সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর সেখানকার কনটেইনারের হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আকাশের মেঘে মিশে গেছে। এর ফলে আগামী কয়েকদিন বৃষ্টিতে না ভিজতে সতর্ক করে একটি পোস্ট শেয়ার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের আশংকার কোনো ভিত্তি নেই। মনগড়া তথ্য প্রচার করে জনমনে ভীতি তৈরি করা হচ্ছে।
ফেসবুকে শেয়ার করা পোস্টের শেষে ‘ডিএমপি পরিচালক’ উল্লেখ রয়েছে। তবে এ ধরনের কোনো বার্তা দেয়ার তথ্য নাকচ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
ফেসবুকের পোস্টে বলা হয় (বাক্য ও বানান অপরিবর্তিত), ‘ব্রেকিং... সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে।। আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে কোন বৃষ্টি আসলে কেউ এটা তে ভিজবেন না। চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ড ভয়াবহ আগুনে যে, রাসায়নিক কেমিক্যাল গুলো ঝলসে গেছে। তার ফলে আকাশের মেঘ গুলোতে HYDROGEN PER OXIDE GAS টা মিশে গিয়েছে। সকলকে সতর্ক বার্তাটি প্রদান করুন, নিজে বাঁচুন, অন্য কে ও সাহায্য করুন৷ বিশেষ করে বৃদ্ধদের বৃষ্টির সময় ঘর থেকে বের হতে দিবেন না। -ডিএমপি পরিচালক’
ডিএমপির কর্মকর্তারা নিউজবাংলাকে জানান, ডিএমপিতে পরিচালকের কোনো পদ নেই। এই পদ ব্যবহার করে প্রচার করা ম্যাসেজটি ভুয়া।
ডিএমপির মুখপাত্র উপ-কমিশনার মো. ফারুক হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডিএমপির পক্ষ থেকে এমন কোনো ম্যাসেজ পাঠানো হয়নি। যারা এ ধরনের তথ্য ছড়াচ্ছে তাদের শনাক্তে আমাদের সাইবার টিম কাজ করছে।’
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মেঘে মিশে যাওয়ার দাবির বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. জি এম গোলজার হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মূলত ডিকম্পোজ হয়ে অক্সিজেন তৈরি হয়। এই এইচটুওটু (H2O2) মূলত হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। এটাকে ভেঙে অক্সিজেন রিলিজ হয় আর পানি তৈরি হয়। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে যদি কনটেইনারে রাখা হলে উত্তাপে অক্সিজেন রিলিজ হয়ে ব্লাস্ট (বিস্ফোরিত) হয়।’
বিএম কনটেইনার ডিপোর হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মেঘের সঙ্গে মেশার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড সেভাবে থাকবে না। ওটা ডিকম্পোজ হয়ে যাবে। ডিকম্পোজ হয়ে গেলে অক্সিজেন বাতাসের সঙ্গে চলে যাবে, আর পানিটা নিচে থাকবে। এটা মেঘের সঙ্গে মেশার কোনো সুযোগ নেই।’
একই মত দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম মিজানূর রহমান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে জ্বলে না, কিন্তু সে যখন বেশি হিটেড অবস্থায় থাকে তখন ডিকম্পোজ হয়ে অক্সিজেনের লেভেলটা বেড়ে গেলে বিস্ফোরণ ঘটে।’
মেঘের সঙ্গে এই যৌগ মিশলেও কোনো ক্ষতি নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মেঘের সঙ্গে মিশলে তখন সেটা আর হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থাকবে না। সেটা অক্সিজেনে কনভার্ট হয়ে যাবে। তখন আর কোনো ক্ষতি নেই।
একই বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে জ্বলে না, কোন কারণে হিট হলে সেটা অক্সিজেন প্রডিউস করে। আর সেই অক্সিজেন অন্যকে জ্বলতে সাহায্য করে। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ভেঙে খুব পিওর অক্সিজেন তৈরি করা যায়। আর এটা অনেক দামি হয়।’
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মেঘে মিশে মানুষের ক্ষতির কারণ হওয়ার দাবিকে ‘কাল্পনিক ও অবান্তর কথাবার্তা’ বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ওমর।
অন্যদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ শাহ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে এসিড বৃষ্টি হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও সামান্য হয়, তা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায়। কারখানা থেকে বের হওয়া ধোঁয়া বা অন্যান্য রাসায়নিক জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে বৃষ্টি শুরুর প্রথম ১-২ মিনিটে ঝরে পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সাধারণত ডিসেম্বর, জানুয়ারি মাসে, যে সময় বৃষ্টিপাত কম হয়, তখন খুবই অল্প পরিমাণে এসিড বৃষ্টি হয়ে থাকে। এতে বৃষ্টি পানির রং লালচে দেখা যায়। এই এসিড বৃষ্টিতে খুবই সামান্য ক্ষতি হয়ে থাকে। এবং তা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় হয়।
‘আমাদের দেশে এ ধরনের এসিড বৃষ্টি হলেও সীতাকুণ্ডের কনটেইনারে থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কারণে হবে না। এটা ভ্রান্ত ধারণা।’
আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ শাহ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখন বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হয় না, সেই সময়টায়- বিশেষ করে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এসিড বৃষ্টি হয়। আর তা হয় ধোঁয়ায় থাকা কার্বন ডাই অক্সাইড, সিলিকনের মতো পদার্থ মিশে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির সঙ্গে নিচে নেমে আসে এবং খুব অল্প সময়েই তা ঝরে যায়।’
আরও পড়ুন:প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে বিল ভাউচার, কোথাও কোথাও নামমাত্র বাস্তবায়ন, কোথাও আবার কৃষকের ফসলি জমিতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে প্রদর্শনী দেখিয়ে বরাদ্দের অর্থ আত্মসাতের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে এক কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে কৃষি কর্মকর্তার দাবি, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কৃষকদের সব উপকরণ বিতরণ করেছেন তিনি।
যদিও তার এমন দাবি নাকচ করেছেন সংশ্লিষ্ট উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা।
তাদের ভাষ্য, কোনো প্রদর্শনীর বরাদ্দের পরিমাণ জানেন না তারা।
অভিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তার নাম সুমন কুমার সাহা, যিনি ২০২৩ সালের ১৭ মে থেকে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায় কর্মরত।
এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে উপজেলার পাঁচটি প্রকল্পে প্রায় এক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা।
কোন প্রকল্পে কী ধরনের অনিয়মের অভিযোগ
বেশ কিছু প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রোপা আমন/বোরো ধানের প্রদর্শনী, বীজ গ্রাম প্রদর্শনী, ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন প্রদর্শনী, পার্টনার প্রকল্প, বসতবাড়িতে সবজি চাষ ও একক ফল বাগান, মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদন প্রদর্শনী ও গ্রুপ গঠন।
রোপা আমন/বোরো ধানের প্রদর্শনী
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ফ্রিপ প্রকল্পের রোপা আমন বীজ উৎপাদনের প্রদর্শনী করেন তাড়াইলের বাঁশাটি গ্রামের কামরুল ইসলাম। এর বিপরীতে তিনি উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ৩৩ শতক জমির জন্য পাঁচ কেজি বীজ, ১০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি ও ১০ কেজি এমওপি সার পান। এসব উপকরণের সর্বোচ্চ বাজারমূল্য এক হাজার টাকা।
ওই কৃষক জানান, তার মতো এমন শত শত কৃষককে এ পরিমাণ সামগ্রীই দেয়া হয়। অথচ তার অনূকূলে বরাদ্দ দেখানো হয় ১০ হাজার টাকার উপকরণ।
ফ্রিপ প্রকল্পের অধীনে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৪০৬টি প্রদর্শনী বরাদ্দ আসে তাড়াইল উপজেলায়। এগুলোতে বরাদ্দের পরিমাণ ৭৯ লাখ ৮২ হাজার ৬০০ টাকা।
এ প্রকল্পের অর্ধেকেরও বেশি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন না করার অভিযোগ পাওয়া যায় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার সাহার বিরুদ্ধে।
কামরুলের মতো আরেক কৃষক ঘোষপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম। রাজস্ব খাতের অর্থায়নে একটি বোরো ধানের প্রদর্শনী করেন তিনি।
এ কৃষক উপকরণ হিসেবে পাঁচ কেজি বীজ ধান, ১০ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি এমওপি, ১০ কেজি টিএসপি সার ও একটি সাইনবোর্ড পান। এসব উপকরণের সর্বোচ্চ বাজারমূল্য এক হাজার টাকা।
রফিক বলেন, ‘কৃষি অফিস থেকে যেগুলো দেয়, এতে আমাদের কিছুই হয় না। কৃষি অফিসের প্রদর্শনী করে আমাদের নিজেদের হাত থেকে আরও অনেক খরচ হয়।’
এ প্রদর্শনীতে রফিকের অনূকূলে ১২ হাজার টাকার উপকরণ বরাদ্দ দেখায় উপজেলা কৃষি অফিস।
তাড়াইল উপজেলায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বোরো ধান, আউশ, আমন ও সরিষার ১০০টি প্রদর্শনী বরাদ্দ আসে। রাজস্ব খাতের এসব প্রদর্শনীতে বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ টাকা।
১০০ প্রদর্শনীর মধ্যে প্রায় ৫০টি বাস্তবায়ন না করার অভিযোগ পাওয়া যায় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
বীজ গ্রাম প্রদর্শনী
এডিবির অর্থায়নে ফ্রিপ প্রকল্পের বীজ গ্রামের প্রদর্শনী করেন তাড়াইল উপজেলার আড়াইউড়া গ্রামের শামীম, কাইয়ুম, শফিক, বাদল ও কামরুল। প্রদর্শনী এলাকার জমির পরিমাণ পাঁচ একর দেখানো হলেও তা এক থেকে দেড় একর।
সাইনবোর্ডে ধানের জাত বিনা-১৭ লেখা থাকলেও খানিকটা জায়গা ছাড়া বাকি জমিগুলো অন্যান্য কৃষকের। তারা সেখানে ভিন্ন ভিন্ন ধানের চাষ করেন।
বীজ গ্রামের নির্দেশনার কোনো কিছুই মানা হয়নি প্রদর্শনীতে। মূলত প্রদর্শনীতে নাম থাকা কৃষকদের কিছু বীজ, সার, ড্রাম দিয়ে বীজ গ্রাম প্রদর্শনী বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে।
কৃষকদের ভাষ্য, তারা সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার উপকরণ পান। অথচ এ প্রদর্শনীর ব্যয় ধরা হয় দেড় লাখ টাকা।
কৃষকদের মধ্যে শামীমের নামে ময়মনসিংহ প্রকল্পেরও একটি একক ধানের প্রদর্শনী রয়েছে। বীজ গ্রামের পশ্চিম পাশের জমিটি আবার ময়মনসিংহ প্রকল্পের প্রদর্শনী। সে জমিতে শামীম চাষাবাদ করেন।
শামীমের নামে ফ্রিপ ও ময়মনসিংহ প্রকল্পের প্রদর্শনী থাকার পরও তার স্ত্রী ফরিদার নামে দেয়া হয়েছে অনাবাদি প্রকল্পের একটি সবজি বাগান প্রদর্শনী।
শামীম-ফরিদা দম্পতির সঙ্গে কথা বলে জানায়, বরাদ্দকৃত অর্থ বা উপকরণের তেমন কিছুই পাননি তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, একই পরিবারের সদস্যদের ভিন্ন ভিন্ন প্রদর্শনী বরাদ্দ দিয়ে কৃষি উপকরণ বিতরণে অনিয়ম করেন কৃষি কর্মকর্তা।
ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) উৎপাদন প্রদর্শনী
তাড়াইল উপজেলায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ফ্রিপ প্রকল্পের দুটি ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন প্রদর্শনী বরাদ্দ আসে, যার একটি পান জাওয়ার ইউনিয়নের বেলংকা গ্রামের আবদুল হেকিম।
তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সবেমাত্র ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, তবে সেখানে কেঁচো সার উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। তা ছাড়া ভার্মী কম্পোস্ট স্থাপনের যেসব নির্দেশনা আছে, সেগুলোও মানা হয়নি।
বাড়িতে এ কৃষককে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মোবাইল ফোনে কথা হলে আবদুল হেকিম জানান, ছয় মাস ধরে গাজীপুরের কালীগঞ্জে অবস্থান করছেন তিনি। কিছুদিন আগে ঘর নির্মাণের সময় বাড়িতে এসেছিলেন। আবার ১৫ দিন পর এসে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করবেন তিনি।
কৃষি অফিস থেকে কী পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপাতত একটা ঘর ছাড়া আর কিছুই পাইনি।’
যে ঘরটি পেয়েছেন তাতে কী পরিমাণ খরচ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ঘরটি করতে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে ধারণা তার।
এ কৃষকের প্রদর্শনীতে ব্যয় ধরা ছিল দুই লাখ টাকা। এর বিপরীতে একটি শেড তৈরি করা হয়। বাকি অর্থ ব্যয় করেননি কৃষি কর্মকর্তা।
দুটি ভার্মি কম্পোস্টের অপরটি পান সেকান্দরনগর গ্রামের বাসিন্দা রানা মিয়া। মোটামুটি সব প্রকল্পেরই একটি করে প্রদর্শনী পান তিনি। এর মধ্যে ফ্রিপ প্রকল্পের একটি ভার্মি কম্পোস্ট ও বস্তায় আদা চাষ প্রদর্শনী, ময়মনসিংহ প্রকল্পের একটি ভার্মি কম্পোস্ট, অনাবাদি প্রকল্পের একটি সবজি বাগান রয়েছে তার বাড়িতে।
রানা জানান, সার উৎপাদনের জন্য ঘর নির্মাণ করে তাকে কিছু কেঁচো দিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তা। এর বাইরে আর কিছুই জানেন না তিনি।
এ কৃষকের প্রকল্পের জায়গাতে ঘর পাওয়া গেলেও সেখানে কেঁচো উৎপাদন শুরুই হয়নি।
রানা মিয়ার দাবি, তাকে সবকিছু দেয়া হয়েছে।
প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ জানা নেই বলে দাবি করেন এ কৃষক।
প্রকল্পের প্রতিটি ভার্মি কম্পোস্ট প্রদর্শনীতে দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও কৃষকেরা তার অর্ধেকও পাননি।
দুই কৃষকের বাড়িতে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন প্রদর্শনীর ঘরের কাজ সবে শেষ করা হলেও সাইনবোর্ডে স্থাপনের তারিখ দেয়া আছে চলতি বছরের ৩০ জুন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, এ দুটি ভার্মি কম্পোস্ট প্রদর্শনী স্থাপন না করে আত্মসাৎ করার পাঁয়তারা করছিলেন কৃষি কর্মকর্তা, কিন্তু উপ-পরিচালকের কার্যালয় থেকে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হলে তড়িঘড়ি করে বাস্তবায়ন করেন তিনি।
কৃষি অফিসের এ কর্মকর্তা আরও জানান, একই অর্থবছরে ময়মনসিংহ প্রকল্পের আরও ছয়টি ভার্মি কম্পোস্ট প্রদর্শনীর বরাদ্দ আসে তাড়াইল উপজেলায়। এগুলোরও বেশির ভাগ নামমাত্র বাস্তবায়ন করার অভিযোগ রয়েছে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
পার্টনার প্রকল্প
তাড়াইলের নন্দীপুর গ্রামের মাসুদা বেগম, নায়না, রিনা, শিবলী আর জাহানারা বেগম মিলে করেন কমিউনিটি বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি প্রদর্শনী।
তারা জানান, প্রত্যেককে পাঁচ কেজি করে বীজ, পাঁচ কেজি করে ইউরিয়া সার, দুটি করে ড্রাম আর দুটি কীটনাশকের বোতল ছাড়া কিছুই দেয়া হয়নি। তারা যেগুলো পেয়েছেন, সেগুলোর বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা। অথচ তাদের অনূকূলে বরাদ্দ দেখানো হয় ৫০ হাজার টাকা।
তাদের মধ্যে জাহানারা বেগমের নামে একটি রোপা আমন বীজ উৎপাদন প্রদর্শনী রয়েছে। সে প্রকল্পে একটি সাইনবোর্ড ছাড়া কিছুই পাননি জাহানারা।
শুধু তাড়াইল উপজেলাতেই ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে আটটি পার্টনার ফিল্ড স্কুলের জন্য আট লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। সেগুলোর বেশির ভাগ নামমাত্র বাস্তবায়নের পাশাপাশি কৃষকদের খাবার ও নাশতার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
বসতবাড়িতে সবজি চাষ ও একক ফল বাগান
বাড়ির পাশে এক খণ্ড জমিতে অনাবাদি প্রকল্পের অধীনে মাচায় সবজি চাষ করেন তালজাঙ্গা ইউনিয়নের আড়াইউড়া গ্রামের ফরিদা বেগম। তার বাগানে টাঙানো ছিল কৃষি অফিসের সাইনবোর্ড।
ফরিদার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
এ কিষাণী জানান, একটি সাইনবোর্ড, চারটি ফট (ফেরোমন ট্র্যাপ) আর কিছু কীটনাশক পেয়েছেন। এ ছাড়া বাগানের সবকিছুই তার নিজস্ব খরচে করা।
তার অভিযোগ, হাঁস-মুরগি বাগানের অনেক কিছু নষ্ট করে ফেলেছে। একটি নেট আবদার করেও পাননি। এমন পরিস্থিতিতে নিজের খরচে বাঁশ, নেট, মাচা তৈরি করেছেন এ নারী। অথচ তার অনূকূলে কৃষি অফিসের স্টক রেজিস্টারে বীজ ও চারা, রাসায়নিক সার, জৈব সার বরাদ্দ ও পরিবহন খরচ দেখানো হয়েছে।
একই ইউনিয়নের বাঁশাটি গ্রামের সাইফুল ইসলাম বিগত কয়েক বছর ধরে রাস্তার পাশের একটি জমিতে লাউ, কুমড়া চাষবাদ করেন। বছরখানেক আগে জমিটিতে কুমড়া লাগিয়েছিলেন। কুমড়া শেষ করে এখন চাষ করেছেন লাউ।
তিনি জানান, কয়েক দিন আগে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এসে তাকে বললেন, ‘আপনাকে একটা সাইনবোর্ড দিই।’ তিনিও তার কথায় রাজি হলেন।
সাইফুল জানান, সাইনবোর্ড লাগিয়ে তিনি পড়েন বিপদে। সারাক্ষণ লোকজন তাকে কী পেয়েছেন, তা জিজ্ঞাসা করেন।
ফরিদার মতো সাইফুলও ময়মনসিংহ প্রকল্পের একটি সাইনবোর্ড আর চারটি ফেরোমন ট্র্যাপ ছাড়া আর কিছুই পাননি। তার অনূকূলেও কৃষি অফিসের স্টক রেজিস্টারে বীজ ও চারা, রাসায়নিক সার, জৈব সার, পরিবহন খরচ বরাদ্দ দেখানো হয়েছে।
ফ্রিপ প্রকল্পের একক ফল বাগানের প্রদর্শনী করেন দড়ি জাহাঙ্গীরপুর এলাকার রহিমা আক্তার। সেখানে গিয়ে কথা হয় তার স্বামী আবুল খায়েরের সঙ্গে।
খায়ের জানান, এ প্রদর্শনীতে ৪০টি আমের চারা, কিছু সার আর অল্প কিছু কীটনাশক পান। তার অনূকুলে ১২ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও তিনি সব মিলিয়ে পান ৪০টি আমের চারাসহ সাড়ে ৪ হাজার টাকার উপকরণ।
প্রদর্শনীতে বরাদ্দের পরিমাণ জানা ছিল না এ কৃষকের।
মসলাজাতীয় ফসল উৎপাদন প্রদর্শনী
বস্তায় আদা চাষের প্রদর্শনী করেন ঘোষপাড়া এলাকার শামসুল আলম রানা। কৃষি অফিস থেকে তার নামে ৪৪ হাজার টাকার উপকরণ বরাদ্দ দেখানো হলেও তিনি পান ৫ কেজি আদা আর ২০০ সাদা বস্তা।
তার অভিযোগ, কৃষি অফিস থেকে আদার যেসব বীজ পান, সেগুলো পচা। আর বস্তাগুলো ছেঁড়া। পরে নিজ উদ্যোগে সবকিছু কিনে বস্তায় আদা চাষ করেন তিনি।
তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্যাটার্নভিত্তিক একক প্রদর্শনী করেন বেলংকা গ্রামের জিয়াউর রহমান।
তিনি এ প্রদর্শনীতে পান পাঁচ কেজি বীজ ধান, এক বস্তা ডিপ সার, ১০ কেজি পটাশ আর ১৫ কেজি জৈব সার।
এ কৃষকের ভাষ্য, প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ জানা নেই তার। কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের কথা অনুযায়ী স্বাক্ষর করেন তিনি।
প্রকল্পটিতে প্রথমে ধানের প্রদর্শনী শেষে একই জমিতে একটি সরিষা এবং একটি ধানের প্রদর্শনী পাবেন তিনি। অর্থাৎ পরপর তিনটি প্রদর্শনী থাকবে তার নামে।
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের ৫০টি প্রদর্শনীতে সাত লাখ ৩১ হাজার ৮০০ টাকা বরাদ্দ দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এগুলোরও কয়েকটি নামমাত্র বাস্তবায়ন করে বাকি অর্থ নিজের কাছে রেখে দেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
গ্রুপ গঠন
কৃষকদের নিয়ে গ্রুপ গঠনেও বরাদ্দের টাকায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে কৃষি কর্মকর্তা সুমন সাহার বিরুদ্ধে।
বেশ কয়েকজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, এখানে প্রতিটি গ্রুপ গঠনে পাঁচ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও কৃষকদের বিকাশ নম্বরে ৪৫০ টাকা করে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি গ্রুপে ৩০ জন সদস্য রয়েছে, যাদের মধ্যে ২০ পুরুষ কৃষক ও ১০ নারী কৃষক।
চলতি অর্থবছরে ৬৩টি গ্রুপ গঠনে তিন লাখ ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এখান থেকেও প্রায় পৌনে ৩ লাখ টাকা তাড়াইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গ্রুপ গঠন প্রকল্পে ১ হাজার ৮৯০ জন কৃষকের খাতা, কলম ও নাশতার জন্য বরাদ্দ ছিল।
প্রান্তিক চাষিদের ক্ষোভ
তাড়াইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন সাহার ওপর ক্ষুব্ধ ঘোষপাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল গাফফার।
বাবার আমল থেকে কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল ও নিজেকে কঠোর পরিশ্রমী দাবি করা এ কৃষকের অভিযোগ, ‘যারা নিজেরা জমি চাষাবাদ করেন না, চাষাবাদ কীভাবে করতে হয়, সেটাও জানেন না, সারা দিন প্যান্ট পরে ঘোরাফেরা করে, তারাই প্রদর্শনী পায়। অথচ সারা জীবনেও কৃষির কোনো প্রদর্শনী পাইনি।
‘নিজ খরচে যেগুলো চাষাবাদ করি, সেগুলোতে কোনো সমস্যা হলে কৃষি কর্মকর্তাদের ডেকেও পাই না।’
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক দামিহা এলাকার এক কৃষকের অভিযোগ, মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা ও অফিসের সঙ্গে যাদের নিয়মিত যোগাযোগ, ঘুরেফিরে সব প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণ তারাই পেয়ে থাকেন।
আবদুল গাফফারের মতো তারও অভিযোগ, প্রকৃতপক্ষে যারা কৃষক এবং কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের কারও খোঁজখবরও নেন না কর্মকর্তারা, কিন্তু যারা নিয়মিত অফিসে দৌড়াদৌড়ি করেন, প্রদর্শনী পান তারাই।
তিনি বলেন, ‘কৃষি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও আরেক সমস্যা।’
কী সমস্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে পরবর্তীতে (পরবর্তী সময়ে) আর কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
বরাদ্দের পরিমাণ জানেন না, দাবি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের
তাড়াইল উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা দিলুফা আক্তার জানান, প্রথমে কৃষক নির্বাচন করে স্লিপ দিয়ে তাকে উপজেলা কৃষি অফিসে পাঠানো হয়। তারপর সেখান থেকে স্টক রেজিস্টারে স্বাক্ষর রেখে কৃষকের নামে বরাদ্দকৃত সব উপকরণ বুঝিয়ে দেয়া হয়।
দিলুফার ভাষ্য, কোন কৃষকের বরাদ্দের পরিমাণ কত, তা জানেন না তিনি। যা করার সবকিছু উপজেলা অফিস থেকেই সমন্বয় করা হয়।
একই বক্তব্য আরেক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা খলিলুর রহমান মিলনের।
তিনি জানান, তারা শুধু কৃষক নির্বাচন করে উপজেলা কৃষি অফিসে পাঠান। এর বাইরে কোনোকিছুতে তাদের হাতে নেই।
তাড়াইল উপজেলা কৃষি অফিসের সর্বজ্যেষ্ঠ উপ-সহকারী কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম। বিগত ৩৫ বছর ধরে কৃষকদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি। এখন তার অবসরে যাওয়ার পালা।
এ কর্মকর্তার দাবি, তিনি জানেন না কোন প্রদর্শনীতে বরাদ্দের পরিমাণ কত।
তার ভাষ্য, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তাদের সেটা জানান না। জানতে চাওয়ার সুযোগও নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ফ্রিপ, ময়মনসিংহ, পার্টনার, রাজস্ব ও অনাবাদি প্রকল্প থেকে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তাড়াইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার সাহা।
কীভাবে আত্মসাৎ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের মোট প্রদর্শনীর প্রায় অর্ধেকের মতো বাস্তবায়ন করেননি সুমন। যেগুলো বাস্তবায়ন করেছেন, সেগুলোতে নামেমাত্র কিছু উপকরণ দিয়ে কৃষকদের বঞ্চিত করা হয়েছে।’
ফাঁকা রেজিস্টার খাতায় স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগ
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এবং কৃষকদের যেখানে স্বাক্ষর নেয়া হয়, সেই রেজিস্টার খাতাটি মূলত ফাঁকা থাকে। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকরা সই করার পর অফিস সহকারী দিয়ে সেখানে বরাদ্দের পরিমাণ লিখে নেন কৃষি কর্মকর্তা। এর ফলে কোন খাতে বা কোন প্রদর্শনীতে কৃষকের অনূকূলে বরাদ্দের পরিমাণ কী, তা জানার সুযোগ থাকে না।
এ কর্মকর্তার বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় স্টক রেজিস্টার দেখে।
অভিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তার ভাষ্য
প্রকল্পে অনিয়মের সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে তাড়াইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার সাহা বলেন, ‘কৃষক শনাক্ত করা থেকে শুরু করে সকল কিছু বাস্তবায়ন করেন উপ-সহকারী কর্মকর্তারা। যদি কোনো উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা অনিয়ম করে থাকেন, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের বক্তব্যের বিষয়টি তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, ‘উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই সবকিছু বাস্তবায়ন করা হয়। তারা সকল মালামাল বুঝে নিয়ে স্টক রেজিস্টারে সই করে থাকেন।’
মালামাল বুঝে নেয়ার আগে ফাঁকা খাতায় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকদের সই নেয়ার বিধান আছে কি না, জানতে চাইলে সুমন চুপসে যান। এরপর একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘এমনটার সুযোগ নেই।’
কী বলছেন জেলা কৃষি কর্মকর্তা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এই কর্মকর্তার (সুমন সাহা) বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর তাকে শোকজ করা হয়েছে। সেই সাথে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
‘তদন্ত কমিটি প্রাথমিকভাবে তার অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। তার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন:ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট সিলেটের গোলাপগঞ্জে গুলিতে ছয়জন প্রাণ হারান। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে মরদেহের তদন্ত ছাড়াই এই ছয়জনের মরদেহ দাফন করা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ওই ঘটনায় মামলা করে নিহতদের পরিবার।
মামলার তদন্তে নেমে পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্তের জন্য নিহতদের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলনের নির্দেশ দেয় আদালত।
আদালতের এই নির্দেশনা প্রায় দেড় মাসেও তামিল হয়নি। পুলিশের দাবি, মরদেহ কবর থেকে উত্তোলনে নিহতদের স্বজনরা আগ্রহী নন। তাই আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে এসব মামলার ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, গত ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর পৃথকভাবে সিলেটের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের বিচারক আবিদা সুলতানা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছয়জনের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলনের আদেশ দেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট গোলাপগঞ্জে গুলিতে নিহত হন উপজেলার নিশ্চিন্ত গ্রামের মৃত তৈয়ব আলীর ছেলে নাজমুল ইসলাম, দক্ষিণ রায়গড় গ্রামের মৃত সুরই মিয়ার ছেলে হাসান আহমদ জয়, শিলঘাট গ্রামের কয়ছর আহমদের ছেলে সানি আহমদ, বারকোট গ্রামের মৃত মকবুল আলীর ছেলে তাজ উদ্দিন, দত্তরাইল বাসাবাড়ি এলাকার আলাই মিয়ার ছেলে মিনহাজ আহমদ ও ঘোষগাঁও ফুলবাড়ি গ্রামের মোবারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন।
ওই হত্যার ঘটনায় গোলাপগঞ্জ থানায় পৃথকভাবে ছয়টি ও আদালতে একটি মামলা করা হয়। সবক’টি মামলায় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়।
গোলাপগঞ্জ থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিহত ছয়জনের কারও মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে মামলা হলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা আদালতে মরদেহ ময়নাতদন্তের আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কবর থেকে মরদেহ তোলার আদেশ দেয় আদালত।
এ ব্যাপারে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আনোয়ার উজ জামান বলেন, ‘আদালতের আদেশ পাওয়ার পর চলতি মাসের শুরুতে চারটি মরদেহ কবর থেকে তোলার জন্য চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
‘এর মধ্যে নিহত গৌছ উদ্দিনের মরদেহ তোলার দায়িত্বে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার জনি রায়, নাজমুল ইসলামের মরদেহ উত্তোলনের দায়িত্বে জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার জর্জ মিত্র চাকমা, হাসান আহমদের মরদেহ তোলার দায়িত্বে জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ও সানি আহমদের মরদেহ উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছেন সহকারী কমিশনার মো. মাসুদ রানা।
গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মো. আব্দুন নাসের শনিবার বলেন, ‘মরদেহ উত্তোলনের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। এ ব্যাপারে উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। তবে নিহতদের স্বজনরা আমাদের মৌখিকভাবে জানিয়েছেন যে তারা কবর থেকে মরদেহ উত্তোলনে আগ্রহী নন। এ ব্যাপারে আদালতে তারা আবেদন করবেন বলেও জানিয়েছেন। তাদের আপত্তির কারণে মরদেহ উত্তোলন কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘হত্যা মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে ময়না তদন্ত প্রতিবেদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ঘটনার সময় ময়না তদন্ত ছাড়াই নিহতদের মরদেহ দাফন করা হয়েছিলো। এখন ময়না তদন্ত করা না গেলে মামলার তদন্তে সমস্যা হবে।’
ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর একটির বাদী নিহত গৌছ উদ্দিনের ভাই মো. রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘কবর থেকে লাশ না তুলতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সিলেটের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের বিচারক আবিদা সুলতানার আদালতে আমি আবেদন করেছি। তবে আদালত এখনও এ ব্যাপারে কোনো আদেশ দেননি।’
আরও পড়ুন:নেত্রকোণার মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহ আলম মিয়াকে ফাঁসাতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন নূরুল আলম কামাল মণ্ডল নামে এক কৃষক লীগ নেতা।
জানা গেছে, ওই কৃষক লীগ নেতা প্রতিবেশী খায়রুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে ইউএনওর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ দেন জেলা প্রশাসকের কাছে। পরে ওই অভিযোগের সূত্রে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়। এ নিয়ে এলাকায় শুরু হয় তোলপাড়।
প্রতারণা করে তার নাম ব্যবহার করে মিথ্যা অভিযোগের বিষয়টি জানতে পেরে খায়রুল ইসলাম চট্টগ্রাম থেকে সম্প্রতি এলাকায় এসেছেন। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারেন যে তার নাম ব্যবহার করে কৃষক লীগ নেতা নূরুল আলম কামাল মণ্ডল ইউএনওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। এ ঘটনায় ওই কৃষক লীগ নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দেন খায়রুল ইসলাম।
রোববার সকালে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস।
খায়রুল ইসলাম নেত্রকোণার মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামের মৃত সুলতু মিয়ার ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই চট্টগ্রামে পরিবারসহ বসবাস করেন এবং সেখানে দিনমজুরের কাজ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত নূরুল আলম কামাল মণ্ডল মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামের মাওলানা আব্দুল মন্নাফের ছেলে। তিনি মদন উপজেলা শাখা কৃষক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক।
স্থানীয় লোকজন ও লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, জলমহাল থেকে রাজস্ব আত্মসাতের কথা উল্লেখ করে গত ৪ সেপ্টেম্বর মদনের ইউএনওর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেন গোবিন্দশ্রী গ্রামের খায়রুল ইসলাম। কিন্তু খায়রুল ইসলাম কয়েক বছর ধরে জীবিকার তাগিদে পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে বসবাস করছেন। ইউএনওর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
খায়রুল ইসলাম নিরক্ষর। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার টিপসহি থাকলেও অভিযোগে খায়রুল ইসলামের স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। এ নিয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি হলে খায়রুল ইসলামের সঙ্গে স্থানীয় সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা যোগাযোগ করেন। খবর পেয়ে তিনি চট্টগ্রাম থেকে মদনে আসেন। পরে জানতে পারেন তার নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কৃষক লীগ নেতা গোবিন্দশ্রী গ্রামের প্রতিবেশী নূরুল আলম কামাল মণ্ডল ইউএনওর বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ দায়ের করেছেন।
প্রতারণা করে হয়রানি করার জন্য কামালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে ২ অক্টোবর জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন খায়রুল ইসলাম।
খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাই। ছয় মাস আগে একবার বাড়িতে এসেছিলাম। এর পর আর বাড়ি আসা হয়নি। এখন আমার নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ইউএনও স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি তো ইউএনও স্যারকে চিনি না। জীবনে কখনও তাকে দেখিনি। আমি জীবনে ডিসি স্যারের অফিসেও যাইনি।’
তিনি বলেন, ‘বাড়িতে এসে জানতে পারলাম প্রতিবেশী কৃষক লীগ নেতা কামাল মণ্ডল আমার নাম ব্যবহার করে ডিসি অফিসে অভিযোগ করেছেন। ওই ভুয়া অভিযোগপত্রে দেখলাম আমার স্বাক্ষর রয়েছে। অথচ আমি নিরক্ষর মানুষ, ভোটার আইডিতেও টিপসহি দিয়েছি। তাই এই ঘটনায় জড়িত কামাল মণ্ডলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ডিসি মহোদয়ের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। আমি চাই এমন প্রতারণা করার সাহস আর কেউ যেস না করে।’
গোবিন্দশ্রী গ্রামের মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘কৃষক লীগ নেতা কামাল মণ্ডল দলীয় প্রভাবে এলাকার খাল ও খাস জমি দখল করে বিক্রি করেছেন। প্রভাব টিকিয়ে রাখতে কয়েক মাস আগে তিনি সাংবাদিক পরিচয়ে কার্ডও নিয়েছেন। খায়রুল ইসলামের মতো একজন নিরীহ মানুষের নাম ব্যবহার করে ইউএনওর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করার আমরা প্রতিবাদ জানাই।’
অভিযুক্ত কৃষক লীগ নেতা কে এইচ এম নূরুল আলম কামাল বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এটা কাদা ছোড়াছুড়ি ছাড়া আর কিছু নয়।’
মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহ আলম মিয়া বলেন, ‘গত মাসে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়ার খবর শুনেছি। আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে প্রশাসন অবশ্যই আমার বিরুদ্ধে যথাযথ নেবে। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কেউ এ কাজ করে থাকলে তদন্তের মাধ্যমে তা বের হয়ে আসুক। অপরাধী যেই হোক তার বিরুদ্ধে যেন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।’
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘দুটি অভিযোগই পেয়েছি। তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আরও পড়ুন:কিশোরগঞ্জে কৃষকের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে এক উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনটি বরাদ্দে ১০০টি বেডের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ এলেও জানেন না কৃষকরা।
আলাদা তিনটি স্মারকে বরাদ্দের তিনটি কপি এসেছে নিউজবাংলার প্রতিবেদকের হাতে, যেগুলোর একটিও বাস্তবায়ন করেননি এ কর্মকর্তা।
কৃষকদের জন্য ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বরাদ্দের পুরোটাই এ কর্মকর্তা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০২৪ সালে একটি স্পেশাল বরাদ্দ আসে কিশোরগঞ্জে। সেটিও এ কর্মকর্তা ভাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এ বরাদ্দে ছিল চার লাখ ৬০ হাজার টাকা।
এসবের বাইরে কৃষকের মাঠ দিবস, প্রশিক্ষণের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযুক্ত সাখাওয়াত হোসেন ২০২৩ সালের ২৮ মে থেকে নিকলী উপজেলায় কর্মরত।
প্রকল্পগুলো কী ও বরাদ্দের পরিমাণ কত
কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের অনুকূলে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ভাসমান বেডে মসলা, লতাজাতীয় ও লতাবিহীন সবজি প্রদর্শনী রাজস্ব ব্যয় বাবদ নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার অনুকূলে ব্যয় মঞ্জুরিসহ চার লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। লতাজাতীয় ২৩টি প্রদর্শনীর জন্য দুই লাখ ৩০ হাজার (প্রতিটি প্রদর্শনীর ব্যয় ১০ হাজার) টাকা ও লতাবিহীন ২৩টি প্রদর্শনীর জন্য দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০২৪ সালের ২ মে পাওয়া এ বরাদ্দের একটি প্রদর্শনীও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
ভাসমান বেডে লতাজাতীয় সবজি ও লতাবিহীন সবজি প্রদর্শনীর জন্য ২০২৪ সালের ২১ মে নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার অনুকূলে ব্যয় মঞ্জুরিসহ বরাদ্দ দেয়া হয় তিন লাখ টাকা।
ভাসমান বেডে মসলা প্রদর্শনীতে পাঁচটিতে বরাদ্দ ৫০ হাজার টাকা (প্রতিটি প্রদর্শনীতে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ)। ভাসমান বেডে লতাজাতীয় সবজি প্রদর্শনীর জন্য ১০টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় ১ লাখ টাকা। এ ছাড়াও ভাসমান বেডে লতাবিহীন সবজির ১৫টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় দেড় লাখ টাকা। এখানে ৩০টি প্রদর্শনীতে মোট তিন লাখ টাকা বরাদ্দের একটি প্রদর্শনীও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
একই বছরের ৬ জুন ভাসমান বেডে মসলা প্রদর্শনীর ১১টিতে বরাদ্দ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা (প্রতিটি প্রদর্শনীতে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ)। ভাসমান বেডে লতাজাতীয় সবজি প্রদর্শনীর জন্য ৯টি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় ৯০ হাজার টাকা।
এ ছাড়াও ভাসমান বেডে লতাবিহীন সবজি চারটি প্রদর্শনীতে বরাদ্দ প্রদান করা হয় ৪০ হাজার টাকা। এখানে ২৪টি প্রদর্শনীতে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দের একটি প্রদর্শনীও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
কোন খাতে কী বরাদ্দ জানেন না উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকরা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, প্রদর্শনীর বিভিন্ন উপকরণ ক্রয় বাবদ সরকার বরাদ্দ দেয় উপজেলা কর্মকর্তা বরাবর। প্রদর্শনী অনুযায়ী কৃষক নির্বাচন করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে। তারা কৃষক নির্বাচন করে নিশ্চিত করেন উপজেলা কর্মকর্তাকে।
একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে উপসহকারীদের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা।
নিয়ম অনুযায়ী, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষক নির্বাচন করে উপজেলা অফিসে জমা দেবেন। পরবর্তী সময়ে কৃষি কর্মকর্তা উপকরণ কিনে নির্ধারিত একটি তারিখে কৃষকদের অফিসে আসতে বলবেন। পরে সেখান থেকে উপকরণ বিতরণ রেজিস্ট্রারে (স্টক রেজিস্ট্রার) সাক্ষর রেখে মালামাল বুঝিয়ে দেয়া হয় কৃষককে। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো উপসহকারীর সঙ্গে সমন্বয় করেননি।
সমন্বয় না করলে প্রদর্শনীতে কী কী উপকরণ বরাদ্দ এসেছে সেগুলো উপসহকারী কর্মকর্তা কিংবা কৃষকদের জানারও সুযোগ থাকে না।
নিকলী সদর ইউনিয়নের ষাইটধার গ্রামের কৃষক মিয়া হোসেন জানান, বিগত দুই বছর পূর্বে ৮০ শতাংশ জমিতে সূর্যমুখী চাষ করেছিলেন তিনি। তখন ১০ কেজি বীজ, এক বস্তা ইউরিয়া আর এক বস্তা ডিএপি সার ছাড়া কিছুই পাননি। এরপর আর তার অনুকূলে কোনো বরাদ্দ আসেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিকলী উপজেলার গুরই, সিংপুর ও সদর ইউনিয়নের একাধিক কৃষক জানান, অন্যান্য বছর আগস্টের মধ্যেই তাদের ভাসমান বেড তৈরির বরাদ্দ দেয়া হতো। এবার তাদের কাউকেই কোনো প্রকার বরাদ্দ দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে তারা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করার পর তাদের জানানো হয়েছে, এ বছরের বরাদ্দ আসেনি।
কৃষকরা জানান, বরাদ্দ এলে তাদের দেয়া হবে বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
প্রান্তিক কৃষকদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান শুরু করে নিউজবাংলা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের আওতায় আলাদা তিনটি বরাদ্দে ১০০টি বেডের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। আলাদা তিনটি স্মারকে বরাদ্দের তিনটি কপি আসে এ প্রতিবেদকের হাতে, যেগুলোর একটিও বাস্তবায়ন করেননি এ কর্মকর্তা।
অভিযুক্ত কৃষি কর্মকর্তার ভাষ্য
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন বরাদ্দ আসার বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করেন। খানিকটা পর বলেন, ‘কয়েকটা ছোট বরাদ্দ এসেছে। পানি বেশি থাকায় সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। অচিরেই সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।’
একপর্যায়ে বরাদ্দের কপি দেখানোর পর বিশেষ বরাদ্দের টাকা উত্তোলনের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের তৎকালীন উপ প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বিবেকানন্দ হীরা তার ব্যাচমেট। হঠাৎ একদিন হীরা তাকে ফোনে বলেন, ‘তোমার নামে একটি স্পেশাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তুমি বরাদ্দের টাকাটা উত্তোলন করে আমাকে পাঠিয়ে দাও। অফিসের বিভিন্ন আনুষঙ্গিক খরচে সেটি ব্যয় করা হবে।’ তিনিও তার কথামতো সেটি করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আপনারাও তো বোঝেন, অনেক সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছুই করতে হয়। আমিও সেটি করেছি।
‘তারপরও বিষয়টি যেহেতু আপনাদের নজরে চলে এসেছে আমি তার সাথে কথা বলে অচিরেই বাস্তবায়ন করে নেব।’
এ কথার একপর্যায়ে তিনি ফোনে কথা বলেন হীরা নামের ওই কর্মকর্তার সঙ্গে।
সাখাওয়াত তাকে বলেন, ‘তুমি যে একটা স্পেশাল বরাদ্দ দিয়েছিলে, সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেছে।’
নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আরও আছে। এর আগে এ কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায়। সেখানেও তার বিরুদ্ধে কৃষকের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ, সার, বীজসহ বিভিন্ন প্রণোদনার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠে।
এ বিষয়ে জাতীয় একটি পত্রিকায় প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। পরে সেখান থেকে তাকে বদলি করা হয় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে, তবে সেখানে গিয়ে বেশি দিন থাকতে হয়নি তার। তিনি চলে আসেন কিশোরগঞ্জের নিকলীতে।
মোহনগঞ্জে থাকা অবস্থায় অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সেখানে কোনো প্রকার অনিয়ম দুর্নীতি করেননি বলে দাবি করেন সাখাওয়াত।
এ কর্মকর্তার দাবি, সেখানকার এক সাংবাদিক তার কাছে থেকে অনৈতিক সুবিধা নিতে চেয়েছিলেন। দেননি বলে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন।
যা বললেন তৎকালীন উপ প্রকল্প পরিচালক
কৃষি সম্প্রসারণের আওতাধীন ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের তৎকালীন উপ প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) বিবেকানন্দ হীরার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ প্রকল্পের মেয়াদ আগস্টেই শেষ হয়ে যায়। এ প্রকল্পের সবকিছুই ক্লোজ হয়ে গেছে। তিনিও বর্তমানে এ প্রকল্পের দায়িত্বে নেই।
তিনি জানান, তার জানা মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকল্পের বরাদ্দও কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। তারপরও যদি কোনো কর্মকর্তা সেটি বাস্তবায়ন না করে আত্মসাৎ করে থাকেন, তবে এর দায়ভার একান্তই তার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের উপপরিচালকের ভাষ্য
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘যদি কোনো কর্মকর্তা এ ধরনের অনিয়ম বা আত্মসাৎ করে থাকেন এবং তদন্তে এসবের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে।’
আরও পড়ুন:খুলনার বুকে মোজ্জামেল হক ছিলেন যেন এক অদৃশ্য সম্রাট, যার অধীনে গড়ে উঠেছিল চাঁদাবাজির এক অভিজাত সাম্রাজ্য। শহরের প্রতিটি কোণ- আবাসিক হোটেল, বাসস্ট্যান্ড, স্বর্ণ পাচার, জুয়ার আসর, ক্লাব, এমনকি পরিবহন ব্যবস্থাতেও ছিল তার নেটওয়ার্কের শক্তিশালী হাত।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) শীর্ষ পদটিতে বসে টাকার নেশায় বুঁদ হয়ে কমিশনার মোজাম্মেল হক প্রতি মাসে চাঁদা আদায়ের টার্গেট বেঁধে দিতেন থানার ওসি-ডিসিদের। বিশ্বস্ত দুর্নীতিবাজ সহকর্মীদের খুলনায় এনে, ধীরে ধীরে এই সংগঠিত চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।
চাঁদাবাজির এই সাম্রাজ্য থেকে প্রতি মাসে খুলনার পুলিশ কমিশনারের কাছে জমা পড়ত বিপুল পরিমাণ অর্থ, যার অংশবিশেষ ভাগ-বাটোয়ারা হতো স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে।
রাজনৈতিক সুযোগ বুঝে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা জামায়াত- সময়মতো সব দলের চাটুকারিতাও চালিয়ে গেছেন ওই দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা। ‘জয় বাংলা’ থেকে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’- সব স্লোগানই নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর খুলনার পুলিশ কমিশনারের সেই ক্ষমতার দম্ভ ধূলিসাৎ হয়েছে। টাকার মোহে অন্ধ মোজ্জামেল হককে অবশেষে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পুলিশ কর্মকর্তা মোজাম্মেল হকের বিদায়ের পর খুলনার সুশীল সমাজ মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা এখন দাবি জানাচ্ছেন, মোজ্জামেল হকের বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হোক।
টার্গেট নির্ধারণ করে চাঁদা আদায়
কেএমপির পরিদর্শক পদমর্যাদার চারজন কর্মকতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি মাসে খুলনা সদর থানা থেকে পাঁচ লাখ টাকা আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করে দেন কমিশনার। এছাড়া অন্য সাতটি থানায় প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা করে মোট ২১ লাখ টাকা আদায়ের মাত্রা নির্ধারণ করে দেন তিনি।
মাসিক তিন লাখ টাকা জমা দিতে না পারায় ১০ মাস আগে এক থানার ওসিকে বিএনপির অনুসারী আখ্যা দিয়ে বদলি করে দেন কেএমপি কমিশনার মোজাম্মেল।
ওই ওসি বলেন, ‘আমাকে জমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে বলা হয়েছিল। তবে তিন লাখ টাকা বৈধভাবে আদায় করা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে এই পুলিশ কমিশনারের আন্ডারে আর চাকরি করা সম্ভব ছিল না।
‘আমার ডেপুটি কমিশনার ভালো ছিলেন। তিনি আমাকে সেইভ করার চেষ্টা করেন। পরে কমিশনার আমাকে বদলি করে দিয়ে নতুন এক ওসিকে এনে সেই থানায় বসান।’
পরিদর্শকরা জানান, কমিশনারের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস ছিল পরিবহন খাত। নগর ট্রাফিক বিভাগকে প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। এই টাকা আদায় করার জন্য শহরের ইজিবাইকগুলো থেকে মাসিক চাঁদা আদায় শুরু করেছিলেন সার্জেটরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সার্জেট বলেন, ‘খুলনা শহরে প্রচুর সংখ্যক ইজিবাইক রয়েছে। এই কমিশনার দায়িত্ব গ্রহণের পর ইজিবাইক থেকে মাসিক চাঁদা আদায়ের নির্দেশ দেন। কিভাবে আদায় করতে হবে, সেই দিকনির্দেশনাও দিয়ে দেন তিনি।
‘ইজিবাইকগুলো নিয়ম না মেনে কোথাও পার্কিং করলে এক হাজার ৫০০ থেকে দু’হাজার টাকা করে জরিমানা করতে বলেন। তবে যদি কোনো ইজিবাইক মাসিক তিন হাজার টাকা করে সার্জেন্টদের পরিশোধ করতো, তবে সেই মাসে অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য তাকে কোন মামলা দেয়া হতো না।’
তিনি বলেন, ‘মাসিক চাঁদা দেয়া ইজি বাইকগুলোকে কোনো টোকেন বা রং দিয়ে চিহ্নিত করা হতো না। বরং চালকদের নামের তালিকা করে সার্জেন্টরা এই হিসাব রাখতেন। মাসিক চাঁদার টাকা আদায় করা হতো বিকাশের মাধ্যমে।’
থানার ওসিদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি কেএমপির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাত থেকেও টাকার ভাগ নিতেন কমিশনার।
এর পাশাপাশি নগর ডিসি অফিসেও তার চাঁদা আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। কোনো গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে বিশেষ মূল্যবান কোনো কিছু জব্দ করতে পারলে ওই টাকার ভাগ নিতেন কমিশনার।
এছাড়াও, পুলিশ লাইনের মেস থেকে মাসিক দুই লাখ, রেশন স্টোর থেকে এক লাখ ও কেএমপির গাড়িগুলোর জন্য প্রতি মাসে ইস্যুকৃত জ্বালানি তেল খাত থেকে তিন লাখ টাকা আদায় করতেন মোজাম্মেল হক। নগর পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে প্রতিটি পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য কমিশনারকে ২০০ টাকা করে দিতে হতো।
ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের এনে দল গঠন
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাত্র কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে পুরো নগর পুলিশ জিম্মি ছিল। কেএমপিতে যোগদানের পর নিজের বিশ্বস্ত সব কর্মকর্তাকে বিভিন্ন স্থান থেকে তিনি খুলনায় বদলি করে নিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছেন খালিশপুর থানার বর্তমান ওসি আনোয়ার হোসেন, যিনি পুলিশ কমিশনারের নিজ জেলা পাবনার সন্তান।
পরিদর্শকরা জানান, ওসি আনোয়ারের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন অপরাধে পর যেসব ওসি ও এসআইর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়, তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে মাফ পেয়ে যাওয়ার উপায় বের করে দেয়া।
এছাড়া থানার ওসিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক মো. হাফিজুর রহমান ও বিশেষ শাখার এএসআই মো. আব্দুর রাজ্জাক।
বর্তমানে কমিশনারের বাংলোর দায়িত্বে রয়েছেন এএসআই মো. আব্দুর রাজ্জাক। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি টাকা আদায়ের বিষয় অস্বীকার করে বলেন, ‘এসবের সাথে আমি জড়িত ছিলাম না।’
অন্যদিকে ওসি আনোয়ার বলেন, ‘আমি মোবাইলে এই বিষয়ে কোনো কথা বলবো না।’
কমিশনারকে বিএনপির ‘গণদুশমন’ আখ্যা ও ছাত্রদের বয়কট
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারে পতনের পর বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মিলে খুলনার যে পুলিশ সদস্যরা নানাভাবে প্রতারণা ও অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, তাদের ‘গণদুশমন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ৭ আগস্ট একটি তালিকা প্রকাশ করে মহানগর বিএনপি। ওই তালিকায় নাম ছিল কেএমপি কমিশনার মোজাম্মেল হকের।
এ প্রসঙ্গে খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বলেন, ‘কেএমপি কমিশনার ছাত্র-জনতার বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে সহায়তা করেছিলেন।’
এরপর ৮ আগস্ট কেএমপির সম্মেলন কক্ষে শিক্ষাথীদের তোপের মুখে পড়েন কমিশনার মোজ্জামেল হক।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আল মুজাহিদ আকাশ। তিনি পুলিশ কমিশনারের কাছে প্রশ্ন করেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে কেন আপনারা আমাদের ওপর গুলি চালালেন? ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর আপনারা কে? কার নির্দেশে আপনারা আমাদের ওপর গুলি চালালেন?’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক তানভীর বলেন, ‘আপনার মতো পুলিশ কমিশনারকে আমরা খুলনাতে চাই না। আপনি আমাদের নিরীহ ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছেন।’
সেই সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের কর্মকাণ্ডের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চান কমিশনার মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কেন এগুলো করতে হয়েছিল তা এই সরকারের অধীনে চাকরিতে থাকলে তোমরা বুঝতে। এ নিয়ে আমি তোমাদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।’
‘জয়বাংলা’ থেকে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান
জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে ২০২৩ সালের ১৬ এক প্রজ্ঞাপনে মোজাম্মেল হককে কেএমপি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। খুলনায় যোগদান করেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাইদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। একইসঙ্গে খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেকর ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেন। কমিশনার যে কোনো সভায় যোগ দিয়ে তাদের পা ছুয়ে সালাম করতেন, পাশাপাশি আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ বেশ জোরেশোরেই উচ্চারণ করতেন।
খুলনা মহানগর বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিলটন বলেন, ‘এই পুলিশ কমিশনার খুলনায় যোগদানের পর বিএনপির কোনো নেতা রাতে নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারতেন না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে তিনি নিয়মিত বিএনপির নেতাদের ওপর নির্যাতন শুরু করেছিলেন। প্রতিনিয়ত গায়েবি মামলা ও গণগ্রেপ্তার করাটা যেন তার নেশা ছিল।’
তিনি বলেন, ‘কমিশনার মোজাম্মেল আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাদের পা ছুঁয়ে সালাম করতেন। পাশাপাশি চাঁদাবাজি করে নেয়া টাকার একটা অংশ তিনি ওই নেতাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।’
তবে ৫ আগস্ট সরকার পতদের পর কমিশনার মোজ্জামেল হক মিশে যান বিএনপি নেতাদের সঙ্গে। তাদের নানা সভায় অংশ নিয়ে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেয়া শুরু করেন। পাশাপাশি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রশংসা শুরু করেন।
কমিশনার মোজাম্মেল হক ৮ আগস্ট ছাত্রদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে কেএমপিতে দাওয়াত দেন বিএনপি নেতাদের। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা। সে সময় কমিশনারকে সংশোধন হতে হুঁশিয়ারি দিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক তানভীর বলেন, ‘আপনারা এতদিন একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেছেন৷ এখন আরেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে আমাদের সভা করার জন্য ডেকেছেন।
‘আপনাদের চাটুকারিতা কমে নাই। আমরা আপনাদের মতো চাটুকার পুলিশ কর্মকর্তাদের চাই না। আপনারা নিজ বিভাগের মধ্যে সংস্কার করেন। চাটুকারিতা বাদ দেন।’
তদন্তের দাবি সুশীল সমাজের
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মোজাম্মেল হককে ২৭ আগস্ট সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ওই রাতেই তিনি খুলনা ছেড়ে চলে যান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
তবে তার অন্যায় কর্মকাণ্ডের জন্য শুধু বাধ্যতামূলক অবসর নয়, তদন্ত করে শাস্তি নিশ্চিতের দাবি সুশীল সমাজের।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) খুলনা শাখার সভাপতি কুদরত-ই খুদা বলেন, ‘পুলিশের যে পর্যায়ের কর্মকর্তা হোক না কেন, তাকে শুধু অবসরে পাঠালে হবে না। অন্যায়ের জন্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
‘রাষ্ট্রে শাসন ফিরে এসেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের রাষ্ট্র থেকে জনগণের রাষ্ট্র হয়েছে। এতদিন যারা অন্যায় করেছে, তদন্ত করে তাদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে।’
‘জন্মদাতার হাতেই সন্তানের ভবিষ্যৎ ভস্মীভূত’- ঠিক এমনটাই ঘটেছে চতুর্থ প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ভাগ্যলিপিতে। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন খান আলমগীর নিজেই ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দেন।
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ঋণ অনুমোদন, ব্যবস্থাপনা কমিটিকে মূল্যায়ন না করা, অনুমোদনের আগেই ঋণের টাকা সরবরাহ, গ্রাহকের হিসাব থেকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে নেয়া, ঋণ দিতে বিপুল অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য এবং শেয়ার বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে ম খা আলমগীরের বিরুদ্ধে।
আর এসব অপকর্মে এই জালিয়াতকে সহায়তা করেছেন ব্যাংকটির ইসি কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী। তিনি নিজেও তার পরিবারের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দিতে ব্যাংকটিকে ব্যবহার করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে ফারমার্স ব্যাংকের এই দুই কুশীলবের বিরুদ্ধে এমন অসংখ্য অভিযোগ উঠে আসে। এমনকি ২০১৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানেও ব্যাংকটিকে ধ্বংসে বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ততার তথ্য মেলে।
এ বিষয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘লুটপাটে ফারমার্স ব্যাংক শেষ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠাতারাই ব্যাংকটিকে লুটপাট করে শেষ করে দিয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ সালে ব্যাংকের গুলশান শাখা কর্তৃক তনুজ করপোরেশনের বিপরীতে বড় অঙ্কের একটি ঋণ ক্রেডিট কমিটির সুপারিশ ছাড়া এবং পর্ষদ বা ইসি কমিটির অনুমোদন ছাড়াই মঞ্জুর ও বিতরণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণে অনিয়ম হয়েছে। ব্যাংকের পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ম খা আলমগীর, তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীম এবং ওই শাখার ব্যবস্থাপক এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এ ছাড়া গুলশান শাখায় কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো ‘সেংশন লেটার’ বা অনুমতি পত্র ছাড়াই শুধু চেয়ারম্যানের সুপারিশে বড় বড় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। ২০১৭ সালে গুলশান শাখাসহ বেশ কয়েকটি শাখা থেকে আলাদা আলাদা অ্যাকাউন্টে ৪০ কোটি, ১২ কোটি ৪৫ লাখ, ৯ কোটি ১৫ লাখ, ১০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা প্রদান করা হলেও কোনোটির ক্ষেত্রেই ব্যবস্থাপনা কমিটি ‘লোন সেংশন’ করেনি।
একই বছরের ১৮ অক্টোবর ৪০ কোটি টাকার ঋণ বর্ধিতকরণের জন্য চেয়ারম্যান ও এমডি ফরমাল সুপারিশ করলেও তার আগেই ঋণটি প্রদান করা হয়। সেখানে কোনো প্রকার ব্যাংকিং নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে, ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই গুলশান শাখায় তনুজ করপোরেশনের মেয়াদি ঋণের হিসাব থেকে ১ কোটি ২২ লাখ টাকা গ্রাহকের চলতি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। একই দিনে এ হিসাব থেকে ৪২ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন এবং অবশিষ্ট ৮০ লাখ টাকা পে-অর্ডার হিসেবে স্থানান্তর করতে পিও ইস্যু করা হয়।
একদিন পর ২০ জুলাই পে-অর্ডারটি বাতিল করে পার্কিং হিসেবে (টিওএস) স্থানান্তর করা হয়। ওইদিনেই আবার তা থেকে ১৮ লাখ টাকা এবং ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। এর একটিতে ম খা আলমগীরের নাম এবং অন্যটিতে বাবুল চিশতীর নাম উল্লেখ রয়েছে। এভাবে গ্রাহকের হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলনের মাধ্যমে নিজস্ব প্রয়োজনে পে-অর্ডার করে অনিয়ম/জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন ম খা আলমীগ ও বাবুল চিশতী।
ব্যাংকের গুলশান শাখার ৩টি ঋণ (তনুজ করপোরেশন, জাহান ট্রেডার্স এবং এস২আরএস করপোরেশন) হিসাবের অনুকূলে বিতরণকৃত ঋণের অধিকাংশ অর্থেরই প্রকৃত সুবিধাভোগী সাবেক পর্ষদ চেয়ারম্যান ম খা আলমগীর এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান বাবুল চিশতী।
এ ছাড়া ওই তিন গ্রাহকের বিভিন্ন ঋণ হিসাব থেকে ম খা আলমগীর এবং বাবুল চিশতী কর্তৃক ব্যাংকের অন্য উদ্যোক্তা পরিচালকদের থেকে শেয়ার কেনার জন্য একাধিক পে-অর্ডারের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরও করা হয়। এ ক্ষেত্রে সন্দেহজনক বেশ কিছু লেনদেনের তথ্য পায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল। এ ছাড়া শাখার গ্রাহক এডিএম ডাইং অ্যান্ড ওয়াশিং এবং সাবাবা অ্যাপারেলসের অনুকূলে বিতরণকৃত মোট ৫৭ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী ওয়েলটেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদুল হক চিশতী (শামীম চিশতী)। তিনি সম্পর্কে বাবুল চিশতীর ভাই। ছেলে রাশেদুল হক চিশতীও এমন সুবিধা নিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, যেসব কোম্পানিকে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হতো, বেশিরভাগের ব্যাংক হিসাব তার কিছুদিন আগে করা। অর্থাৎ ঋণ নেওয়ার জন্যই হিসাব খোলা হয়েছে।
কাগজে-কলমে নানা রকমের ব্যবসার কথা বলা হলেও ঋণ নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে সিংহভাগ টাকা তোলা হতো নগদে। অর্থাৎ সেই টাকা কার অ্যাকাউন্টে বা কোথায় যাচ্ছে তা কেউ বলতে পারবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা মনে করেন, এভাবে প্রচুর টাকা দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর দুটি অ্যাকাউন্টে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ট্রান্সফার করা হয়েছিল মোটা অঙ্কের অর্থ। প্রথমটির নামে দেখা যায়, ফারিব অটো রাইস মিলস, দ্বিতীয়টির নাম এসএনডি। তাদের দুটি হিসাবে স্থানান্তর করা হয় যথাক্রমে ৬ কোটি ২ লাখ ২০ হাজার ও ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। অবাক করা বিষয় হলো- এ দুটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয় ২৭ নভেম্বর। অর্থাৎ যেদিন অ্যাকাউন্ট খোলা হয় সেদিনই ঋণের টাকা স্থানান্তর করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে বাবুল চিশতীর ভাই ও তার ছেলের কয়েকটি কোম্পানি ছিল- যেসব কোম্পানির নামে বিপুল অর্থ বের করে নেওয়া হয় ফারমার্স ব্যাংক থেকে। শুধু তা-ই নয়, ভুয়া ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে মোটা কমিশনের বিনিময়ে বড় অঙ্কের লোন দিতেও কার্পণ্য করত না এই চক্র।
এসব ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে দুদকে বাবুল চিশতী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করা হলেও রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় ম খা আলমগীর। অবশ্য ২০১৮ সালে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে আসে, বাবুল চিশতী ও রাশেদুল হক চিশতী ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে ফারমার্স ব্যাংক থেকে কৌশলে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
আরও পড়ুন:কক্সবাজারের টেকনাফে নাফ নদের বাংলাদেশ অংশে রয়েছে কড়া নজরদারি। সীমান্ত এলাকায় কড়া পাহারা বসিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি ও কোস্টগার্ড। এতোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার পরও মিয়ানমারে জান্তা বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর চলমান সংঘাতে রোহিঙ্গারা আবার অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে বিজিবি ও কোস্টগার্ড কার্যত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পুরোপুরি ঠেকাতে পারছে না।
বিজিবি ও কোস্টগার্ড কর্মকর্তাদের দাবি, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা সামান্যই। রোহিঙ্গা বোঝাই অনেক নৌকাকে অনুপ্রবেশে বাধা দেয়া হয়েছে এবং অনেক রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতের বেলায় কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি।
শাহপরীর দ্বীপ বিওপির কোম্পানি কমান্ডার আব্দুর রহমান বাহার এমনটা দাবি করলেও বস্তুত মঙ্গলবার রাতেও ২০ জনের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা এখন উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে।
অনুপ্রবেশকারী মোশাররফ, এরশাদ, রাজু আক্তার, মরিয়ম বেগম, সমজিদা, রফিক, মকবুল হোসেন, জিয়া উদ্দিনসহ আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা জানায়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি মগদের সশস্ত্র বাহিনী আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইনে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হয়েছে।
আরাকান আর্মি গ্রামে প্রবেশ করে এক ঘণ্টার মধ্যে সবাইকে গ্রামটি খালি করতে বলে। গ্রাম না ছাড়লে সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। আবার তাদের সঙ্গে যুক্ত না হলে পুরুষদের হত্যা করা হচ্ছে।
এ অবস্থায় প্রাণের ভয়ে তারা গ্রাম ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। ওপারে সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায় তাদের মতো আরও অনেকে এপারে চলে আসার পথ খুঁজছে।
অনুপ্রবেশকারী মোশাররফ জানান, মংডুর নলবাইন্যা ও মেরোংলা এলাকায় সোমবার তাণ্ডব চালিয়ে আরাকান আর্মি ২০টি ঘরে আগুন দিয়েছে। এ সময় তাদের গুলিতে ১০ জন রোহিঙ্গা গুরুতর আহত হয়েছে। অনেকে মারাও গেছে। প্রাণে বাঁচাতে তারা নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
জান্তা বাহিনী আগে এসব এলাকায় তাণ্ডব করেনি। এখন মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি বেশি নির্যাতন করছে আরাকান আর্মি। তাদের দলে যোগ না দিলে হত্যার হুমকি দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের। নইলে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলছে।
আরেক অনুপ্রবেশকারী এরশাদ বলেন, ‘আরাকান আর্মি ১৫টি গ্রামে তাণ্ডব চালিয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের মদদ দিচ্ছে বলে নাটক করছে। তারা এখন রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করতে নতুন নতুন এলাকা বেছে নিচ্ছে।
‘ওদিকে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের এলাকায় এসে যুদ্ধ শুরু করলে তখন আমাদের গ্রামকে লক্ষ্য করে মিয়ানমার বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। এতে আমরা দুই পক্ষ থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। নারী-শিশু ও বৃদ্ধ নিহত হচ্ছে।’
রাজু আক্তার নামের এক নারী বলেন, মংডু সুএজাতে আমাদের গ্রামে মগবাগি ঢুকে আছে। আমরা বেশি কষ্টে ছিলাম। আমাদের নির্যাতন করতেছে। আমরা ঘরবাড়ি ফেলে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলাম।
‘আমাদের এলাকার দুজন তাদের বাড়িঘর দেখতে গেছিল। আরাকান আর্মি তাদের গলা কেটে হত্যা করেছে। আমরা আসার আগেও হত্যা করছে তিনজনকে। তাই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে চুরি করে চলে আসি। পথে আমার স্বামীকে গুলি করে আরাকান বাহিনী। টাকা ও গয়না যা ছিল সব লুট করে নিয়েছে তারা।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, সীমান্তে বিজিবি ব্যাটালিয়নের সীমান্ত চৌকি আছে এক থেকে দুই কিলোমিটার পর পর। চৌকিগুলোতে বিজিবি সদস্যরা সতর্কতার সঙ্গে পাহারা দিচ্ছেন। কিন্তু এক চৌকি থেকে অন্য চৌকি দেখা যায় না। আঁকাবাঁকা নদীর তীর ধরে গড়ে ওঠা কিছু সড়ক অংশ কিংবা উপকূলীয় প্যারাবন থাকায় দৃষ্টিসীমা খুব বেশি দূরে যায় না। এ কারণে কোথায় কোন সময় রোহিঙ্গাদের নৌকা ভিড়ছে তা বিজিবি সদস্যরা সহজে বুঝতে পারেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে টেকনাফ ২ বিজিবি অধিনায়কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে একাধিকবার কল করলেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম কোস্টগার্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের সবসময় চেষ্টা আছে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে। অনেক রোহিঙ্গা পুশব্যাক করা হয়েছে ইতোমধ্যে।’
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সীমান্তে কঠোর নজরদারি রেখেছে। তারপরও ফাঁকফোকর দিয়ে দালালের মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। সেসব দালালকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
টেকনাফ রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হক জানান, টেকনাফ উপজেলার সঙ্গে নদীপথে মিয়ানমারের ৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান থাকলেও অসংখ্য ফাঁকফোকর থাকায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সহজেই অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। তাই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের টহল আরও জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি সীমান্তে সক্রিয় দালালগুলোকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
বিজিবির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে তিন হাজার ৩৫৪ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। পরে তাদের মিয়ানমারে (স্বদেশে) ফেরত পাঠায় বিজিবি। তাদের মধ্যে ৮৪৮ জন নারী, ৭৪৯টি শিশু ও ১৭৫৭ জন পুরুষ। আর তিন রোহিঙ্গাকে থানা পুলিশে দেয়া হয়।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন চালায়। সে সময় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। তখন সীমান্ত অতিক্রম করে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। আগে আসা রোহিঙ্গাসহ ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ঠাঁই হয় উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে।
আরও পড়ুন:
মন্তব্য