নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক শুরু থেকেই। তবে ৪৩ বছর আগে আজকের এই দিনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে যেটি হয়েছে, তা এর আগে এবং পরে এই অঞ্চলে কখনও দেখা যায়নি।
১৯৭৮ সালের ৩ জুনের এই ভোট যেদিন চলছিল, সেদিনও জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সেনাপ্রধান। সে সময়ের পোস্টারেও সেনাবাহিনীর পোশাক পরা জিয়াউর রহমানকে দেখা যায়। অথচ সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় ভোটে দাঁড়ানো অবৈধ।
ওই নির্বাচনের আগে জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলসহ (জাগদল) ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করা হয়। মেজর জেনারেল পদে চাকরি করা জিয়াউর রহমানকে প্রার্থী করে এই জোট।
তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পাঁচটি দলের সমন্বয়ে গঠিত গণঐক্য জোটের প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানী।
ভোটে জিয়াউর রহমানের পক্ষে ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পড়ে বলে জানানো হয়। বলা হয়, ওসমানীর পক্ষে পড়ে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ।
তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই নির্বাচন ছিল সাজানো। সে সময় নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো কোনো কেন্দ্রে ১১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। জাল ভোট পড়েছে। এটিও উল্লেখ ছিল।’
তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের ভূমিকা আগে থেকেই বিতর্কিত। প্রথমে তার ক্ষমতাকে অটুট রাখার জন্য হ্যাঁ-না ভোটের আয়োজন করলেন। তাতে সব ভোট তার পক্ষে পড়ল। এরপর তিনি পদে থেকে নির্বাচন করলেন। সেনাপ্রধান পদে থেকে যে নির্বাচন করলেন, সরকারি চাকরিবিধি অনুসারে সেটা অবৈধ।’
‘ভোটেও সাজানো একটা নাটক করলেন। বিরোধী দল হিসেবে জেনারেল ওসমানীকে নিয়ে এসেছেন। এটা ছিল জনগণকে ধোঁকা দেয়া। ভোটকেন্দ্রগুলোতে কিছু বিদেশি সাংবাদিককে নিয়ে এসেছিলেন। তারাও লক্ষ করেছেন ভোটাররা আসেনি। জেনারেল জিয়া স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এসে ভোট দিতে বাধ্য করেছেন। এভাবে প্রহসনের নির্বাচন করেছেন’- বলেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
সে সময়ে সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার। মেজর জেনারেল পদে থেকে অবসরে যাওয়া এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সামরিক গবেষক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিনি (জিয়াউর রহমান) যে প্রার্থী হলেন, এটি সম্পূর্ণ অবৈধ। কারণ, তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। তিনি প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মকর্তা। নির্বাচনের আগেই কিন্তু তিনি প্রেসিডেন্ট হলেন স্বঘোষিত হিসেবে। এর আগে তিনি সামরিক আইন প্রশাসক হন। আর একের পর এক আদেশ জারি করে নিজের প্রার্থিতাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি পারেননি।’
তিনি বলেন, ‘সেই নির্বাচনে একজন ব্যক্তির ভোটে দাঁড়াতে হলে কয়েকটি শর্ত ছিল। তার বয়স হতে হবে কমপক্ষে ৩৫ বছর। আর তাকে এমপি হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে আবার তিনি কোনো লাভজনক পদে থাকতে পারবেন না।
‘সেনাবাহিনীর পদ ছিল লাভজনক পদ আর তার জারি করা বিধান অনুসারেই সেই নির্বাচনে দাঁড়ানো ছিল অবৈধ। এটা সাংবিধানিক বিধানের পরিপন্থি, আর্মির শৃঙ্খলারও পরিপন্থি। তার কারণ, আর্মির পদে থাকা অবস্থায় নির্বাচন করা যায় না। সেনাবাহিনীর যে আইন রয়েছে, সেখানেও সেটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় কেউ রাজনীতি করতে পারবে না।’
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘তিনি কেবল আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন তা-ই নয়, তিনি সেনাবাহিনীকেও বিতর্কের মধ্যে ফেলেছেন।’
সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় দলের প্রতিষ্ঠাতার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘এটা ৪৩ বছর আগের ঘটনা। আপনি কি রিসার্চ করবেন, নাকি নিউজ করবেন? যদি রিসার্চ করেন আমি আপনাকে কোনো হেল্প করতে পারব না। আর এত বছর আগের ঘটনা, এটা নিয়ে এখন নিউজ হতে পারে না। আপনাদের কি আর কোনো কাজ নাই?’
তিনি এও বলেন, ‘এটা নিয়ে রিসার্চ করলে তো এটাও জানা উচিত যে তখন তিনটা রিট হয়েছিল। আর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন তার সব কটি খারিজ করে দিয়েছিলেন।’
যেভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে বলতে গেলে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পর থেকেই।
তবে এরও এক বছর পর ১৯৭৬ সালের ১৯ নভেম্বর সামরিক আইন জারি করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন সে সময়ের মেজর জিয়াউর রহমান।
১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই জিয়া হয়ে যান রাষ্ট্রপতি। উর্দি পরা অবস্থাতেই ওই বছরের ৩০ মে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট দেন তিনি। বিস্ময়করভাবে ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পড়ে ‘হ্যাঁ’র পক্ষে।
এরপর সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থাতেই ১৯৭৮ সালের ৩ জুনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয় ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি।
জিয়ার ক্ষমতায় আরোহণ ও শাসন অবৈধ ঘোষণা
জিয়াউর রহমানের এই সেনাশাসন ও তার ক্ষমতায় আরোহণ দুটিই হাইকোর্টের রায়ে অবৈধ ঘোষণা হয়েছে যে সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি।
১৬ বছর আগে ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট এই রায় আসে পুরান ঢাকার মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে।
সেই রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জারি করা সব ধরনের ফরমান অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ১৯৭৫ সালে খন্দকার মোশতাক আহমদ, একই বছরের ৬ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ এবং সামরিক শাসন জারি অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি হিসেবে উল্লেখ করে আদালত।
সে সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি এবং এই রায় সরকারের জন্য ছিল ভীষণ বিব্রতকর।
এই রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষ থেকে আপিল করা হলে ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সে আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়।
সেই আবেদনটি আপিল বিভাগের যে বেঞ্চ খারিজ করে দেয়, তাতে বিচারক ছিলেন অবসরে থাকা এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি বলেন, ‘১৯৭৮ সালের ৩ জুনের নির্বাচন ছিল সংবিধান পরিপন্থি, তামাশার নির্বাচন।’
তিনি বলেন, ‘জিয়া তো প্রথম থেকেই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। সেনাপ্রধান থেকে নির্বাচন করা সংবিধান লঙ্ঘনের নতুন সংযোজন মাত্র। তার কারণ জিয়া যে সেনাপ্রধান হয়েছিলেন, সেটাও সংবিধান লঙ্ঘন করেই হয়েছিলেন।
‘পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, সেটাও সংবিধান লঙ্ঘন করে। তিনি সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলেন। সেটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা।’
তিনি বলেন, ‘উচ্চ আদালতের রায়েই তার সব কর্মকাণ্ড অবৈধ হয়ে গিয়েছে। সেই অর্থেই আমরা বলছি, আইনের দৃষ্টিতে জিয়া কখনও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন না। অবৈধ ক্ষমতা দখলদার ছিলেন।’
কমিশন গঠনের সুপারিশ
বাংলাদেশের আইনে মৃত্যু-পরবর্তী কাউকে বিচারের আওতায় আনা যায় না। তবে সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ তদন্তে এখন একটি তদন্ত কমিশন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।
তিনি বলেন, ‘কমিশনের ফলে এটা রিপোর্টেড থাকবে জিয়া কী কী অন্যায়, অপরাধ করে গেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং সংবিধান ছিন্নভিন্ন করে গেছেন।
‘এগুলো কিন্তু বিভিন্ন মামলার বিভিন্ন রায়ে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী, তাহের হত্যা মামলাসহ অনেক মামলাতেই উল্লেখ রয়েছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাতেও এর উল্লেখ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তদন্ত কমিশন করার দরকার। যাতে তারা জানতে পারে। মানুষ জানতে পারবে জিয়া দেশের যত ক্ষতি করেছিলেন, আর কেউ এমন ক্ষতি দেশের কেউ করেনি। এটি শত শত বছর ধরে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে।’
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে হ্যাঁ-না ভোট
১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগের বছরের ৩০ মে হ্যাঁ-না ভোট হয় দেশে। সেই নির্বাচনে কোনো প্রার্থী ছিল না। পক্ষে বিপক্ষে প্রচারও ছিল না। ব্যালট পেপারে কোনো মার্কাও ছিল না।
ব্যালটে কেবল লেখা ছিল, ‘আপনি কি রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের (বীর উত্তম) প্রতি এবং তার দ্বারা গৃহীত নীতি ও কার্যক্রমের প্রতি আস্থাশীল?’
অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস লিখেছেন, ভোটের দুদিন আগে সড়কের পাশের দেয়ালে, চলমান রিকশা-বাস ও মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি থামিয়ে জোর করে জেনারেল জিয়ার সামরিক পোশাক পরিহিত পোস্টার সাঁটিয়ে দেয়া হয়। একধরনের আতঙ্ক ছড়ানো হয় মানুষের মধ্যে। ভোটের দিন ভয়ে কেউ বের হওয়ার সাহস পায়নি। ফলে ভোটারবিহীন থেকে যায় ভোটকেন্দ্রগুলো। একপর্যায়ে মানুষ খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ভোট দিতে নিয়ে যাওয়া হয়।’
আরও পড়ুন:চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এখন চলছে ভোট গণনার প্রস্তুতি। এ নির্বাচনে ভোট হয়েছে ব্যালট পেপারে। গণনা হচ্ছে ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) পদ্ধতিতে। ভোট গণনা সরাসরি দেখানো হবে এলইডি স্ক্রিনের মাধ্যমে। এজন্য রয়েছে ১৪টি এলইডি স্ক্রিন।
চাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন বলেন, চাকসু নির্বাচনে হাতে লাগানো অমোচনীয় কালি উঠে যাওয়াসহ বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ হয়েছে। বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে।
উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, খুবই শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ-উদ্দীপনা দেখে সত্যি ভালো লাগছে। আমাদের পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সিভিল প্রশাসনের লোকবল রয়েছে। ক্যাম্পাসকে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘ভোট দিলে বেহেশতে যাওয়া সহজ হবে, এমন প্রচারণা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা।’
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয়তাবাদী ওলামা দল আয়োজিত কোরআন অবমাননা ও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে আয়োজিত সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, জামায়াত ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা কিছু ছেলেপেলেকে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যাচার, কটূক্তি ও করুচিপূর্ণ কথা ছড়ানোর বাহিনী গড়ে তুলেছে। এরা মিথ্যাকে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রচার করছে প্রতিনিয়ত।
তিনি আরও বলেন, ‘জামায়াত আওয়ামী লীগের লেজ ধরে চলতে ভালোবাসে, এখনো কেন যেন আওয়ামী লীগের ভোট নেওয়ার জন্য কায়দা কানুন করছে। শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ইসলামের মৌলিক নীতির বাইরে কথা বলছে তারা।’
সাধারণ মানুষ পিআর সম্পর্কে জানে না জানিয়ে রিজভী বলেন, ‘যারা নভেম্বরে গণভোটের কথা বলছেন তাদের কোনো মাস্টারপ্ল্যান আছে, তারা শর্ত দিয়ে বিভ্রান্ত করে জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চাচ্ছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের হয়ে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ তুলেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মৎস্য ভবনের সামনে জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা আয়োজিত মানববন্ধনে এ অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে প্রশাসন ও উপদেষ্টা পর্যায়ে দলীয় প্রভাবমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কিছু উপদেষ্টা একটি দলের হয়ে কাজ করছেন। কারা কারা ষড়যন্ত্রে জড়িত, তাদের তালিকা ও রেকর্ড আমাদের কাছে রয়েছে।
তিনি আরো দাবি করেন, বর্তমানে ডিসি, এসপি ও ইউএনও নিয়োগে পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে। একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে এই নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারের কিছু উপদেষ্টা, যারা নিজেরা নিরপেক্ষ থাকার কথা বললেও, মূলত একটি দলের হয়ে ভূমিকা রাখছেন।
তাহের বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই ষড়যন্ত্র থামাতে হবে। প্রশাসনের ভেতর দলীয় প্রভাব ও গোপন মদদ থাকলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যারা নির্বাচনের নামে নাটক করতে চায়, জনগণ তা মেনে নেবে না।
জামায়াতের পক্ষ থেকে আবারও গণভোটের দাবি তুলে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি গণভোট আয়োজন করতে হবে। এতে জনগণের ইচ্ছা ও বাস্তবতা পরিস্কার হবে। স্বচ্ছতা থাকলে ২১ দিনেই গণভোট সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, একটি দল মুখে গণতন্ত্র ও সংস্কারের কথা বললেও ঐক্যমতের ক্ষেত্রে তারা অনুপস্থিত। জুলাই সনদের বাস্তবায়নের জন্য আমরা রাজপথে থাকব। প্রয়োজন হলে আরও বড় কর্মসূচিতে যাব।
জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার জবাবে তাহের বলেন, জামায়াত দখলবাজি করে না, চাঁদাবাজি করে না। আমরা জনগণের জন্য রাজনীতি করি। ক্ষমতায় গেলে কৃষকের ঋণ মামলাগুলো প্রত্যাহার করব। আমরা সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক বিচার চাই, যেন-তেন বিচার নয়।
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, গণমানুষের দাবি মেনে নিতে হবে। গণভোট দিতে হবে। পিআর পদ্ধতি মানতে হবে। আর যারা খুন-গুমে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ পাঁচ দফা দাবিতে শেরপুরে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মানব বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকালে শেরপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রথম গেইটে এ মানব বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
মানব বন্ধনে বক্তব্য রাখেন জেলা জামায়াতের আমির মাও: হাফিজুর রহমান, জেলা সেক্রেটারি নুরুজ্জামান বাদল, সাবেক নায়েবে আমির মাও: আব্দুল বাতেনসহ আরো অনেকে।
এসময় বক্তারা বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা ছাড়া এদেশে কোন নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। তারা জামায়াত ঘোষিত পাঁচ দফা দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই ভারতে অবস্থান করছেন তিনি। তবে অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে দেশ ও বিদেশে নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন মিটিং এ যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানি দিতে দেখা গেছে হাসিনাকে।
এদিকে ২০২৪ সালের শেষভাগে ‘জয় বাংলা ব্রিগেড’ নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত একটি জুম বৈঠককে কেন্দ্র করে এই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা গড়ে ওঠে। ২০২৪ সালে ১৯ ডিসেম্বর ওই ভার্চুয়াল সভায় দেশ ও বিদেশ থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়।
সিআইডির ফরেনসিক ও গোয়েন্দা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই সভায় অংশগ্রহণকারীরা অন্তর্বর্তীকালীন বৈধ সরকার উৎখাতের আহ্বান, গৃহযুদ্ধ উসকে দেয়ার পরিকল্পনা এবং পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় আনার ঘোষণা দেন।
এই তথ্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলে, ২০২৫ সালের ৪ মার্চ মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে সিআইডিকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার তদন্ত ও অভিযোগ দায়েরের অনুমতি প্রদান করে। পরবর্তীতে ২৭ মার্চ রমনা থানায় সিআর মামলা নং-২২২/২০২৫ দাখিল হয়, যার ধারাগুলো- বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১২১, ১২১(ক), ১২৪(ক)।
পাঁচ মাসেই সিআইডির তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দাখিল করার পর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় হাসিনাসহ ২৮৬ জনের বিচার শুরু হচ্ছে। আদালত আসামিদের অনুপস্থিতিতেই বিচারকার্য পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত তিনটি প্রধান এজেন্ডা- সংস্কার, নির্বাচন ও বিচার বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার তদন্ত কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গতকাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ ২৮৬ জন আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির রাষ্ট্রদ্রোহ সম্পর্কিত ধারায় (১২১/১২১ক/১২৪ক) অভিযোগপত্র দাখিল করেছে সংস্থাটি। এ মামলার বিচারকার্য শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
মঙ্গলবার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নং-১৮, ঢাকায় মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আসামিদের অধিকাংশ অনুপস্থিত থাকায় আদালত জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের মাধ্যমে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ প্রদান করেন।
ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদনে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ড. রাব্বি আলমসহ দলটির কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ের বেশ কিছু প্রভাবশালী নেতার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে দেশে থাকা সন্দেহভাজনদের অবস্থান শনাক্ত করে বিভিন্ন জেলা কারাগারে থাকা ৯১ জনকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। বাকি ১৯৫ জন আসামি এখনো পলাতক বলে জানা গেছে।
গতকালকের শুনানিতে প্রধান আসামিসহ অধিকাংশ অভিযুক্ত আদালতে অনুপস্থিত থাকায়, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে ‘প্রকাশ্য সমন ও গণবিজ্ঞপ্তি’ জারি করার আবেদন করা হয়। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন প্রকাশের মাধ্যমে আসামিদের হাজির হতে আহ্বান জানানোর নির্দেশ দেন।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা অনুপস্থিত থাকলে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫১২ ধারার আওতায় অনুপস্থিতিতেই বিচার পরিচালনা করা হবে বলে আদালত উল্লেখ করেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন—রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৮৬ জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হওয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বিচারিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের ‘বিচার ও দায়বদ্ধতা’ এজেন্ডার বাস্তব প্রতিফলন, তেমনি রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনার দৃঢ় সঙ্কেতও।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে মঙ্গলবার দিনব্যাপী দেবিদ্বার উপজেলার ৬নং ফতেহাবাদ ইউনিয়নে লিফলেট বিতরণ ও ধানের শীষের পক্ষে গণসংযোগ করেন কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব এ এফ এম তারেক মুন্সী। এ সময় তিনি খলিলপুর বাজার, নূরপুর, ফতেহাবাদ মোকামবাড়ি ও ফতেহাবাদ বাজার এলাকায় লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ করেন। এছাড়া খলিলপুর উচ্চ বিদ্যালয়, গঙ্গামন্ডল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ, নূরপুর উচ্চ বিদ্যালয় এবং ফতেহাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়সহ স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
গণসংযোগকালে এ এফ এম তারেক মুন্সী বলেন, “ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘোষিত রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা কর্মসূচি হলো জাতির পুনর্জাগরণের নকশা। এই কর্মসূচির মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন ও জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ধানের শীষ কেবল একটি প্রতীক নয়, এটি পরিবর্তন ও আশার প্রতীক। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে একটি গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।”
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন—উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গিয়াস উদ্দিন, পৌর বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন মাহফুজ, সদস্য সচিব আব্দুল আলিম পাঠান, ফতেহাবাদ ইউনিয়ন পূর্ব বিএনপির সভাপতি শাকিল মুন্সী, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হান্নান, উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম, পশ্চিম শাখার সভাপতি এডভোকেট সোহরাব হোসেন, সদস্য সচিব দৌলত খান, কুমিল্লা উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এস এম ইমরান হাসান, উপজেলা যুবদলের সভাপতি নুরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক মো. রকিবুল হাসান, জাফরগঞ্জ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নেয়ামত উল্লাহ এবং উপজেলা মৎস্যজীবী দলের আহ্বায়ক কাউছার মোল্লা।
যারা ভারতীয় আধিপত্যের বাইরে থাকবে, তাদের সঙ্গে এনসিপি জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের চিন্তা করছে বলে জানিয়েয়েছেন দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।
এ সময় তিনি বলেন, এনসিপির শাপলা প্রতীকে আইনি কোনো বাঁধা নেই। তাই আমরা শাপলা প্রতীকেই নির্বাচন করব। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এনসিপি যেকোনো এলায়েন্সেও যেতে পারে। তবে এনসিপি নিজের প্রতীকে নির্বাচন করবে।
গত সোমবার রাতে শেরপুর শহরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে জেলা ও উপজেলা নেতা ও কর্মীদের নিয়ে সমন্বয় সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের নিজেদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সাংগঠনিক ভিত্তিকে মজবুত করা। আগামীর রাজনীতির লড়াইয়ের জন্য, গণতান্ত্রিক পথ উত্তরণের জন্য, ফ্যাসিস্টবিরোধী লড়াই অব্যাহত রাখার জন্য কিংবা নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতি, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই সাংগঠনিক কাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রত্যেক জেলায় সমন্বয় সভা করছে এনসিপি।
তিনি বলেন, ইতোপূর্বে বিএনপি কখনো এককভাবে সরকার গঠন করেনি, আবার জামায়াতও কখনো বড় পরিসরে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেনি। সে জায়গা থেকে আগামী নির্বাচনে কারা সরকার গঠন করবে সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর ভূমিকায় থাকবে এনসিপি। এজন্য আমরা সাংগঠনিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সারাদেশে সমন্বয় সভা করছি। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের সব ওয়ার্ডে এনসিপির কমিটি থাকবে।
শেরপুর জেলা এনসিপির প্রধান সমন্বয়ক ইঞ্জিনিয়ার মো. লিখন মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে এনসিপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকিন আলমসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের এনসিপি নেতা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতারা ও জুলাই যোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য