কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের একটি পুরনো সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা পদার্থের এমন এক নতুন দশা তৈরি করেছেন, যেখানে সময়ের দুটি মাত্রা বা ডাইমেনশন। পদার্থের এই দশা কঠিন, তরল ও বায়বীয় দশার চেয়ে ভিন্ন।
পরম তামপাত্রার (-৪৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) কাছাকাছি তাপমাত্রায় কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের কাজ করে কিউবিট। একই সঙ্গে আশেপাশের বিদ্যুত ও চৌম্বক ক্ষেত্রকে এড়িয়ে তাদেরকে এ কাজটা করতে হয়।
বিদ্যুৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবের কারণে কিউবিটের তথ্য প্রবাহে বিঘ্ন হয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের এ ত্রুটিগুলো সারানোর পথ খুঁজে বের করাটাই বিজ্ঞানীদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।
কানাডার একদল বিজ্ঞানীর দাবি, তারা এ সমস্যা সমাধানের নতুন এক উপায় বের করেছেন। আর সেটা করতে গিয়ে তারা পদার্থের এমন এক দশা তৈরি করেছেন, যেখানে সময় একটি নয়, দুটি মাত্রা নিয়ে অস্তিত্বশীল।
এক প্রতিবেদনে এটি জানিয়েছে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ভিত্তিক সাইট ভাইস। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য সেটির ভাষান্তর করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
নতুন এ আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হয়েছে নেচার জার্নালে, গত বুধবার। গবেষকদের অন্যতম সদস্য ও কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অ্যান্ড্রু পটার এক ই-মেইলে ভাইসকে জানিয়েছেন, ‘পদার্থের নতুন দশাকে নিয়ে তারা যে কাজ করেছেন, সেটা আমাদের পরিচিত কঠিন, তরল ও বায়বীয় অবস্থার চেয়ে ভিন্ন।
তিনি লেখেন, ‘পদার্থের দশাগুলি সম্পর্কে চিন্তা করার আধুনিক উপায় হল একটি দশাকে স্থিতিমাপের বিশেষ অঞ্চল হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা, যেখানে পরিবর্তনের সম্মুখীন না হয়ে কোনো দশার টিকে থাকা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, কঠিন পদার্থকে তাপ দিলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে গলে তরলে পরিণত হয় না। এটা তখনই গলতে শুরু করে যখন এটা একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা অতিক্রম করে, যা ওই পদার্থের মেল্টিং পয়েন্ট।’
তাপমাত্রার কীভাবে পদার্থের দশায় পরিবর্তন ঘটায় সেটার চেয়ে পটার ও তার সহকর্মীরা দেখেছেন যে বস্তুর কোনো অবস্থায় সময় কীভাবে একটি সীমানা নির্ধারণ করে দিতে পারে। এ সীমানার ফলে যা সৃষ্টি হচ্ছে তাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘ডাইনামিক টপোলজিক্যাল ফেজ’। এতে করে, তাপমাত্রার বদলে কোয়ান্টাম সিস্টেমের ভুলগুলো ফেজে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।
পটার যোগ করেন যে, এই দশায় তাদের সিস্টেমকে রেখে দলটি দেখিয়েছে যে তারা কিউবিটকে এক ধরণের ত্রুটি থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এই অবস্থা ধরে রাখার জন্য কিউবিটগুলির এমন কিছু প্রয়োজন যা অসম্ভব শোনায়, আর তা হলো দ্বিমাত্রিক সময়।
এটি অর্জন করার লক্ষ্যে গবেষকরা প্রাচীন ও বিখ্যাত একটি গাণিতিক প্যাটার্ন নিয়ে কাজ করেছেন– ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স। ১১ শতকে ইতালির গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি প্রথম এটি উদ্ভাবন করেন। এ সিকোয়েন্স আসলে সংখ্যার এমন একটি ধারা যেখানে প্রতিটি সংখ্যা আগের দুই সংখ্যার যোগফল। প্রাকৃতিক অনেক বিষয় যেমন সূর্যমুখী ফুলের বিজের সর্পিল বিন্যাসে এ সিকোয়েন্স লক্ষ্য করা যায়।
তাদের গবেষণার জন্য পটার ও তার দল এ সিকোয়েন্সে সংখ্যাগুলোর অনুপাতের দিকে লক্ষ্য করেছেন ও বের করার চেষ্টা করেছেন কী করে তারা সিস্টেমে আটকে পড়া কিউবিটকে এ অনুপাতে লেসার ছুড়ে রক্ষা করতে পারেন।
পটার বলেন, ‘ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্সে সংখ্যার পুনরাবৃত্তি নেই, আবার এটি কোনো দ্বৈবচয়ন ভিত্তিক ধারাও নয়। এর ফলে কার্যত আমরা সিস্টেমে সময়ের দুটো আলাদা মাত্রাকে ব্যাখ্যা করতে পেরেছি।’
ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্সের ফলে একটি আপাত-পর্যায়ক্রমিক ছন্দ তৈরি হয়েছে, যার সঙ্গে কোয়াসিক্রিস্টাল নামক পদার্থের আরেক ধরণের অদ্ভূত দশার মিল রয়েছে। সাধারণ একটি ক্রিস্টালে শৃঙ্খলাবদ্ধ কাঠামো ও একই ধরণের কাঠামো (মৌচাক যেমন) দেখা যায়, কিন্তু কোয়াসিক্রিস্টালে শৃঙ্খলাবদ্ধ কাঠামো থাকলেও তাতে পুনরাবৃত্তি থাকে না। কারণ কোয়াসিক্রিস্টালগুলো আসলে অন্য কোনো উচ্চমাত্রায় চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ১ বা ২ মাত্রার চেহারা।
ঠিক যেভাবে কোয়াসিক্রিস্টালগুলো তাদের বাড়তি মাত্রাগুলো লুকিয়ে ফেলতে পারে, গবেষকরা দেখেছেন ঠিক একই ভাবে ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স সময়ের ক্ষেত্রে একটা বাড়তি মাত্রা লুকিয়ে রাখতে সক্ষম।
পটার বলেন, ‘কার্যত এটি আমাদের সময়ের দুটো মাত্রাকে চিড়ে-চ্যাপ্টা করে সময়ের একটা নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত করতে সহায়তা করে। আর এতে করে আমরা সার্বিকভাবে কিউবিটগুলোকে সুরক্ষা দিতে পারি।’
গবেষকরা তাদের এ পরীক্ষা কোয়ান্টাম কম্পিউটারে আটকে পড়া কিউবিটের ওপর করে দেখেছেন যে, ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স ব্যবহার করা লেসার পালসগুলো পরীক্ষা চলাকালীন পুরো সময় (৫.৫ সেকেন্ড) কিউবিটগুলোকে স্থির রাখতে সক্ষম হয়েছে। সাধারণ লেসার পালসের ক্ষেত্রে এ সময়টা ১.৫ সেকেন্ড।
যদিও এ গবেষণা দিয়ে এখনই কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের সব ত্রুটি দূর করা যাবে না, তবে পটারের মতে কোনো পদ্ধতি ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম মেমোরি ও কম্পিউটিংয়ের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে সেটার একটা ধারণা এ থেকে পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, ‘এ পরীক্ষাগুলো থেকে অন্তত এটা প্রমাণ হয়েছে যে, ভুল আর গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির ত্রুটির প্রতি সংবেদনশীল নয় এমন কোয়ান্টাম সিস্টেমকে নিজেদের কাজে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের উপায় রয়েছে। আমি আশাবাদী এটি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হতে পারে।’
প্রচলিত জাতের মিষ্টি আলুর চেয়ে বেশি পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এবং দুই থেকে তিন গুণ বেশি ফলনের নতুন তিনটি জাত উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।
দুই বছর গবেষণার পর তারা বাউ মিষ্টি আলু-৪, বাউ মিষ্টি আলু-৫ এবং বাউ মিষ্টি আলু-৬ উদ্ভাবন করেছেন।
এই গবেষণার প্রধান গবেষক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক আরিফ হাসান খান রবিন। তার সঙ্গে ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবেদাতুন নাহার।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, মিষ্টি আলুর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে অনেকেই জানে না। এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ, বি, সিসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ আছে।
দেশে এই আলুর গড় উৎপাদন বাড়াতে এবং কৃষকপর্যায়ে চাষাবাদ লাভজনক করতে ২০২০ সালের শুরুতে ইন্টারন্যাশনাল পটেটো সেন্টারের অর্থায়নে তিনটি নতুন জাত নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। ধারাবাহিক গবেষণায় জাত উদ্ভাবনে সফলতা মিলেছে।
গবেষক জোবেদাতুন নাহার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচলিত যেকোনো মিষ্টি আলুর চেয়ে উদ্ভাবিত নতুন জাতগুলোতে রয়েছে অধিক পুষ্টিমান। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘জাতগুলোর জীবনকাল স্বল্প এবং একটি জাত সারা বছর চাষযোগ্য হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হবেন।’
অধ্যাপক আরিফ হাসান খান রবিন বলেন, ‘আবাদি জমি ছাড়াও একটি জাত সারা বছর সবজি হিসেবে ছাদবাগানে, গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আশপাশে, পুকুর পাড়ে বা যেকোনো জায়গায় স্বল্প পরিসরে চাষ করা সম্ভব।
‘ডাল কাটিংয়ের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করায় বীজ সংগ্রহ করতে বা কিনতে তেমন অর্থ ব্যয় হবে না। তাই অল্প খরচে এই ফসল চাষ করে কৃষকরা অনেক লাভবান হতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন জাতগুলোর চারা এখন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ও কিশোরগঞ্জে উৎপাদন করা হচ্ছে। এর ফলন প্রচলিত গড় ফলনের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি। বাংলাদেশে শুধু বারি-১২ জাত সারা বছর চাষ করা যায়। তবে এর আবাদ ও ফলন বেশ কম।
‘বাউ মিষ্টি আলু-৪ অক্টোবর থেকে নভেম্বরে লাগাতে হবে এবং ফলন পাওয়া যাবে ফেব্রুয়ারি-মার্চে। বাউ মিষ্টি আলু-৫ শীত ছাড়াও বছরের অন্য সময় চাষের উপযোগী আর বাউ-৬ আগাম জাতের। আগামী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে মাঠ দিবসের মাধ্যমে আমরা এসব জাতের চারা কৃষকদের মাঝে বিতরণ করব।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে মিষ্টি আলুর আবাদ হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ফলন হয় ১০ টন। আর একজন মানুষ বছরে গড়ে মিষ্টি আলু খায় ১ কেজি ৭৫ গ্রাম।
আরও পড়ুন:ব্রয়লার মুরগির মাংস ও লেয়ার মুরগির ডিমে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধকরণে সাফল্য পাওয়ার দাবি করেছে একটি প্রতিষ্ঠান।
বাকৃবি সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন আপিজ সেইফ ফুড এগ্রো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিকরুল হাকিম।
তিনি জানান, ২০১৬ সালে বাকৃবির চারজন তরুণ শিক্ষার্থীর উদ্যোগে আপিজ সেইফ ফুড এগ্রো লিমিটেড যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান কৃষিবিদ মোহাম্মদ আহসান হাবিব ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সমন্বয়ে গঠিত ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট টিম’ মুরগির মাংস ও ডিমকে ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ করার গবেষণাটি শুরু করে। ২০২২ সালের এপ্রিলে গবেষণা শেষ হয়।
প্রকল্পটিতে মূলত মুরগির খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্য গ্রহণে পরিবর্তন আনা হয়। মুরগিকে প্রতিদিনের খাদ্যের সঙ্গে কড লিভার অয়েল, ফ্ল্যাক্স সিড অয়েল, ফিশ অয়েল ইত্যাদি ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ উপাদান সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রতিষ্ঠানটি দেশে প্রথম ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ মুরগির মাংস উৎপাদন করতে পেরেছে দাবি করে তিনি আরও বলেন, ‘‘নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের জোগান দেয়া এবং দেশের মেধাবী ও পরিশ্রমী জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃষিক্ষেত্রে সমৃদ্ধি আনা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য।
‘‘ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ ‘সেইফ ওমেগা-৩ ব্রয়লার’ ও ‘সেইফ ওমেগা-৩ এগ’ শিগগিরই বাজারজাত করবে বেসরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি।’’
দাম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সাধারণ ব্রয়লার মুরগির মাংসের দাম কেজিপ্রতি ২৮০-২৯০ টাকা হলেও ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ব্রয়লার মুরগির মাংসের দাম হবে কেজিপ্রতি ৫৯০ টাকা।
‘সাধারণ লেয়ার মুরগির ডিমের দাম প্রতি ডজন ১২০ টাকা হলেও ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ডিমের দাম হবে প্রতি ডজন ২২৫ টাকা। আগামী সপ্তাহ থেকেই ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন সুপারশপে পণ্যগুলো কিনতে পাওয়া যাবে।’
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক কৃষিবিদ মো. আহসান হাবীব বলেন, ‘গবেষণায় লেয়ার মুরগির ডিমের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ গ্রামে ৩৭৪ দশমিক ২৯ মিলিগ্রাম ও ব্রয়লার মুরগির মাংসের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ গ্রামে ১৮৭ দশমিক ১৫ মিলিগ্রাম ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া গেছে, যা ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রা থেকে বেশি।’
গবেষণায় পাওয়া ফল বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) পরীক্ষা করেছে বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন:বস্ত্র ও পোশাক শিল্পে নতুন উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে টেক্সটাইল ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রামের সপ্তম সিজনের সমাপনী হয়েছে।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রকল্প প্রদর্শন করে পুরস্কার পেয়েছেন পাঁচ শিক্ষার্থী।
ঢাকার এজি কনফারেন্স হলে মঙ্গলবার সপ্তম সিজনের সমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে টেক্সটাইল টুডে।
অনুষ্ঠানে পোশাক শিল্পে আমূল পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রকল্পের ফল প্রদর্শন করা হয়। বিচারকরা প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে বিজয়ী ও রানারআপ নির্ধারণ করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘যদি পিএইচডি এবং ডক্টরেট ডিগ্রিগুলো টেক্সটাইল শিল্পকে আরও সামনে এগিয়ে নিতে ও কার্যত সহায়তা না করতে পারে, তাহলে এই ডিগ্রিগুলো মূল্যহীন।’
বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘একইভাবে বিজিএমইএও উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আর বিজিএমইএ আগামী মাস থেকে বিজিএমইএর উত্তরা অফিসে একটি ইনোভেশন সেন্টার খুলছে।
‘এই ইনোভেশন সেন্টার আমাদের পোশাক রপ্তানি খাতে আরও বৈচিত্র্য আনতে সাহায্য করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
বিজিএমইএর পরিচালক ও টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, ‘বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে টেক্সটাইল শিল্পের এগিয়ে যাওয়ার জন্য ইনোভেশনই একমাত্র চাবিকাঠি।’
টেক্সটাইল টুডের প্রতিষ্ঠাতা তারেক আমিন বলেন, ‘সপ্তম সিজনে নতুন মডেলের সঙ্গে আমরা সঠিক প্রতিভা আবিষ্কারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছি।’
টেক্সটাইল ট্যালেন্ট হান্ট (টিটিএইচ) টেক্সটাইল টুডের উদ্যোগ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস এবং ফ্যাশনে অধ্যয়নরত স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে প্রতিভা খোঁজার প্রতিযোগিতা এটি।
টেক্সটাইল টুডে ২০০৮ সাল থেকে টেক্সটাইল ট্যালেন্ট হান্ট ইভেন্টের আয়োজন করে আসছে। এর মাধ্যমে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস এবং ফ্যাশনে অধ্যয়নরত স্নাতক শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা এবং শেখার প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমসহ আরও অনেকে। অনুষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন বিজিএমইএর পরিচালক ও টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ হিল রাকিব।
বিজয়ী কারা
১. বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সটাইলের সাদমান সাকিব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তার প্রকল্পের নাম ‘পোশাক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আরএফআইডি ভিত্তিক ট্র্যাকিং সিস্টেমের সঙ্গে আইওটি বাস্তবায়ন’।
২. প্রথম রানারআপ হয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের তানভীর হোসেন। তার প্রকল্পের নাম ‘ডেভেলপিং জুট-কটন ব্লেন্ড মেলাঞ্জ ইয়ার্ন’।
৩. ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. তানভীর হোসেন, ‘ইলেক্ট্রোস্পিনিং টেকনিক ব্যবহার করে পুনর্ব্যবহৃত পিইটি বোতল থেকে ইলেক্ট্রোস্পুন ন্যানোফাইব্রাস ফেসমাস্কের বিকাশ’ বিষয়ে উপস্থাপনা করে দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছেন।
৪. তৃতীয় রানারআপ হয়েছেন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, চট্টগ্রামের মুশফিক আহমেদ। ‘এ ক্রিটিকাল রিভিউ: টেকসই উৎস থেকে অ্যাসিটিক অ্যাসিডের উৎপাদন ও পরিশোধন প্রক্রিয়া’ শীর্ষক উপস্থাপনা করেন তিনি।
৫. শেখ কামাল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী মো. একুব হোসেন হৃদয় চতুর্থ রানারআপ হয়েছেন।
অনুষ্ঠানটি পরিবেশন করেছে টিম গ্রুপ ও ডাইসিন গ্রুপ।
আরও পড়ুন:হলুদের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) একদল গবেষক। নাম দিয়েছেন বিনাহলুদ-১।
গবেষকদের দাবি, রোগ সহনশীল এই জাতের ফলন প্রচলিত জাতের দ্বিগুণ। সারা দেশের কৃষক নতুন এই জাতের উৎপাদনে নামলে বাজারে হলুদের ঘাটতি থাকবে না। বাজারে সবচেয়ে সস্তা মসলার নামটি হবে হলুদ।
বিনার বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে হলুদ বিপ্লবের অপেক্ষায় আছেন।
হলুদের নতুন জাত উদ্ভাবনে গবেষকদের নেতৃত্ব দেন বিনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. রফিকুল ইসলাম। সহযোগী গবেষক ছিলেন একই বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শামসুল আলম মিঠু, সাদিয়া তাসমীন, ফরিদ আহম্মেদ ও নাজমুল হাসান মেহেদী।
বিনা জানায়, ভারতের আসামে উৎপাদিত একটি জাত থেকে হলুদের জার্মপ্লাজম আনা হয়। ২০১৭ সালের শুরুতে পুরোদমে গবেষণা শুরু হয়। সংগৃহীত জার্মপ্লাজম বিনার প্রধান কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন উপকেন্দ্রে বাছাই প্রক্রিয়ায় BHL-1 নামক কৌলিক সারি শনাক্ত করা হয়।
সারিটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ২০১৯ সালে সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়। একই বছর জাতীয় বীজ বোর্ড কৌলিক সারিটিকে বিনাহলুদ-১ নামে নিবন্ধন করে। এখন কৃষক পর্যায়ে হলুদের নতুন জাতটি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
জাতটির সহযোগী গবেষক সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শামসুল আলম মিঠু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিন বছর গবেষণা করে জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটি চাষে অধিক ফলন পাবেন কৃষক। জাতটি সারা দেশে কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কৃষকরা এটি চাষাবাদে আগ্রহী হলে বাংলাদেশে হলুদের বিপ্লব ঘটবে।’
বিনাহলুদ-১-এর বৈশিষ্ট্য
ড. শামসুল আলম বলেন, ‘নতুন জাতে প্রতি হেক্টরে ৩০ থেকে ৩৩ টন ফলন হয়। যা প্রচলিত জাতের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এতে গাঢ় হলুদ ও শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ শতকরা ৩৮ থেকে ৪০ ভাগ। গাছ লম্বা আকৃতির, পাতা গাঢ় সবুজ ও লম্বা। পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা ১২৫ থেকে ১৪৫ সেন্টিমিটার। প্রতি গাছে ছড়ার সংখ্যা ২৫ থেকে ২৮টি। ছড়া ১২ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার চওড়া।
‘এটি পাহাড়ি ও সমতলে চাষ উপযোগী। সেদ্ধ করে শুকালে রঙের পার্থক্য হয় না এবং রান্নায় তিতাভাব থাকে না। লিফব্লচ ও রাইজোম রট রোগসহনশীল। বপনের ৩১০ দিনের মধ্যে ফলন সংগ্রহ করা যায়।’
চাষ পদ্ধতি
ড. শামসুল আলম মিঠু চাষাবাদ সম্পর্কে বলেন, ‘চৈত্র (মধ্য মে থেকে মধ্য এপ্রিল) মাস কন্দ লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে, মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে (বৈশাখের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত) হলুদের কন্দ রোপণ করা যায়। রোপণের জন্য পরিপুষ্ট, চকচকে ও রোগবালাইমুক্ত কন্দ নির্বাচন করতে হয়।
‘রোপণের ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা আগে ব্যভিস্টিন/স্কোর ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে কন্দ ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর পানি থেকে কন্দ তুলে ছায়ায় শুকিয়ে মূল জমিতে রোপণ করতে হয়। গাছের ওপরের অংশ সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে ফসল সংগ্রহ করা লাগে। ফেব্রুয়ারি ফসল তোলার উপযুক্ত সময়।’
ফলন বাড়ানোর পরিকল্পনা
বিনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিনাহলুদ-১ জাত নিয়ে নানা পরিকল্পনা রয়েছে। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, নীলফামারী ও পার্বত্য জেলাগুলোতে জাতটি ব্যাপক চাষাবাদের জন্য কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে ফুলবাড়িয়ায় প্রদর্শনী হিসেবে ৫০ শতাংশ জমিতে বিনাহলুদ-১ চাষ হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক কৃষককে নতুন জাতটি বিনা মূল্যে দেয়া হয়েছে। কৃষকরা জাতটি একবার চাষে দ্বিগুণ ফলন পেলে প্রতিবার চাষ করবেন। কৃষকদের দোরগোড়ায় জাতটি ছড়িয়ে দিতে পারলে বাজারে সবচেয়ে সস্তা মসলার নাম হবে হলুদ।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক মো. মতিউজ্জামান বলেন, ‘ময়মনসিংহের কৃষকরা কুমারিকা জাতের হলুদ আবাদ করেন। জেলায় গত বছর ১ হাজার ৭৬১ হেক্টর জমিতে এটি চাষ হয়েছে। এ জাতে প্রতি হেক্টর জমিতে ১৫ থেকে ২০ টন ফলন হয়। বিনাহলুদ-১ উদ্ভাবনের তথ্য কৃষকদের জানানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বিনাহলুদ-১ চাষে প্রতি হেক্টরে ৩০ থেকে ৩৩ টন ফলন হলে কৃষকরাই লাভবান হবেন। নতুন এ জাত চাষের আওতায় আনতে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’
আরও পড়ুন:ভারত থেকে তিন বছর পর আর পাটবীজ আনতে হবে না জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা প্রতিবেশী দেশের তুলনায় ভালো পাটবীজ উদ্ভাবন করেছেন।
জাতীয় পাট দিবস উপলক্ষে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে রোববার এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী এ কথা বলেন।
বস্ত্র ও পাটসচিব মো. আব্দুর রউফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মির্জা আজম এবং বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা একদম পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ করেছি কীভাবে পেঁয়াজ ও পাটসহ অন্যান্য ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা যায়। চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই তা সম্ভব হবে। এ জন্য দেশে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। পাট ও পেঁয়াজে পার্শ্ববর্তী দেশ বা অন্যের নির্ভরতা আর থাকবে না।
‘এখন আমাদের পাটবীজ আনতে হয় ভারত থেকে, তবে আমাদের বিজ্ঞানীরা জিন টেকনোলজি ব্যবহার করে ভারতের চেয়েও উন্নত বীজ আবিষ্কার (উদ্ভাবন) করেছে। এই বীজ এরই মধ্যে কৃষক পর্যায়ে দেয়া শুরু হয়েছে। উৎপাদনশীলতা ভালো; আঁশও ভালো। তিন বছর পর ভারত থেকে বীজ আমদানি করতে হবে না।’
অনুষ্ঠান আয়োজকদের সমালোচনা করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে চেতনা তৈরি হয়েছে। মানুষ এখন পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যবহারে ঝুঁকছে, কিন্তু এখানে যে ফুল ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্লাস্টিকের। এটা কি ঠিক হয়েছে? আমরা কেন প্লাস্টিকের ফুল ব্যবহার করব?
‘যশোরের গদখালী যান, শ্রীপুর যান। কত কষ্ট করে চাষিরা ফুল উৎপাদন করেন। সে ফুলের দাম পান না তারা, নানান সমস্যা। আমরা বলছি, পরিবেশকে রক্ষা করব। সেখানে পাট মন্ত্রণালয়ের এই প্লাস্টিকের ফুল ব্যবহার করা কি ঠিক হয়েছে? প্লাস্টিকের ফুল আমদানি আমরা বন্ধ করতে পারব না, তবে ট্যাক্স বাড়াতে পারব, দাম বাড়াতে পারব, ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারব। আর চাষিদের আমরা উৎসাহিত করতে পারব; দেশকে বাঁচাতে পারব।’
পাট রপ্তানি নিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী পাটসহ সব কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছেন, কিন্তু পাটের ক্ষেত্রে সেখানে তিন স্তরের প্রণোদনা রয়েছে। ফলে সব পাটপণ্য রপ্তানিকারক ২০ শতাংশ প্রণোদনা পাচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সব পাটপণ্য রপ্তানিকারকের জন্য ২০ শতাংশ প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘পাট রপ্তানিতে আমরা বিপ্লব ঘটাব এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের পাট নিয়ে যে প্রতিযোগিতা, সেটা মোকাবিলা করে আমাদের সোনালি আঁশের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকব।’
পাটের বৈশ্বিক চাহিদা নিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে পাটের চাহিদা বাড়ছে। তাই উৎপাদনশীলতা বাড়াতে না পারলে টিকে থাকা অনেক কঠিন হবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে।
‘সারা পৃথিবীতে পরিবেশবান্ধব হিসেবে পাটের যে চেতনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটিকে আমাদের ব্যবহার করতে হবে। পাটের সম্ভাবনা অসীম, তবে প্রযুক্তি দিয়ে সেখানে আমাদের টিকে থাকতে হবে।’
পাট দিবস উপলক্ষে পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে অবদানের জন্য ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
এবার পাট দিবসের স্লোগান ‘সোনালি আঁশের সোনার দেশ, পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ।’
এর আগে দিবসটি উপলক্ষে সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন থেকে আব্দুল গনি রোডে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি হয়। পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে র্যালির উদ্বোধন করেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।
লেবুর হালি কত হতে পারে? ১০, ২০, ৫০ কিংবা বড়জোর ১০০ টাকা। এই তো হওয়ার কথা। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই যে, সিলেটে এখন লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকায়! তবে এটি সাধারণ লেবু নয়, বিশেষ জাতের এই লেবুর নাম- জারা।
বিশেষ এই লেবুটি দেশের মধ্যে কেবল সিলেট জেলাতেই চাষ হয়। আর হয় সিলেটের পার্শ্ববর্তী ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে।
সিলেটে ব্যাপক জনপ্রিয় এই ফল রপ্তানিও হয়। ফলে বছরজুড়েই এর চাহিদা থাকে। দামও থাকে আকাশছোঁয়া।
আকারেও বিশাল এই লেবুর একেকটা বড় পেঁপের মতো হয়। ফলে একেকটির ওজন এক থেকে দুই কেজিও ছাড়িয়ে যায়।
রোববার সিলেট নগরের বন্দরবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতি হালি জারা লেবু ৩ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর একটি করে কিনলে দাম পড়ছে ৮০০ টাকা।
জারা লেবুর সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায়। সম্প্রতি এই উপজেলার হরিপুর বাজারে গিয়েও দেখা যায়, প্রতি হালি লেবু ৩ হাজার টাকা দাম হাঁকাচ্ছেন বিক্রেতা।
জারা কী
জারা একটি সাইট্রাস গোত্রের লেবু জাতীয় ফল। এর বৈজ্ঞানিক নাম sytrus medica. আর্দ্র ও অম্লীয় মাটি এবং উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে ফলে এই লেবু। এটি চাষে প্রচুর বৃষ্টিপাতেরও প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে সিলেটের জৈন্তাপুরে রয়েছে সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র। দীর্ঘদিন ধরে জারা নিয়ে গবেষণা চলছে এই কেন্দ্রে। উদ্ভাবন করা হয়েছে নতুন জাতও।
এই গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন ভূইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জারা লেবু সাইট্রাস গোত্রের মধ্যে ইউনিক ফল। এর সঙ্গে অন্য কোনো জাত মিলবে না। সাইট্রাস গোত্রের আদি তিনটি ফলের মধ্যে রয়েছে কমলা, বাতাবি লেবু ও জারা লেবু। এগুলোর মধ্যে সংমশ্রিণ হয়ে এবং প্রাকৃতিক উপায়ে হাইব্রিড হয়ে পরে আরও অনেক জাতের সৃষ্টি হয়েছে।’
স্বাদ ও গন্ধে জারা লেবু ‘ইউনিক’ উল্লেখ করে বোরহান উদ্দিন জানান, এর উৎপত্তি সিলেটের আরও উপরে, আসাম ও মেঘালয়ের পাহাড়ে। জারার অনেকগুলো ধরন রয়েছে। এর মধ্যে গোল জারা, গুটি জারা ও পানি জারা সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। সিলেট অঞ্চলে মূলত গুটি ও পানি জারা চাষ হয় বলে জানান তিনি।
বোরহান উদ্দিন ভূইয়া বলেন, ‘আমরা ২০১৯ সালে বারি-১ নামে জারার একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করে উন্মুক্ত করেছি। এখন আরও কয়েকটি জাত নিয়ে কাজ করছি।’
সিলেটের মাটিকে জারা চাষের উপযুক্ত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জারা চাষের জন্য টিলাভূমির অম্লীয় মাটি প্রয়োজন। যেখানে প্রচুর বৃষ্টি হবে। কিন্তু পানি জমে থাকবে না। দ্রুত নিষ্কাষণ হবে। এ কারণে সিলেট এই ফল চাষের উপযুক্ত।’
কীভাবে খাওয়া হয়
সাধারণত লেবুর রসটুকুই গ্রহণ করে মানুষ। তবে জারা লেবুর খোসা আর চামড়াও খাওয়া যায়। এই লেবুর চামড়া ও খোসা বেশ পুরু। আর রসের পরিমাণ খুবই কম। এ ক্ষেত্রে সালাদ হিসাবে জারা লেবুর কদর সবচেয়ে বেশি। এটি দিয়ে আচারও তৈরি হয়।
এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘জারা লেবুর খোসা ও চামড়ায় একটি বিশেষ ধরনের মিষ্টি স্বাদ রয়েছে। এর গন্ধও আলাদা। স্বাদ ও গন্ধের কারণেই এটি ভোজনরসিকদের প্রিয়।’
তিনি জানান, সাইট্রাস গোত্রের ফলের মধ্যে শুধু জারার চামড়াই রান্না করে কিংবা রান্না ছাড়াই খাওয়া যায়।
সিলেটের রন্ধনশিল্পী সেলিনা চৌধুরী বলেন, ‘জারা লেবুর রসের স্বাদ টক আর খোসা মিষ্টি। এর রস বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে খাওয়া হয়। আর খোসা ও চামড়া সালাদের পাশাপাশি তরকারি বিশেষ করে মাছের সঙ্গে রান্না করে খাওয়া হয়। খোসা দিয়ে হয় আচারও।’
তবে মাংসের সঙ্গে জারার খোসা রান্না করা যায় না জানিয়ে সেলিনা বলেন, ‘এতে মাংসের স্বাদ তেতো হয়ে যায়।’
কোথায় চাষ
সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলার টিলাভূমিতে জারা লেবুর চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় জৈন্তাপুর উপজেলায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, জেলায় জারা লেবুর প্রায় ১৫০টি বাগান রয়েছে। এর মধ্যে জৈন্তাপুর উপজেলায়ই রয়েছে প্রায় ৬০টি। তবে বছরে কী পরিমাণ জারা উৎপাদন হয় তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই কৃষি অফিসের কাছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই লেবু চাষ খুবই লাভজনক। কারণ এর ক্রেতা মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। সিলেটের প্রচুর মানুষ ইউরোপ আমেরিকায় থাকেন। তারাই এই লেবুগুলো কিনেন। ফলে এগুলো অনেক উচ্চ দামে বিক্রি হয়। সিলেট ছাড়াও দেশের অন্যান্য স্থানেও এই লেবুর চাহিদা বাড়ছে। ফলে জারা চাষ করে সহজেই লাভবান হওয়া সম্ভব।’
তিনি জানান, সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে চারা রোপনের এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে জারার ফল ধরে। একটি গাছ থেকে অনেক বছর ফলন পাওয়া যায়।
এখন সিলেটের বাইরে অনেকে ছাদবাগানেও জারা চাষ করছেন বলেও জানান তিনি।
জৈন্তাপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের বাগেরখাল গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ৫০ শতক ভূমিতে লেবু চাষ করি। সাধারণত বর্ষকালে এর ফলন হয়।’
আগে কেবল নিজেরা খাওয়ার জন্য চাষ করতেন জানিয়ে সাইফুল বলেন, ‘এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছি। গত বছরও প্রায় লাখ টাকার জারা বিক্রি করেছি। বাজারেও নিয়ে যেতে হয়নি। বাগান থেকে ব্যবসায়ীরা এসে নিয়ে গেছেন।’
এই এলাকার আরেক লেবু চাষী খাইয়রুল ইসলাম বলেন, ‘পরিণত একেকটি গাছে সহস্রাধিক লেবু ধরে। তবে বৃষ্টি ভালো না হলে ফলন কমে যায়। লেবুতে নানা পোকাও আক্রমণ করে।’
এতো দাম কেন
সম্প্রতি জৈন্তাপুরের হরিপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাহার উদ্দিন নামে এক বিক্রেতা গোটা বিশেক জারা লেবু নিয়ে বসেছেন। এর মধ্যে বড় আকারের প্রতি হালি জারার দাম তিনি ৩ হাজার টাকা করে চাইছেন।
লেবুর এমন দামের বিষয়ে জানতে চাইলে বাহার বলেন, ‘এখন তো লেবুর সিজন না। এটি বর্ষাকালে ভালো পাওয়া যায়। এখন নানা জায়গা থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনে আনতে হয়। ফলে দামও বেশি।’
সিলেট নগরের মধ্যে কেবল বন্দরবাজারে গিয়ে জারা লেবু বিক্রি হতে দেখা গেছে। এখানে আকৃতিভেদে দামের তারতম্য রয়েছে। বড় আকারের লেবু প্রতিটি ৮০০ টাকা ও ছোট আকারেরগুলো প্রতিটি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এই বাজারের লেবু বিক্রেতা জাহাঙ্গির আলম বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে এসব লেবুর হালি ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু এখন লেবুর মৌসুম না হওয়ায় এগুলোর দাম বেশি।’
তিনি জানান, জৈন্তাপুরের বিভিন্ন বাগান থেকে বন্দরবাজারে লেবু আসে। বাগান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা আগে কিনেন। পরে তাদের হাত ঘুরে বন্দরবাজারের খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আসে এই লেবু।
দাম বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ জানালেন রোববার ওই বাজারে জারা লেবু কিনতে আসা ফয়সল আহমদ। তিনি বলেন, ‘এই লেবুগুলোর ক্রেতা সাধারণত প্রবাসীরা। তাদের আত্মীস্বজন এগুলো কিনে বিদেশে পাঠায়। প্রবাসীরা মূল ক্রেতা হওয়ায় ব্যবসায়ীরা অহেতুক অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ কারণে আমরা এগুলো কিনতে পারছি না।’
রপ্তানি হয় না ১৫ বছর
এক সময় জারা লেবুসহ সাইট্রাস গোত্রের বিভিন্ন ফল সিলেট থেকে রপ্তানি হতো ইউরোপ ও আমেরিকায়। তবে ১৫ বছর ধরে রপ্তানি বন্ধ। ক্যাংকারস ভাইরাস সংক্রমণের কারণে ২০০৭ সালে সাইট্রাস গোত্রের ফল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা। এখনও এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়নি।
জালালাবাদ ভেজিটেবল অ্যান্ড ফ্রোজেন ফিশ এক্সপোর্টার্স গ্রুপের সভাপতি হিলকিল গুলজার জানান, ইউরোপ ও আমেরিকায় জারা লেবু, সাতকরাসহ সাইট্রাস গোত্রের ফলের বড় বাজার রয়েছে। দীর্ঘদিন রপ্তানি বন্ধ থাকায় এই বাজার এখন হারিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় সাইট্রাস ক্যাংকারস জটিলতা দূর করে সিলেটে সরকারি উদ্যোগে সবজি ও ফল রপ্তানি অঞ্চল স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছি। কৃষকদের প্রশিক্ষণের কথা বলছি। কিন্তু কোনো সুফল মিলছে না।’
সাইট্রাস গোত্রের ফল ক্যাংকারসমুক্ত করা গেলে বছরে কয়েকশ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব বলে জানান এই রপ্তানিকারক। এও জানান, রপ্তানি না হলেও এখন অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রবাসী আত্মীয়স্বজনের কাছে লেবু ও সাতকরা পাঠান।
ক্যাংকারস ভাইরাস প্রসঙ্গে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিন ভূইয়া বলেন, ‘বাগান বেশি পুরনো হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় না রেখে গাছ লাগানো, নিয়ম মেনে ওষুধ ব্যবহার না করা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবেই এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাগান ক্যাংকারসমুক্ত রাখতে আমরা চাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এর ফলে সিলেট অঞ্চলের বেরিভাগ বাগানই এখন ক্যাংকারসমুক্ত।’
আরও পড়ুন:
মন্তব্য