করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে শনাক্তের হার হু হু করে বেড়ে চলছে। এক সময় ঢাকাকেন্দ্রিক শনাক্তের পরিসংখ্যান বদলে গিয়ে ঢাকার বাইরে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে সংক্রমণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর এখন ৫০ শতাংশের বেশি গ্রামগঞ্জে।
রোগীর ভিড় এখন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয়, যেখানে করোনা চিকিৎসার সুযোগ অনেক সীমিত। চিকিৎসকরা বলছেন, পরিস্থিতির আরেকটু অবনতি হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া কষ্টকর হয়ে যাবে।
কিন্তু এভাবে চিত্রটা উল্টে গেল কীভাবে? কেন রাজধানী ও বড় শহরগুলোর বাইরে করোনা ভয়াবহ রূপে ফিরে এলো?
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর কয়েকটি কারণ অনুমান করছেন। তারা বলছেন, লকডাউনের মধ্যে ঢাকার মানুষের গ্রাম ফেরার প্রবণতা একটা কারণ হতে পারে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সীমান্তে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়া। তা ছাড়া, গ্রামাঞ্চলে নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতাও আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আগের চেয়ে বেশি লোক করোনা শনাক্তের পরীক্ষার আওতায় আসছে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীনতাও গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ বৃদ্ধির একটা বড় কারণ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে আটটি বিভাগের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি খুলনা, ঢাকা ও রাজশাহীতে। গত এক সপ্তাহের করোনা পরীক্ষা ও শনাক্তের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ছিল শনাক্তের হার।
কী বলছে পরিসংখ্যান
নিউজবাংলার পক্ষ থেকে ৪ জুলাই থেকে ১০ জুলাই এ সাত দিনের শনাক্তের হার ও পরীক্ষা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ সময় ঢাকা বিভাগে শনাক্তের গড় হার ছিল ২৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
খুলনা বিভাগে শনাক্তের গড় ৩৫ দশমিক ১৫ শতাংশ।
করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের পর থেকেই সেটির হার সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল রাজশাহীতে। এ বিভাগে গত সাত দিনে শনাক্তের গড় হার ২৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
ঢাকার বাইরে করোনা শনাক্তের এই উচ্চ হার নিয়ে নিউজবাংলার সাথে কথা বলেছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, লকডাউনের মধ্যে কর্মহীন মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে গেছে। সেখান থেকে করোনা পর্যায়ক্রমে গ্রামে ছড়িয়েছে। এটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সীমান্ত এলাকায় গ্রাম থেকে গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এমন অনেক গ্রাম আছে, যেখানে সীমান্তবর্তী মানুষের মধ্যে শনাক্ত বাড়ছে ।
তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ‘অনেক গ্রামের মধ্যে দিয়ে ভারতের সীমান্ত চলে গেছে। যখন প্রথম ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ ধরা পড়ে, তখন এসব এলাকায় যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু লোকজন পায়ে হেঁটে চলাচল করেছে। এভাবে গ্রাম থেকে গ্রামে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
এরই মধ্যে আবার ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য পরির্বতন হয়েছে উল্লেখ করে মোশতাক বলেন, ‘ভারতে যখন দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দিলো, তখন কুম্ভমেলায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। ভাইরাসটি খাপ খাইয়ে নিয়েছে শ্রমিক ও কৃষকের শরীরে। সেই ধরনটিই এখন বাংলাদেশে আসছে।’
কোরবানি ঈদে লোকে বিপুল পরিমাণে শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছে। ঈদের পর লোকে গ্রাম থেকে ঢাকামুখী হলে আবার ঢাকায় সংক্রমণ বেশি হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, বিশেষ করে শহর অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বেশি সংক্রমণের শঙ্কা রয়েছে।
খুলনায় শনাক্ত বেশি
এখন সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে খুলনায়। গত সাত দিনের রোগী শনাক্তের গড় হার ছিল ৩৫ শতাংশ।
হঠাৎ করে এত রোগী শনাক্তের কারণ জানতে চাইলে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সুহাস রঞ্জন হালদার নিউজবাংলাকে বলেন, আগের থেকে এখন পরীক্ষা বেশি হচ্ছে। মানুষ এখন করোনা উপসর্গ দেখা দিলে পরীক্ষা করাতে আসছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে এখন করোনা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা হয়েছে।
বেশি মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই হাসপাতালে আসছেন শেষ মুহূর্তে। ততক্ষণে তাদের শারীরিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ছে। বেশির ভাগ রোগীর অক্সিজেন লেভেল নেমে যাচ্ছে ৮০-এর নিচে। এ সমস্ত রোগীই মৃত্যুর তালিকা বাড়াচ্ছেন।’
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. রাশেদা সুলতানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেসব রোগীর ডায়বেটিস, হার্টের সমস্যা রয়েছে, লিভারের রোগে আক্রান্ত ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত, অ্যাজমা, হাইপারটেনশন, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, করোনা আক্রান্ত হলেই তাদের অক্সিজেন লেভেল কমে যাচ্ছে। চিকিৎসকেরা চেষ্টা চালিয়েও তাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারছেন না। এ ছাড়া দেখা গেছে বেশি মারা যাচ্ছেন বয়স্ক রোগীরা।’
শনাক্তের হার কমে আসছে রাজশাহীতে
তিন বিভাগের মধ্যে শনাক্তের হার রাজশাহীতে কম। তবে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট রাজশাহী সীমান্ত দিয়েই দেশে প্রবেশ করেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শুরুতে এই বিভাগে শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এখন তা ২০-এর ঘরে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর কিছু দিন করোনা শনাক্তের হার বৃদ্ধি পেয়েছিল। এখন অনেক কমে এসেছে। রাজশাহীতে গত বছর প্রথম ঢেউয়ে সবচেয়ে বেশি ৯৮ জন রোগী ভর্তি ছিল। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর সর্বোচ্চ ১৩৬ রোগী ভর্তি হয়েছে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এ অঞ্চলের একমাত্র ভরসার জায়গা উল্লেখ করে নওশাদ আলী বলেন, ‘এখানে নাটোর, নওগাঁসহ ছয়টি জেলার মানুষ চিকিৎসা সেবা নেয়। তার মানে ওই জেলাগুলোতেও রোগী কম ছিল। গত বছরের তুলনায় এবার রোগীর নমুনা পরীক্ষার বেড়েছে। পরবর্তীতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে রোগী শনাক্তের হার কমতে শুরু করেছে।’
জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকার তুলনায় বাইরে এখন নমুনা পরীক্ষা বেশি হচ্ছে। সরকারের প্রচারণার কারণে মানুষ এটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এখন সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইউনিয়ন পর্যায়ে অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হচ্ছে, সেটা আগে ছিল না।’
করনীয় কী হতে পারে
আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন লকডাউনকেই সমাধান মনে করেন না। তিনি বলেন, এর সঙ্গে সঙ্গে যারা শনাক্ত হচ্ছে, তাদের প্রতিটি লোকের খোঁজখবর নিতে হবে। লোকজনের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে, অন্যদিকে বাড়িতে করোনা রোগীর সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যরা যাতে বসবাস না পারে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
তবে ঢাকায় দেশের অন্য জেলাগুলো থেকে শনাক্তের হার কম হচ্ছে। অনেকেই ভেবে নিয়েছেন, ঢাকারবাসীর দেহে অ্যান্টিবডি বেশি থাকার কারণে শনাক্ত কম।
এই ধারণাকে ভুল বলে জানান মুশতাক। তিনি বলেন, ১৬ কোটি মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে হলে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হবে। করোনা আক্রান্ত হয়ে যাদের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তাদের পরিমাণ অনেক কম। এ ছাড়া গ্রামের মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম– এটাও বাজে কথা। শহর ও গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র হওয়ার কারণে বিপদ ও মহামারি সম্পর্কে জানার পরও জীবিকার তাগিদে তারা লকডাউনের মধ্যে বাইরে বের হচ্ছে।
আরও পড়ুন:দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩১২টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যে কেউ মারা যায়নি। আজ মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। এ দিন প্রতি ১০০ নমুনায় শনাক্তের হার ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ‘২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যু ২৯ হাজার ৫২১ জন। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। এছাড়া ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে মোট শনাক্ত হয়েছে ২০ লাখ ৫২ হাজার ১২৭ জন। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৫৮২ জন।
এডিশ মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সারা দেশে মশা নিধন কার্যক্রমের দুর্বলতার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক মোড় নিয়েছে। চলতি বছরের মে মাসের তুলনায় জুন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরের শুরুর দিকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। জানুয়ারিতে ১,১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬ এবং এপ্রিলে ৭০১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে মে মাস থেকে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে এবং জুনে এসে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। আশঙ্কার বিষয় হলো, ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে, বিশেষ করে বরগুনায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি।
এদিকে চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ২৯৬ জনে পৌঁছেছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৪২৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ে কারও মৃত্যু হয়নি।
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নতুন শনাক্ত ৪২৯ জন ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে— বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৪৯ জন; চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৭ জন; ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬১ জন; ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৪২ জন; ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৪৫ জন; খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২১ জন ও রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৪ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়পত্র পেয়েছেন ৩৫৮ জন রোগী। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মোট ৯ হাজার ৮৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন।
চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং নারী ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৪২ জন মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে একজন রাজশাহী বিভাগের বাসিন্দা।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এডিস মশার বিস্তার এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরের এলাকাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার গণমাধ্যমকে বলেন, 'মে মাসের তুলনায় জুনে আক্রান্তের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে জুলাইয়ে এ সংখ্যা চার থেকে পাঁচগুণ এবং আগস্টে দশগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।'
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৯৬ জনে। এর আগে ২০২৩ সালের পুরো বছরে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। ২০২৪ সালের পুরো বছরের (১ জানুয়ারি–৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) সর্বমোট হিসাব অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ৫৭৫ জন।
করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের মধ্যে দেশে আরও ২১ জনের শরীরে প্রাণঘাতী ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয়েছে।
রবিবার (২৯ জুন) সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় এসব শনাক্ত হয়েছে। তবে, নতুন করে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এই সময়ের মধ্যে।
সোমবার (৩০ জুন) স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৮৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ২০ লাখ ৫২ হাজার ১১৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২২ জন। আর দেশে ভাইরাসটিতে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৫২১ জনের।
গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৩৮৩ জন রোগী। এসব রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩৬ জন আক্রান্ত বরিশাল বিভাগে। একইসঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৩৬ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৫ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪৮, ঢাকা উত্তর সিটিতে ৩২ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২৮, খুলনা বিভাগে ৪১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জন এবং রাজশাহী বিভাগে ৩৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে গত এক দিনে সারাদেশে ৩৪৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮ হাজার ৭২৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৯ হাজার ৮৬৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪২ জনের।
সারাদেশে করোনা ভাইরাসের নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট এর সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পর সিলেট এ ভাইরাসে আক্রান্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে।
শনিবার দুপরে এ তথ্যটি নিশ্চিত করেছে সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নতুন করে করোনার আক্রমন শুরুর পর সিলেটে প্রথম এই কোন রোগী মারা গেলেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, করোনায় আক্রান্ত ৬৯ বছর বয়েসি পুরুষ ১৯ জুন শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান তিনি। এছাড়া সিলেটে এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০ জন বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মো. মিজানুর রহমান জানান, নিহত ব্যক্তির বাড়ি সিলেট সদর উপজেলায়। তিনি করোনা ছাড়াও আরও অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে; গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন আরও ছয়জন। এ নিয়ে চলতি জুন মাসেই জেলায় করোনায় মৃতের সংখ্যা সাতজনে দাঁড়াল।
২৮ জুন চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাঠানো সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলার মিরসরাই উপজেলার বাসিন্দা সালেহা বেগম (৪০) নামে এক নারী শুক্রবার নগরের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে থেকেই তিনি হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
এদিকে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৯১টি নমুনা পরীক্ষা করে ছয়জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন নগরের এবং দুজন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।
শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে নগরের শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চারজন এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে দুজনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে চলতি জুন মাসে মোট ১৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ৬৬ জন পুরুষ, ৬৩ জন নারী ও একজন শিশু রয়েছে।
মশাবাহীত রোগ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশালের দুই জেলায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময় গোটা বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন আরও ১০৫ জন আক্রান্ত রোগী। এ নিয়ে বর্তমানে বিভাগের ছয় জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৩৫ জন। মৃত্যুবরণ করা দুজন হলেন- বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ি এলাকার বাসিন্দা আ. করিম (৫০) ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের রাজপাড়া এলাকার মো. ইউসুফ খন্দকার (৭২)। এর মধ্যে আ. করিম বরিশাল শেরইবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে ও বৃদ্ধ মো. ইউসুফ খন্দকার কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গতকাল শুক্রবার দুপুরে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা উদ্বেগ ও আশঙ্কাজনক। এ পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হবে। চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি। তাই মশার বিস্তার রোধ করতে বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৩০৫ জন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪৩৫ জন।
বরগুনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মৃত ১১ জনের মধ্যে ছয়জনেরই বরগুনার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। শুধু মৃত্যুই নয় এ জেলায় আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি, বরগুনা জেলায় এ পর্যন্ত ২ হাজার ৬৩২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
মন্তব্য