক্লায়েন্ট ভারতীয় সরকার।
ভারত সরকার কখনও এনএসও গ্রুপের ক্লায়েন্ট হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত বা অস্বীকার করেনি। ফরবিডেন স্টোরিজ এবং এর সহযোগীদের পাঠানো বিশদ প্রশ্নের জবাবে মিনিস্ট্রি অফ ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজির এক মুখপাত্র লেখেন, ‘নির্দিষ্ট লোকের উপর সরকারি নজরদারির অভিযোগের কোনো সত্যতা বা শক্ত ভিত্তি নেই।’
২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ১২১ পেগাসাস টার্গেটের চারজনের খবর প্রকাশিত হলেও, ফরবিডেন স্টোরিজের পাওয়া রেকর্ড যাচাই করে মনে হচ্ছে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।
দুই হাজারেরও বেশি ভারতীয় ও পাকিস্তানি নম্বরকে ২০১৭ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে টার্গেট করা হয়েছে। এর মধ্যে দ্য হিন্দু, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ইন্ডিয়া টুডে, ট্রিবিউন ও পাইওনিয়ারের মতো প্রায় সব শীর্ষ ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক রয়েছেন।
পাঞ্জাবি ভাষায় পাঞ্জাব থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক জশপাল সিং হেরানের মতো স্থানীয় সাংবাদিকদেরও টার্গেট করা হয়।
স্বাধীন অনলাইন সংবাদ মাধ্যম দ্য অয়্যারের তিন প্রতিষ্ঠাতার দুই জন সিদ্ধার্থ ভরদরাজন ও এমকে ভেনুর ফোনেও পেগাসাস আক্রমণ করে। এর মধ্যে ভেনুর ফোন হ্যাক করা হয় গত জুলাইয়ে।
ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর পার্টনার যার মধ্যে দ্য অয়্যারও রয়েছে তাদের হাতে আসা রেকর্ড ঘেঁটে দেখে গেছে, অয়্যারের অন্যান্য সাংবাদিক যারা এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বা কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করেন যেমন কলামনিস্ট প্রেম শংকর ঝা, অনুসন্ধানী রিপোর্টার রোহিনি সিং, কূটনৈতিক সম্পাদক দেভিরুপা মিত্র আর কন্ট্রিবিউটর স্বাতী চতুর্ভেদি সবাইকে টার্গেট করা হয়।
২০১৮ সালে ভরদরাজনের ফোন হ্যাক করা হয়। তিনি বলেন, ‘দ্য অয়্যারের সঙ্গে জড়িত এতগুলো নাম থাকাটা উদ্বেগজনক। অবশ্য অয়্যারের সঙ্গে জড়িত নন এমন সংখ্যাও অনেক। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের নজরদারিতে রাখার বিষয়টিকে সাধারণ প্রবণতা বলে মনে হচ্ছে।’
হ্যাক হওয়া ফোনের সাংবাদিকদের সঙ্গে ফরবিডেন স্টোরিজ ও অংশীদার সংবাদসংস্থাগুলো কথা বলেছে। তারা সবাই এনক্রিপ্টেড মেসেজ ব্যবহার ও নিয়মিত আপডেটের সতর্কতা অবলম্বনের পরও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত না থাকার বিষয়টি জানতে পেরে হতাশা প্রকাশ করেন।
ইসমায়িলোভা বলেন, ‘সরকারের চোখ থেকে লুকাতে আমরা একে অন্যকে ফোনে এই টুল ব্যবহার করা যায়, বা ওই টুলটা ভালো- এগুলো নিয়মিত বলতাম। আর গতকাল আমি বুঝতে পারলাম, কোনো লাভ নেই। নিজেকে লোহার তাবুতে আটকে রাখা ছাড়া আমার যোগাযোগ ব্যবস্থায় ওদের বাধা ঠেকানোর প্রয়োজন নেই।’
পানিউই চিন্তিত যে, টার্গেট হওয়ার খবরটা প্রকাশ পেয়ে গেলে তার সোর্সরা ভবিষ্যতে যোগাযোগের জন্য আর আগ্রহী হবে না।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক সাংবাদিক যাদেরকে টার্গেট করা হয়েছে তারা চিন্তায় আছেন, তাদের ওপর নজরদারির খবর যদি প্রকাশ পায় বা আমাদেরকে পাঠানো গোপন বার্তা যদি কেউ পড়ে ফেলে তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সঙ্গে আর কে কথা বলবে? সবাই ভাববে আমরা কলুষিত ও বোঝা হয়ে দাঁড়াব।’
‘পেছন থেকে লুকিয়ে দেখা’: শূন্য ক্লিকে কীভাবে সাংবাদিকদের ওপর নজর রেখেছে পেগাসাস
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাবে সাংবাদিকদের যেসব সেল ফোনের ফরেনসিকস পরীক্ষা হয়েছে সেগুলোর ফলাফল অতীতের অন্য কয়েকটি পরীক্ষার ফলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর মধ্যে আছেন গত বছরের ডিসেম্বরে সিটিজেন ল্যাব চিহ্নিত হ্যাকের শিকার হওয়া সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের কয়েক ডজন সাংবাদিক।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাবের পরিচালক ক্লদিও গারনিয়েরি বলেন, ‘এগুলো একই ঘটনার কয়েকটি আলাদা অংশ যা সুন্দরভাবে জোড়া লেগে যাবে। আমার কোনো সন্দেহ নেই, আমরা যা দেখছি সেটা পেগাসাস। কারণ এর বৈশিষ্ট্য অন্যসব স্পাইওয়্যারের চেয়ে একদম আলাদা। আর আমরা যে বিষয়গুলো পেয়েছি সেগুলো একে অপরের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয়।’
এর আগে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) ২০১১ সাল থেকে নয়টি দেশের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে চারটি দেশের সফটওয়্যার কোম্পানির তৈরি করা স্পাইওয়্যারের ৩৮টি উদাহরণ নথিভুক্ত করেছিল।
ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশনের (ইএফএফ) সাইবার সিকিউরিটির পরিচালক ইভা গালপেরিন বলেন, ২০১০ এর দশকের গোড়ার দিকে বেশির ভাগ ম্যালওয়্যার আক্রমণ এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না।
তিনি বলেন, ‘২০১১ সালে আপনি একটি ইমেল পেতেন ও ইমেলটি আপনার কম্পিউটারে যেত। এর ম্যালওয়্যারটি এমনভাবে তৈরি যে এটি নিজে থেকেই আপনার কম্পিউটারে ইনস্টল হতো।
“২০১৪ সালের দিকে সাংবাদিকদের ওপর নজরদারির জন্য ‘মোবাইল-ফার্স্ট’ পদ্ধতি জনপ্রিয়তা অর্জন করে, কারণ স্মার্টফোনগুলি সহজলভ্য হয়ে ওঠে। এনএসও, হ্যাকিং টিম ও ফিনফিশারের মতো কোম্পানির ক্লায়েন্টরা টার্গেটদের জন্য বিশেষায়িত মেসেজ পাঠাতো যেগুলোতে প্রায়ই তাদের পরিবার বা কোনো খবর সম্পর্কিত তথ্য থাকতো। ম্যালওয়ারগুলো তাদের ফোনে ইনস্টল হতে হলে টার্গেটদের একটি লিঙ্কে ক্লিক করতে হতো।”
অস্ট্রোভস্কি বলেন, ‘গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর টার্গেট প্রায়ই হন সাংবাদিকেরা, কারণ তারা সবসময়ই তথ্যের জন্য নতুন নতুন উৎস খুঁজতে থাকেন, যা তাদের ফিশিং প্রচেষ্টার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এছাড়া অনেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তার সেরা পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করেন না।’
পেগাসাস আক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রথম মেক্সিকোতে চিহ্নিত করা হয় ২০১৫ ও ২০১৬ সালে।
আরিসতেহি নোতিসিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা ও মেক্সিকান অনুসন্ধানী সাংবাদিক কারমেন আরিসতেহি, মেক্সিকোর সাবেক প্রেসিডেন্ট এনিরিকে পেনা নিয়েতোর সম্পত্তি নিয়ে অনুসন্ধান প্রকাশ করার পর ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সন্দেহজনক লিংকসহ মেসেজ পেতে থাকেন।
ডিজিটাল অধিকার সংস্থা সিটিজেন ল্যাব পরবর্তীতে ২০১৭ সালে গোবের্নো এসপিয়া (সরকারে গুপ্তচরবৃত্তি) রিপোর্টে প্রকাশ করে যে, আরিসতেহি ক্ষতিকর পেগাসাস লিঙ্কযুক্ত ২০টিরও বেশি টেক্সট মেসেজ পান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একই সময়ে তার বেশ কয়েকজন সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যের ফোনে ক্ষতিকর লিঙ্কযুক্ত টেক্সট পাঠানো হয়। এর মধ্যে ছিলেন তার সহকর্মী সেবাস্তিয়ান বারাগান ও রাফায়েল কাব্রেরা ও আরিসতেহির ছেলে এমিলিও, যার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর।
ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর সহযোগীরা প্রথমবারের মতো এটা খুঁজে বের করে যে, ২০১৬ সালে আরিসতেহির কাছের আরও তিন জনের ওপর নজরদারি করা হয়। এরা হলেন তার বোন তেরেসা, তার সিএনএনের প্রযোজক কারিনা মারসিয়েল ও তার সাবেক সহকারী সান্দ্রা নোহালেস।
পেগাসাস প্রজেক্টের অংশ হিসেবে কাজ করা আরিসতেহি বলেন, ‘আমার কাছের মানুষদের ওই তালিকাতে দেখা চমকের মতো ছিল। আমার ছয় ভাই বোন আছে, এদের মধ্যে অন্তত একজন আমার বোন এই সিস্টেমের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। আমার শিডিউল, যোগাযোগ, দৈনিক ও ঘণ্টার সূচি জানতেন যে ব্যক্তিগত সহকারী সান্দ্রা নোহালেস তিনিও ওই সিস্টেমের মধ্যে ঢুকে যান।’
গারনিয়েরি বলেন, শুরুর দিনগুলোর চেয়ে স্মার্টফোনে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ইনস্টলের প্রক্রিয়া আরও সূক্ষ্ম হয়ে উঠেছে। স্পাইওয়্যার ইনস্টল করার জন্য টার্গেটকে এখন কোনো লিঙ্কে ক্লিক করারও দরকার পড়ে না। শূন্য-ক্লিকের মাধ্যমে টার্গেটের কোনো ধরনের অংশগ্রহণ ছাড়াই ফোনের নিয়ন্ত্রণ ক্লায়েন্টের হাতে চলে যায়।
তিনি বলেন, ‘এই আক্রমণগুলো করার জটিল পদ্ধতি গাণিতিক হারে বেড়েছে।’
একবার ফোনে সফলভাবে ইনস্টল হয়ে গেলে পেগাসাস স্পাইওয়্যার এনএসও ক্লায়েন্টকে সম্পূর্ণ ডিভাইসের অ্যাক্সেস দেয়। এর ফলে সিগন্যাল, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপগুলিকে বাইপাস করার ক্ষমতাও পায় এটি। ডিভাইস বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পেগাসাস ইচ্ছামত সক্রিয় করা যেতে পারে। ডিভাইস অন করার সঙ্গে সঙ্গে এটি আবার ফোনকে আক্রমণ করতে সক্ষম।
হার্ভার্ডের বার্কম্যান ক্লাইন সেন্টার ফর ইন্টারনেট অ্যান্ড সোসাইটির ক্রিপ্টোলজিস্ট ও ফেলো ব্রুস স্নাইয়ার বলেন, ‘যদি কেউ আপনার কাঁধের ওপর দিয়ে কিছু পড়েন তবে আপনি কোন ধরনের এনক্রিপশন ব্যবহার করছেন সেটা কোনো বিষয় নয়।’
গারনিয়েরির মতে, পেগাসাস অপারেটররা দূর থেকে অডিও ও ভিডিও রেকর্ড, মেসেজিং অ্যাপ থেকে ডেটা বের করা, অবস্থান জানার জন্য জিপিএস ব্যবহার ও পাসওয়ার্ড ও অথেনটিকেশন কি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম।
নজর রাখা সরকারগুলো সাম্প্রতিক বছরে শনাক্তকরণ এড়ানোর জন্য ‘হিট অ্যান্ড রান’ কৌশল গ্রহণ করেছে, বলেন গেলপারিন। তাদের লক্ষ্য, ফোনে আক্রমণ, ডেটা উদ্ধার ও দ্রুত বের হয়ে যাওয়া।
অস্ট্রোভস্কির ধারণা, এই ধরনের ডিজিটাল প্রযুক্তি দৈহিক নজরদারির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল অনুপ্রবেশ খুবই মূল্যবান। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনার ক্যালেন্ডারটি যদি আমি জানি, যদি জানা যায় যে, আপনি একটি নির্দিষ্ট মিটিং করতে যাচ্ছেন বা আপনার ইমেইলটিতে নজর দিতে পারি, আপনার নোট বা বেশিরভাগের ফোনে যা থাকে সেগুলো যদি জানতে পারি তাহলে যে লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছি তাতে আরও বেশি সফল হতে পারব।’
স্পাইওয়্যারের জন্য নতুন বাজার
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাংবাদিকদের নজরদারিতে রাখা নতুন কিছু নয়। যা বদলেছে তা হলো স্পাইওয়্যারের জন্য বাজার।
গালপেরিনের মতে, আগের সরকারগুলো যেখানে নিজ ঘরে স্পাইওয়্যার বানাতো। এখন গোয়েন্দা কর্মসূচি বিকাশের জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা না থাকা সরকারগুলোকে নিজেদের পণ্য বিক্রির বাজার হিসেবে দেখছে এনএসও গ্রুপ, ফিনফিশার ও হ্যাকিং টিমের মতো বেসরকারি স্পাইওয়্যার কোম্পানিগুলো।
তার মতে, এতে করে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর নজরদারির ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’ তৈরি হচ্ছে।
ডিজিটাল রাইটস অর্গানাইজেশন সিটিজেন ল্যাবের ২০১৮ সালের ‘হাইড অ্যান্ড সিক’ প্রতিবেদনে সৌদি আরব, মরক্কো এবং বাহরাইনসহ সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের নির্বিচারে আটকের রেকর্ড থাকা বেশ কয়েকটি দেশে এনএসওর পেগাসাস অপারেটরদের চিহ্নিত করা হয়। সংবাদ সংস্থাগুলোর প্রাপ্ত ফাঁস হওয়া ডেটাবেজ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায়, এই দেশের এনএসও ক্লায়েন্টরা কয়েক হাজার ফোন নম্বর নির্বাচন করেছে।
ফরবিডেন স্টোরিজ মরোক্কোর ফ্রি-ল্যান্স অনুসন্ধানী সাংবাদিক ওমর রাদির মতো কয়েকজন সাংবাদিকের ফোনে সাইবার অনুপ্রবেশের ঘটনা ২০২০ সালে প্রকাশ করে। রাদি ও ভারতীয় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী আনন্দ টেলটুম্বডের ফোনে আক্রমণের বিষয়টি অধিকার গোষ্ঠী ও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর তাদের কারাবন্দি করা হয়।
স্পাইওয়্যার নির্মাতা কোম্পানিগুলো তাদের স্পাইওয়্যার সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য তুলনামূলকভাবে খুবই কম আইনি বা আর্থিক জরিমানার মুখোমুখি হয়েছে। সাম্প্রতিক আইনি মামলাগুলো এই নির্মাতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। ২০২১ সালের জুনে ফরাসি স্পাইওয়্যার নির্মাতা অ্যামেসিসকে ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে লিবিয়ায় স্পাইওয়্যার বিক্রির কারণে ‘নির্যাতনে জড়িত’ থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।
সেই মামলার বাদীদের মতে, ডিজিটাল নজরদারি দিয়ে যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল তা ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরোধীদের চিহ্নিত ও খুঁজে বের করে কারাগারে নির্যাতনের কাজে ব্যবহার করা হয়।
গালপেরিন বলেন, ‘আপনি যদি সঠিক সাংবাদিকতা করেন, আপনি যদি ক্ষমতায় থাকা লোককে সত্য কথা বলেন তাহলে ক্ষমতায় থাকাদের আপনি রাগিয়ে দিচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির কাহিনী প্রকাশ করতে যারা সাংবাদিকতা করছিলেন তাদেরকে প্রায়ই টার্গেট করা হতো। যে ব্যক্তিরা আবার অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারের প্রতিবাদ করেছিলেন, তারা নজরদারির তালিকার শুরুর দিকে ছিলেন।’
এনএসও গ্রুপ বলছে, তাদের প্রযুক্তি অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের অনুসরণ করতে একমাত্র গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যবহার করে। ২০২১ সালের জুনে প্রকাশিত এনএসও গ্রুপের ট্র্যান্সপারেন্সি অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ৪০টি দেশে এর ৬০টি ক্লায়েন্ট রয়েছে।
প্রতিবেদনে এনএসও গ্রুপ লেখে, ‘পেগাসাস কোনো গণনজরদারি করার প্রযুক্তি নয়। এটা গুরুতর অপরাধ ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির মোবাইল ডিভাইস থেকে ডেটা সংগ্রহ করে।’
যদিও এনএসও বলছে, তাদের ৫৫টি দেশের একটি তালিকা রয়েছে, বাজে মানবাধিকার রেকর্ডের জন্য তাদের কাছে তারা পণ্য বিক্রি করবে না। তবে সেই দেশের নামগুলো প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনএসও গ্রুপ ২০১৬ সাল থেকে মানবাধিকার শর্ত পূরণ না করা পাঁচ ক্লায়েন্টের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে ও অপব্যবহারের অভিযোগে পাঁচ ক্লায়েন্টের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে।
ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর মিডিয়া সহযোগীদের কাছে পাঠানো এক লিখিত বিবৃতিতে এনএস গ্রুপ জানায়, ‘এনএসও গ্রুপ সব ধরনের অপব্যবহারের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের তদন্ত করবে ও তদন্তের ফলের ওপর ভিত্তি করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এর মধ্যে গ্রাহকদের সিস্টেম বন্ধ করে দেয়া অন্তর্ভুক্ত। এনএসও প্রমাণ করেছে এমনটা করতে তাদের দক্ষতা ও সদিচ্ছা রয়েছে। প্রমাণিত অপব্যবহারের কারণে এমনটা তারা আগেও একাধিকবার করেছে ও ভবিষ্যতেও পরিস্থিতি অনুযায়ী এমনটা করতে সংকোচ করবে না।’
তারপরও ফাঁস হওয়া ডেটায় দেখা গেছে, বাকস্বাধীনতা দমনকারী অনেক স্বৈরাচারী সরকার তাদের ক্লায়েন্টের তালিকায় রয়ে গেছে।
পেগাসাস প্রজেক্টের অংশ হিসাবে, ফরবিডেন স্টোরিজ আজারবাইজানে প্রথমবারের মতো পেগাসাসের ব্যবহার লক্ষ্য করেছে। দেশটির দুটি মুক্ত সংবাদমাধ্যম আজাদলিক ডটইনফো ও মেহদার টিভির সাংবাদিকসহ ৪০ জনেরও বেশি সাংবাদিককে টার্গেট হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে।
আজারবাইজানে অধিকাংশ মুক্ত সংবাদমাধ্যম ব্লক করা এবং সেখানে কাজ করা সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যরা নিয়মিতভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিগৃহীত হন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, কয়েক দশক ধরে দেশটিতে শাসন করা প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ ও তার পরিবার সমালোচকদের কণ্ঠ ‘পরোক্ষভাবে রোধ’ করছে।
ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাবের বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সেভিংক ভাকিফকিজির ফোন ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আক্রান্ত হয়।
মেহদার টিভির ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা ভাকিফকিজিকে বেশ কয়েকবার হুমকির শিকার হতে হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ কাভার করতে গিয়ে তিনি মারও খেয়েছেন।
৩০ বছর বয়সের আশেপাশে থাকা কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলের এই সাংবাদিক ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর সহযোগীদের জানান, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সরকার তার ব্যক্তিগত তথ্যে অনুপ্রবেশ করছে।
তিনি বলেন, ‘আমি বন্ধুদের সবসময় বলে এসেছি যে তারা আমাদেরকে শুনতে পায়। আমার সোর্স, যারা আমাকে বিশ্বাস করে ও হোয়্যাটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠায় তাদের নিয়ে আমি চিন্তিত। তাদের যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে সেটা আমাদের জন্যও ভালো কিছু হবে না।’
তিনি তিন মাসের বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে আসার পরও নিজ দেশের সরকারের কাছ থেকে নিরাপদ বোধ করছেন না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও অন্যান্য সংস্থাগুলো যাচাই করে দেখেছে, দেশ ছাড়ার পরও আজারবাইজানি অধিকার কর্মীদের শারীরিক ও ডিজিটাল হুমকির শিকার হতে হচ্ছে।
ভাকিফকিজি বলেন, ‘আপনার যদি একটা ফোন থাকে তাহলে তারা জার্মানিতেও আপনাকে টার্গেট করতে পারবে।’
চোখের আড়ালে, কিন্তু নাগালের বাইরে নয়
প্যারিসে হিশাম মানসুরির মেইসো দ্য জ্যনালিস্তেস (হাউজ অফ জার্নালিস্টস) এর অফিসের দেয়াল রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যম অধিকার রক্ষা প্রতিষ্ঠানের পোস্টারে ঢেকে গেছে। হিশাম ওই দালানেই থাকতেন, যেটি শরণার্থী সাংবাদিকদের আশ্রয় ও প্রদর্শনীর গ্যালারি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেখান থেকে তিনি চলে গেছেন, তবে নিচ তলায় এখনও তার ছোট একটা অফিস আছে যেখানে সপ্তাহে তিন দিন যান।
ফরবিডেন স্টোরিজের সঙ্গে কথা বলার আগে মানসুরি তার ফোন বন্ধ করে ব্যাকপ্যাকের ভেতরে রাখেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি ল্যাবের ফরেনসিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে মানসুরির আগের আইফোনটিতে ২০ বার পেগাসাসের আক্রমণ হয়েছে।
মানসুরি একজন ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিক ও মরোক্কান অ্যাসোসিয়েশন অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (ফরাসি অ্যাক্রোনিম এএমজেআই) সহ-প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে তিনি মরক্কোর কারাগারে অবৈধ মাদক ব্যবসা নিয়ে একটি বই লিখছেন। বহু সংখ্যক আইনি ও শারীরিক হুমকির পর ২০১৬ সালে তাকে মরক্কো ছাড়তে হয়।
মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে ২০১৪ সালে এক সভা শেষে তাকে ও ইতিহাসবিদ মাতি মনজিবকে অজ্ঞাত দুই সন্ত্রাসী মারধর করে। মনজিবও পরবর্তী সময়ে পেগাসাস আক্রান্ত হন। এক বছর পর গোয়েন্দা বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা তার বাসায় সকাল ৯টায় অভিযান চালায়। গোয়েন্দা সদস্যরা তাকে ও তার এক বান্ধবীকে তাদের বেডরুমে খুঁজে পায়। তাকে নগ্ন করে ফেলা হয় ও ‘ব্যাভিচারের’ অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়। ব্যাভিচার মরক্কোতে অপরাধ।
তিনি কাসাব্লাঙ্কার কারাগারে ১০ মাস আটক থাকেন। তাকে যে সেলে রাখা হয় সেটা সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধীদের জন্য বরাদ্দ। অন্য কয়েদিরা ওই সেলটির নাম দিয়েছে ‘লা পুবেল’ বা দ্য ট্র্যাশ বিন। ছাড়া পাওয়ার পরদিনই মানসুরি মরক্কো ছেড়ে ফ্রান্সে চলে আসেন ও রাজনৈতিক আশ্রয় পান।
ওই ঘটনার পাঁচ বছর পর মানসুরি জানতে পারেন, এখনও মরক্কো সরকারের টার্গেট তিনি।
মানসুরি ফরবিডেন স্টোরিজকে বলেন, ‘প্রতিটা স্বৈরাচারী সরকার সবসময় সব জায়গায় বিপদ দেখে। আমরা নিজেদের বিপজ্জনক ভাবি না, কারণ আমরা আইন মেনেই সবকিছু করি, আমরা জানি যে এটা আমাদের অধিকার। কিন্তু তাদের কাছে এগুলো বিপজ্জনক। তারা স্ফূলিঙ্গকে ভয় পায়, কারণ সেখান থেকে আগুন ছড়াতে পারে।’
ফাঁস হওয়া ডেটা থেকে জানা যায়, এনএসওর সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট হিসেবে মরক্কো চার দেশের ৩৫ জন সাংবাদিকের ওপর নজর রেখেছে। এদের মধ্যে মরক্কোর অনেক সাংবাদিকই কোনো না কোনো সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন, মানহানি করা হয়েছে বা অন্য কোনো ভাবে গোয়েন্দা বাহিনীর শিকার হয়েছেন। টার্গেটের অন্যতম দুই জন পত্রিকার সম্পাদক তৌফিক বুয়াশ্রিন ও সোলাইমানে রাইসোনিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মরক্কোতে মুক্ত সাংবাদিকতাকে রুখতে মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে তারা উস্কানি দিয়েছেন।
ফরবিডেন স্টোরিজ ও তার সহযোগীদের উদ্দেশে পাঠানো এক বিবৃতিতে মরক্কো দূতাবাসের প্রতিনিধি জানান, তারা ‘প্রশ্নগুলো কোন প্রসঙ্গে করা হয়েছে’ সেটা বুঝতে পারেননি। তারা ‘মরক্কোর সঙ্গে ইসরায়েলি কোম্পানির’ সম্পর্ক থাকার ‘সুনির্দিষ্ট প্রমাণ’ চেয়েছেন ফরবিডেন স্টোরিজের কাছে।
আখবার আল-ইয়ায়ুমের সম্পাদক বুয়াশ্রিনকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানবপাচার, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি ও হয়রানির মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। সিপিজে জানায়, যে ১৪ জন নারী বুয়াশ্রিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন তাদের ১০ জন কোর্টে হাজিরা দেন। এদের পাঁচ জন বলেন যে, বুয়াশ্রিন নির্দোষ।
বুয়াশ্রিন মরক্কান স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখেছেন। যেখানে তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়, যার মধ্যে এক বছর তাকে নিঃসঙ্গ কারাগারে রাখা হয়।
ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর সহযোগীরা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে যে, ওই মামলায় জড়িত অন্তত দুই জন নারীকে পেগাসাসের টার্গেট করা হয়।
বুয়াশ্রিনের উত্তরসূরী সোলাইমানে রাইসোনিকেও যৌন হয়রানির মামলায় ২০২০ সালের মে মাসে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরের বছর জুলাইয়ে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। রাইসোনির বিরুদ্ধে আদিল আইত ওউশরা নামের এক এলজিবিটিকিউ কর্মী হয়রানির অভিযোগ আনেন। আদিল সিপিজেকে জানান, নিজের লৈঙ্গিক পরিচয়ের কারণে প্রকাশ্য অভিযোগ করতে তিনি স্বস্তি বোধ করেননি।
সাংবাদিক ও সংবাদ অধিকারকর্মীরা সিপিজেকে বলেন, তাদের বিশ্বাস রাইসোনির সমালোচনা মূলক প্রতিবেদনের প্রতিশোধ হিসেবেই এই মামলা করানো হয়। ২০২১ সালে বিচারের অপেক্ষায় থাকা রাইসোনি এই প্রতিবেদন লেখার সময় ১০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে অনশন করছিলেন। তার পরিবারের সদস্যরা জানান ৭৬ দিনের পর তার অবস্থা খারাপের দিকে চলে যায়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে শীর্ষ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে কাজ করা স্বাধীন সংবাদমাধ্যম তালকুয়েল ও নিশানের প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক সাংবাদিক আহমেদ বেনশেমসি বলেন, ‘নজরদারির উদ্দেশই হচ্ছে কারও ব্যক্তিগত জীবনে নজর রাখা। যাতে করে কোনো একটা ত্রুটি বের করে তাকে বড় একটা মামলায় ঝুলিয়ে দেয়া যায়।’
তার মতে, অতীতে মরক্কোর সাংবাদিকরা নিয়মিতভাবে তাদের লেখায় রাজাকে অসম্মান বা অশ্রদ্ধা করার জন্য আইনি হামলার শিকার হয়েছেন। তবে নতুন কৌশল হল, তাদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ আনা। এই উদ্দেশ হাসিলের জন্য ব্যক্তিগত তথ্য বের করে আনতে নজরদারি এখন অন্যতম হাতিয়ার।
বেনশেমসি বলেন, ‘বড় কোনো কুৎসার পেছনে খুব অল্প পরিমাণ সত্য থাকে। কিন্তু সেই অল্প সত্যটি সাধারণত কোনো ব্যক্তিগত ও গোপন তথ্য যা একমাত্র নজরদারি করেই পাওয়া সম্ভব।’
বিদেশি যেসব সাংবাদিক মরক্কোর সাংবাদিকদের দুর্দশার বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করেছেন তাদেরকেও টার্গেট করা হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তাদের ফোনে সফল আক্রমণও চালানো হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাবের এক বিশ্লেষণ, যেটাকে পরে ডিজিটাল অধিকার সংস্থা সিকিউরিটি ল্যাবও পর্যালোচনা করে, তাতে পাওয়া যায় যে, ফরাসি অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম মিডিয়াপার্টের পরিচালক ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এডুই প্লেনেলের ফোনে ২০১৯ এর গ্রীষ্মে আক্রমণ করা হয়।
ওই বছরের জুনে প্লেনেল মরক্কোর অনুসন্ধানী ম্যাগাজিন ল্য ডেস্কের প্রতিষ্ঠাতা ও মিডিয়াপার্টের সহযোগী সাংবাদিক আলি আমারের আমন্ত্রণে মরক্কোর এসাউইরাতে দুই দিনের এক সম্মেলনে যোগ দেন। ফরবিডেন স্টোরিজের হাতে আসা ফোন রেকর্ডের মধ্যে আলি আমারের নম্বরও ছিল। ওই সম্মেলনে প্লেনেন একাধিক সাক্ষাৎকারে মরক্কোর সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলেন। প্যারিসে ফেরার পর তার ফোনে সন্দেহজন কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
ফরবিডেন স্টোরিজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্লেনেল বলেন, ‘আমরা আলি আমারের সঙ্গে কাজ করেছি। একই সঙ্গে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপিয়েছি। মরক্কোতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য লড়তে থাকা অনেক সাংবাদিকের মতো আলি আমারকেও আমি কিছুটা চিনি। যে কারণে আমি নজরদারি সম্পর্কে যখন জানতে পারলাম তখন সবকিছুই বুঝতে পেরেছি।’
প্লেনেল জানান, তার ও মিডিয়াপার্টের আরেক সাংবাদিক লেনা ব্রেদোর ফোনে পেগাসাসের যে আক্রমণ করা হয়, যেটা মূলত তাদের মরক্কান সহকর্মীদের উদ্দেশে পাঠানো একটি ‘ট্রোজান হর্স ম্যালওয়্যার’।
মনসুরির মতো অনেক মরক্কান সাংবাদিক হয় দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বা পুরোপুরি সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়েছেন। রাইসোনি আর বুয়াশ্রিনের পত্রিকা আখবার আল-ইয়ায়ুম তাদের গ্রেপ্তার ও আর্থিক অনটনের ভার নিতে পারেনি ও ২০২১ সালের মার্চে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
বেনশেমসি বলেন, ‘১০ বা ১৫ বছর আগেও মরক্কোতে বাক স্বাধীনতার জায়গা ছিল। এখন আর নেই। সব শেষ। যদি আপনি সরকারকে সমর্থন করেন তাহলে সব ঠিক, না হলে টিকে থাকতে নিজে থেকেই কঠোর সেন্সরশিপ মানতে হবে।’
ভয়ংকর এক মারণাস্ত্র?
এনএসও গ্রুপের ২০২১ সালের ট্র্যান্সপারেসি প্রতিবেদনে একটি বাক্য তিনবার ঘুরে ফিরে এসেছে: ‘জীবন বাঁচানো’। এক জায়গায় কোম্পানিটি লিখেছে, ‘আমাদের লক্ষ্য রাষ্ট্রকে এর নাগরিকদের নিরাপদে রাখতে সাহায্য করা ও জীবন বাঁচানো।’
তবু সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে এনএসও স্পাইওয়্যারের উদ্বেগজনক ব্যবহার তাদের এই ব্যাখ্যাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
২০১৮ সালের ২ অক্টোবর, দুপুর ১টার দিকে ওয়াশিংটন পোস্টের কলামনিস্ট জামাল খাশোগজি তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে যান এবং সেখান থেকে আর ফেরেননি। ভিন্ন মতের এই সাংবাদিকের নির্লজ্জ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার সংস্থা ও সচেতন নাগরিকরা সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। তার হত্যাকাণ্ডে এনএসও গ্রুপের স্পাইওয়্যার জড়িত থাকার সম্ভাবনা আছে।
ওই হত্যার দুই সপ্তাহ পর সিটিজেন ল্যাব জানায়, খাশোগজির মৃত্যুর অন্তত মাসখানেক আগে তার কাছের বন্ধু ওমার আব্দুলাজিজের ফোনে পেগাসাসের আক্রমণ হয়।
এনএসও নিজেদের সাফাইয়ে বারবার বলেছে, তাদের কাছে এটিকে অকার্যকর করার উপায় আছে। এবং যেসব ক্লায়েন্ট মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় তাদের অ্যাকসেস তারা মুছে ফেলেছে।
কোম্পানিটি খাশোগজির হত্যায় তাদের কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
তবে ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর সহযোগীরা বের করেছে, খাশোগজি মারা যাওয়ার মাত্র চারদিন পর তার বাগদত্তা হাতিস চেঙ্গিজের ফোনে সফল ভাবে পেগাসাস ঢোকানো হয়েছে।
ফরবিডেন স্টোরিজের হাতে আসা ডেটা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, এই কাজটি করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার। তারা খাশোগজির হত্যার কয়েক সপ্তাহ পর তার ছেলের ফোনকে টার্গেট করে। এনএসওর ক্লায়েন্ট নিহত সাংবাদিকের কাছের বন্ধু, পরিবার ও সহকর্মীদেরকে টার্গেট করে। পেগাসাস প্রজেক্টের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দুই ক্লায়েন্টকে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে।
ফরবিডেন স্টোরিজকে লেখা এক চিঠিতে এনএসও গ্রুপ জানায়, ‘যেমনটা এনএসও আগেও বলেছে যে, আমাদের প্রযুক্তি কোনো ভাবেই জামাল খাশোগজির ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। আমরা নিশ্চিত করতে পারি, আপনাদের জিজ্ঞাসায় যেমনটা বলা হয়েছে- তার বা তার পরিবারের সদস্যদের কথা শোনা, নজরদারিতে রাখা, গতিপথ চিহ্নিত বা তথ্য সংগ্রহ করার জন্য আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি।’
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাশোগজির মৃত্যু ও এতে স্পাইওয়্যার ব্যবহারের সন্দেহ কোনো ‘অনন্য’ ঘটনা নয়।
গালপেরিন বলেন, ‘ক্ষুব্ধ সরকারের হাতে খুন হয়েছেন এমন সাংবাদিক খাশোগজিই প্রথম নন। আর ক্ষুব্ধ সরকারের হাতে খুন হওয়া তিনিই প্রথম সাংবাদিক নন, যার মৃত্যুতে ম্যালওয়্যার ও নজরদারি জড়িত ছিল। এই বিষয়গুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্কযুক্ত।’
২০১৭ সালের ২ মার্চ, স্থানীয় মেক্সিকান সাংবাদিক সিসিলিও পিনেদা তার ফোনে নিজের সবশেষ ভিডিও রেকর্ড করেন।
আলতামিরানো শহরের এক প্রতিবেদক যিনি ৫০ হাজার ফলোয়ারের একটি ফেসবুক পেজ চালান, তার ওই ভিডিওতে রাজ্য সরকার, স্থানীয় পুলিশ ও মাদক ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ নিয়ে কথা বলেন।
দুই ঘণ্টা পর তাকে মৃত পাওয়া যায়। তাকে এক কার ওয়াশের সামনে একটি হ্যামকে শোয়া অবস্থায় দুই মোটরবাইক আরোহী অন্তত ছয়টি গুলি করে।
২০১৭ সালে পিনেদাকে যখন ৩৮ বছর বয়সে হত্যা করা হয়, সেটা নিয়ে বিশ্বে খুব একটা মাতামাতি হয়নি। তার মৃত্যুটি ছিল মেক্সিকোর মতো সাংবাদিকদের জন্য মৃত্যুকূপে আরেক জন সাংবাদকের মৃত্যু মাত্র। ফরবিডেন স্টোরিজ ও তার সহযোগীদের হাতে আসা রেকর্ড যাচাই করে দেখা যায়, পিনেদার মৃত্যু এক স্থানীয় ড্রাগ কার্টেলের হাতে রাস্তায় খুন হওয়ার ঘটনা মতো নয়।
পিনেদার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে এনএসওর এক মেক্সিকান ক্লায়েন্ট তার মোবাইল ফোনটিকে টার্গেট করে।
ফরবিডেন স্টোরিজ নিশ্চিত করতে পেরেছে, শুধু পিনেদা নন, মামলাটির দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় আইনজীবী হাভিয়ের ওলেয়া পেলায়েসকেও, পিনেদার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ বা মাসখানেক আগে পেগাসাসের টার্গেট করা হয়। ফরবিডেন স্টোরিজ পিনেদার খুন হওয়ার পরপরই তার হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনটিরও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়। ওই সময় থেকে পেলায়েস তার সঙ্গে ফোন রাখেননি, ফলে তাকে পেগাসাস আক্রমণ করেছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
যখন টার্গেট করা হয় ওই সময় পিনেদা স্থানীয় মাফিয়া বস ‘এল তেকিলেরো’ ও গেরেরো রাজ্যের গভর্নর হেক্তর আস্তুদিয়োর মধ্যে যোগাযোগ নিয়ে অনুসন্ধান করছিলেন। পিনেদার বন্ধু ও পরিবার যারা ফরবিডেন স্টোরিজ ও এর অংশীদারদের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা জানান, পিনেদা হুমকি পেতেন ও সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তাকে থাকতে বলা হয়েছিল।
পিনেদার বন্ধু ইসরায়েল ফ্লোরেস এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেন, “সিসিলিও পিনেদা অনেক ভয়ংকর হুমকি পেতেন কিন্তু সেগুলোকে পাত্তা দিতেন না। উনি সবসময়ই বলতেন, ‘কিছুই হবে না’”।
পিনেদা স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও মাদক ব্যবসায়ীদের জোটের বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে হুমকি আরও জোরেশোরে আসতে থাকে। তার মা জানান, পিনেদার মৃত্যুর কয়েক দিন আগে, একটি সাদা গাড়িতে করে আসা কয়েকজন লোক তাদের বাড়ির ছবি তোলেন।
যেদিন তাকে হত্যা করা হয়, সেদিন এক রাজনৈতিক সমাবেশে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার আগে পিনেদা মায়ের বাড়িতে যান। সেটাই ছিল মায়ের সঙ্গে তার শেষ দেখা।
তার মা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “সে আমাকে বলত ‘দুষ্টু লোকেরা আমাকে মারবে না। তারা আমাকে চেনে। তারা আমার বন্ধু। আমাকে যদি কেউ হত্যা করে সেটি হবে সরকার।’”
পিনেদার স্ত্রী মারিসল তোলেদো ফোরবিডেন স্টোরিজের এক সদস্যকে জানান, পিনেদার মৃত্যুর পরদিন তিনি একজন সরকারি কর্মচারীর কাছ থেকে একটি ফোন পান। তাকে ওই ব্যক্তি বলেন যে, তিনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছেন। পরে তিনি আর কখনওই যোগাযোগ করেননি।
তোলেদো বলেন, ‘আমরা জানি না তদন্তে কী ঘটল। আমরা কোনো ঝামেলা চাই না। ক্ষমতায় যারা আছেন তারা চাইলে যে কারও সঙ্গে যা খুশি তাই করতে পারেন।’
পিনেদার ফোন পাওয়া যায়নি, পুলিশ আসার পর সেটি ক্রাইম সিন থেকে গায়েব হয়ে যায়। তবে যখন পিনেদার গতিবিধিগুলো ট্র্যাক করার ক্ষেত্রে স্পাইওয়্যারের সম্ভাব্য ভূমিকার কথা বলা হয়েছে, তোলেদো অবাক হননি।
তিনি বলেন, ‘তারা যদি এতে সফল হয় তাহলে সে (পিনেদা) কোথায়, কখন আছে তা সবসময়ই জানতে পারার কথা।’
আরও পড়ুন:আজ বৃহস্পতিবার জিলহজ মাসের ৮ তারিখ পবিত্র হজের দিন। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাক’... মধুধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে পবিত্র আরাফার পাহাড় ঘেরা ময়দান ছাপিয়ে আকাশ-বাতাস মুখর ও প্রকম্পিত এখন। সু-উচ্চকণ্ঠ নিনাদের তালবিয়ায় মহান আল্লাহ তায়ালার একত্ব ও মহত্ত্বের কথা বিঘোষিত হচ্ছে প্রতি অনুক্ষণ। ‘আমি হাজির। হে আল্লাহ! আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই। সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধুই তোমার। সাম্রাজ্য তোমারই। তোমার কোনো শরিক নেই।’ লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত আরাফা প্রান্তর।
বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মিলন পবিত্র হজ। আজ ভোর থেকে সৌদি আরবের মক্কা নগরীর আরাফার আদিগন্ত মরু প্রান্তর এক অলৌকিক পুণ্যময় শুভ্রতায় ভরে উঠেছে। সফেদ-শুভ্র দুই খণ্ড কাপড়ের এহরাম পরিহিত হাজিদের অবস্থানের কারণে সাদা আর সাদায় একাকার। পাপমুক্তি আর আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এই পবিত্র হজ পালন করেছেন।
আজ ফজরের পর গোটা দুনিয়া থেকে আগত ২৫ লক্ষাধিক মুসলমান ঐতিহাসিক আরাফার ময়দানে উপস্থিত হচ্ছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশি হজযাত্রীর সংখ্যা ৮৭ হাজারের বেশি। আজ ৮ জিলহজ মূল হজের দিন তারা এখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করবেন। আরাফার ময়দানের মসজিদে নামিরায় জোহরের নামাজের আগে এ বছর পবিত্র হজের খুতবা দেবেন মসজিদুল হারামের প্রখ্যাত খতিব ও সৌদি সিনিয়র ওলামা পরিষদের সদস্য ড. শায়খ সালেহ বিন হুমায়েদ।
সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা আরাফার ময়দানে অবস্থান করে আল্লাহ তা’আলার জিকির আসকার ইবাদতে মশগুল থাকবেন। অতঃপর মাগরিবের নামাজের আযানের পর মুজদালিফার উদ্দেশ্যে আরাফার ময়দান ত্যাগ করবেন হাজিরা। মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ এশার ওয়াক্তে একত্রে পড়বেন এবং সারা রাত অবস্থান করবেন। মিনায় জামরাতে নিক্ষেপ করার জন্য ৭০টি কংকর এখান থেকে সংগ্রহ করবেন। মুজদালিফায় ফজরের নামাজ পড়ে পুনরায় মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। ১০ জিলহজ মিনায় পৌঁছার পর হাজিদের পর্যায়ক্রমে চারটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। প্রথমে মিনাকে ডান দিকে রেখে হাজিরা দাঁড়িয়ে শয়তানকে (জামারা) পাথর নিক্ষেপ করবেন। দ্বিতীয় কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করা। অনেকেই মিনায় না পারলে মক্কায় ফিরে গিয়ে পশু কোরবানি দেন। তৃতীয় পর্বে মাথা ন্যাড়া করা। চতুর্থ কাজ তাওয়াফে জিয়ারত। জিলহজের ১১ তারিখ মিনায় রাত যাপন করে দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হাজিরা বড়, মধ্যম ও ছোট শয়তানের ওপর সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করবেন।
১২ জিলহজ মিনায় অবস্থান করে পুনরায় একইভাবে হাজিরা তিনটি শয়তানের ওপর পাথর নিক্ষেপ করবেন। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা শেষ হলে অনেকে সূর্যাস্তের আগেই মিনা ছেড়ে মক্কায় চলে যাবেন। মক্কায় পৌঁছার পর হাজিদের একটি কাজ অবশিষ্ট থাকে। সেটি হচ্ছে কাবা শরিফ তাওয়াফ করা। একে বলে বিদায়ি তাওয়াফ। স্থানীয়রা ছাড়া বিদায়ি তাওয়াফ অর্থাৎ কাবা শরিফে পুনরায় সাত বার চক্কর দেওয়ার মাধ্যমে হাজিরা সম্পন্ন করবেন পবিত্র হজব্রত পালন।
সৌদিতে গতকাল গড় তাপমাত্রা ছিল ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রখর রোদ আর প্রচণ্ড গরম। সৌদি বার্তা সংস্থা ‘এসপিএ’ জানায়, প্রচণ্ড গরমে ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজিরা।
প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র না থাকায় ২ লাখ ৬৯ হাজার মুসল্লিকে পবিত্র মক্কা নগরে প্রবেশ করতে দেয়নি সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ। এসব মুসল্লি পবিত্র হজ পালন করতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন।
হজের খুতবা বাংলায় অনুবাদ করবেন চার বাংলাদেশি:
প্রতি বছরের মতো পবিত্র হজের খুতবা এবারও বাংলাসহ বহু ভাষায় অনুবাদ করা হবে। বাংলায় অনুবাদ করবেন চার জন বাংলাদেশি। তারা হলেন ড. খলীলুর রহমান, আ ফ ম ওয়াহিদুর রহমান, মুবিনুর রহমান ও নাজমুস সাকিব। তারা সবাই মক্কার উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন।
হজের খতিবের সঙ্গে ধর্ম উপদেষ্টার সৌজন্য সাক্ষাৎ:
বাংলাদেশি হজযাত্রীদের হজ ব্যবস্থাপনা মনিটরিং দলের দলনেতা ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন এবং ধর্মসচিব এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামাণিকও এখন মিনায় অবস্থান করছেন। পবিত্র আরাফার ময়দানে খুতবা প্রদান করবেন মসজিদলু হারামের প্রখ্যাত খতিব ও সৌদি সিনিয়র ওলামা পরিষদের সদস্য ড. শায়খ সালেহ বিন হুমায়েদ। তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।
কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাতে তিস্তা নদীতে পানির স্তর বাড়তে থাকায় গতকাল শনিবার রেড অ্যালার্ট জারি করেছে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (আইএমডি)। ইতোমধ্যে সিকিমের মাঙ্গান, গিয়ালশিং ও সোরেং জেলাগুলোতে বন্যা ও ভূমিধসের শঙ্কায় রেড অ্যালার্ট জারি করেছে ভারতের আবহাওয়া অধিপ্তর (আইএমডি)। এদিকে বাংলাদেশেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
গ্যাংটক জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এক জরুরি গণবিজ্ঞপ্তিতে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, তবে আতঙ্কিত না হতে অনুরোধ করেছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মাঙ্গান জেলার তিস্তা নদীর অববাহিকা, বিশেষ করে ডিকচু থেকে সিংতাম পর্যন্ত অঞ্চলটি বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা টিমগুলোকে সর্বোচ্চ প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে, ভারতের উজানে পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে বাংলাদেশ অংশেও বাড়ছে তিস্তার পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, আগামী তিন দিন পানির স্তর আরও বাড়তে পারে। লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও রংপুর জেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে নতুন করে বন্যার শঙ্কা।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এখনো পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও যেকোনো সময় পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে শুক্রবার দুপুর ১২টায় পানি রেকর্ড হয়েছে ৫১.১৫ মিটার, যা বিপদসীমার মাত্র এক মিটার নিচে। রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টেও পানি দ্রুত বাড়ছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর অগ্রগতির কারণে ১ জুন পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। গেলো ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় গড়ে ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে রংপুরের গঙ্গাচড়া, পীরগাছা ও কাউনিয়া উপজেলার কিছু এলাকায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে। প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা এবং ভাঙনের আশঙ্কায় আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তিস্তাপাড়ের প্রায় ৯৫টি চর এলাকা পানিতে প্লাবিত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব নিচু চরজমিতে বসবাসকারী মানুষজন এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। আদিতমারী উপজেলার চর গোবর্ধন এলাকার বাসিন্দা ফজলার রহমান বলেন, ‘বন্যা এলে আমাদের কিছুই থাকে না। মাঠের ফসল, গবাদি পশু সবই ভেসে যায়। এবারও সবাই ঘরবাড়ি তুলে নিচ্ছে, উঠোনে পলিথিন দিয়ে জিনিসপত্র বাঁচানোর চেষ্টা চলছে।’
ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পর গত ১০ মে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হলেও দুই দেশের মধ্যে বাকযুদ্ধ এখনো চলছে। দুই প্রতিবেশী দেশই প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে পাল্টাপাল্টি মন্তব্য এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেদের দেশের অবস্থানের কথা তুলে ধরার চেষ্টাও জারি আছে।
ইরান সফরে গিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ জানিয়েছেন, পাকিস্তান শান্তির বিষয়ে কথা বলতে প্রস্তুত এবং তারা পানি, বাণিজ্য ও সন্ত্রাসের মোকাবিলার বিষয়ে আলোচনায় বসতে পারে যদি ভারত গুরুত্ব দেয়। এরই মধ্যে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে আবার পাল্টাপাল্টি বিবৃতিতে জড়িয়েছে দুই দেশ।
ভারত আরও একবার নিজেদের পক্ষে স্পষ্ট করে গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা হলে তা সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা এবং পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েই হবে। অন্যদিকে ইসলামাবাদের বক্তব্য পাকিস্তান কখনোই কাশ্মীর ছেড়ে যাবে না।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং একটি অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন, পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের বাসিন্দাদের তিনি পরিবারের অংশ বলেই মনে করেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দৃঢ় বিশ্বাস পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের বাসিন্দারা একসময় নিজের ইচ্ছায় ফিরে (ভারতে) আসবেন। পরে সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংএ কাশ্মীর ইস্যুতে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে বলতে শোনা যায়, দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হলে তা দ্বিপাক্ষীকভাবেই হবে এবং এই বিষয়ের ওপর হবে যে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর তারা (পাকিস্তান) কবে খালি করবে।
এরপর ইসলামাবাদও পাল্টা জবাব দেয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির জানিয়ে দেন, কাশ্মীর নিয়ে কোনো সমঝোতা সম্ভব না। কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি বার্ষিক বিজনেস সামিট ২০২৫ উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। মঞ্চে ভাষণের সময় ওঠে আসে পাকিস্তানের প্রসঙ্গ।
এ সময় রাজনাথ সিং বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ এবং আলোচনার বিষয়টি নিয়ে আমরা পুনর্মূল্যায়ন করেছি। যখনই আলোচনা হোক, তা হবে শুধু সন্ত্রাসবাদ ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে। পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের বিষয়েও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জনগণ আমাদের নিজেদের। তারা আমাদের পরিবারেরই অংশ। আমরা এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারতের সংকল্পের প্রতি দায়বদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস যে আমাদের ভাইয়েরা যারা ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে আজ আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা একদিন অবশ্যই আত্মসম্মান নিয়ে, স্বাধীন ইচ্ছায় ভারতের মূলধারায় ফিরে আসবেন। রাজনাথ বলেছেন, আমি জানি, সেখানকার বেশির ভাগ মানুষই ভারতের সঙ্গে এক ধরনের সংযোগ অনুভব করেন। কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ রয়েছে, যাদের ভুল বোঝানো হয়েছে। ভারত সব সময় হৃদয়ের সংযোগে বিশ্বাস করে।
পেহেলগ্রাম হামলার কদিন আগে এক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের আসিম মুনিরকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে বিশ্বের কোনো শক্তি কাশ্মীরকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে পারবে না। কাশ্মীরকে পাকিস্তানের জাগুলার ভেইন (যা মস্তিষ্ক, ঘাড়, মুখের একাংশ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে হৃৎপিণ্ডে পৌঁছে দেয়) বলে অভিহিত করেছিলেন তিনি। পেহেলগ্রাম হামলার পর, তার সেই মন্তব্যকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়।
তিনি বলেছিলেন, কাশ্মীরের বিষয়ে আমাদের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট, এটি আমাদের জাগুলার ভেইন ছিল এবং থাকবে। আমরা একে ভুলব না। আমরা আমাদের কাশ্মিরী ভাইদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে ত্যাগ করব না। পাশাপাশি উপস্থিত ব্যক্তিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মকে এই বিষয়ে অবগত করতে হবে।
তিনি বলেছিলেন, আপনাদের সন্তানদের পাকিস্তানের কথা বলতে হবে যাতে তারা আমাদের পূর্বপুরুষদের চিন্তা-ভাবনাকে ভুলে না যায়, ভুলে না যায় যে আমরা হিন্দুদের থেকে আলাদা। আমাদের ধর্ম, রীতিনীতি, ঐতিহ্য, চিন্তা-ভাবনা, উদ্দেশ্য সবই আলাদা। তার বক্তব্যে বিভাজনমূলক বিষয় রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছিল এবং বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
এদিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগ আরও একবার তুলেছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসের ব্যবসা চালানোটা ব্যয়সাশ্রয়ী বিষয় নয়। পাকিস্তান আজ বুঝতে পেরেছে যে এর জন্য তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে। আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কৌশল এবং প্রতিক্রিয়া উভয়কেই নতুন করে ডিজাইন ও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছি। পরে সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংএ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে পাকিস্তানের বিষয়ে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে একাধিক প্রশ্ন করা হয়।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জয়সওয়াল বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট ও ধারাবাহিক। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যেকোনো আলোচনা শুধু দুই দেশের মধ্যে, অর্থাৎ দ্বিপাক্ষীকই হতে হবে।
দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার আবহে সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করা হয়েছিল। সেই চুক্তি এখনো স্থগিত রয়েছে।
জয়সওয়ালকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে বলব, যতক্ষণ না পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্যভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করা বন্ধ করছে, ততদিন এই নিয়ে কোনো কথা হবে না। যেমনটি প্রধানমন্ত্রী আগেই বলেছেন।
গাজার দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত একটি সংস্থার পরিচালিত নতুন ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে মঙ্গলবার হাজারো ফিলিস্তিনি ভিড় করেন। এ সময় চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ইসরাইল এদিন গাজায় নতুন ত্রাণ বিতরণ পদ্ধতি কার্যকর করে।
ফিলিস্তিনের রাফা থেকে এএফপি জানায়, মাত্র কয়েকদিন আগে ইসরাইল কর্তৃক আরোপিত পূর্ণাঙ্গ ত্রাণ অবরোধ আংশিকভাবে শিথিল করার পর রাফায় এ ঘটনা ঘটেছে। ২ মার্চ থেকে আরোপিত সেই অবরোধ খাদ্য ও ওষুধের তীব্র সংকট তৈরি করে।
পরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু স্বীকার করেন যে ‘ত্রাণকেন্দ্রে এক মুহূর্তের জন্য নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম’। তবে এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা এই বিতরণকে ‘সফলতা’ হিসেবে আখ্যা দেন।
যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) জানায়, বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে।
বাস্তুচ্যুত গাজাবাসী আয়মান আবু যায়েদ এএফপিকে বলেন, তিনি কেন্দ্রে সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ‘হঠাৎ করেই অনেক মানুষ ধাক্কা দিয়ে এলোমেলোভাবে ঢুকে পড়তে থাকে’।
তিনি বলেন, ‘এটা হয়েছে ত্রাণের অভাব এবং বিলম্বের কারণে। মানুষ ভেতরে ঢুকে যতটুকু পারা যায় সংগ্রহের চেষ্টা করেছে।’
একপর্যায়ে ‘ইসরাইলি বাহিনী গুলি ছোড়া শুরু করে, শব্দটা খুব ভয়ের ছিল। মানুষ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তারপরও অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রাণ নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়।’
পরবর্তীতে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানায়, তারা ‘কেন্দ্রের বাইরের এলাকায় সতর্কতামূলক গুলি’ ছুঁড়েছে।
তারা আরও জানায়, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিকল্পনামাফিক চলবে, এবং আইডিএফ (ইসরাইলি বাহিনী)-এর সদস্যদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি।’
জিএইচএফ এক বিবৃতিতে জানায়, ‘এসডিএস (ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র)-এ একসময় এত বেশি ভিড় হয় যে আমাদের দল পেছনে সরে গিয়ে কিছু সংখ্যক গাজাবাসীকে নিরাপদে ত্রাণ নিতে দেয় এবং ছত্রভঙ্গ হতে দেয়।’
‘স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে’, যোগ করে সংস্থাটি।
এএফপির ফুটেজে দেখা গেছে, মঙ্গলবার বিপুল সংখ্যক মানুষ ত্রাণের বাক্স, যার গায়ে ‘জিএইচএফ’ চিহ্ন ছিল, বহন করে এলাকা ত্যাগ করছে।
-‘৪,৬২,০০০ খাবারের ব্যবস্থা’-
জিএইচএফ আরও জানিয়েছে, ‘হামাসের আরোপিত অবরোধ’ তাদের একটি কেন্দ্রে কয়েক ঘণ্টার বিলম্ব সৃষ্টি করেছে।
এদিকে হামাসের সরকারি গণমাধ্যম দপ্তর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গাজায় ত্রাণ বিতরণের জন্য ইসরাইলের নতুন উদ্যোগ ‘চরমভাবে ব্যর্থ’ হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যর্থতা দেখা দেয় তখন, যখন হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ, যারা প্রায় ৯০ দিন ধরে দখলদার বাহিনীর অবরোধে খাদ্য ও ওষুধবিহীন অবস্থায় রয়েছে, দুঃখজনক ও মর্মন্তুদ দৃশ্যের মধ্যে ওইসব এলাকায় ছুটে যায়।’
মঙ্গলবারের বিবৃতিতে জিএইচএফ জানায়, এখন পর্যন্ত ‘প্রায় ৮,০০০ খাবারের বাক্স বিতরণ করা হয়েছে... যা ৪,৬২,০০০ খাবার হিসেবে গণ্য’। তারা জানায়, এর আগের দিন থেকেই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।
এক জ্যেষ্ঠ ইসরাইলি সামরিক কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, ‘আজকের দিনটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের জন্য সফল ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘হামাস চেষ্টা করেছিল যেন সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে এগিয়ে না আসে। কিন্তু গাজাবাসীরা হাজার হাজার প্যাকেজ নিতে এসেছিল।’
ইসরাইল জিএইচএফ-এর ত্রাণ বিতরণ প্রচেষ্টাকে সহযোগিতা করছে, এবং বলছে যে তারা ত্রাণকে হামাসের হাত থেকে দূরে রাখতে চায়।
মঙ্গলবার নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা আমাদের মার্কিন বন্ধুদের সঙ্গে পরিকল্পনা করেছি, যাতে ত্রাণ বিতরণ সাইটগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় এবং একটি মার্কিন কোম্পানি ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর মধ্যে খাবার বিতরণ করে।’
‘এক মুহূর্তের জন্য নিয়ন্ত্রণ হারানো গিয়েছিল, তবে পরে তা পুনরুদ্ধার করা গেছে।’
-‘হৃদয়বিদারক দৃশ্য’-
জিএইচএফ-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তারা ইসরাইলের সামরিক লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহায়তা করছে, ফিলিস্তিনিদের উপেক্ষা করছে, জাতিসংঘের ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়েছে এবং মানবিক নীতিমালার সঙ্গে অসামঞ্জস্য আচরণ করছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র মঙ্গলবারের দৃশ্যকে ‘নেহায়েত হৃদয়বিদারক’ বলে উল্লেখ করেন।
স্টেফান দুজারিক বলেন, ‘গত সপ্তাহে মহাসচিব যা বলেছেন, আমরা ও আমাদের অংশীদাররা একটি সুসংহত, নীতিনির্ভর, পরিচালনাযোগ্য পরিকল্পনা তৈরি করেছি, যা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন নিয়ে জরুরি মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।’
জেনেভায় গত ফেব্রুয়ারিতে নিবন্ধিত হলেও, জিএইচএফ-এর কোনো অফিস বা প্রতিনিধি নেই মানবিক বিশ্বের অঘোষিত রাজধানীতে।
সংস্থাটির সাবেক নির্বাহী পরিচালক জেক উড রোববার পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, মানবিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করা সম্ভব নয়।
কিছু মানবিক কর্মী যুক্তি দিয়েছেন যে, নিরাপদ ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র নির্ধারণের মাধ্যমে মানুষকে পুনরায় স্থানচ্যুত হতে বাধ্য করা মানবিক নীতির লঙ্ঘন।
সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, এসব বিতরণ কেন্দ্র কোথায় হবে তা কে নির্ধারণ করেছে ু বিশেষ করে যখন ইসরাইল ‘গাজা বিজয়ের’ পরিকল্পনা করছে বলে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
জাতিসংঘ জিএইচএফ-এর পরিকল্পনায় অংশ নেওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘এটি আমাদের মৌলিক নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় নিরপেক্ষতা, স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার মতো নীতিগুলোর সঙ্গেও না।’
২৪ মে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসরাইলি কর্মকর্তাদের বরাতে বলা হয়, গাজার জন্য যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত নতুন ত্রাণ পরিকল্পনাটি ‘মূলত ইসরাইলিদের দ্বারা তৈরি ও পরিকল্পিত, এর লক্ষ্য হামাসকে দুর্বল করা।’
ইউরোপীয় অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (এসিইএ) মঙ্গলবার জানিয়েছে, চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতাদের শেয়ার বৃদ্ধি পাওয়ায় এপ্রিল মাসে ইলন মাস্কের টেসলার তৈরি গাড়ির বিক্রি অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে।
প্যারিস থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানায়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশে সামগ্রিকভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ির বিক্রি বৃদ্ধি পেলেও, ইলন মাস্কের টেসলার শেয়ার নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে।
ইউরোপীয় অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (এসিইএ) জানিয়েছে, এপ্রিল মাসে টেসলার বিক্রি কমে ৫ হাজার ৪৭৫টি গাড়িতে দাঁড়িয়েছে, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৫২.৬ শতাংশ কম।
২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে, টেসলার বিক্রি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬.১ শতাংশ কমে ৪১ হাজার ৬৭৭টি গাড়িতে দাঁড়িয়েছে।
জেটো ডায়নামিক্সের পরামর্শদাতাদের মতে, একসময় বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রিতে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান টেসলাকে এপ্রিল মাসে ভক্সওয়াগন, বিএমডব্লিউ, রেনল্ট এবং চীনা নির্মাতা বিওয়াইডিসহ ১০টি প্রতিদ্বন্দ্বী টেসলাকে ছাড়িয়ে গেছে।
টেসলা এপ্রিল মাসে ঘোষণা করেছিল, প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী তাদের বিক্রয় ১৩ শতাংশ কমেছে, যা মাস্কের ওপর চাপ বাড়িয়েছে, যদিও কোম্পানিটি আংশিকভাবে মডেল ওয়াই স্ট্যান্ডার্ড-বেয়ারার আপগ্রেডের কারণে উৎপাদন হ্রাসের জন্য দায়ী করেছে।
মাস্ক তখন থেকেই ঘোষণা করেছেন, তিনি ট্রাম্পকে মার্কিন সরকারের ব্যয় কমাতে সাহায্য করার জন্য তার কাজ কমিয়ে দেবেন এবং গত সপ্তাহে বলেছিলেন টেসলার বিক্রয় ‘ভালো’ হচ্ছে।
এসিইএ তথ্য অনুসারে, এপ্রিল মাসে বৈদ্যুতিক গাড়ির বিক্রি গত বছরের তুলনায় সামগ্রিকভাবে ২৬.৪ শতাংশ বেড়ে বাজারের ১৫.৩ শতাংশ অংশ দখল করেছে।
ইউরোপ জুড়ে এই বৃদ্ধি অসম কারণ বিভিন্ন সরকার এবং নির্মাতারা বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়। জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি এবং স্পেনে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা গেছে। তবে ফ্রান্সে বৈদ্যুতিক গাড়ির বিক্রি কমেছে।
এসিইএ-এর মহাপরিচালক সিগ্রিড ডি ভ্রিস বলেন, ব্যাটারি-বৈদ্যুতিক যানবাহনের চাহিদা ধীরে ধীরে গতি পাচ্ছে, কিন্তু ইইউ দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান এবং অসম রয়ে গেছে’।
তিনি বলেন, ‘ব্যাটারি-ইলেকট্রিক যানবাহনকে মূলধারার পছন্দে পরিণত করার জন্য, সরকারগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির শর্তাবলী, যেমন ক্রয় এবং আর্থিক প্রণোদনা, রিচার্জিং অবকাঠামো এবং বিদ্যুতের দাম বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা অপরিহার্য।’
ইউরোপীয় বাজারে এখনও ছোট বৈদ্যুতিক ব্যাটারি সহ হাইব্রিড গাড়ির বিক্রি প্রাধান্য পেয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে ২০.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে একই সময়ে কেবল পেট্রোল-চালিত গাড়ি ২০.৬ শতাংশ কমেছে।
বিওয়াইডি, এমজি, এক্সপেং এবং লিপমোটর ব্র্যান্ডগুলোর বৈদ্যুতিক এবং হাইব্রিড বিক্রয় বছরে ৫৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এসিইএ বিশেষজ্ঞ ফেলিপ মুনোজ বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বৈদ্যুতিক যানবাহনের মতো চীনা হাইব্রিড গাড়ির ওপর শুল্ক আরোপ করে কিনা তা এখনও দেখার বিষয়।
২০৩৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপ এবং ২০৩০ সালের এক্সপোসহ বড় বড় আন্তর্জাতিক ইভেন্ট আয়োজনের প্রস্তুতির আগে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করতে চায় সৌদি আরব। এ লক্ষ্যে ২০২৬ সালের মধ্যে ৬০০টি পর্যটন স্থানে দীর্ঘদিনের জন্য মদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য সান এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এক ধাক্কায় ‘অতি-রক্ষণশীল’ দেশটি পাঁচ তারকা হোটেল, বিলাসবহুল রিসোর্ট এবং প্রবাসী-বান্ধব কম্পাউন্ডসহ লাইসেন্সপ্রাপ্ত স্থানে ওয়াইন, বিয়ার এবং সাইডার বিক্রির অনুমতি দেবে। তবে জনসাধারণ, বাড়ি, দোকান এবং ফ্যান জোনে মদ্যপান নিষিদ্ধ থাকবে।
দ্য সানের প্রতিবেদন বলছে, এই নাটকীয় নীতিগত পরিবর্তন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’-এর অংশ। এর লক্ষ্য আন্তর্জাতিক পর্যটন বৃদ্ধি করা, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং এর ‘টিটোটাল ভাবমূর্তি’ ঝেড়ে ফেলা।
কর্মকর্তারা আশা করছেন, নিওম, সিন্দালাহ দ্বীপ এবং লোহিত সাগর প্রকল্পের মতো জমকালো এলাকায় নিয়ন্ত্রিত অ্যালকোহল বিক্রি দেশটিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের মতো উপসাগরীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সুবিধা দেবে-যেখানে পর্যটন অঞ্চলে মদ্যপান ইতোমধ্যেই বৈধ। দ্য সানের প্রতিবেদন অনুসারে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত স্থানগুলো কঠোরভাবে ‘নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার’ অধীনে পরিচালিত হবে। প্রশিক্ষিত কর্মী এবং অপব্যবহার রোধ ও দেশের ইসলামী মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার জন্য কঠোর নিয়ম থাকবে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লক্ষ্য হলো-সাংস্কৃতিক পরিচয় না হারিয়ে বিশ্বকে স্বাগত জানানো। বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে সৌদি আরবকে একটি প্রগতিশীল, অথচ সম্মানজনক খেলোয়াড় হিসেবে স্থান দেওয়া। প্রতিবেদন অনুসারে, এই পরিকল্পনাটি ২০২৬ সালে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে - বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আট বছর আগে। দেশের ভাবমূর্তি আধুনিকীকরণের ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত এসেছে।
দ্য সানের প্রতিবেদন আরও বলছে, চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ঘোষণা করেছিলেন, ২০৩৪ বিশ্বকাপে মদ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হবে। এরপর এটি ইংল্যান্ডের ফুটবল ভক্তদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়।
সৌদির উপ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন বন্দর আল সৌদ গত ফেব্রুয়ারিতে এলবিসি রেডিওকে বলেছিলেন, ‘এখানে কোনো অ্যালকোহল নেই, বরং আমাদের আবহাওয়ার মতো, এটি একটি শুষ্ক দেশ। প্রত্যেকেরই নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। আমরা আমাদের সংস্কৃতির সীমানার মধ্যে থাকা মানুষকে আপন করে নিতে পেরে খুশি, কিন্তু আমরা অন্য কারও জন্য আমাদের সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে চাই না। এটি কোনো সৌদি অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি ‘বিশ্ব অনুষ্ঠান’ এবং অনেকাংশে যারা আসতে চান তাদের আমরা স্বাগত জানাব।’
এরপর বিষয়টি পশ্চিমা মহলে ক্ষোভের জন্ম দেয়। দ্য সান অনুসারে, কিন্তু এখন সৌদি অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা আশা করছেন, নতুন মদ নীতি সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেবে এবং দেখাবে যে, দেশটি ‘পার্টি করতে প্রস্তুত’, তবে সীমাবদ্ধতার মধ্যে।
সূত্র দ্য সানকে জানায়, এই মডেলটি দুবাই এবং মানামায় সফল ‘অ্যালকোহল প্রচারণা’ থেকে অনুপ্রাণিত। যেখানে কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, ফলে ঐতিহ্যকে নষ্ট না করে পর্যটন এবং ব্যবসাকে বাড়িয়ে তুলেছে। সৌদি জোর দিয়ে বলছে, কেউ আইনের অপব্যবহার করলে, ধরা পড়লে তাকে দ্রুত পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।
দ্য সান বলছে, একটি সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বিক্রয় কেবলমাত্র নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে হবে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত পরিষেবাকর্মী এবং স্পষ্ট পরিচালনামূলক নিয়মাবলী নিশ্চিত করার জন্য, যাতে অ্যালকোহল দায়িত্বশীলতা এবং সম্মানের সাথে পরিচালনা করা হয়।’ আরও জানানো হয়, ২০% এর বেশি ‘ABV’ স্পিরিট এবং হার্ড লিকার নিষিদ্ধ থাকবে। দোকান, টেকওয়ে বা হোম ব্রুয়িং থাকবে না।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বর্বরতা অব্যাহত রয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় শুক্রবার থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৭৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আল-জাজিরাকে স্থানীয় একটি চিকিৎসা সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, হামলা অব্যাহত থাকায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ছে। গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে এক পরিবারকে লক্ষ্য করে চালানো বোমাবর্ষণে প্রায় ৫০ জন নিহত বা নিখোঁজ হয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তারা অভিযোগ করেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী মজা করে বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, গাজার পরিস্থিতি এখন এই ‘নিষ্ঠুর সংঘর্ষের সবচেয়ে নিষ্ঠুর পর্যায়ে’ পৌঁছেছে। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিরা অভুক্ত থেকে মরছে, অথচ ইসরায়েল সাহায্য হিসেবে কেবল ‘এক চামচ ত্রাণ’ প্রবেশ করতে দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত অবরুদ্ধ উত্তর গাজায় কোনো ত্রাণ পৌঁছায়নি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলমান যুদ্ধে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৩ হাজার ৮২২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ২২ হাজার ৩৮২ জন। তবে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, মৃতের প্রকৃত সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০-এর বেশি হতে পারে। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো বহু মানুষ চাপা পড়ে রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
খাবারে পানি মিশিয়ে বেশি দিন চালানোর চেষ্টা
দুই বছর বয়সী মেয়ার, হাসপাতালে একটি বেডে শুয়ে আছে। তার পাঁজরের হাড় বেরিয়ে এসেছে, পেট ফোলা। মেয়ের দুর্বল হাত ধরে শার্ট পরিয়ে দিচ্ছিলেন মা আসমা আল-আর্জা। বেডে শুয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হঠাৎ চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। এই প্রথম নয়, আগেও অপুষ্টির কারণে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে গাজা উপত্যকার এই নিষ্পাপ শিশুটি। তবে এবারই টানা ১৭ দিন বাচ্চাটি হাসপাতালে রয়েছে বলে জানান তার মা।
মেয়ারের সিলিয়াক ডিজিজ নামের একটি বিশেষ রোগ রয়েছে। এ কারণে গ্লুটেনজাত খাবার খেতে পারে না সে, তার জন্য বিশেষ খাবারের দরকার হয়। কিন্তু ১৯ মাসের যুদ্ধ আর ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের কারণে গাজায় এই খাবার এখন আর নেই। সাধারণ খাবারও সে হজম করতে পারে না। মেয়ারের মা বলেন, ডায়াপারের পাশাপাশি ওর সয়ামিল্ক আর বিশেষ খাবারের দরকার। কিন্তু সীমান্ত বন্ধ থাকায় এগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও অনেক দাম, আমি কিনতে পারি না। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর গাজায় নয় হাজারের বেশি শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। আগামী বছর এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইসরায়েল যদি সামরিক অভিযান বন্ধ না করে এবং গাজায় ত্রাণ প্রবেশের ওপর আরোপিত অবরোধ পুরোপুরি না তুলে নেয়, তাহলে গাজায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে বারবার সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যে গাজায় অনেক মানুষ খাবার পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের ফিলিস্তিনি অঞ্চলের প্রতিনিধি নেস্টর ওয়োমুহাঙ্গি বলেন, গাজার যেদিকে তাকাবেন, ক্ষুধার্ত মানুষ চোখে পড়বে। সবাই ইশারায় দেখান যে তারা খাবার চান। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় এখন সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি চলছে।
টানা অবরোধে টান পড়েছে ত্রাণে
সবশেষ গত ২ মার্চ গাজায় সব ধরনের খাদ্য, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় ইসরায়েল। প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস এই অঞ্চলে। একের পর এক বিমান হামলা ও স্থল অভিযানের সঙ্গে চলছে এই অবরোধ। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গাজার মানুষ বাইরের সহায়তার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কারণ ইসরায়েলের হামলায় স্থানীয়ভাবে খাবার উৎপাদনের প্রায় সব ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে গেছে।
অবরোধের পর গাজার খাদ্যসংকট নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে প্রথমদিকে ইসরায়েল দাবি করেছিল, গাজায় পর্যাপ্ত খাবার আছে। তবে শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর চলতি সপ্তাহে গাজায় সীমিত পরিসরে শিশুখাদ্যসহ মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে দেয় ইসরায়েল।
জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েল যেটুকু সহায়তা প্রবেশ করতে দিয়েছে, তা একেবারেই অপ্রতুল। অবরোধের আগে প্রতিদিন প্রায় ৬০০টি ত্রাণের ট্রাক গাজায় প্রবেশ করত। বর্তমানে যা প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে, তা আগের সংখ্যার ধারেকাছেও নয়।
জাতিসংঘের শিশু সংস্থার সদস্য টেস ইনগ্রাম বলেন, এরই মধ্যে গাজায় শিশুরা অপুষ্টিতে মারা যেতে শুরু করেছে। যদি দ্রুত পুষ্টিকর খাবার না পৌঁছায়, তাহলে আরও অনেক শিশু প্রাণ হারাতে পারে। তাছাড়া, সামরিক নিয়মকানুন ও গাজার অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ায় সহায়তা ঠিকঠাক পৌঁছানোও কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বুধবার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা জানান, মধ্য গাজায় কয়েকটি গুদামে ১২টির বেশি ট্রাক পৌঁছেছে। অবরোধ কিছুটা শিথিল হওয়ার পর এটিই প্রথম সহায়তা, যা সরাসরি বিতরণের জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে।
এদিকে, হামাস সদস্যরা ত্রাণ আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে ইসরায়েল। যদিও তারা এই বক্তব্যের সপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি ত্রাণ বিতরণের নতুন পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নতুন পরিকল্পনায় হামাস যোদ্ধারা যাতে খাবার না পায়, তা নিশ্চিত করা হবে বলে জানানো হয়েছে। যদিও নেতানিয়াহুর এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে জাতিসংঘসহ অন্যান্য ত্রাণদাতা সংস্থা।
অনবরত হামলার কারণে এত এত আহত মানুষ নিয়ে চরম সংকটে পড়েছে গাজার হাসপাতালগুলো। সেখানকার খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে সবসময় রোগীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
মন্তব্য