রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশফাকুর রহমান। ঢাকার বিভিন্ন বারে মদ পান করার সময় ওয়েটারদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে ওয়েটারদের মাধ্যমে মদের বোতল কিনতে শুরু করেন আশফাক। কিছু লাভ রেখে বন্ধুদের কাছে সেই মদ বিক্রিতে নামেন তিনি।
ফেসবুকে একটি প্রাইভেট গ্রুপ খুলে তিনি শুরু করেন মদের হোম ডেলিভারি। এই ব্যবসা চালাতে আশফাককে মদ কোথাও সংরক্ষণ করতে হয়নি। অর্ডার পেলে বারের ওয়েটারদের মাধ্যমে বিদেশি মদ সংগ্রহ করে তিনি নিজে পৌঁছে দিতেন ক্রেতার কাছে।
তবে করোনার সময়ে বার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মদের চাহিদা যেমন বাড়ে, তেমনি সরবরাহেও তৈরি হয় ঘাটতি। এ সময় পরিচিত এক ওয়েটার তাকে টিউনিং করা মদের (বিদেশি বোতলে দেশীয় মদ বা ভেজাল মদ) বোতল বিক্রির পরামর্শ দেন।
এ ধরনের ভেজাল মদের দাম কম, লাভ বেশি। আশফাক কিছুদিন এ ধরনের মদ বিক্রি করেছেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অধিকাংশ সময় ক্রেতারা নিম্ন মানের এই মদের তফাত ধরতে পারতেন না। তবে অভিজ্ঞরা ধরে ফেলতেন। সে জন্য কয়েকবার ঝামেলায় পড়েছি। যারা বুঝতেন, তারা টাকা পরিশোধ করতেন না। এভাবে আমার বেশ কিছু টাকা খোয়া গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার সরবরাহ করা মদ খেয়ে কেউ অসুস্থ বা মারা যাননি। তবে কয়েক দিন আগে ভাটারা এলাকা থেকে আমার সেই সোর্স ভেজাল মদ বানানোর অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে বলে শুনেছি। এখন ওই গ্রুপের কারও সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই।’
রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একজন ব্যবসায়ী নিয়মিত মদ পান করেন। তিনি জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে বাজারে বিদেশি মদের ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে।
ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগের দামের তুলনায় এক-দেড় হাজার টাকা বেশি দিয়েও মদ কিনেছি। তবে তিন মাস ধরে কারও কাছেই মদ পাওয়া যাচ্ছে না, যাকে ফোন করি সে-ই বলে, নাই। প্রায় তিন সপ্তাহ আগে বন্ধুদের একটা আড্ডার আয়োজন ছিল। তখন মদের জন্য একটা ফেসবুক পেজের নম্বরে ফোন দিয়েছিলাম। দুই বোতল অ্যাবসোলিউট ভদকা আনিয়েছিলাম ১১ হাজার টাকা দিয়ে। কিন্তু একটু মুখে দিয়েই বুঝেছি ঝামেলা আছে। মুখে দেয়ামাত্রই মনে হলো মুখ পুড়ে যাচ্ছে। এখন তো শুনি এসব খেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে।’
বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকের পিআর প্রতিষ্ঠান ফোরথটপিআরের ৪৩ জন কর্মী অবকাশ কাটাতে গত ২৮ জানুয়ারি যান গাজীপুরের সারাহ রিসোর্টে। সেখানে মদ পান করে ঢাকায় ফেরার পর মারা যান তিনজন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় আরও বেশ কয়েকজনকে।
রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ৩১ জানুয়ারি মারা যান। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে পুলিশের দাবি, ওই ছাত্রী ২৮ জানুয়ারি উত্তরার একটি রেস্তোরাঁয় মদ পান করেন। তাদের মধ্যে এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে ৩০ জানুয়ারি সিটি হাসপাতালে মারা যান। এর পরদিন মারা যান ওই ছাত্রী। অবশ্য অসুস্থ অবস্থায় ছাত্রীটিকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরপরই তার বাবা বন্ধুদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে একটি মামলা করেছেন।
এসব ঘটনায় ভেজাল মদের ভয়াবহতা নিয়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ। নিউজবাংলা টানা অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে, ভেজাল মদের কারণে রাজধানীতে মারাত্মক অসুস্থতার পাশাপাশি মৃত্যুর বেশ কিছু ঘটনা সম্প্রতি ঘটেছে। সমালোচনা এড়াতে এসব ঘটনার বেশির ভাগই চেপে যাচ্ছে ভুক্তভোগী অথবা তাদের পরিবার।
হাসপাতালের পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর ও গ্রিন রোড এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি বার। এই এলাকার আশাপাশের সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি হাসপাতালের পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক কয়েক মাসে ভেজাল মদ খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
রাজধানীর আনোয়ার খান মডেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, গত ছয় মাসে তারা এ ধরনের অন্তত ১৩ জন রোগী পেয়েছেন। পান্থপথের বিআরবি হাসপাতাল এমন রোগী ভর্তি হয়েছেন ১০ জনের বেশি।
পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছেন ভেজাল মদে অসুস্থ বেশ কয়েকজন। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান জানাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
বেসরকারি হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক নিউজবাংলাকে জানান, পুলিশসহ অন্য ঝামেলা এড়াতে মদ খেয়ে অসুস্থরা সাধারণত হাসপাতাল এড়িয়ে চলতে চান। পরিস্থিতি গুরুতর হলেই কেবল তারা হাসপাতালে আসেন। এ ক্ষেত্রেও বেশির ভাগই সরকারি হাসপাতাল বেছে নেন।
বিষয়টি নিয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মদ পান করে অসুস্থতার ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। তবে সঠিক পরিসংখ্যান আমরা দিতে পারব না।’
ডা. সোহেলের সঙ্গে গত ৪ জানুয়ারি কথা বলে নিউজবাংলা। সে সময় তিনি বলেন, ‘বিষাক্ত মদ পানে মারা গেছেন এমন তিন জনের দেহ এই মুহূর্তে ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে আছে।’
ভেজাল মদ কেন প্রাণঘাতী
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষাক্ত মদে কিডনি ও লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভেজাল মদে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এছাড়া স্নায়ুতন্ত্রেও মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।’
বিষাক্ত মদপানের প্রাথমিক উপসর্গের বিবরণ দিয়ে ডা. সোহেল বলেন, ‘খাবার অযোগ্য মিথানল শরীরে প্রবেশ করলে বিষক্রিয়ায় কোষে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। শরীরে অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং কিডনি সেই অতিরিক্ত অ্যাসিড বের করে দিতে সক্ষম হয় না। এ কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, প্রচণ্ড বমি হতে থাকে, দম বন্ধ হয়ে আসে। একপর্যায়ে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
‘মিথানল গ্রহণ করার পর যত সময় যায়, ততই তা শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে শরীরের আরও বেশি ক্ষতি হয়।’
ভেজাল মদ নিয়ে নিউজবাংলাকে বিস্তারিত জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা।
তিনি বলেন, ‘আগে আমরা ভেজাল মদ বলতে যা পেতাম তা ছিল দেশীয় মদের সঙ্গে পানি বা ঘুমের ওষুধের মিশ্রণ অথবা ইথাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে পানি বা রঙ মিশিয়ে বানানো। তবে এখন যা পাচ্ছি তা হল মিথানল, যা পূর্নাঙ্গ টক্সিক বা বিষ। ’
দুলাল কৃষ্ণ জানান, ইথালন হলো রেকটিফাইড স্পিরিট, তবে এটি মিথানলের মতো অতটা প্রাণঘাতী নয়। মিথানল ব্যবহার করা হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজে, এই মিথানল দিয়ে কাঠের আসবাবও রং করা হয়। এটা পরিপূর্ণ বিষ, আর মানুষ এটা খেয়েই মারা যাচ্ছে। ’
তিনি জানান, দেশে প্রাকৃতিক উপায়েই ইথানল তৈরি হচ্ছে, আর শিল্প কারখানার জন্য আমদানি করা হচ্ছে মিথানল। সে হিসেবে ইথানল ও মিথানল দুটি রাসায়নিকই বাংলাদেশে সহজলভ্য।
পান্থপথের বিআরবি হাসপাতালের সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার রকিবুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালকোহলের ক্ষেত্রে মিথানল মিশিয়ে সেগুলো পানের অযোগ্য করে ফেলে হয়। তখন এটাকে বলে মিথিলেটেড স্পিরিট। এই স্পিরিট মূলত বার্নিশের দোকানসহ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্ষেত্রে কাজে লাগে।’
ডা. রকিব জানান, ইথানল ও মিথানল আলাদা করা যায় রঙ দেখে। রেকটিফায়েড স্পিরিট বা ইথানল পানির মতো সাদা হয়, তবে মিথিলেটেড স্পিরিটে বেঞ্জিনসহ অন্য উপাদান মেশানোর ফলে রঙ খানিকটা বাদামি ও হালকা গন্ধ থাকে।
ভেজাল মদের বিষক্রিয়া কীভাবে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তা ব্যাখ্যা করে ডা. রকিব বলেন, ‘যে ক্যামিক্যাল বডিতে যাচ্ছে তা প্রথমে রক্তে যাবে। শরীর এটাকে মেটাবোলাইজ (পরিপাক) করে। লিভার টক্সিক পাওয়ারটা নষ্ট করে। তারপর কিডনি এটাকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। তাই এই ধরনের কেমিক্যাল ঢুকলে প্রথমে লিভার ও কিডনিকে আক্রান্ত করে। বেশি পরিমাণ খেলে লিভার ফেইল করে। পড়ে সেটা ব্রেইনে অ্যাটাক করে। ’
ইথানলের পরিবর্তে অতি বিষাক্ত মিথানল কেন
দেশে ইথানল ও মিথানল দুটি রাসায়নিকই সহজলভ্য। তবে মদে ভেজালকারীরা সম্প্রতি অত্যন্ত বিষাক্ত মিথানল ব্যবহার কেন বাড়িয়েছে, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে নিউজবাংলা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, দামের পার্থক্যই মূলত এর কারণ। এক লিটার ইথানল কিনতে খরচ হয় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। অন্যদিকে, এক লিটার মিথানলের খুচরা দাম মাত্র ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ চোখে ইথানল আর মিথানলের পার্থক্য করা কঠিন। এ কারণে ভেজালকারিরা অনেক সময় না বুঝেই ইথানলের বদলে মিথানল দিয়ে মদ বানাচ্ছেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাত্র ১২ মিলি লিটার মিথানল মানুষের পেটে গেলেই অন্ধত্বসহ মৃত্যু হতে পারে। ৬০ মিলি লিটার (এক পেগ) মদে অ্যালকোহল থাকে সর্বোচ্চ ৩০ মিলি লিটার। সেই সূত্র মেনেই ভেজালকারিরা মিথানল দিয়ে মদ তৈরি করছে।’
ভেজাল মদ চেনার জানতে চাইলে দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘এটা পরীক্ষা করা ছাড়া বোঝার উপায় নেই। ল্যাবে পরীক্ষা করে তবেই নিশ্চিত হওয়া যায়। ’
তবে ঢাকার একটি বারের একজন ওয়েটার জানান, মদে আগুন ধরিয়ে আসল-ভেজাল পরীক্ষা করা সম্ভব। ভেজাল মদে পানির মিশ্রণ থাকে বলে তাতে আগুন জ্বলে না।
রাজধানীর ভাটারা এলাকায় গত ১ জানুয়ারি অভিযান চালিয়ে ভেজাল মদ তৈরির একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির গুলশান গোয়েন্দা বিভাগ।
এই বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চক্রটির ভেজাল মদ তৈরি করতে খরচ পড়ত সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। মুনাফার জন্য তাদের মানুষ মারতেও দ্বিধা নেই। ভাটারার এই চক্রটিই মূলত উৎপাদনের কাজ করত, তারপর ছড়িয়ে দিত রাজধানী ও আশপাশের এলাকায়। এই ভেজাল মদই গাজীপুর, মোহাম্মদপুরসহ অন্যান্য জায়গায় মানুষের মৃত্যুর কারণ।’
বেড়েছে মদের খালি বোতলের বিক্রি
ভেজাল মদকে নতুন হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয় পুরোন বোতলে ভরে। নিউজবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে গত কয়েক মাসে পুরান ঢাকায় এ ধরনের বোতল বিক্রি বেড়েছে।
মদের পুরোন বোতল বিক্রিতে জড়িতরা নিউজবাংলাকে জানান, ফেলে দেয়া খালি বোতলগুলো সংগ্রহ করে টোকাই বা ভাঙারির লোকজন। তাদের কাছ থেকে একেকটি বোতল পাঁচ থেকে ১০ টাকায় কেনেন ভাঙারির দোকানিরা। এরপর সেগুলো পরিষ্কার করে ২৫ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি করা হয়।
মদের খালি বোতল পাইকারি দামে পাওয়া যায় পুরান ঢাকার নিমতলি এলাকায়। এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সম্প্রতি পুলিশের ভেজাল মদবিরোধী অভিযান শুরুর পর এখন আর প্রকাশ্যে মদের খালি বোতল বিক্রি হচ্ছে না। ব্যাবসায়ীরা জানান, এখন শুধু পরিচিত এবং বিশ্বস্তদের কাছেই বোতল বিক্রি করা হচ্ছে।
নিমতলীতে খালি মদের বোতল বিক্রেতাদের অন্যতম সাব্বির। নিমতলী মসজিদের ঠিক বিপরীত পাশে তার দোকানে সাজানো আছে কিছু কাঁচের কৌটা। তবে আড়ালে তার সংগ্রহে রয়েছে নানা ব্র্যান্ডের মদের খালি বোতল।
সাব্বিরের দোকানের কাছেই আরেক ব্যবসায়ী মামুনের দোকান। রাস্তার মাথায় তার ছোট ভাঙারির দোকানে অন্য পণ্যের পাশাপাশি কিছু কাঁচের বোতলও রাখা আছে। তবে পাশের আরেকটি ঘরে তার মূল গুদামে রয়েছে মদের অসংখ্য খালি বোতল।
মামুন নিউজবাংলাকে জানান, দামি ব্র্যান্ডের বোতলের দাম একটু বেশি। আর সাধারণ আকার, বিশেষ করে গোলাকৃতির বোতল ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী বলেন, গত তিন-চার মাসে দামি ব্র্যান্ডের বোতল বিক্রি বেড়েছে। পানি খাওয়া বা শোপিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য এসব বোতলের তেমন চাহিদা নেই। এগুলো মূলত ভেজাল মদ প্রস্তুতকারকেরা নিয়ে যান।
বৈধ মদের সংকট কেন
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসেবে সারাদেশে বৈধ বার ও ক্লাবের সংখ্যা ১৮৬টি। এদের কোনো কোনোটি বিদেশ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ সরাসরি আমদানি করছে, বাকিরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে সরবরাহ নিচ্ছে।
এর বাইরে দেশে ২০৩টি মদ বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে, যার মধ্যে ১৪টি বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য শুল্কমুক্ত ওয়্যারহাউজ।
দেশে বেশ কিছু শর্ত ও অতিরিক্ত কর আরোপ করে মদ্যপানকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সরকার। বার সংশ্লিষ্টদের দাবি, ওয়্যার হাউজ থেকে কূটনৈতিক পাসপোর্টের বিপরীতে প্রতি মাসে ২০০ ডলারের মদ সরবরাহের বিধান রয়েছে। তবে সিন্ডিকেট তৈরি করে এসব ওয়্যার হাউজ থেকে মদ নিয়ে বিক্রি করছিল বিভিন্ন বার। এটি বন্ধে সম্প্রতি শুল্ক বিভাগ প্রতিটি ওয়্যার হাউজে অডিট শুরু করে। এর পর থেকে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বিদেশি মদের সংকট।
ঢাকার একটি ওয়্যার হাউজের সুপারভাইজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে আমাদের এখান থেকে বিভিন্ন বারে মদ যেত। শুল্ক গোয়েন্দাদের ম্যানেজ করেই সব চলছিল। তবে এবার আর তাদের ম্যানেজ করা যাচ্ছে না বলেই ঝামেলা হচ্ছে।’
মদের দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা একটা ব্ল্যাক লেভেল এখান থেকে দেই তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়, সেটা বারে বিক্রি হয় আট থেকে নয় হাজার টাকায়। একটা ভ্যাট সিক্সটিনাইন আমরা দেই দেড় হাজার টাকায়, সেটা বাইরে বিক্রি হয় সাড়ে তিন হাজার টাকায়। ক্রেতারা ঠিকই বেশি দাম দিয়ে কিনে খান, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত লাভের টাকা যায় সিন্ডিকেটের কাছে।’
পরিচয় গোপন রেখে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন রাজধানীর একটি বারের ব্যবস্থাপক। তিনি বলেন, ‘আমাদের বারের মদ আমদানির লাইসেন্স আছে। আমরা একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ আমদানি করি। তবে আমদানি করে বিক্রি করা পর্যন্ত আমাদের যা খরচ, তা ওয়্যার হাউজ থেকে আনা মদের দামের চেয়ে ৬০০ গুণ বেশি। আমরা আমদানি করতে গেলে হাজারে ৩০০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এখানেই শেষ না, বিক্রি করতে গেলে প্রতি হাজারে ৩৫০ টাকা সরকার নিয়ে যায়, তার উপর আবার আছে ২০ শতাংশ ভ্যাট। তাহলে বৈধ পথে ব্যবসা করব কী করে?’
ভ্যাট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, বার বা বিভিন্ন অনুমোদিত রেস্তরাঁয় বিক্রি হওয়া মদের বেশিরভাগ আসছে অবৈধ পথে। ওয়্যার হাউজ থেকে সংগ্রহ ছাড়াও স্থলসীমান্ত দিয়ে চোরাচালান ও বিদেশিদের লাগেজে আনা হয় অবৈধ মদ। এতে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে বলেই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, করোনায় বিমান যোগাযোগ সীমিত হয়ে যাওয়া, সীমান্তে কড়াকড়ি ও ওয়্যার হাউজ থেকে বারে মদ বিক্রির সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ায় বারে অবৈধ মদ কেনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এই সংকটের মাঝে বেড়েছে ভেজাল মদ তৈরির প্রবণতা।
ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বৈধ পথে মদ আমদানি বন্ধ নেই। তবে অবৈধ পথগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এতে করে সরকারের রাজস্ব বেড়েছে। আমাদের এ অবস্থান অব্যাহত থাকবে। তবে একটি পক্ষ আমদানি বন্ধ বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহম্মদ আহসানুল জব্বার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভেজাল মদ তৈরি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। কোনো বার ভেজাল মদ বিক্রির সাহস করবে না। তবুও আমরা বারগুলোতে নজরদারি বাড়িয়েছি। বৈধ বারে মানুষ মদ পান করবে, এটা নিয়মের মধ্যেই আছে, কিন্তু অবৈধ মদ পেলে তো আমরা জব্দ করবই।’
মদ আমদানিতে বিপুল করের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিছুদিন ধরে শুনছি বার মালিকেরা অতিরিক্ত শুল্কের কথা বলছেন, কিন্তু এতদিন পর শুল্ক নিয়ে কথা কেন? সরকারি শর্ত মেনেই তো তারা এই ব্যবসায় এসেছেন। এখন চুরি করতে পারছেন না বলে শুল্ক নিয়ে মাথাব্যথা। আমার স্পষ্ট কথা তারা বৈধ ব্যবসা করতে চাইলে সবসময় আমাদের সহযোগিতা পাবেন।’
প্রতি জেলায় বৈধ বারের পক্ষে পর্যটন করপোরেশন
দেশের প্রতিটি জেলায় সরকার অনুমোদিত বার চালুর প্রস্তাব করেছে পর্যটন করপোরেশন। সংস্থার ব্যবস্থাপক জিয়াউল হক হাওলাদার (জনসংযোগ) নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিটি জেলায় বার করা হবে। ডমেস্টিক ওয়েতে বারগুলো উন্নত করতে পারলে ট্যুরিস্টদের মধ্যে আস্থা বাড়বে। ট্যুরিস্টদের সঙ্গে লোকাল মানুষের কানেকটিভিটি বাড়লে স্বাচ্ছন্দ্যে টুরিস্টরা বারে প্রবেশ করতে পারবে। ’
বারে শুল্ক কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণভাবে সরকার ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে চাইলেও আমরা কিছু করতে পারব না।’
আরও পড়ুন:ঋণ জালিয়াতি, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, পাচার, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনসহ নানা অপরাধের অভিযোগে এক ডজনেরও বেশি মামলা কাঁধে নিয়ে বছরের পর বছর বহালতবিয়তে থেকে গেছেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম ও তার পরিবাবের সদস্যরা।
দেশের আর্থিক খাতে অনিয়মের শিরোমণি এই বিতর্কিত ব্যবসায়ী বিধি ভেঙে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকার দ্বিতীয় নামটি ছিল এই বিতর্কিত ব্যবসায়ীর। ২০২১ সালের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায়ও দ্বিতীয় নামটি তার।
অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার এবং অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের পৃথক তিন মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড কাঁধে নিয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন এই বিতর্কিত ব্যবসায়ী।
অবশেষে তার ১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবশেষ বুধবার ওবায়দুল করিমসহ তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আর্থিক খাতে নানামুখী অপকর্মে সিদ্ধহস্ত ওবায়দুল করিম সাজা থেকে বাঁচতে মামলার নথি গায়েব ও শুনানি পেছানোর কূটকৌশলে পার করেছেন ১৬ বছর। সাজা ঘোষণার তিনটিসহ তার বিরুদ্ধে মোট ১৪টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ৪৮৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১১টি মামলা হয়। ২০০৭ সালে করা এসব মামলার বিচারকাজে এখন স্থবিরতা বিরাজ করছে। তবে এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ওবায়দুল করিম ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। সে সময় যৌথ বাহিনীর গঠিত দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্সের অভিযানের সময় গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তবে দুর্নীতির মামলা ও সাজা থেকে রক্ষা পাননি। তার অনুপস্থিতিতে বিশেষ আদালতে রায় ঘোষণা হয়। একটিতে যাবজ্জীবনসহ তিনটি মামলায় তার অন্তত ৪৮ বছর কারাদণ্ড হয়। এর মধ্যে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের প্রায় ৭ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে যাবজ্জীবন (৩০ বছর) কারাদণ্ড দেওয়া হয় ও আত্মসাতের সমপরিমাণ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকা অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
২ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং পাচারের সমপরিমাণ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। অবৈধ উপায়ে ৫০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের দায়ে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জরিমানা করা হয় ১০ লাখ টাকা। জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
অবৈধ উপায়ে ৫২ কোটি ৯২ লাখ টাকা অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর রমনা থানায় মামলাটি করেন দুদকের উপপরিচালক আবদুল করিম। বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২৫ জুন এক রায়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে ১০ বছর এবং তথ্য গোপনের দায়ে ৩ বছরসহ মোট ১৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন বিশেষ জজ আদালত-৯-এর বিচারক খন্দকার কামাল উজ-জামান। রায়ে ৫২ কোটি ৯০ লাখ টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।
এ ছাড়া ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। রায়ে বলা হয়, ওবায়দুল করিম পলাতক থাকায় তিনি যেদিন আত্মসমর্পণ করবেন বা গ্রেপ্তার হবেন, সে দিন থেকে সাজার মেয়াদ শুরু হবে। কিন্তু ওবায়দুল করিম রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন। হাইকোর্ট শুনানি শেষে রায় স্থগিত করেন। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে দুদক আপিল করলে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে ওবায়দুল করিমকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। এ মামলায় বিচারিক আদালতে মামলার নথি খুঁজে না পাওয়ায় বিচারকাজে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
এর মধ্যে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা শীর্ষ ঋণখেলাপিদের তালিকায় উঠে আসে ওবায়দুল করিমের নাম। সে সময় তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা ঠুকেই বাঁচার চেষ্টা করেন তিনি।
বিধি ভেঙে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ
বিধি লঙ্ঘন করে ওরিয়ন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন পাওয়ার প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংক অগ্রণী, জনতা ও রূপালী। এ ক্ষেত্রে অন্তত দুটি নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং একটিতে ব্যাংক কোম্পানি আইন শিথিল করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তিনটির প্রস্তাবিত ওই ঋণের অনুমোদন পায় প্রতিষ্ঠানটি।
সিন্ডিকেট ফাইন্যান্সিং বা অর্থায়নের মাধ্যমে সম্প্রতি ওই ঋণের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে সমস্যা জর্জরিত জনতা ব্যাংক এ ঋণের সিংহভাগ অর্থাৎ ৫ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে।
রূপালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এ ঋণ নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও ঋণটি বিতরণের জন্য পাইপলাইনে রয়েছে, কিন্তু ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে এ ঋণ বিতরণে দেরি হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ওবায়দুল করিমের মালিকানাধীন ওরিয়ন গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ১৪৫ কোটি ২২ লাখ ৫৪ হাজার ৬০৬ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অন্তত হাজার কোটি টাকা।
ঋণের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওরিয়ন গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম ও তার ছেলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান ওবায়দুল করিম একটি ব্যাংক থেকে ১৬৬ কোটি ৩০ লাখ ২১ হাজার ৫০৮ টাকা ঋণ নেন। কিন্তু কোম্পানি তো দূরের কথা, টিআইএন নম্বরেরও খোঁজ মেলেনি। বেলহাসা একম জেভি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম, এমডি সালমান ওবায়দুল করিম ও স্পন্সর পরিচালক মাজেদ আহম্মেদ সাঈফের নামে ঋণের পরিমাণ ৭৮ কোটি ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৬৪৮ টাকা। ওবায়দুল করিম আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের নামে ৫১ কোটি ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৮৬৮ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৭১৭ টাকা পরিশোধ করেননি। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বা অংশীদারত্বের কোনো বৈধ কাগজ পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।
১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের কাছ থেকে বারবার সময় নিয়েও ঋণ পরিশোধ করেনি ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। ফলে প্রতিষ্ঠানটির ১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখাতে ব্যাংকটিকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তথ্য অনুসারে, সোনালী ব্যাংককে ২২ আগস্টের মধ্যে ঋণের যথাযথ শ্রেণিবিভাগ করে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। এতে ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের ১০৬ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। কোম্পানিটির বকেয়া ঋণ গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খারাপ ঋণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ ছিল। তখন পর্যন্ত কোম্পানিটি চারটি কিস্তি পরিশোধ করতে পারেনি।
জানা গেছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তির মূল অর্থের পরিমাণ ৩০ কোটি টাকা এবং ৭৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা সুদ বাবদ বকেয়া ছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমতির ওপর ভিত্তি করে এতদিন এই ঋণ খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়নি। সম্প্রতি সোনালী ব্যাংককে দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে কিস্তি বাকি থাকায় কোম্পানিটির ঋণ খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করতে বলা হয়েছে।
ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে প্রায় দুই দশক আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে টার্গেট করে ওরিয়ন গ্রুপ। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ভেঙে ৪০ বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেওয়ার অপতৎপরতাও চালায় গ্রুপটি। সোনালী, রূপালী ও জনতা ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ ভাগিয়েও নেয়। গত জুন শেষে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গ্রুপটির নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। যার বড় একটি অংশই নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানের বাইরে গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিমের গ্যারান্টার হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণও হাজার কোটি টাকার বেশি। যার একটা অংশ খেলাপির হলেও প্রভাব খাটিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে নেন তিনি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের মেয়াদও বারবার বাড়ানো হয়।
সম্প্রতি একটি প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেক রয়েছে ওরিয়ন গ্রুপসহ তিনটি গ্রুপের পকেটে। এতে বলা হয়, ব্যাংকটি থেকে বেক্সিমকো, এস আলম এবং ওরিয়ন গ্রুপের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকের জনতা ভবন করপোরেট শাখার ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণের বড় অংশ রয়েছে ওরিয়ন গ্রুপের পকেটে।
এ ছাড়া গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষের দিকে (৬ মে) রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকে ১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকার আরেকটি ঋণ প্রস্তাব করা হয় গ্রুপটির ওরিয়ন রিনিউয়েবলস মুন্সীগঞ্জ লিমিটেডের নামে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের জামানত বা সিকিউরিটি মর্টগেজ হিসেবে যে সম্পদ দেখানো হয়েছে তা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। সে সময় জামানতের সম্পদমূল্য ৫৪০ কোটি টাকা দেখানো হলেও তা সর্বোচ্চ ১৮০ কোটি টাকা হবে। এভাবে জামানতে ভুল তথ্য দিয়েও ঋণ ভাগিয়ে নেওয়ার আশ্রয় নিয়েছে গ্রুপটি।
গত জুনের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের তফসিলভুক্ত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নেওয়া ব্যবসায়ী গ্রুপ ওরিয়নের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ৮২০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর বাইরে ননফান্ডেড ঋণ রয়েছে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা। গ্রুপটির মোট ১২৪টি কোম্পানির মধ্যে সচল থাকা ২২টির ব্যাংক হিসাবের লেনদেন পর্যালোচনা করে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, গ্রুপের মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে নিজের ব্যক্তিগত গ্যারান্টার হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১ হাজার ১২৯ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে ৮ কোটি টাকার ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে ঋণ খেলাপি হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করে দেয়। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ খেলাপি তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে নেন তিনি।
২০২০ সালে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ওরিয়ন গ্রুপের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ভেঙে টাকা উত্তোলনের অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগ তোলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ভেঙে খাওয়ার টার্গেটে নামে গ্রুপটি। এরপর তারা হাজার হাজার কোটি টাকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য ২০১৯ সালের ২৬ জুলাই থেকে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালায়। কোম্পানিটি ঋণ হিসাবে ৯০৬ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার নেওয়ার আবেদনও করে। টাকার অঙ্কে হিসাব করলে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্টভাবে কোনো একটি ব্যাংক থেকে একসঙ্গে এত টাকা ঋণ পাওয়ার নজির বাংলাদেশে নেই।
গ্রুপটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম ২০০৭ সালে ব্যাংক থেকে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাতের এক মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বেশ আলোচনায় আসে। তবে তিনি সেই মামলার নথি আদালত থেকে গায়েব করে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। নথি হারিয়ে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির পরবর্তী বিচার প্রক্রিয়া থমকে যায়। ফলে অন্যতম আসামি ওবায়দুল করিমসহ দোষীরা বহাল তবিয়তে থেকে যান। রহস্যজনক কারণে দীর্ঘ বছরে মামলাটি নিয়ে দায়িত্বশীলদের কোনো নজরদারিও নেই।
মামলা সূত্রে জানা যায়, বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ না করেই ২০০৮ সালে ওই রায় বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। রুল শুনানি শেষে ওই বছরই বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় স্থগিত করেন হাইকোর্ট। ২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে আসামি ওয়াবদুল করিমকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
নিয়মানুসারে মামলার মূল নথিটি উচ্চ আদালত থেকে বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর সেই নথিপত্র গ্রহণ করেন বিচারিক আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এরপর থেকে এ মামলার কার্যক্রম আর অগ্রসর হয়নি। মামলার মূল নথি খুঁজে না পাওয়ায় বর্তমানে ‘মামলা ও আসামিদের সর্বশেষ অবস্থা’ সম্পর্কে কেউই বলতে পারছেন না।
ওবায়দুল করিম পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ
আর্থিক খাতে অনিয়মের শিরোমণি এবং জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিমের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। একইসঙ্গে তার স্ত্রী-সন্তানসহ ছয়জন ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে।
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়ে অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে বলেছে। সন্ধ্যায় বিএফআইইউর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়, হিসাব জব্দ করা ব্যক্তিদের নিজস্ব ও ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সব লেনদেন বন্ধ থাকবে। আগামী ৩০ দিন এসব হিসাবের মাধ্যমে কোনো ধরনের লেনদেন করতে পারবে না তারা। প্রয়োজনে লেনদেন স্থগিত করার এ সময় বাড়ানো হবে। লেনদেন স্থগিত করার এ নির্দেশের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারা প্রযোজ্য হবে বলে চিঠিতে বলা হয়েছে। এতে ওবায়দুল করিম ও তার স্ত্রী আরজুদা করিম, ছেলে সালমান ওবায়দুল করিম, মেহেদি হাসান ও মেয়ে জারিন করিমের নামসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রেজাউল করিমের নামসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যও দেওয়া আছে।
এ ছাড়া চিঠিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ওপরে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য (পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রী, পুত্র/কন্যা ও অন্যান্য) এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সকল হিসাবের কেওয়াইসি, হিসাব খোলার ফরম ও শুরু থেকে হালনাগাদ হিসাব বিবরণীসহ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য আগামী দুই কার্যদিবসের মধ্যে বিএফআইইউর কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে।
আর্থিক অনিয়মের বিস্তর অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ওরিয়ন গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন:সংঘাতপূর্ণ মিয়ানমারের সীমান্ত থেকে ছোড়া গুলি এসে পড়ছে টেকনাফ স্থলবন্দরে। এ অবস্থায় স্থলবন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
বুধবার দুপুরে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি স্থলবন্দরে এসে পড়ে। এতে স্থলবন্দরের অফিস ভবনের জানালা ও বন্দরে অবস্থান করা ট্রাকের কাচ ভেঙে গেছে। এ অবস্থায় স্থলবন্দরে নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্থলবন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়।
টেকনাফ স্থলবন্দরের শ্রমিক মো. নাজির বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে মালামাল নিয়ে একটি ট্রলার টেকনাফ স্থলবন্দর ঘাটে পৌঁছায়। এই ট্রলার থেকে মালামাল খালাসের সময় মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি এসে পড়ে। এতে শ্রমিকরা ভয়ে পালিয়ে যান। এখন বন্দরজুড়ে আতঙ্ক।’
টেকনাফ স্থলবন্দরের ব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন জানান, বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা থেকে পর পর তিনটি গুলি এসে পড়ে টেকনাফ স্থলবন্দরে। একটি গুলি স্থলবন্দরের অফিসে এসে পড়লে অফিসের কাচ ভেঙে যায়। দ্বিতীয় গুলি এসে পড়ে স্থলবন্দরের মালামাল বহনকারী ট্রাকে। অপরটি নারিকেল গাছে এসে লাগে।
টেকনাফ স্থলবন্দর ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্টের ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দুপুরে মিয়ানমার থেকে ছোড়া দুটি গুলি আমাদের অফিসে এসে পড়ে। এ ঘটনায় বন্দরের শ্রমিকরা কাজ না করে চলে যান। ফলে মিয়ানমার থেকে আসা ২৪ হাজার ব্যাগের একটি বাণিজ্যিক ট্রলারের মালামাল খালাস বন্ধ রয়েছে।’
জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্ত থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে তিনটি গুলি এসে পড়েছে। তবে কেউ হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। কারা গুলি করেছে সেটি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’
টেকনাফ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে দুটি গুলি এসে টেকনাফ বন্দরে পড়ে। গুলিগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। তবে কেউ হতাহত হয়নি।’
স্থানীয়রা জানান, মিয়ানমারের ওপারে তোতারদিয়া দ্বীপে কয়েকদিন ধরে দু’পক্ষে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। এ কারণে গত কয়েকদিন ধরে টেকনাফ স্থলবন্দরসহ সীমান্ত এলাকায় গুলি এসে পড়ছে।
আরও পড়ুন:অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বুধবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে এনইসি সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এ তথ্য জানান।
উপদেষ্টা বলেন, ‘নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আর করছি না। রাজনৈতিক সরকার এলে হয়তো করবে, কিন্তু আমরা করব না।
‘কবে উন্নত দেশ হবে, কবে মাথাপিছু আয় কত হবে- এ পরিকল্পনা আমরা করব না।’
প্রসঙ্গত, নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং এসডিজি বাস্তবায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৫ সালের জুলাই থেকে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) দুপুর ২টার সংবাদ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচারের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালককে (ডিজি) চিঠি পাঠিয়েছে তথ্য অধিদপ্তর।
বুধবার পাঠানো এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন প্রধান তথ্য অফিসার মো. নিজামুল কবীর।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ টেলিভিশনের দুপুর ২টার সংবাদ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচার করার প্রয়োজন নেই বলে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করা হলো।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংস্কারের জন্য প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন এবং কমিশনের প্রধানদের নাম ঘোষণা করেন।
‘সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. শাহদীন মালিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল। এই কমিশনের প্রধান হিসেবে তার পরিবর্তে আলী রীয়াজের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক, আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র অনাবাসিক ফেলো ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজের (এআইবিএস) প্রেসিডেন্ট।
বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেয়া প্রকল্প পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একইসঙ্গে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্প গ্রহণের কথা বলেছেন তিনি।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় একথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন ড. ইউনূস।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বুধবার এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেয়া প্রকল্পের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। মেগা প্রকল্পও বাদ দিতে হবে। নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করতে হবে।
‘এখন থেকে প্রকল্পের সব তথ্য ওপেন থাকবে। শুধু পিডি জানবে তা নয়, সবাই জানবে। সামনে বড় প্রকল্প নয়, জনগুরুত্বপূর্ণ ছোট প্রকল্প নেয়া হবে।’
মেগা প্রকল্প না নিয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ ছোট প্রকল্প নেয়ার বিষয়ে সভায় উপস্থিত উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যরা একমত হয়েছেন।
আরও পড়ুন:জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) চারটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ও একনেক চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বুধবার অনুষ্ঠিত সভায় এই অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এটি ছিল প্রথম একনেক বৈঠক।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়- বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্পে ৭০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া ‘দুটি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ (সুন্দলপুর-৪ ও শ্রীকাইল-৫) এবং দুটি অনুসন্ধান কূপ (সুন্দলপুর সাউথ-১ ও জামালপুর-১) খনন প্রকল্পে ৫৮৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)’-এর জন্য চারশ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৯৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা সরকারি অর্থায়ন এবং ১০০ কোটি ১৬ লাখ টাকা ইউনিসেফের অনুদান।
এছাড়া মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘তথ্য আপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) (দ্বিতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্পটির মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি, প্রকল্পের নাম পরিবর্তনের পাশাপাশি ব্যয় পুনঃপ্রাক্কলন করার নির্দেশনা দিয়ে অনুমোদন করা হয়েছে।
প্রকল্পটিতে দুই বছরের জন্য ১৬৩ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ব্যয়ও কমানো হবে।
অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ; পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ; আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং ভূমি উপদেষ্টা হাসান আরিফ; পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন; শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান; প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সংযুক্ত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ, সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ সংশ্লিষ্টরা সভায় অংশ নেন।
সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সিনিয়র সচিব ও সচিব এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য