বিস্তৃর্ণ হাওর, হাওরজুড়ে শুষ্ক মৌসুমে ধান আর বর্ষায় মাছ, পাগল করা বাউল সুর আর প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য খ্যাতি ছিল সুনামগঞ্জের। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সামনে নিয়ে এসেছে অচেনা এক সুনামগঞ্জকে।
হেফাজতে ইসলামের সমালোচনা করাই যেন অপরাধ এখানে। সমালোচনা করলেই গ্রেপ্তার, মারধর, হেনস্তা করা হচ্ছে। বাড়িঘরে হামলা-হুমকি তো রয়েছেই। সাম্প্রতিক এ রকম কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে সুনামগঞ্জে। এমনকি একজন সমালোচনা করার কারণে পুরো গ্রামে তাণ্ডবও চালানো হয়েছে। এসব ঘটনায় পুলিশ সব সময় সমালোচনাকারীর বিরুদ্ধে খড়গহস্ত করছে। তবে এতে করে তারা নিজেরাও রক্ষা পাচ্ছে না। থানাতেও ঘটেছে হামলার ঘটনা।
অসাম্প্রদায়িকতা ও সংস্কৃতিচর্চার জন্য বিখ্যাত সুনামগঞ্জে কেন একের পর এক এ রকম ঘটনা ঘটছে? কীভাবে উগ্রবাদী গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে উঠল হাওরের এই সরল জনপদে?
স্থানীয় পর্যায়ের একাধিক রাজনীতিবিদ, সংগঠক, সংস্কৃতিকর্মী ও সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপ হয় এ নিয়ে। প্রত্যেকেই বলছেন, বামধারার রাজনীতি দুর্বল হয়ে যাওয়া, ভোটের লোভে আওয়ামী লীগ নেতারা আদর্শচ্যুত হওয়া ও ভিন্ন আদর্শের লোকদের দলে ভেড়ানো, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা ও দুর্বল হয়ে পড়া এবং একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ব্যাপক কর্মকাণ্ড গত দুই দশকে বদলে দিয়েছে সুনামগঞ্জের চিত্র।
অথচ মুক্তিযুদ্ধের পরও এখানে ভোটের মূল লড়াই হতো আওয়ামী লীগ আর বাম দলগুলোর মধ্যে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক চর্চার জন্য খ্যাতি ছিল এই অঞ্চলের। খ্যাতি ছিল বাউল ও সহজিয়া দর্শনের সাধকদের উর্বরভূমি হিসেবে।
হাসন রাজা, রাধারমন, দুর্বিন শাহ, শাহ আব্দুল করিম- সুনামগঞ্জের এমন অসংখ্য সাধক গানে-কথায় জীবনভর অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবপ্রেমের কথা প্রচার করে গেছেন। আবার এই অঞ্চলে জন্ম নিয়ে বরুণ রায়, আবদুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো নেতারা বাম ও আওয়ামী ধারার রাজনীতিতে জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
অথচ এই সুনামগঞ্জ থেকেই এখন ছড়াচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প।
একের পর এক ঘটনা
গত ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে হেফাজতে ইসলামের একটি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী ও মামুনুল হক। পরদিন দিরাইয়ের পাশের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাস নামের এক যুবক ফেসবুকে মামুনুল হকের সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দেন।
এ নিয়ে ওই দিনই শাল্লায় উত্তেজনা দেখা দেয়। স্থানীয় লোকদের উসকে দেয় উগ্রবাদীরা। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে ওই রাতেই ঝুমন দাসকে পুলিশের হাতে তুলে দেন গ্রামবাসী।
পরদিন ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সকালে ঝুমনের গ্রাম নোয়াগাঁওয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায় কয়েক হাজার লোক। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে আশপাশের গ্রাম থেকে মিছিল নিয়ে এসে তারা ভাঙচুর ও লুটপাট করে গ্রামের অন্তত ৮০টি বাড়িতে।
এ ঘটনার রেশ না কাটতেই রিসোর্ট-কাণ্ডের পর ৪ এপ্রিল হেফাজত নেতা মামুনুল হক ও ‘শিশুবক্তা’ রফিকুল ইসলাম মাদানীকে নিয়ে সমালোচনা করায় তোপের মুখে পড়েন দিরাইয়ের এক স্কুলশিক্ষক। ফেসবুকে নয়, স্থানীয় একটি বাজারে চায়ের আড্ডায় মামুনুল হক ও মাদানীর সমালোচনা করেছিলেন স্থানীয় একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এসবি গোলাম মোস্তফা। এতেই ক্ষেপে যায় হেফাজত অনুসারীরা।
প্রথমে তর্কাতর্কি, পরে কয়েক শ লোক জড়ো করে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মিছিল করে তারা। যথারীতি অভিযোগ আনা হয় ধর্ম অবমাননার। পরে ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় প্রশাসন হাজির হয় ঘটনাস্থলে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ক্ষমা চান স্কুলশিক্ষক।
তবে এতেও ক্ষান্ত হয়নি হেফাজত অনুসারীরা। তারা স্কুলশিক্ষকের পদচ্যুতির দাবি জানায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়ায় যে, শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসানকেও সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসককে ফোন করে ওই শিক্ষকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশ দিতে হয়।
মামুনুল হক যেদিন নারীসহ ধরা পড়লেন সোনারগাঁয়ে, সেদিনও সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে হেনস্তার শিকার হন যুবলীগের এক নেতা। মামুনুলের নারীসহ রিসোর্টে যাওয়ার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে বিপাকে পড়েন যুবলীগ নেতা এমাদ হোসেন জয়।
এই পোস্টকে কেন্দ্র করে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসে। পরদিন আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি। জয় ওই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা জজ মিয়ার ছেলে ও ইউনিয়ন যুবলীগের মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক।
সর্বশেষ হেফাজতের সমালোচনা করে পোস্ট দিয়ে হেনস্তার শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রলীগের নেতা আফজাল খান। তার বাড়ি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায়। হেফাজতকে নিয়ে পোস্ট দেয়ার পর গত মঙ্গলবার তাকে ধর্মপাশার জয়শ্রী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ অফিসে আটকে রেখে লাঞ্ছিত করা হয়। তাৎক্ষণিক কয়েক শ মানুষ জড়ো হয়ে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে আসে ও উত্তেজিত জনতার কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে।
এদিকে, গত শনিবার রাতে মামুনুল হককে আটক করা হয়েছে এমন খবরে ছাতকে মিছিল বের করে হেফাজতে ইসলামের অনুসারীরা। এই মিছিল থেকে ছাতক থানায় হামলা ও ভাঙচুর করা হয়।
এ রকম একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলছে। ফেসবুকে হেফাজত ও তাদের নেতাদের সমালোচনা করে পোস্ট দিলেই হামলা, হেনস্তা, গ্রেপ্তার ছাড়াও ফেসবুকে গালাগালি ও হুমকির অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য।
প্রশাসনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা
শাল্লার তাণ্ডবের পরই প্রশ্ন ওঠে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। আগের দিন উত্তেজনা জানার পরও নোয়াগাঁওয়ে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি; সেই সুযোগে তাণ্ডব চালানো হয় পুরো গ্রামে।
পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তে এই অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে। এই হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার দায়ে গত মঙ্গলবার শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হককে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া দিরাই থানার ওসি আশরাফুল ইসলামকে মৌলভীবাজারে বদলি করা হয়েছে।
শাল্লায় মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে সমালোচনা করায় আটক ঝুমন দাশের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে পুলিশ। এই মামলায় পুলিশের বাদী হওয়া আইনবিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবীরা।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তাহিরপুর, ধর্মপাশা ও দিরাইয়ের ঘটনায়ও। হেফাজতের সমালোচনা করায় তাহিরপুরে যুবলীগ নেতাকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো, ধর্মপাশায় ছাত্রলীগ নেতাকে কেন হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে আসা ও ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হলো, এসব প্রশ্ন তুলে তার সমালোচনা করছেন অনেকেই।
ধর্মপাশায় ছাত্রলীগ নেতাকে হেনস্তার ঘটনায় থানার ওসি দেলোয়ার হোসেনসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে বুধবার বদলি করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা মনে করেন, হেফাজত ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে একটা ভীতির পরিবেশ তৈরি করে। প্রশাসনও এতে ভয় পায়। ফলে তাদের ব্যাপারে নমনীয় থাকে। এই নমনীয়তাকে কাজে লাগায় হেফাজত। এ ছাড়া মাঠ প্রশাসনে অনেকে তাদের অনুসারীও থাকতে পারে।
হেফাজতের সমালোচনা করলেই কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, এমন প্রশ্ন করা হয় সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমানকে। তিনি অযথা কাউকে আটক বা হেনস্তা করা হচ্ছে না জানিয়ে বলেন, অনেক সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে অনেক ভূমিকা নিতে হয়। তবে যা কিছু হচ্ছে আইন মোতাবেকই হচ্ছে।
তিনি বলেন, কাউকে ধরে আনা মানেই সে অপরাধী নয়। পুলিশের কাজ বিচার করা নয়। পুলিশ আটকের পর আদালতে পাঠায়। আদালত যদি মনে করে সে অপরাধী নয় তাহলে ছেড়ে দেয়।
তবে সাম্প্রতিক সুনামগঞ্জের ঘটনাগুলো প্রসঙ্গে পুলিশের সিলেট রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, যেসব ঘটনার ব্যাপারে অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। কারও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, পুলিশ, আইনের বাইরে কেউ কিছু করতে পারবে না। করলে বিপদে পড়বে। এ ব্যাপারে সবাইকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে।
আওয়ামী লীগ-হেফাজত একাকার
১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে যে সমাবেশটি করে হেফাজতে ইসলাম, সরাসরি এর সহযোগিতায় ছিলেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা। আওয়ামী লীগ দলীয় দিরাই পৌরসভার মেয়র বিশ্বজিত রায় ওই সমাবেশে মঞ্চে উঠে বক্তৃতাও করেছেন।
কেবল এই সভায়ই নয়, সম্প্রতি সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ধর্মীয় সভার নামে বেশ কয়েকটি জমায়েত করে হেফাজতে ইসলাম। এতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন। তার সবগুলোতেই অর্থ, জনবল, স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে এবং অতিথি হয়ে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।
সুনামগঞ্জের তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও হেফাজত অনেকটা একাকার হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ দলটির অনেক নেতার। তারা নিজেদের গ্রুপ ভারী করতে জামায়াত-হেফাজতকে দলে ভেড়াচ্ছেন। আবার অনেক নেতা নিজেই হেফাজতের প্রতি ঝুঁকছেন বলে অভিযোগ আছে। এ
ছাড়া দলীয় গ্রুপিং ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে অনেকে হেফাজতকে ব্যবহার করে সুবিধা নেয়ার অভিযোগও আছে।
দিরাইয়ে সমাবেশের পর শাল্লায় হিন্দুপল্লিতে যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তাতে প্রধান আসামি করা হয়েছে স্থানীয় ইউপি সদস্য শহীদুল ইসলাম স্বাধীনকে। তিনি যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে এলাকায় চাউর আছে।
এ ছাড়া ধর্মপাশায় ঢাবি শাখা ছাত্রলীগ নেতা আফজাল খানকে হেনস্তার ঘটনায় করা মামলার আসামি জয়শ্রী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের (সদ্য বহিষ্কৃত) সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম আলম ও তার ছেলে আল মুজাহিদ।
মুজাহিদের নেতৃত্বেই স্থানীয়দের উসকে দিয়ে এই হেনস্তার ঘটনা ঘটে বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন আফজাল। এ ঘটনায় আবুল হাশেম আলমকে বুধবার বহিষ্কার করেছে আওয়ামী লীগ। একই দিনে তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ।
সুনামগঞ্জে সাম্প্রতিক এ রকম সবগুলো ঘটনায়ই দেখা গেছে আওয়ামী লীগ ও হেফাজত নেতারা একাকার। সমাবেশ কিংবা হামলা- সবই মিলেমিশে করছেন তারা।
সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি এম রশিদ আহমদের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতকে। জেলার আওয়ামী রাজনীতির এই অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন ভোটের রাজনীতি করি। আদর্শ রাজনীতি থেকে সরে এসেছি। এতে প্রতিক্রিয়াশীলরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। একসময় সুনামগঞ্জের প্রগতিশীল নেতারা সারা দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন সেদিন বদলে গেছে। আমরাই দলে প্রতিক্রিয়াশীলদের জায়গা করে দিচ্ছি।’
একই ধরনের মন্তব্য করেছেন জগন্নাথপুর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদির আহমদ মুক্তাও। তিনি বলেন, ‘রাজনীতির অদূরদরদর্শিতার কারণে এমনটি হচ্ছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা মূল আদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। দলে আদর্শবিরোধী অনেকে ঢুকছে। অনেক নেতার মাধ্যমে তারা ঢুকছে। দলীয় আদর্শ প্রচারের চেয়ে নেতারা গড্ডালিকায় গা ভাসান। আবার মুখে ধর্মের বুলি আওড়ে হেফাজতিরা আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয়দের সহজেই দলে ভিড়িয়ে নিতে পারে।’
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খাইরুল কবির রুমেন বলেন, ‘সুনামগঞ্জ শান্তির শহর। সংস্কৃতির শহর। কিন্তু কিছু মৌলবাদী এ শহরের শান্তি নষ্ট করতে নানা রকম পাঁয়তারা করছে। এদের মধ্যে আমাদের দলের কিছু লোক তাদের সহযোগিতা করছে। ইতোমধ্যে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ থেকে কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং আমাদের মনিটরিং সেল এসব বিষয়ে নজরদারি রাখছে। এমন যাদেরই পাওয়া যাবে, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।’
আছে উসকানি, গুজব
সুনামগঞ্জে সাম্প্রতিক সবগুলো ঘটনার পেছনেই উসকানি দিয়ে ও গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করার অভিযোগ রয়েছে।
শাল্লা, দিরাই, তাহিরপুর কিংবা ধর্মপাশায় ঘটা সাম্প্রতিক সবগুলো ঘটনায় দেখা গেছে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার পর দ্রুততম সময়ে তা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তে জড়ো হয়ে যায় হাজারও মানুষ। হেফাজতে ইসলামের সমালোচনাকে ইসলাম ধর্মের সমালোচনা বলেও অপপ্রচার চালানো হয় এবং সমালোচনাকারীকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়।
সুনামগঞ্জের একটি থানার ওসি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হেফাজতের নেতারা উসকানি দিয়ে ও গুজব ছড়িয়ে এমন পরিস্থিতির তৈরি করে তাতে এলাকায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। ফলে অনেকের জানমাল রক্ষায় পুলিশ বাধ্য হয়ে সমালোচনাকারীকে ধরে নিয়ে আসে।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য খ্যাতি রয়েছে সুনামগঞ্জের। অসংখ্য বাউল ও লোকশিল্পীর জন্ম এ অঞ্চলে। বছরজুড়েই লেগে থাকত গান-নাচ-নাটকের উৎসব। তবে সাম্প্রতিক একদিকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে হেফাজত ইসলামের বিভিন্ন কর্মসূচিকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের সাংবাদিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী শামস শামীম বলেন, ‘সুনামগঞ্জে আগে বছরজুড়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা হতো। ছোটবেলা পথেঘাটে মেলা, বাউল গানের আসর, ওরস দেখেছি। এগুলোতে সব ধর্মের মানুষ যেত। সব মানুষের সম্মেলনের কথা বলা হতো। এখন এগুলো বন্ধ। এখন এসব আয়োজন করতে গেলেই বাধা আসে। ধর্মান্ধরা বাধা দেয়। প্রশাসন বাধা দেয়। এখন সব বন্ধ করে কেবল ওয়াজ মাহফিল হয়। আর এসব মাহফিলে ধর্মচর্চার চেয়ে উগ্রতা ও উসকানিমূলক কথাই বেশি হয়। এ জন্য প্রশাসন ও সরকার দায়ী।’
সুনামগঞ্জের বাউলশিল্পী লাল শাহ। শাল্লার তাণ্ডবের পর সেখানে ছুটে গিয়েছেন তিনি। লাল শাহ বলেন, ‘আমি যদি মানুষই হতে পারি না, তাহলে মুসলমান হব কীভাবে?’
লাল শাহ বলেন, ‘আমরা এখন মনে করছি নামাজ পড়লে, রোজা রাখলেই বেহেশতে চলে যাব। কিন্তু মানুষ চিনলাম না। বিভিন্ন জনকে ফতোয়া দিলাম। এসব করে তো হবে না। আগে মানুষ হতে হবে। মানুষ চিনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘মানুষ কেবল ভুল চিন্তা করছে। আমাকে বেহেশতে নেবে আমার সৎকর্ম। আমার দেহের ভেতরে যে প্রকৃত মানুষ আছে সে-ই মানুষ।’
আরও পড়ুন:ভারতীয় নাগরিককে জুলাই যোদ্ধা বানিয়ে অপপ্রচার শনাক্ত করেছে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)’র ফ্যাক্ট চেক ও মিডিয়া রিসার্চ টিম বাংলাফ্যাক্ট।
বাংলাফ্যাক্ট অনুসন্ধানে শনাক্ত হয় যে, ভারতীয় নাগরিককে জুলাই যোদ্ধা বানিয়ে অপপ্রচার করা হয়েছে।
ফ্যাক্টচেক করে দেখা যায় যে, বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত একটি ভিডিওটিতে হুইল চেয়ারে বসা এই ব্যক্তি কোনো জুলাই যোদ্ধা নন। রোগীর ছদ্মবেশে থাকা ওই ব্যক্তি একজন ভারতীয় নাগরিক। তার নাম নজরুল হক।
গত ১৭ মার্চ ভারতের কলকাতা থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন রোগীর ছদ্মবেশে থাকা নজরুল হক নামের এক ভারতীয় নাগরিক। সে সময় তার কাছ থেকে মদ ও কসমেটিকস উদ্ধার করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ওই ঘটনার ভিডিওকে আহত জুলাই যোদ্ধার কাছ থেকে এয়ারপোর্টে মদ উদ্ধারের ঘটনার ভিডিও দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
বাংলাদেশে চলমান গুজব, ভুয়া খবর, অপতথ্য প্রতিরোধ ও জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ায় দায়িত্ব পালন করছে বাংলাফ্যাক্ট।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের যেন ভোগান্তির শেষ নেই। টাকা দিয়ে হাসপাতালের সরকারি ওষুধ নেওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠানো, কমিশন বাণিজ্য, হুইলচেয়ার বাণিজ্য ও প্রথমে সাপ্লাই নেই বলে রোগীকে ওষুধ না দেওয়াসহ নানা অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে। এসব কারণে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে বিপাকে রয়েছেন রোগীরা।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে এসব অভিযোগ পাওয়া যায় অহরহ।
এদিকে খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সেনাবাহিনীর একটি দল। এ সময় তারা সরকারি ওষুধ বিক্রি এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ রোগীকে দেওয়ার অভিযোগে মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ড বয় হরষিতকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
হরষিতের কাছ থেকে সরকারি ওষুধ কিনে বিপাকে পড়া সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া এলাকার মোহাম্মদ আলী বলেন, ঈদের পরদিন আমার স্ত্রীকে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করালে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে বলেন, এ ওষুধ সাপ্লাই নেই, বাহিরে থেকে নিয়ে আসেন। আমি প্রথম থেকেই সব ওষুধ বাহির থেকেই নিয়ে আসছিলাম, হঠাৎ এক ওয়ার্ড বয় বলল চাচা ওই ওষুধটা বাহিরের থেকে কত টাকা করে কিনছেন? আমি বললাম ৮৫০ টাকা। পরে সে ওষুধ ৫০০ টাকায় ওয়ার্ড বয় আমাকে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, চারটা ওষুধ আমার স্ত্রীর শরীরে পুশ করলে জ্বালা যন্ত্রণার অনুভব করে এবং তার জ্বর আসে। পরে জানা যায় ওষুধগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ।
এদিকে, সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে ওষুধ বিক্রির কথা স্বীকার করে মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ড বয় হরষিত বলেন, আমি ছয়-সাত মাস আগে হাসপাতালে ডাস্টবিন থেকে কয়েকটি ওষুধ কুড়িয়ে পাই। সুযোগ বুঝে এখন ওষুধগুলো বিক্রি করেছি।
এদিকে হরষিতের কাছ থেকে কেনা ছয়টি ওষুধের অবশিষ্ট দুটি ওষুধে দেখা গেছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মেয়াদ শেষ।
আব্দুল গফুর নামে একজন বলেন, টাকা ছাড়া এখানে কোনো কাজই হয় না। রোগীর যদি কোনো পরীক্ষা করতেই হয় টাকা দিতে হয়। এরপর হুইল চেয়ারে যদি টয়লেটে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে ১০০ টাকা করে দিতে হয়। টাকা নিয়েই সব কাজ করে তাহলে এটি সরকারি হাসপাতাল হলো কিভাবে।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, আমরা এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মেডিকেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিটিং করেছি। হাসপাতালে ডাক্তাররা ঠিকমতো ডিউটি না করা, গাড়ির গ্যারেজে অতিরিক্ত টাকা আদায়সহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা প্রতিবাদ করেছি। ওষুধ থাকবে হাসপাতালের স্টোরে। যেখান থেকে সুষ্ঠুভাবে রোগীর হাতে পৌঁছাবে। সেই ওষুধ কীভাবে ওয়ার্ড বয়ের মাধ্যমে বিক্রি হলো এটার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. কুদরতে খোদা বলেন, ওষুধ বিক্রির বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনারা রোগীর লোককে একটু বলেন, আমার কাছে একটা অভিযোগ দিতে। তাহলে যে এ কাজ করেছে তাকে আউট করে দেব।
ইউটিউবে ভিডিও দেখে নওগাঁয় কালো সৈনিক পোকা বা ব্ল্যাক সোলজারস ফ্লাই নামের একটি পোকা থেকে লার্ভা উৎপাদন করে সাফল্য পেয়েছেন আহসান হাবিব নামে উদ্যোক্তা। এ পোকার লার্ভা মাছের বিকল্প খাবার হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিক্রি করে প্রতি মাসে আয় করছেন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। মাছের খাবারের বিপল্প হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় এই পোকা চাষে আগ্রহ বাড়ছে স্থানীয়দের। উদ্যোক্তা আহসান হাবিব সদর উপজেলার তিলেকপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত উলিপুর গ্রামের বাসিন্দা।
জানা যায়, আহসান হাবিব পেশায় একজন কৃষক। কৃষি কাজের পাশাপাশি তিনি পুকুরে মাছ চাষ করতেন। বাজারে যখন মাছের খাবারের মূল্য বৃদ্ধি তখন খরচ কমাতে বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন। এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে ইউটিউব ভিডিও দেখে কালো সৈনিক পোকা বা ব্ল্যাক সোলজার চাষের আগ্রহ হয়। পরিকল্পনা করেন এই পোকা চাষের। ২০২৪ সালে খামার সম্প্রসারণে পিকেএসএফ এর কারিগরি সহযোগিতায় মৌসুমি আরএমটিপি প্রকল্প তাকে সহায়তা দেন। এরপর কালো সৈনিক পোকা বা ব্ল্যাক সোলজারস ফ্লাই বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে সাফল্য পান। মাসে এখন তার খামারে ২৫০ থেকে ২৬০ কেজি লার্ভা উৎপাদন হয়। নিজের পুকুরে মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিক্রি করে থাকেন। এলাকায় তিনি পোকা চাষি হাবিব নামে পরিচিত।
কালো সৈনিক পোকা বা ব্ল্যাক সোলজারস ফ্লাই মূল পোকাগুলো একটি জালের মধ্যে, দিনের বেলায় আলো-বাতাস আসে এমন জায়গায় রাখা হয়। পোকাগুলো প্রজনন সম্পন্ন করার পর সেখানে কাঠের স্তরের মধ্যে ডিম পাড়ে। সেই ডিমগুলো হ্যাচিং করে ফোটানোর কিছুদিন পর আলাদা করে অন্য জায়গায় রাখা হয়। এরপর সেখান থেকে তৈরি হয় লার্ভা। এসব লার্ভা উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বাসা বাড়ি, হোটেল-রেস্তোরাঁ উচ্ছিষ্ট খাবার, পচনশীল ফলমূল অথবা শাকসবজি। এসব পচনশীল আবর্জনা সংরক্ষণ করে সেটির প্রক্রিয়াজাত করা হয়। তারপরও সেখানে জন্ম নয় এসব লার্ভা। এসব পোকা মাছের জন্য প্রোটিন সমৃদ্ধ একটি খাবার। ব্যাপক প্রোটিনসমৃদ্ধ হওয়ায় মাছের বিকল্প খাবার হিসেবে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এটি ব্যবহারে যেমন উৎপাদন বাড়বে তেমন কমবে খরচে উৎপাদনে। শুধু লার্ভা উৎপাদনে নয় আবর্জনা ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে দূষণ কমাতে সহায়ক ভৃমিকা রাখছে এমন উদ্যোগ।
স্থানীয় মাছ চাষি রফিকুল ও রাজা বলেন, আমাদের নিজেদেরই পুকুর আছে। বাজার থেকে খাবার কিনে মাছে চাষে খরচ বেশি হয়। লাভবান হওয়া যায় না। কিন্তু কম খরচে উচ্ছিষ্ট খাবার থেকে কালো সৈনিক পোকা বা ব্ল্যাক সোলজারস থেকে লার্ভ তৈরি করে মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করলে লাভবান হওয়া যাবে। চিন্তাভাবনা করেছি আহসান হাবিরের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে এরকম একটি উদ্যোগ নিবো।
মৌসুমি আরএমটিপি প্রকল্পের মনিটরিং কর্মকর্তা আব্দুর রউফ পাভেল বলেন, উন্নয়ন সংস্থা মৌসুমির মাধ্যমে জেলায় এই প্রথম আগ্রহী মাছ চাষিদের মাধ্যমে কালো সৈনিক পোকা চাষের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চাষিদের মাছ চাষে অধিক লাভবান করতে ও ভোক্তাদের মাঝে বিষমুক্ত মাছ পৌছে দিতেই এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামীতে এই প্রকল্পটি আরো বিভিন্ন উপজেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
নওগাঁ সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো: বায়েজিদ আলম বলেন, এই পোকার খাবার হচ্ছে ফেলে দেওয়া বাড়ির উচ্ছিষ্ট, ময়লা আর আবর্জনা। ফেলে দেয়া এই ডাস্টগুলো রিসাইকেল হতে যে ক্ষতিকর গ্রীণ হাউজ গ্যাস নি:সরণ ঘটে সেই গ্যাসও এই পোকা শোষণ করে। মাছ চাষি ও ভোক্তাদের মাঝে এই পোকার উপকারি দিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সরকারি ভাবেও এই পোকা চাষের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গবেষণার মাধ্যমে ফিডের মতো করে এই পোকার পাউডার তৈরি করে বাজারজাত করতে পারলে চাষিদের মাছ চাষে খরচ কমার পাশাপাশি দেশের ভোক্তাদের কাছে বিষমুক্ত মাছ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হতো। এছাড়াও আবর্জনা ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে দূষণ কমাতে সহায়ক ভৃমিকা রাখবে।
মানুষের আগ্রাসন অপরিকল্পিত নগরায়নে প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে গাছ। বনাঞ্চলের সঙ্গে কমছে প্রাণীর সংখ্যাও। খাদ্য ও বাসস্থানের সংকট, অবৈধ শিকার, পাচার, কীটনাশকের অতি ব্যবহারের মতো নানা কারণে প্রতি বছরই পৃথিবী থেকে কোনো না কোনো প্রাণী বিলুপ্ত হয়। কুষ্টিয়াতে প্রায় বিলুপ্তির পথে জীববৈ চিত্র্য। গাছ-পালা নিধন দ্রুত শহরায়নের ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে পাখি।
কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, মিল কল কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ও কারেন্ট জালের ব্যবহারের ফলে মারা পড়ছে কৃষিবান্ধব পাখি। রাস্তার দুপাশে গাছ, ক্যানাল এর দুপাশেরসহ বিভিন্ন ফসলের মাঠের ধারের বড় বড় গাছ, কলকারখানা, ইটভাটা, প্লাইউড কারখানা ও আবাসস্থল তৈরির জন্য গাছ ও বনজঙ্গল নির্বিচারে কেটে ধ্বংস করে জলবায়ু পরিবর্তন ও পাখিদের হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এক সময় বিল ও জলাশয়ের ধারে দল বেধে নামত দেশি সাদা বক। কৃষকের লাঙ্গল দিয়ে জমি কর্ষণ ও ফসল কাটার সময় পাখির দল কৃষককে ঘিরে ধরত। ওই পাখির দল ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে পেট ভরত। জীববৈচিত্র্যে আদরমাখা এই দেশি পাখি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। শুধু গ্রামগঞ্জে ফসলের জমিতে ও শহরের কিছু জলাশয়ে শীতের মৌসুমে দেখা মেলে স্বল্পসংখ্যক পাখির।
এক সময় কুষ্টিয়া জেলার গ্রামের মাঠে ধানের ক্ষেতে চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করার সময় দেখা গেল শত শত সাদা বক ও বিভিন্ন দেশী পাখি। এইসব বক ও পাখি উড়ে এসে কৃষক ও লাঙ্গলের ফলার চার পাশে ঘিরে কিচিরমিচির শব্দে উড়ে উড়ে পোকা খেত। কখনো ঝাঁক ধরে উড়ে যেত আকাশে। কখনো আবার এক জমি থেকে অন্য জমিতে উড়ে গিয়ে বসতো। এরই মাঝে ধরে ধরে জমি থেকে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় খেতে। অপূর্ব এই কোলাহল দেখে মুগ্ধ হত পথচারীরা। কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন কৃষকরা জানান, এই সাদা বক ও পাখি আমাদের অনেক উপকার করে। চারা ধানের জমিতে মাজরা পোকা ও ফড়িংসহ ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে ফসল রক্ষা করে পাখিরা। এছাড়া ক্ষেতে পানি দেওয়ার পর যেসব পোকা ভাসতে থাকে তারা তা খেয়ে সাবাড় করে। এতে ফসলের উপকার হয়। কিন্তু এখন সৌন্দর্যের প্রতীক এই সাদাবক ও পাখি আগের মতো আর দেখা যায় না।
বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য, নির্বাচারে বৃক্ষনিধন ও পাখি শিকারিদের ফাঁদে পড়ে প্রায় বিলুপ্তির পথে এই সব উপকারী পাখি।
পাখি সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ জীব ও বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশন (বিবিসিএফ) এর সহসভাপতি শাহাবউদ্দিন মিলন বলেন, পাখি প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেমন তাদের আবাসস্থল ঠিক রাখা উচিত তেমনি তাদের খাদ্যের উৎস রক্ষা করা জরুরি। পাখি শুধু পরিবেশের সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, কৃষি ও কৃষকের বন্ধু হিসেবে কাজ করে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই পাখি সুরক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি, আবাসস্থল সংরক্ষণ, শিকার ও পাচার বন্ধ করতে হবে।
জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চরাঞ্চলের কাঁদাময় ও ভাঙ্গাচোরা রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে উপজেলার পোগলদিঘা ইউনিয়নের বয়ড়া ব্রিজপাড়সংলগ্ন গাছ বয়ড়া মানু মেম্বারের বাড়ি হতে বিন্নাফৈর মোড় হয়ে টাকুরিয়া পর্যন্ত রাস্তাটি দীর্ঘ ১০ বছর পর কাদাযুক্ত ও ভাঙ্গাচোরা কাঁচা সড়কটি সংস্কার করা হয়। জেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদুল কবির তালুকদার শামিম এর নির্দেশে পোগলদিঘা ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান ফরহাদের নিজস্ব অর্থায়নে এ রাস্তাটি সংস্কার করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এই রাস্তাটি একাধিকবার দাবি জানালেও কোনো চেয়ারম্যান বা মেম্বার মেরামত, সংস্কার করেনি। একটু বৃষ্টি হলেই পানি উঠে যায়, বিভিন্ন স্থানে কাঁদা হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়। স্কুল-কলেজে যাওয়ার মতো অবস্থা থাকে না। বয়ড়া ব্রিজ ও মাদারগঞ্জ-ধনবাড়ী মহাসড়কের সংযোগ সড়ক পর্যন্ত অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এই মাটির কাঁচা রাস্তাটি পাকা করা হয়নি। এর ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় কয়েকটি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষের।
পোগলদিঘা ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান ফরহাদ বলেন, এই ইউনিয়নের সব থেকে পিছিয়ে আছে এই গ্রামটি৷ কারন এই কয়েকটি গ্রামে বিএনপির সমর্থক বেশি। তাই ইচ্ছে করেই কোন চেয়ারম্যান এ রাস্তার উন্নয়ন করেনি। অনেক সময় কাঁদায় গাড়ি আটকে বিকল হয়ে গেলে গাড়ি আটকা পড়লে অন্য কোন গাড়ি আর যেতে পারে না। যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানের রাস্তাটির করুন অবস্থা আমাদের জেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদুল কবির তালুকদার শামীম ভাইকে জানালে তার নির্দেশে আমি আমার নিজস্ব অর্থায়নে অবহেলিত এই গ্রামের মানুষের সঙ্গে নিয়ে পুরো রাস্তাটি সংস্কার কাজ করছি।
উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি চাঁন মিয়া চানু মন্ডল বলেন, এক যুগেও এক টুকরো মাটি দেওয়া হয়নি, উন্নয়ন বঞ্চিত এ রাস্তাটি পাকাকরণ এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় চলাচলের অযোগ্য এ রাস্তায় পানি জমে ভোগান্তি বাড়ে কয়েক গুন। বিভিন্ন স্থানের পানি রাস্তায় উঠে দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি ছড়ায় পানিবাহিত রোগও। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে দ্রুত এই রাস্তাটি পাকা করার দাবি জানান তিনি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এই সরকারের কাছে মানুষ আইনের শাসন প্রত্যাশা করে। আপনারা দৃষ্টান্ত রেখে যাবেন, যাতে করে নির্বাচিত সরকার এলে আপনাদের ভালো দৃষ্টান্তগুলো চিহ্নিত করে আরও ভালো কিছু করার চেষ্টা করে।’
তিনি বলেন, কেন এই সময়ে এসে এত খুন-জখম হবে, কেন এত ডাকাতি, চুরি হত্যাকাণ্ড ঘটবে, এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। বলা হচ্ছে, পুলিশের মধ্যে এখনো আস্থা ফিরে আসেনি, কেন আস্থা ফিরবে না? গতকাল বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘আমরা বিএনপির পরিবার প্রধান পৃষ্ঠপোষক তারেক রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় জুলাই-অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রিজভী বলেন,’ ২৪ জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পটভূমি রচনার প্রধান নায়ক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আমরা দেখেছি যখন ছাত্র-জনতা বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে তখন তিনি দলের সব নেতা-কর্মীকে নির্দেশ দিয়েছেন তাদের সঙ্গে আন্দোলনে সক্রিয় থাকার জন্য। কখনো তিনি লন্ডন থেকে বক্তব্যের মাধ্যমে কখনো আমাদের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পাশে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এই আন্দোলনে আমাদের ছাত্রদলের অনেক নেতা-কর্মী, বিএনপির সমর্থক অনেকেই আত্মহুতি দিয়েছেন গণতন্ত্রকে ফেরানোর জন্য।’ বিডিআর হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ তুলে রিজভী বলেন, ‘আমরা বিডিআর হত্যাকাণ্ডের যে ঘটনাগুলো দেখেছি, সেখানে আমরা শুনতে পাচ্ছি, জানতে পারছি- যারা তদন্তে আছেন তারা নানা কারণেই গোপনীয়তা রক্ষা করছেন, যদিও তারা বলেছিলেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে হয়তো বিশেষ কারণে নামগুলো এখনো বলছেন না। কিন্তু রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় যা হয়েছে এইটা বলছেন তারা। তার মানে পরিকল্পিতভাবে পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। হয়তো কারও স্বার্থে প্রভুদের স্বার্থে অথবা অন্য কোনো স্বার্থে এই ঘটনা ঘটিয়েছিল তৎকালীন যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল।’ তিনি বলেন, ‘এমন দেশ তো এই দেশের মানুষ চায়নি। যে দেশ যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হতে এত মানুষের প্রাণহানি, এত ক্ষয়ক্ষতি, সেই দেশে নিজের দেশের সরকার জোর করে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে নানা ধরনের প্রকল্প তৈরি করেছিল এবং তারা যে বয়ান তৈরি করত সেই বয়ানগুলোও ছিল পরিকল্পিত। যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিপক্ষের শক্তি এমন নানা ধরনের কথা বলে গোটা দেশটাকে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে প্রতি সেকেন্ডে ওরা বিভাজন করে রেখে গেছে।’
ঢাকার পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন। এ ঘটনায় তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের নানা মাত্রায় সংশ্লিষ্টতার যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছে কমিশন।
গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিআরআইসিএম নতুন ভবনের সপ্তম তলায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত তদন্ত কমিশন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিভিন্ন সাক্ষ্য হতে প্রতীয়মান যে রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের নামে অযথা কালক্ষেপণ করায় এবং সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে বিদ্রোহীরা নির্বিঘ্নে হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য অপরাধ সংঘটন করতে সমর্থ হয়েছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই পিলখানার ভেতর থেকে আটকে পড়া অফিসার ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বারংবার অনুরোধ-আকুতি সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ফজলুর রহমান বলেন, এই পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এটা বলা যায় যে তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সময়মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। অপরাধ সংঘটনের সময় তারা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ছিল, যার ফলে তারা বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড প্রতিহত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
তদন্ত কমিশন জানায়, তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে এই পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে প্রতীয়মান। গোয়েন্দা ব্যর্থতার স্বরূপ ও কারণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং আলামত ধ্বংস করার প্রয়াস প্রতীয়মান হয়েছে। এর পেছনে দায়ী ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোকে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
কমিশনের সভাপতি বলেন, পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ চলাকালে কিছু গণমাধ্যম পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রচার করার মাধ্যমে বিদ্রোহ উসকে দিয়েছে। একই সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে সামরিক অফিসারদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার প্রয়াস চালিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিদেশি সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেগুলো যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কমিশন মনে করে যে সময়মতো সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধ করা যেত।
সংবাদ সম্মেলনে পিলখানার অভ্যন্তরে সংঘটিত অপরাধের ধরন উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, বেঁচে যাওয়া কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জবানবন্দি থেকে পিলখানার অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া এক মর্মন্তুদ চিত্র পাওয়া গেছে। কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা ছাড়াও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর চালানো হয়েছে অমানবিক নির্যাতন। নারী ও শিশুদের মারধর, সশস্ত্র অবস্থায় হুমকি প্রদান, বাড়িঘর ভাঙচুর, অমানবিক পরিবেশে খাবার ও পানি ছাড়া কোয়ার্টার গার্ডে দীর্ঘ সময় আটকে রাখা, রাষ্ট্রের ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধ্বংস সাধন, আলামত ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ ছাড়াও নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য আরও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত সর্বমোট ১৫৮ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। আরও আনুমানিক ৫০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ বাকি আছে। ৮ জন সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনের সাক্ষাৎকার জেলে নেওয়া হয়েছে। তিনজন উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। দুজন পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম ই–মেইলে জবানবন্দি দিয়েছেন।
তদন্ত কমিশন জানায়, এখন পর্যন্ত শহীদ পরিবারের ছয়জনের বিস্তারিত জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। সব শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুটি সম্মেলন করা হয়েছে। সেখানে পরিবারের সদস্যরা তাদের অভিজ্ঞতা ও মতামত ব্যক্ত করেছেন। সম্মেলনে সব ইচ্ছুক সদস্যদের লিখিত বা কমিশনে উপস্থিত হয়ে বিস্তারিত জবানবন্দি দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অনেক শহীদ পরিবারের সদস্য ইতিমধ্যেই তা করেছে। বেঁচে ফিরে আসা ১৫ জন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ৫০ জন বেঁচে যাওয়া অফিসারদের লিখিত জবানবন্দি প্রদান করার জন্য সেনাসদরের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দেওয়া হয়েছে। দুটি সম্মেলনে তাদের সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে মতবিনিময় হয়েছে।
তদন্ত কমিশন জানায়, ৫৫ জন সামরিক অফিসার, যারা বিভিন্নভাবে পিলখানা ট্র্যাজেডির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, তাদের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন একাধিক সাবেক সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর প্রধান; বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
তদন্ত কমিশন জানায়, ২০ জন অসামরিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক, আমলা, আগের তদন্ত কমিটির সদস্য, তৎকালীন আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার ও অন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। ৯ জন বেসরকারি ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী, টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি। যাদের কাছে ঘটনাসংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। কারাগারে দণ্ডপ্রাপ্ত ২৫ জন বিডিআর সদস্যের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তারা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, সে সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্য দিয়েছে। যেগুলো এখন বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আরও সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান। এর বাইরে ২৯ জন কারামুক্ত বিডিআর সদস্যের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
তদন্ত কমিশন জানায়, প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ ও তদন্ত কার্যক্রমে অধিকতর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য কমিশন ৩৩ জন ব্যক্তির দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পলাতক ব্যক্তিদের সাক্ষ্য প্রদানের জন্য কমিশন তিনটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
কমিশন জানায়, ৬টি দেশের দূতাবাস ও ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় থেকে তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পিলখানা ট্র্যাজেডিসংক্রান্ত কোনো তথ্য আছে—এরূপ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমকে কমিশনের কাছে তথ্য প্রদান করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
কমিশনের জানিয়েছে, প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদনের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করা হয়েছে, যা বর্তমানে কমিশনের সদস্যরা পর্যালোচনা করছেন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ চলমান রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের জন্য আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পুনঃসাক্ষ্য গ্রহণ প্রয়োজন হবে।
তদন্তে চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দৈনিক পত্রিকায় একাধিক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। কিছু দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে চাহিদাকৃত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-দলিলাদি এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। উল্লিখিত তথ্য অনতিবিলম্বে সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ৫০ জনের অধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ এখনো বাকি আছে। এছাড়া কিছুসংখ্যক ব্যক্তির পুনঃসাক্ষ্য গ্রহণেরও প্রয়োজন হবে। গৃহীত সাক্ষ্যগুলোর পূর্ণাঙ্গ লিখিত রূপ প্রস্তুত, স্বাক্ষর গ্রহণ ও বিশ্লেষণের কাজ চলমান রয়েছে। এটি একটি সময়সাপেক্ষ কাজ। কিছু বিদেশি দূতাবাস ও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহের প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। যার জন্য কিছু সময় প্রয়োজন। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের মেয়াদ আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন।
মন্তব্য