বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আরও এক দিক থেকে ছিল অনন্য। এটি মুক্তিযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভিডিও রেকর্ডেড ভাষণ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার সেই ভাষণের ভিডিওচিত্র ধারণ করেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সাত বাঙালি কর্মকর্তা। শুধু ভিডিওচিত্র ধারণই নয়, এটি ডেভেলপের পাশাপাশি সংরক্ষণও তারা করেছিলেন।
২৫ মার্চ কালরাতের পর অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের সরকারি দপ্তর থেকে তারা সেই ভিডিওটেপ গোপনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করেছেন তারা। সে সময় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের ক্যামেরা সহকারী ছিলেন আমজাদ আলী খন্দকার। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভিডিওটেপ সরিয়ে কীভাবে তারা দোহারের একটি বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলেন, সে গল্প তিনি বলেছেন নিউজবাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আশিক হোসেনের কাছে।
একাত্তরে তো আপনারা পাকিস্তান সরকারের কর্মচারী। তারপরও ৭ মার্চের ভাষণ ধারণ করলেন কীভাবে? আর কোনো বিভাগ কি আপনাদের সঙ্গে ছিল?
৭ মার্চ কিন্তু একদিনে আসেনি। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামের পথেই ৭ মার্চ এসেছে। এই ভাষণ ধারণ করার জন্য আমাদের পরিচালকের নেতৃত্বে দুই দিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমরা কে কী করব, সেগুলো আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। আমরা তখন মূলত ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ফিল্ম ডিভিশনের স্টাফ। আমরাই এটা করেছি। তখন পাকিস্তানের আরও কিছু সংস্থা, যেমন ডিএফপি ছিল। তারা কিন্তু এ কাজ করেনি। তারা কিন্তু মাঠের ধারেকাছেও আসেনি। আমরা ফিল্ম ডিভিশন এ কাজটা করেছি। আমাদের ফিল্ম ডিভিশনের পরিচালক ছিলেন আবুল খায়ের (খ্যাতিমান অভিনেতা) সাহেব। ক্যামেরাম্যান ছিলেন জি জেড এম এ মবিন, এম এ রউফ। অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলাম আমি, এস এম তৌহিদ আর সৈয়দ মইনুল আহসান। দুইজন ছিল লাইটবয়; জুনায়েদ আহমেদ আর একজন হাবিব। লাইটবয়রা আমাদের সহযোগিতা করত। আর আমাদের পরিচালক জানত, কে কী কাজ করতে পারে।
মঞ্চে মূল কাজটা কীভাবে করলেন? কার কী দায়িত্ব ছিল? প্রস্তুতিই বা শুরু করলেন কীভাবে?
মবিন সাহেব ছিলেন ফিল্মের ক্যামেরাম্যান মূলত। আর আমি ছিলাম এফডিসির রাইজিং ক্যামেরাম্যান। পরিচালক মনে করলেন, এই দুজনকে যদি মঞ্চে দিই তাহলে তারা ভালো রেকর্ড করতে পারবে। আমাদের দুজনকে মঞ্চে দিলেন। রউফ সাহেব আর তৌহিদকে দায়িত্ব দিলেন, তারা ঘুরে ঘুরে ছবি নেবে। আর মইনুলকে দিলেন এই যে টেপ রেকর্ডার বসবে, সেইটা চালুর দায়িত্ব।
তখন কলরেডি ছিল। তারা আগের দিন পুরো মাঠে শত শত মাইক বসিয়েছে। তারা হাইভোল্টেজ লাইন এনেছিল। আমরা ক্যামেরা চালাব কারেন্ট দিয়ে, ব্যাটারি দিয়ে যদি চালাই, তাহলে সে ক্যামেরায় অনেক আওয়াজ হবে, কখন ব্যাটারি বসে যাবে আমরা বুঝতে পারব না।
সিংক মোটর বলে একটি জিনিস আছে। সেটা দিয়ে আমরা ক্যামেরা চালালাম, যাতে করে কোনো শব্দ না পায়। সাউন্ডপ্রুফ ক্যামেরা নিয়ে গেলাম। কারণ, আমাদের ক্যামেরায় যদি আওয়াজ হয়, একটা লোকও মাঠে থাকবে না। এত আওয়াজ হবে, সব মানুষ চলে যাবে। এর জন্য আগের দিন বিকেলে একটা কয়েল তার নিয়ে গেলাম কলরেডির কাছে। তখন যারা কাজ করছিল, তারা আমাকে আর লাইন দেবে না। পরে কলরেডির মালিক আসার পরে আমরা লাইন পেলাম। তো তখনই ভিডিওধারণের জন্য লাইন টেনে রাখা হলো।
পরের দিন ৭ মার্চ, সকাল ৭টায় ক্যামেরা নিয়ে মাঠে চলে গেলাম।
৭ মার্চ সকালে যখন রেসকোর্স ময়দানে গেলেন, তখন কী দেখলেন? আপনাদের ভয় করেনি?
সকালে মাঠে গিয়ে দেখি, মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। একদিকে কালীমন্দির, এদিকে টিএসসি, একদিকে ঢাকা ক্লাব আর ওদিকে হাইকোর্ট। তখন তো কোনো গাছপালা ছিল না। পুরো মাঠ ছিল খালি। তো আমরা গিয়ে দেখলাম, পুরো মাঠ মানুষ দিয়ে ভরে গেছে। আমরা তখন ক্যামেরা-ট্যামেরা লাগিয়ে সব রেডি করে রেখেছি।
এর মধ্যে একটা গুজবও ছিল যে, বোমা মেরে সব উড়িয়ে দেবে। প্রস্তুতিও নাকি ছিল। আমরা তো তখন ভয় পেয়েছি। এই যে সাতজনের নাম বললাম, আমরাই প্রথম প্রকাশ্যে মাঠে এসেছি। আর কেউ কিন্তু আসেনি। তখন আমরা পাকিস্তান সরকারের কর্মচারী। গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা উপস্থিত ছিল। তারা আমাদের দেখেছে যে আমরা কাজ করছি। ভয় ছিল, ধরে নিয়ে যাবে। তবে সাহস ছিল, বঙ্গবন্ধু আমাদের যেভাবেই হোক বের করে নিয়ে আসবে। আটকে রাখতে পারবে না। আর মরে গেলে তো মরেই গেলাম।
এভাবেই আমরা কাজ করলাম। ভয় আমাদের ছিল না। যখন একবার কাজের নেশায় চলে গিয়েছি, তখন আর ভয় নাই। তখন চিন্তা, কীভাবে ফোকাস থাকবে।
যারা ফিল্মের ক্যামেরাম্যান তারা বুঝবে কী কষ্ট করে আমরা এ কাজটা করেছি। ম্যাগাজিন, ফিল্ম চেঞ্জিং। ব্যাগ সব সাইডে রাখা আছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট দুজন সাইডে আছে। আমাদের ৫০০ ফিট লোড করলে মাত্র ৫ মিনিট শ্যুট করা যায়। এক ঘণ্টা শ্যুট করা যায় এ পরিমাণ ফিল্ম আমাদের কাছে ছিল।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সেই মুহূর্তের কথা আপনার মুখে শুনতে চাই।
বঙ্গবন্ধু আসলেন। এত মানুষ হয়েছে, কিন্তু কারও মুখে কোনো কথা নেই। এই যে মাইকে বলে ডানে আসেন বামে আসেন, বসেন, এসব কোনো কথা বলতে হয়নি। সব একদম সাইলেন্ট। মানুষের চিন্তাটা এ রকম ছিল যে, এই যে এত দিনের এক আন্দোলন, এত সংগ্রাম হয়েছে, এটা তার ফসল। আজকে তিনি কী নির্দেশ দেন তা শুনে বাড়ি যাব। সবাই সেটা শুনতেই এসেছে। একটা কথাই মানুষ শুনতে এসেছে যে, বঙ্গবন্ধু কী বলেন। এ জন্যই সবাই চুপ করে বসে ছিল। বঙ্গবন্ধু আসলেন একদম বীরের মতো। মঞ্চে উঠলেন। আশেপাশে যারা ছিল, কারও সাথে কোনো কথা না বলে সরাসরি ডায়াসে এসে চশমা রেখে উনি ভাষণ শুরু করলেন। একটানা বলে গেলেন। কারও কোনো স্লিপও নিলেন না, কারও কোনো ইশারাও শুনলেন না। কী বলবেন, আগে থেকে কোনো কিছু ঠিকও করা ছিল না। থাকে না, মানুষের ভাষণ লেখা থাকে। এ রকম কিছুই ছিল না। উনি অনর্গল ওনার কথা বলে গেলেন। আর যা বললেন, তা তো রেকর্ডে আছেই, আপনারা শুনেছেন। তখন পাকিস্তান আমল। তার মধ্যেও তিনি বললেন স্বাধীনতার কথা।
রেকর্ড তো করলেন। তারপর এটা ডেভেলপ করলেন কীভাবে? কেউ সন্দেহ করেনি?
আমরা ভাষণ রেকর্ড করলাম। আমাদের অফিস ছিল সচিবালয়ের ২২ নম্বর শেডে। অর্ধেকটা আমাদের, আর বাকিটা অন্য ডিপার্টমেন্টের। এখন সমস্যা হলো এই যে, বঙ্গবন্ধুর নামে কীভাবে ফিল্মগুলো ডেভেলপ করে আনব। ক্যামেরাম্যানের দায়িত্ব হলো শ্যুট করে দেয়া। এখন ডেভেলপের দায়িত্ব তো আমাদের ওপরে। তখন ডেভেলপ করতে হতো এফডিসিতে। এফডিসিতে গেলাম। কিন্তু ফিল্মের উপরে লিখব কী? সে বছর একটা সাইক্লোন হয়েছিল। তো একটা ফিল্মের উপর লেখলাম, ‘সাইক্লোন’। অন্যগুলো কোনোটাতে ‘নির্বাচন’। এভাবে লিখে ‘এক’, ‘দুই’ দিয়ে আমরা ডেভেলপে দিতাম। তারপর সেগুলো রক্ষণও আমরাই করতাম। পরিচালকের একটা আলমারি ছিল। সেখানে সারিবদ্ধভাবে রাখা হতো। আমরা এভাবেই ফিল্ম প্রসেস করে নিয়ে আসলাম।
২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের সময় বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেন। দেশের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নিল সেনাবাহিনী। তখন তো তারা অনেক নথি নষ্ট করে ফেলে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রক্ষা পেল কীভাবে?
২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে গেল পাকিস্তানিরা। এরপর আর্মিরা প্রায় সব অফিসের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিল। সচিবালয়ে আর্মির আনাগোনা বেড়ে গেল। একদিন আমাদের পরিচালক (আবুল খায়ের) ডেকে বললেন, ‘আমজাদ, তোমাকে একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং সেটা এই মুহূর্তে এবং আজই।’ আমি বললাম, ‘কী করতে হবে স্যার।’ তিনি আমাকে নানা কারণে অনেক বিশ্বাস করতেন। যা হোক, আমাকে বললেন, ‘তুমি এখনই সদরঘাট যাও।’ তখন সবকিছু কিনতে হলে সদরঘাট যেতে হতো। আমাকে তিনি বললেন, ‘সদরঘাট থেকে একটা ট্রাংক নিয়ে এসো।’ টাকা দিয়ে দিলেন, আমি ৪২ ইঞ্চির একটি বড় কালো ট্রাংক নিয়ে আসলাম। উনাকে দেয়ার পরে এটাতে ভরলেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, যেটা আমরা ৭ মার্চ রেকর্ড করেছিলাম, সেটা। এর সাথে কাজী নজরুল ইসলামের উপরে একটা ডকুমেন্টারি আমরা করেছিলাম গোপনে, সেটা। সাথে বঙ্গবন্ধুর আরও কিছু ছবি ট্রাংকে ভরলেন। এরপর আমাকে বললেন, ‘তোমাকে আজই বের হয় যেতে হবে।’ আমি বললাম, ‘কোথায় যাব?’ বললেন, ‘জয়পাড়া যাবা।’ কোথায় যেতে হবে ঠিকানা দিয়ে দিলেন। আমি বললাম, ‘স্যার আমার বাবার সাথে একটু দেখা করে আসি।’ উনি আমাকে পয়সা দিয়ে বললেন, ‘যাও।’ আমি বাবাকে বললাম, ‘বাবা, আমার আসতে দুই দিন দেরি হবে, চিন্তা করবেন না।’ ফিরে আসার পর আমাকে তিনি (আবুল খায়ের) রুমের ভেতর নিয়ে গেলেন। আমার হাতটা ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললেন, ‘আমজাদ! আল্লাহ হাফেজ!’ তার চোখগুলো এত বড়বড় হয়ে গেল। উনি জানতেন, এই ছেলে যদি বের হয়ে যায়, আর ধরা পড়ে, তাহলে এখনই শেষ হয়ে যাবে। আর ফিরে আসবে না।
সারা শহরে তখন আর্মির প্রহরা। এর মধ্যে বের হলেনই বা কীভাবে?
প্রথম যে সংকটটা হলো: সচিবালয় থেকে বের হব কীভাবে? সব জায়গায় তো পাঞ্জাবিরা আছে, বিহারিরা আছে। গেট পাস দিবে কে? যে গেট পাস দেবে, সেই তো পরে ধরা পড়বে। এখন তাহলে গেট পাস ছাড়াই আমাকে বের হতে হবে। কিন্তু কীভাবে? তখন ২ নম্বর গেটে একজন সার্জেন্ট ছিলেন ফরিদ, বাঙালি। তার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তাকে আমি বললাম, বের হতে চাই, এই হচ্ছে ব্যাপার। সে যেহেতু বাঙালি, আমাদের বিষয়ে সব সে জানত আর কী। তো আমাকে বলল, ‘ঠিক আছে অসুবিধা নাই, তুমি বেবি নিয়ে আসো, আমি তোমাকে বের করে দেব।’ দ্বিতীয় গেট দিয়ে তখন শুধু ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না। ফরিদ করল কী, পল্টন থেকে যে গাড়িগুলো আসছিল ওগুলোকে আটকে দিয়ে আমাকেসহ বেবিটা বের করে দিল। আমার সাথে যারা চাকরি করত, অনেককেই বললাম, ‘আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আয়।’ কিন্তু কেউ আসল না। আমি একাই আল্লাহর নাম নিয়ে বের হয়ে গেলাম। বেবিওয়ালাও বুঝল, এটা মনে হয় বিশেষ ব্যবস্থা। সে-ও কোনো দিকে না তাকিয়ে দিল এক টান।
প্রেস ক্লাবের সামনে আর্মি একটা বড় ট্রাকের উপরে বসে আছে। তার নিচ দিয়েই বেবিটা চলে গেল। ওরা আমাকে ডাকলও না, আমিও তাকালাম না। ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ করতে করতে চলে গেলাম।
কার্জন হল, চানখাঁর পুলের সামনে দিয়ে গেলাম চকবাজার। চকবাজার গিয়ে একটু স্বস্তি পেলাম। কিছু লোকজন দেখা যায়। আর সব রাস্তা ফাঁকা। আর্মি টহল দিচ্ছে। এখান থেকে সোয়ারি ঘাটে যাওয়ার পর দুটো ছেলে এগিয়ে এলো ট্রাংক নিতে। আমি তাদের বললাম, ‘তোমরা পারবা না। বড় কাউকে ডাকো।’ পরে একজন এলো। ট্রাংক নিয়েই বলে উঠল, ‘ইসমে কেয়া হ্যায় ইতনা ওজন।’ আমি বললাম, ‘নিয়ে যা, কোনো কথা কইস না। আমাকে পার করে দে আগে।’ এখান থেকে এভাবে জিঞ্জিরা পর্যন্ত গেলাম। সেখানে দেখি, শয়ে শয়ে লোক জীবন নিয়ে পালাচ্ছে। বোঝেন না, জীবনের ভয়ে ওরা পালায়, আর আমি ছুটছি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাঁচাতে।
দেখলাম একটা বাস ছেড়ে দিচ্ছে। আমি সেটার পেছনে জোরে এক থাপ্পড় দিলাম। তখন তরুণ ছিলাম, চেহারার মধ্যে একটা অন্য রকম ইয়ে ছিল। ড্রাইভার তখন পেছনে তাকিয়ে আমাকে দেখল, কী বুঝল জানি না। বাস থামিয়ে দিল। আমাকে ইঙ্গিত দিল উপরে তুলে দেন। আমি বাসের ছাদে উঠে পড়লাম। তারপরেও কিন্তু শান্তি পেলাম না। ভয় হলো (আর্মি) যদি আমার পিছু নেয়, যদি দেখে ফেলে তাহলে কী হবে?
তখন এক বাঙালি অন্য বাঙালিকে খুব সহযোগিতা করত। জিঞ্জিরা থেকে গেলাম বক্সনগর নামে একটা জায়গা আছে, সেখানে। এই পর্যন্তই বাস যেত, তারপরে আর যেত না। রাস্তা ছিল দুই পাশে ইট বিছানো, সেটা দিয়েই বাস যেত। সেখানে নামার পরে ট্রাংক নামালাম। এখন যদি নৌকায় উঠি, তাহলে আমাকে যদি চেক করে, তাহলে তো দৌড়াতে পারব না। আমি করলাম কী, একটা ঘোড়াওয়ালা ঠিক করলাম। সেখান থেকে গেলাম জয়পাড়া মজিদ দারোগার বাড়ি, দোহার থানায়। সেখানে গিয়ে উঠি।
এদিকে (আবুল খায়ের) খায়ের সাহেব তো আমাকে বিদায়ের সাথে সাথে বের হয়ে আমাকে পায়নি। এত জলদি যে আমি বের হয়ে যাব, এটা উনি চিন্তা করেননি। আমাকে না পেয়ে আবার তিনি গেছেন পাগল হয়ে। তিনি মনে করেছেন, আমাকে মনে হয় ধরে নিয়ে গেছে, মেরে ফেলেছে। আমার যেই বাড়িতে যাওয়ার কথা তিনিও সেই বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। এদিকে আমিও পৌঁছেছি। আমি তো ওখানে গিয়ে বলিনি, বলেছি অফিসের কাগজপত্র। এটার মধ্যে কী আছে, এত কিছু বলিনি।
এটা কার বাড়ি ছিল?
এটা ছিল জয়পাড়া মজিদ দারোগার বাড়ি। আমি বলেছি, স্যার পাঠিয়েছেন, কিছু কাগজপত্র আছে। এদিকে খায়ের সাহেব চলে এসেছেন। আমাকে দেখে বলেন, ‘ও এসেছ তুমি?’ বললেন, বসো। আমরা ওখানে খাওয়াদাওয়া করলাম। পরের দিন সকালে সেখান থেকে চলে এলাম।
ট্রাংকটা কি তাহলে মজিদ দারোগার বাসাতেই ছিল শেষ পর্যন্ত?
কিছুদিন ছিল মজিদ দারোগার বাসায়। তারপর খায়ের সাহেবের ফ্যামিলির কেউ তো আর তখন ঢাকায় নেই। দোহারের চরকোশায়ই নামে একটা গ্রাম আছে, জয়পাড়ার পাশেই। আমাকে (তিনি) বললেন, ‘তুমি আমার ফ্যামিলি নিয়ে আসো। চরকোশায়ই দানেশ খাঁর বাড়িতে চলে এসো।’
দানেশ খাঁর ভাই উমেদ খাঁ আমার পরিচিত ছিলেন। দানেশ খাঁ যে তারই ভাই, এটা তখনও আমি জানতাম না। একদিন পর তার ফ্যামিলি নিয়ে ফিরলাম। তিনি যে পরের দিনই কলকাতা চলে যাবেন, এই কথাটা আবার আমার থেকে গোপন করে গেছেন। আমাকে শুধু বলেছে, ‘যা ঘটবে, শুধু ছবি তুলে রাখবা।’ এই দায়িত্বটা দিয়ে গিয়েছিলেন।
আমাদের মধ্যে কিছু নন-বেঙ্গলি ছিল। তারা বলত যে, ‘আমজাদ, তুমি বঙ্গবন্ধুর ভাষণও সরালা, আবার পরিচালককেও সরায় দিলা।’
আমি ভয় পেলাম। যদি এসব প্রকাশ করে দেয়, আমি তো মরে যাব। তখন আমি আত্মগোপনে এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেলাম। পরে অবশ্য ফিরে আসি।
তাহলে ভাষণের ভিডিওটা কোথায় ছিল? চরকোশাই?
ভাষণটা তো চরকোশাই নিয়ে গেল। উমেদ খাঁর ধানের গোলায় চলে গেল ওটা। খায়ের সাহেব যখন কলকাতায় চলে গেলেন, সেখানে বাংলাদেশ হাই কমিশনে যোগাযোগ করে মুক্তিবাহিনী পাঠিয়ে ওটাকে নিয়ে যান ভারতে। যুদ্ধ চলাকালে পুরো সময় ওটা ভারতেই ছিল। অনেকে জানে না কোথায়। দেশ যখন স্বাধীন হলো, তখন উনি ওটা নিয়ে দেশে ফিরলেন।
আরও পড়ুন:আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে শ্রমিকেরা যে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তাদের সে আত্মত্যাগের সম্মানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দিবসটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে সকল গণমাধ্যম বিভিন্ন লেখা প্রকাশ ও অনুষ্ঠান প্রচার করবে।
এবারের মহান মে দিবসের প্রতিপাদ্য-‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এ দেশ নতুন করে’।
মহান মে দিবসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে জাতীয় ছুটির দিন। আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়।
দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বিশ্বজুড়ে শ্রমিক শ্রেণির মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মালিক-শ্রমিক সম্পর্কে এই দিবসের তাৎপর্য ও প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এর ফলে শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময় নেমে আসে আট ঘণ্টায়।
সারা বিশ্বের শ্রমিকরা তাদের শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা পেতে শুরু করেন। নিজেদের অধিকার আদায়ে সফল হয়েছেন। বিশ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় সামাজিক পরিবর্তনের নতুন অধ্যায়। মে দিবসের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের জীবনে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়, তার ফলে ধীরে ধীরে লোপ পেতে শুরু করে সামাজিক শ্রেণি-বৈষম্য।
তবে শ্রেণি-বৈষম্য এখনও পুরোপুরি দূর না হলেও মে দিবসের সেই আত্মত্যাগ নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে অনেকটাই মুক্ত করেছে।
এদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শ্রম অধিকার রক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ণে শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে। গত ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে ১০ সদস্যের একটি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন শ্রম বিষয়ে অংশীজন ও বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে শ্রম সংস্কার কমিশন ২১ এপ্রিল তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করে তারা।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শ্রম শাখার এক স্মারকে শ্রমিককে চাকুরিচ্যুতি, ছাঁটাই এবং মহান মে দিবসে কারখানা বন্ধ রাখা প্রসঙ্গে যা বলা হয়েছে :
গত ৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আরএমজি বিষয়ক ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (আরএমজি বিষয়ক টিসিসি) এর ২০তম সভার বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সভার সিদ্ধান্তসমূহ প্রতিপালন ও বাস্তবায়ন করার জন্য নির্দেশক্রমে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করা হয়। সিদ্ধান্তসমূহ হচ্ছে- ‘যৌক্তিক কারণ এবং শ্রম আইনের প্রতিপালন ব্যতীত শ্রমিক চাকুরিচ্যুত/ছাঁটাই করা যাবে না। এক্ষেত্রে শ্রমিক চাকুরিচ্যুত/ছাঁটাই করার পূর্বে স্থানীয় প্রশাসন, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শিল্পাঞ্চল পুলিশ এবং বিজিএমইএ এর ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে। শ্রম আইন মেনে শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত/ছাঁটাই করা না হলে-মালিকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্মারকে বলা হয়, মহান মে দিবসে সকল কারখানা/প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে। কোন কারখানা কর্তৃপক্ষ মে দিবসে কারখানা খোলা রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শ্রম শাখার উপসচিব মোহাম্মদ শামছুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এ স্মারক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম কমিয়েছে সরকার। সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারে এক টাকা কমিয়ে আজ বুধবার (৩০ এপ্রিল) জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। নতুন এ দাম বুধবার দিনগত মধ্যরাত থেকে কার্যকর হবে।
নতুন মূল্য অনুযায়ী, ডিজেলের বিক্রয়মূল্য প্রতি লিটার ১০৫ টাকা থেকে এক টাকা কমে ১০৪ টাকা, কেরোসিন ১০৫ টাকা থেকে এক টাকা কমে ১০৪ টাকা এবং অকটেন ১২৬ টাকা থেকে এক টাকা কমে ১২৫ টাকা, পেট্রোল ১২২ টাকা থেকে এক টাকা কমে ১২১ টাকায় পুনঃনির্ধারণ/সমন্বয় করা হয়েছে। যা ১ মে ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমা-বাড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে দেশে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
এ জন্য ‘জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ নির্দেশিকা’র আলোকে মে মাসের জন্য তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ নিশ্চিতে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছে বলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।
সর্বশেষ গত ১ ফেব্রুয়ারি সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারে এক টাকা বাড়িয়ে বর্তমান দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ মূল্য মার্চ ও এপ্রিল মাসেও বহাল ছিল।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে একটি সিম্পোজিয়াম আয়োজন করছে বাংলাদেশি জার্নালিস্ট ইন ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া (বিজেআইএম)। এতে অংশ নেবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলমসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক ও গবেষকরা। আগামী শনিবার (৩ মে) বিকাল ৩টায় ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার অডিটরিয়ামে এই সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হবে।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বিজেআইএমের আহ্বায়ক স্যাম জাহান ও সদস্য সচিব মোহাম্মদ আলী মাজেদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ আফটার দ্য মনসুন আপরাইজিং : দ্য মিডিয়া ল্যান্ডস্ক্যাপ’ শীর্ষক এই সিম্পোজিয়ামটি তিনটি সেশনে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম সেশনে বিজেআইএম প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর অর্জনের একটি সারসংক্ষেপ ও পরিকল্পনার রূপরেখা উপস্থাপন করা হবে।
দ্বিতীয় সেশনে বিজেআইএমের একজন সদস্যের পরিচালনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলমের সঙ্গে একটি উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। এতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, রাজনীতি, কূটনীতি, ভবিষ্যৎ, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে যে কোনো প্রশ্ন করা যাবে।
তৃতীয় সেশনে দেশের নেতৃত্বস্থানীয় সাংবাদিক, গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্টদের নিয়ে একটি প্যানেল আলোচনা হবে। এতে অংশ নেবেন- প্রথম আলোর ইংরেজি বিভাগের প্রধান আয়েশা কবির, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)-এর প্রতিনিধি সেলিম সামাদ, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রধান প্রতিবেদক আব্বাস উদ্দিন, ইরাবতী ইংরেজির প্রতিবেদক মুক্তাদির রশিদ, ডেইলি স্টারের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জাইমা ইসলাম, বাংলাদেশ সরকার গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান গবেষক এম আবুল কালাম আজাদ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ওমর ফারুক।
সিম্পোজিয়ামে সাংবাদিক, গবেষক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিকসহ সর্বসাধারণ মানুষের যে কেউ অংশ নিতে পারবে। তবে আসন সংখ্যা সীমিত হওয়ায় আগ্রহীদের দ্রুত নাম, বয়স, পেশা ও যোগাযোগ নম্বরসহ [email protected]এ প্রাক-নিবন্ধন করতে হবে।
‘মানবিক করিডর’ নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কক্সবাজার হয়ে জাতিসংঘের ‘মানবিক করিডর’-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই, সরকার তথাকথিত মানবিক করিডর নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি।”
শফিকুল আলম বলেন, ‘আমাদের অবস্থান হলো, জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইনে যদি মানবিক সহায়তা প্রদান করা হয়, তবে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দিতে আগ্রহী থাকবে।’
তিনি জানান, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্য অনুযায়ী রাখাইন রাজ্যে তীব্র মানবিক সংকট চলছে।
দুর্যোগকালীন সময়ে বিভিন্ন দেশকে সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারকে সহায়তা প্রদান করা।
প্রেস সচিব সতর্ক করে বলেন, ‘এছাড়াও, আমরা উদ্বিগ্ন যে এ ধরনের মানবিক সংকট দীর্ঘ হলে রাখাইন থেকে আরও মানুষের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে, যা আমরা সামাল দিতে পারব না।’
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশ্বাস করে যে জাতিসংঘ-সমর্থিত মানবিক সহায়তা রাখাইনকে স্থিতিশীল করতে এবং শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখাইনে সহায়তা পাঠানোর বাস্তবসম্মত একমাত্র পথ হলো বাংলাদেশ।
শফিকুল আলম বলেন, এই রুট ব্যবহার করে সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে লজিস্টিক সহায়তা প্রদানে সম্মত রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘তবে, রাখাইনে সহায়তা প্রদানের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। যথাসময়ে আমরা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ করব।’
বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিশ্বের বড় কোনো শক্তি এই করিডরের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে যে প্রতিবেদন করা হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ও প্রপাগান্ডা বলে তিনি দাবি করেন।
প্রেস সচিব বলেন, ‘বিগত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে একের পর এক বিদ্বেষপূর্ণ বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে আমরা দেখেছি, যা এখনো চলছে। এ ধরণের প্রচারণাও তার ব্যতিক্রম নয়।’
আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করি যেখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি না রাখাটা আত্মঘাতী। এ মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আজ বুধবার (৩০ এপ্রিল) সকালে রাজধানীর কুর্মিটোলায় বিমান বাহিনীর বীর উত্তম এ কে খন্দকার ঘাঁটিতে ছিল বার্ষিক মহড়া। ‘আকাশ বিজয়’ নামে হয় এ বছরের বাৎসরিক মহড়া। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি যুদ্ধবিরোধী মানুষ। পৃথিবীতে যুদ্ধ হোক এটা আমরা কামনা করি না। যুদ্ধ প্রস্তুতি অনেক সময় যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। কাজেই যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়েও একটা ঘোরতর আপত্তি। কিন্তু এমন বিশ্বে আমরা বাস করি, প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি আমাদের ঘিরে থাকে। তো সেখানে প্রস্তুতি না নিয়ে থাকা এটা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
‘কাজেই এই পরিস্থিতির মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি না নেয়াটা আত্মঘাতী। প্রস্তুতি নিতে হলে আধা-আধি প্রস্তুতির কোনো জায়গা নাই।’ বলেন তিনি।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে বিমান বাহিনী। সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তৎপর থাকতে হবে। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে আত্মনির্ভরতার প্রমাণ দিয়েছে বিমান বাহিনী। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জন্য সরকার সহযোগিতা করছে বাহিনীটিকে। পেশাগত কারিগরি সক্ষমতা বজায় রাখতে হবে।
দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যুগোপযোগী বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
এর আগে, সকালে প্রধান উপদেষ্টার তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে ঘরের চাবি তুলে দেয়া এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা। চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লার বন্যাকবলিত পরিবারের মাঝে পুনর্বাসনকৃত ঘরের চাবি হস্তান্তর করা হয়।
লন্ডনে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তাকে আনতে বিএনপির অনুরোধে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে লন্ডন থেকে ঢাকায় ফেরত আনতে বিএনপির পক্ষ থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অনুরোধ নিয়ে কাজ করছে। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত করা হচ্ছে। জানা যায়, খালেদা জিয়াকে লন্ডন থেকে দেশে ফেরাতে কাতারের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের আয়োজন করতে গত সপ্তাহে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনকে চিঠি লিখেছেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন। তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল, তবে ‘আশঙ্কামুক্ত’ নয়। তথাপি তিনি এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে দেশে ফিরতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় চিকিৎসক বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে করে দেশে ফেরাতে পরামর্শ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিএনপির মহাসচিবের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার লন্ডন ও দোহার বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দেশে ফেরাতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিএনপির চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে একটি দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। কভিড-১৯ মহামারির সময় বিগত সরকার তাকে বিশেষ বিবেচনায় কারামুক্তি দেয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দীনের এক আদেশে খালেদা জিয়া মুক্তি পান। এরপর দুর্নীতির যে দুটি মামলায় তিনি কারাবন্দি ছিলেন, সেগুলোর রায় বাতিল করেন আদালত।
গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। টানা ১৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর লন্ডন ক্লিনিক থেকে গত ২৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়াকে তারেক রহমানের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। অর্ধযুগের বেশি সময় পর এবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করেছেন খালেদা জিয়া। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কারাবন্দি অবস্থায় চারটি ঈদ কেটেছে কারাগারে ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।
বর্তমানে তারেক রহমানের বাসায় চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ শারীরিক নানা অসুস্থতায় ভুগছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীরের পেহেলগামে প্রাণঘাতী হামলার পর সামরিক জবাবদিহির বিষয়ে সেনাবাহিনীকে ‘পদ্ধতি, লক্ষ্য ও সময় নির্ধারণে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা’ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে এনডিটিভি গতকাল মঙ্গলবার রাতে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ও প্রতিরক্ষাপ্রধান জেনারেল অনিল চৌহানের সঙ্গে বৈঠকে এই বার্তা দিয়েছেন মোদি।
প্রধানমন্ত্রী মোদি আবারও বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক জবাব দেওয়াই আমাদের জাতীয় সংকল্প’ এবং তিনি ভারতের সেনাবাহিনীর প্রতি ‘সম্পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা’ রাখেন।
এই বৈঠকের কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও ভারতীয় জনতা পার্টির আদর্শিক অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভগবত প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছন।
সূত্রের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তা পেহেলগামে হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর জড়িতদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের সবুজ সংকেত দিয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামা হামলার পর এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। তখন ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ পরিচালিত প্রশিক্ষণশিবিরে নিখুঁত বিমান হামলা চালিয়েছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিচালিত সেই শিবিরগুলোকেই লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।
ছয় বছর পর এই হামলার সঙ্গে আবারও পাকিস্তানভিত্তিক নিষিদ্ধ সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তাদেরই ছায়া সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে এনডিটিভি জানিয়েছে।
এদিকে ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোও বলেছে, প্রাপ্ত প্রমাণ আবারও পাকিস্তানকেই ইঙ্গিত করছে।
এই প্রমাণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান ও কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের প্রতিনিধিদের দেখানো হয়েছে।
ভারত ইতোমধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। প্রথম ধাপে নয়াদিল্লি পাকিস্তানিদের জন্য জারি করা ভিসা বাতিল করে দিয়েছে। তবে পাকিস্তানি হিন্দু ও দীর্ঘমেয়াদি অনুমোদনপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য নয়। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে দেওয়া ভিসাও বাতিল করা হয়েছে।
গত রোববার সব কার্যকর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে, বিশেষ করে বিখ্যাত আটারি-ওয়াঘা চেকপয়েন্টে পাকিস্তানি নাগরিকদের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। সেদিন থেকে প্রায় এক হাজার পাকিস্তানি নাগরিক ভারত ছেড়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ব্যক্তিগতভাবে রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের এই সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরও কূটনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে ভারত ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দাস পানি চুক্তিও স্থগিত করেছে। এই পানি বণ্টন চুক্তির অধীনে পাকিস্তান তার প্রাপ্য মোট পানির প্রায় ৮৫ শতাংশ পেত। এই চুক্তি স্থগিত করাকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে পাকিস্তান। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসলামাবাদ ভারতের সব ভিসা বাতিল করেছে ও শত শত ভারতীয়কে বহিষ্কার করেছে। পাকিস্তান আরও কিছু দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, যেমন ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তিও স্থগিত রেখেছে।
এরই মধ্যে পাকিস্তানের এক শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনার বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও নিউজকে দেওয়া এক মন্তব্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ বলেন, আগামী কয়েক দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পেহেলগামে হামলা নিয়ে নিজের প্রথম প্রকাশ্য মন্তব্যে প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, তার সরকার সন্ত্রাসবাদের ভয়াবহ পরিকল্পনাকে সফল হতে দেবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘এবার সময় এসেছে সন্ত্রাসের আখ্যানের শেষ চিহ্নও মুছে ফেলার। ১৪০ কোটি মানুষের ইচ্ছাশক্তি সন্ত্রাসের প্রভুদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেবে।’
এরপর তিনি একাধিক শক্ত বার্তা দিয়েছেন, যাতে তিনি বলেন, ভারত সন্ত্রাসকে ভয় পায় না এবং এই ভয়াবহ হামলার পরিকল্পনাকারীসহ প্রত্যেক জড়িত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।
সূত্র: এনডিটিভি
মন্তব্য