বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে দায়িত্বপালনে ব্যর্থতা ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ ১১টি অভিযোগ আনা হয়েছে।
তবে এর সবগুলোই প্রত্যাখান করে হাফিজ বলছেন, এগুলো সব কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
অভিযোগের কারণ ব্যাখ্যার জন্য বিএনপির পাঠানো নোটিশের ভাষা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেছেন, ওই নোটিশে তার নামের বানান পর্যন্ত ভুল।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বনানীতে নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ।
হাফিজ উদ্দিন আহমদকে বিএনপির পক্ষ থেকে পাঠানো নোটিশের একটি অনুলিপি পেয়েছে নিউজবাংলা। এতে দেখা গেছে তার নামের ক্ষেত্রে ভুল করে ‘উদ্দীন’ এবং ‘আহমেদ’ লেখা হয়েছে।
কারণ দর্শানোর নোটিশের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমি একজন যুদ্ধাহত, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বিজয়ের মাসে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অসৌজন্যমূলক ভাষায় অসত্য অভিযোগ সম্বলিত কারণ দর্শানোর চিঠি পেয়ে হতবাক হয়েছি।
‘আমি বিগত ২৯ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি সাথে সংশ্লিষ্ট, আমার যোগদানের তারিখ, ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাবার তারিখ, আমার নামের বানানসহ অনেক ভুলই রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত চিঠিতে দৃশ্যমান।’
যুগ্ম মহাসচিবের পক্ষ থেকে ভাইস চেয়ারম্যানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানোর তীব্র সমালোচনা করেন হাফিজ।
তিনি বলেন, ‘আমি বিগত ২২ বছর ধরে দলের অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছি। দলের ভাইস চেয়ারম্যানকে একজন যুগ্ম মহাসচিবের পক্ষ থেকে এমন কঠিন, আক্রমণাত্মক ভাষায় কৈফিয়ত তলবে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছি।
‘এখানে প্রটোকল ও সৌজন্যের ব্যত্যয় ঘটেছে। ব্যক্তি রুহুল কবির রিজভী একজন নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী নেতা, তার সাথে আমার সু-সম্পর্ক রয়েছে, তার কাছ থেকে এ ধরনের চিঠি আশা করিনি।’
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন হাফিজ।
১. সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে অপারগতার অভিযোগের জবাবে তিনি জানান, তাকে কখনও বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের দায়িত্ব দেয়া হয়নি।
২. জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক পদের প্রস্তাব না নেয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অসুস্থতার জন্য এই অফার আমি গ্রহণ করতে পারিনি। আমার বর্তমান বয়স ৭৬ বছর ২ মাস, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে আমার চাইতে বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা চার-এর অধিক হবে না বলেই আমার ধারণা। এই বয়সে মানুষ অসুস্থ হতেই পারে।’
৩. বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে অনুষ্ঠিত সভায় যোগ না দেয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘যোগদানের পূর্বেই পুলিশ আমাকে ঢাকা বিমান বন্দরে গ্রেফতার করে, এ কারণেই বরিশালে যেতে পারিনি। আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল বর্তমান সরকার। বিএনপির কোনো সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে এ ধরনের মারাত্মক অভিযোগ দায়ের করার কথা আমার জানা নেই। এ মামলা ছাড়াও এক ডজন মামলায় আমি গত ১০ বছর ধরে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে যাচ্ছি।’
৪, ৫ ও ৬. দলীয় সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সম্পর্কে মিথ্যা ও অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অতীতে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত স্মরণীয় দিবসে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হতো, গত দেড় বছরে এ ধরনের অনুষ্ঠানে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আমাকে ডাকার প্রয়োজন বোধ করেননি। বোঝাই যাচ্ছে বিএনপিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করে রাখার জন্য একটি মহল সক্রিয় রয়েছে।
বিগত এক বছরে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত ছয়টি সভায় অংশগ্রহণ করেছি। এসব সভায় আমি অসৎ উদ্দেশ্যে বিএনপির সমালোচনা করেছি- এমন অভিযোগ করা হয়েছে, যা একেবারেই অসত্য, ঢালাও মন্তব্য।’
কয়েকটি বক্তব্যের উদাহরণ দিয়ে হাফিজ বলেন, ‘এসব বক্তব্য দলীয় সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সম্পর্কে মিথ্যা ও অসৌজন্যমূলক নয়, বরং আমি আত্মসমালোচনা করেছি। ’
সেই বক্তব্যগুলো হলো:
‘জনগণ মনে করে, যে নির্বাচনে (২০১৪) বিএনপির অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল সেটা তারা বর্জন করেছে, আর যে নির্বাচনে (২০১৮) অংশগ্রহণ নিরর্থক সেটিতে অংশ নিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বৈধতা দিয়েছে।
‘২০১৮ সালের নির্বাচনের পর মাত্র পাঁচ সদস্য নিয়ে বিএনপির সংসদে যোগ দেয়া উচিত হয়নি।
‘বেগম খালেদা জিয়া দু-বছর ধরে কারাগারে অন্তরীণ, অথচ বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল তার মুক্তির জন্য কোনো কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।
‘বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুটি প্রধান দলেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই।’
৭. প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় দলীয় স্বার্থ ও শৃঙ্খলাবিরোধী বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে হাফিজ বলেন, ‘আমি ৩৪ বছর যাবৎ রাজনীতি করছি, কখনও কারও বিরুদ্ধে- এমনকি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য রাখিনি। অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধেও অনেক বক্তব্য রেখেছি, কিন্তু আমি কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করিনি।’
হাফিজ বলেন, ‘আমি কখনওই বেগম খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান সম্পর্কে অসৌজন্যমূলক বক্তব্য রাখিনি। এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ এনে আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে বলে মনে করি। আমি আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচনা করি, কিন্তু কাউকে ব্যক্তিগতভাবে অ্যাটাক করি না, এটা আমার ন্যাচারে নেই। এরশাদকে লম্পট, স্বৈরাচার বলে নানান বক্তব্য দেয়া হয়, আমি কোনোদিন এমন আচরণ করিনি। তাহলে নিজ দলীয়দের বিরুদ্ধে কীভাবে করব?’
৮. ‘হাফিজ নিজেকে মহাসচিব ঘোষণা করেছেন’- এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে ১৩ বছর আগের জরুরি অবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমি একজন নগণ্য রাজনৈতিক কর্মী, নিজেকে মহাসচিব ঘোষণা করেছি এটি একটি হাস্যকর বক্তব্য।
‘২৯ অক্টোবর ক্ষমতার করিডোরে অবস্থানকারী সেনা কর্মকর্তারা স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যকে জোরপূর্বক সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের বাসায় নিয়ে যান। গভীর রাতে সেখানে অনুষ্ঠিত সভায় জনাব সাইফুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও আমাকে অস্থায়ী মহাসচিব রূপে ঘোষণা করা হয়। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না, পরদিন বিষয়টি আমাকে জানানো হয়।
‘সেনা সদস্যরা কয়েকদিন পরেই আবদুল মান্নান ভূইয়াকে জেলে ঢোকায় এবং সাইফুর রহমান গোপনে দেশত্যাগ করেন। সে সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে, নেতাদের উপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়। কারও কারও কাছ থেকে ভবিষ্যতে রাজনীতি করব না- এই মর্মে মুচলেকাও আদায় করা হয়।’
বিএনপিকে সে সময় ভাঙনের হাত থেকে 'রক্ষা করেছেন' দাবি করে হাফিজ বলেন, ‘বিএনপিকে দ্বিখণ্ডিত করার চেষ্টা আমি কখনও করিনি বরং দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছি। আমার অনুরোধে বিতর্কিত সেনা কর্মকর্তারা বিএনপির ১০৫ জন এমপিকে ফেরদৌস কোরাইশির নেতৃত্বাধীন কিংস পার্টিতেন যোগদান থেকে বিরত রাখেন। তারা আজও বিএনপিতে আছেন।
‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার আইনজীবী নওশাদ জমিরের মাধ্যমে সকলকে ঐক্যবন্ধ রাখার জন্য আমার কাছে নির্দেশ পাঠান। সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার তার বাসভবনে আমাকে ও মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে বৈঠকে উপস্থিত হবার জন্য অনুরোধ করেন। আমি তাৎক্ষণিক উপস্থিত হই, কিন্তু দেলোয়ার সাহেব আসেননি।
‘পরবর্তী সপ্তাহে এমপি হোস্টেলে বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব শাহজাহানের বাসায় খন্দকার দেলোয়ারের সাথে দেড় ঘণ্টাব্যাপী এক বৈঠকের পর আমাদের ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়। মহাসচিব আমাকে সেনা কর্তৃপক্ষের সাথে দেনদরবার করে বিএনপিকে ক্ষমতায় নেবার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলেন। পরবর্তীকালে আমি বিভিন্ন সাংবাদিক সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া ও খন্দকার দেলোয়ারের নেতৃত্বে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ রয়েছে বলে বক্তব্য রাখি।’
৯. দলে সংস্কারপন্থির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বেগম জিয়া কারামুক্ত হবার পর আমি তার সাথে দেখা করি। জেলখানা থেকে পাঠানো তার সকল নির্দেশ পালন করেছি জানালে তিনি আমার প্রতি সদয় আচরণ করেন। আমার কার্যক্রম পর্যালোচনা করেই তিনি আমাকে ২০০৮, ২০১০ এর উপনির্বাচন, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেন।’
হাফিজ বলেন, ‘সংস্কার ভালো জিনিস। দলের স্বার্থ রক্ষাতেই সংস্কার জরুরি, কিন্তু আমি কখনওই খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে দল করতে চাইনি। তখনও চাইনি, এখনও চাই না। ’
১০. নিজের নির্বাচনি এলাকায় বিএনপির কর্মীকে নাজেহাল ও দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় রাখার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর কতিপয় বিএনপি কর্মী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যের সঙ্গে আঁতাত করে বিএনপি কর্মীদের উপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটি লালমোহন ও তজুমুদ্দিন থানায় দুইজন নেতাকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য বহিষ্কার করে। এদের একজন রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষর জাল করে চিঠি ইস্যুর কারণে বহিষ্কৃত হয়। ’
১১. নির্বাচনি এলাকায় গ্রুপিং সৃষ্টির অভিযোগও নাকচ করেন হাফিজ। তিনি দাবি করেন, সেখানে দলের মূল কমিটি এবং সহযোগী সংগঠনের কমিটিগুলো গঠনতন্ত্র মেনে কাউন্সিলরদের ভোটে গঠন করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে হাফিজ উদ্দিন আহমদের বলেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনও অভিযোগ কেউ তুলতে পারেনি। বর্ষীয়ান এই নেতা বলেন, ‘ঢাকায় আমার নিজের কোনো বাড়ি নেই। যেটাতে আছি তা আমার বাবার, পারিবারিক ভাগাভাগিতে তা পেয়েছি। বিএনপির এমন অনেক নেতাকর্মী আছেন যাদের ১০০ এর বেশি বাড়ি রয়েছে ঢাকা শহরে।’
হাফিজ উদ্দিনের আহমদের পাল্টা অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি শোকজ নোটিশে সই করা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে নিউজবাংলার প্রতিবেদককে তিনি বলে, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। ’
হাফিজ উদ্দিনের অভিযোগের বিস্তারিত শোনাতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি অনেক বছর ধরে রাজনীতি করছি, তাই বুঝতে পারি সাংবাদিকেরা কী প্রশ্ন করতে পারে। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে রাজি না।’
আরও পড়ুন:আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ তিন দাবিতে হওয়া শাহবাগ অবরোধ কর্মসূচিসহ নানা কর্মসূচি এখন থেকে 'ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য' ব্যানারে পালিত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ।
তিনি বলেন, এই আন্দোলন কোনো একক দলের বা মতের নয়।
বাংলাদেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে একত্রিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন হাসনাত।
শনিবার দুপুরে নিজের ভ্যারিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তিনি এই ঘোষণা দেন।
ফেসবুকে হাসনাত লিখেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে গত দুই দিন ধরে ছাত্র-জনতা রাস্তায় অবস্থান করছে। এখনো পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফ্যাসিস্ট ও সন্ত্রাসী দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারেনি।
বিভিন্ন মহল থেকে এই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে দাবি করেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
তিনি বলেন, নানাভাবে আন্দোলনকে বিতর্কিত ও বিভক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছি, এই আন্দোলন কোনো একক দলের বা মতের নয়। সবার ঐক্যমতের ভিত্তিতে এখন থেকে আমাদের সব কর্মসূচি "ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য" ব্যানারে পালিত হবে।
ঢাকাসহ সারাদেশের ছাত্র-জনতাকে রাজপথে নেমে আসার আহবান জানিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আসুন, আমরা সবাই জুলাইয়ের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হই। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানপন্থী সকল মত ও দল একত্রে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, জুলাই এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ছাত্র জনতার শাহবাগ অবরোধ কর্মসূচি গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত চলছে। আজ বিকেল থেকে আর দুইটি দাবি যোগ করে আন্দোলন কর্মসূচি পালিত হবে বলে ঘোষণা দেন হাসনাত।
দাবিগুলো হলো—আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করা; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আওয়ামী লীগের দলগত বিচারের বিধান যুক্ত করা এবং জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করা।
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ফিরে আসা গণতন্ত্র উত্তরণের পথ সহজ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবেশের আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়া দীর্ঘকাল ফ্যাসিবাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফ্যাসিবাদ বিদায় নেওয়ার পর কারাবন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। সেখানে প্রায় ৪ মাস চিকিৎসা শেষে আজকে দেশে ফিরে আসছেন। এটা আমাদের জন্য, জাতির জন্য একটা আনন্দের দিন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, গণতন্ত্র উত্তরণের এই সময়ে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তার ফিরে আসা আমাদের গণতন্ত্র উত্তরণের পথ সহজ করবে। দেশকে সঠিক ও বৈষম্যহীন পথে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে।
গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সেখানে লন্ডন ক্লিনিকে টানা ১৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৫ জানুয়ারি থেকে তার ছেলে তারেক রহমানের বাসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
আগামী ডিসেম্বর ধরেই জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ চায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। এ সময়ে ভোট আয়োজনে বাঁধা দেখছে না বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও সরকারের চাওয়ার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। সরকার তো বলেনি ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে না। তিনি বলেন, ‘এজন্য আমরা বলেছি, ডিসেম্বরের একটা তারিখ ধরে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হোক।’
আজ সোমবার বিকেলে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে লেবার পার্টির সঙ্গে লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন নজরুল ইসলাম খান।
তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। এটাকে ধরে একটা রোড ম্যাপ ঘোষণা করা হোক। সরকার বলছে যে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তার মানে তারা তো বলেনি যে, ডিসেম্বর নির্বাচন হবে না। কিন্তু আমরা বলছি, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে এরকম একটা তারিখ ধরে রোড ম্যাপ ঘোষণা করা হোক। পার্থক্য তো খুব বেশি না।’
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘সরকারের কথা অনুযায়ী নির্বাচন ডিসেম্বরে হতে পারে, জানুয়ারিতে হতে পারে, ফেব্রুয়ারিতেও হতে পারে। কাজেই আমাদের সঙ্গে সরকারের পার্থক্য তো বহু মাসের না। আমরা শুধু সরকারকে বলছি, এভাবে না বলে, এভাবে বলেন।’
চলতি বছরের মাঝামাঝি নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের দ্বায়িত্ব পূর্ণ করতে যাচ্ছেন। তাহলে ডিসেম্বরে নির্বাচনে বাধা কোথায় প্রশ্ন রেখে বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, যারা ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় না তাদেরই উত্তর দিতে হবে বছরের শেষে ভোটগ্রহণে অসুবিধা কোথায়?
বিএনপি ৩১ দফা থেকে সরে যাচ্ছে কিনা? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘এখানে সরাসরি কোনো ব্যাপার নেই। ৩১ দফা বিএনপির প্রস্তাব। সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব এসেছে এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতামত প্রদান করেছে। এটা নিয়ে এখনো কোনো ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। আমরা বলেছি পর পর দু’বারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবে না। এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলাম তখন আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছিলেন, এর চেয়ে ভালো কোনো প্রস্তাব যদি কারো কাছে থাকে তাহলে সেটা আমরা বিবেচনা করবো। এ কারণে আমরা দেখবো এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব যদি কেউ দেয় সেটা যদি অধিকতর যুক্তিসংগত হয় তবে গ্রহণ করার সঙ্গে ৩১ দফার থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।’
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দাবি করছে প্রশাসন বিএনপির হয়ে কাজ করছে, সেক্ষেত্রে তারা মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে পাল্টা প্রশ্ন রেখে নজরুল ইসলাম বলেন, যারা অভিযোগ করছেন তারা সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন, তারাই বিএনপির লোক বসিয়ে এসেছেন কিনা?
তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে তো প্রশাসন থেকে উৎখাত করা হয়েছে। কোথাও বিএনপির কোনো ছিল না। যারা বৈষম্যের শিকার ছিল, যাদেরকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের ৭’শ অফিসারকে এখনো কোথাও পদায়ন করা হয়নি। তাহলে বিএনপির লোককে বসানো হলো কোথায়?’
বৈঠক শেষে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, জনগণ ও রাজনীতিবিদদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ড. ইউনূস ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেবেন। লেবার পাটির পক্ষ থেকে বিএনপির কাছে জাতীয় কনভেনশন করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আগামীতে যেকোনো নির্বাচনের আগে খুনিদের বিচার ও প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘যেকোনো নির্বাচনের আগে অবশ্যই দুটি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। একটি হচ্ছে খুনিদের বিচার, যা দৃশ্যমান হতে হবে। আর আরেকটি হচ্ছে প্রয়োজনীয় সংস্কার—এই দুটি ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ কোনো নির্বাচন মেনে নেবে না।’
শনিবার (১৯ এপ্রিল) লালমনিরহাটের কালেক্টরেট মাঠে জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই, কালো টাকা ও পেশীশক্তির প্রভাবযুক্ত নির্বাচন আমরা দেখতে চাই না। সেজন্য অবশ্যই নির্বাচনের সমতল মাঠ তৈরি করতে হবে।’
ভারতের সঙ্গে সম্প্রীতি, শ্রদ্ধা ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিবেশী হিসেবে বসবাসের দাবি জানিয়ে জামায়াতের আমির বলেন, ‘আমরা ভালো থাকলে তারাও ভালো থাকবে। আমাদের ভালো কেড়ে নিলে ভারতকে চিন্তা করতে হবে তারা ভালো থাকবে কিনা।’
জামায়াতপ্রধান আরও বলেন, ফ্যাসিবাদের পতন হলেও এখনও কিছু কু-রাজনীতিক চাঁদাবাজি-দখলবাজি করছে। জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের সম্মান, নিরাপত্তা ও কাজের ব্যবস্থা করবে বলেও তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
পাশাপাশি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ লালমনিরহাটের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীকে ক্ষমতায় আনার আহ্বান জানান।
তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, আমরা এমন একটা দেশ চাই—যেখানে পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন চাই না। টুকরা টুকরা জাতি চাই না। আমরা মাইনরিটি ও মেজরিটি শব্দই শুনতে চাই না।
ডা. শফিকুর বলেন, এখন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরাও বলছে এই কথাগুলো বলেই বলেই আমাদের শোষণ করা হয়েছে। আমরাও চাই না। নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই দেশকে গড়ে তুলবো। নারীদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে। তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তারা নিরাপদভাবেই ঘরে থাকবেন, বাইরে যাবেন পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন। যুবকদের হাতকে আমরা কাজের হাতে পরিণত করব। সেই অপেক্ষায় আছি।
তিনি বলেন, আমাদের লাখ লাখ মানুষ বলছেন, জীবন দেবো, দেশের সার্বভৌমত্ব দেবো না। কারো লাল চোখের দিকে আর আমরা তাকাবো না। আমাদের দিকে যদি কেউ লাল চোখ তুলে তাকায় তাও আমরা বরদাশতহ করব না। আমরা পিন্ডির হাত থেকে মুক্ত হয়েছি অন্য কারো হাতে বন্দি হওয়ার জন্য না। বরং সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার জন্য। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সেই বৈষম্যহীন মানবিক সাম্যের বাংলাদেশ গড়তে চায় বলে উল্লেখ করেন জামায়াত আমির।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা সেই দিনটির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা বিভেদহীন জাতি চাই। আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতি নিয়ে সামনে এগোতে চাই, লালমনিরহাটের প্রাণের দাবি তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও লালমনিরহাটের বিমানবন্দর চালু করতে হবে—তাহলে বেকারত্ব দূর হবে।
কালেক্টরেট মাঠ ছাড়াও শহরের অপর একটি মাঠে নারীদের জন্য বড় পর্দার ব্যবস্থা করা হয়।
জেলা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট আবু তাহেরের সভাপতিত্বে জনসভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা মমতাজ উদ্দিন ও অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল। এছাড়া দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দও এসময় জনসভায় বক্তব্য দেন।
বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে নয় বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘বরং বিএনপি সংস্কারেরই দল, তবে সবকিছুর মূলে জনগণ। জনগণের সম্মতিতে যেন সব হয়।’
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) সকালে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির আলোচনার শুরুতে তিনি এসব কথা বলেন।
নজরুল ইসলাম খান আরও বলেন, ‘আমরা গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে নয়, বিএনপি সংস্কারেরই দল। কিন্তু কেউ কেউ নানান কথা বলেন। তারা যখন সংস্কারের দন্তস্য উচ্চারণ করেননি, তখন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ভিশন ২০৩০ দিয়েছেন।’
সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জাতীয় সংসদের এলডি হলে শুরু হয়েছে।
গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন–সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমাদের সামনে আরেকবার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তা কাজে লাগাতে চাই। আমরা এই কমিশনকে সহযোগিতা করছি, এই সরকারকে সহযোগিতা করছি, সেই প্রত্যাশা নিয়েই।’
যদি ঐকমত্য কমিশনের কোনো সনদ না-ও হয়, বিএনপির জন্য সংস্কারের সনদ রয়েছে বলে জানান নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, সবকিছুর মূলে জনগণ এবং জনগণের সম্মতিতে যেন সব হয়। তিনি আরও বলেন, ‘আর জনগণ কার মাধ্যমে সম্মতি জানায়, তা আমরা জানি।’
আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ, নজরুল ইসলাম খান, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ,আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল, সাবেক সচিব নিরুজ্জামান খান অংশ নেন।
আজ দিনব্যাপী এই আলোচনা চলতে পারে বলে ঐক্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে। আজ আলোচনা শেষ না হলে প্রয়োজনে আগামী সপ্তাহে আবারও বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসবে কমিশন।
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের’ ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে’ এমন বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘তার (প্রধান উপদেষ্টার) বক্তব্যে আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট নই।’
আজ বুধবার মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে বিএনপির সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বের হওয়ার পর তিনি এ হতাশা ব্যক্ত করেন। বিএনপির মিডিয়া উইং থেকে জানানো হয়, বৈঠকে দলটির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে একটি চিঠিও দেয়া হয়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট করে নির্বাচনের ডেটলাইন দেননি। তিনি বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে তিনি নির্বাচন শেষ করতে চান। উনি ডিসেম্বর থেকে জুন বলেছেন, উনি বলেননি এটা ডিসেম্বরে হবে। আমরা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি যে, আমাদের কাটঅফ টাইম ইজ ডিসেম্বর। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন যদি না হয়, তাহলে দেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক পরিস্থিতি, সেটা আরও খারাপের দিকে যাবে। সেটা তখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।এ সময় ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে বিএনপি কী করবে-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে দলটির মহাসচিব বলেন, দলের মধ্যে এবং মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের আলোচনার প্রধান বিষয় ছিলো নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নিয়ে। সে বিষয়ে কথা বলেছি। আর বলেছি যে, যে পরিস্থিতি আছে এবং দেশের যে অবস্থা, তাতে করে আমরা বিশ্বাস করি এখানে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, যে সংস্কার কমিশনগুলো করা হয়েছে, সেগুলোতে আমরা সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছি। কয়েকদিন আগে সংস্কার কমিশনের কাছে আমাদের মতামতগুলো দিয়েছি। আগামীকালও আমাদের সঙ্গে বৈঠক আছে। সবগুলো দল যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়ে আমরা একটা চার্টার করতে রাজি আছি। তারপরে আমরা নির্বাচনের দিকে চলে যেতে পারি। বাকি যেসব সংস্কারে আমরা একমত হব, সেটা আমরা অবশ্যই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তারা সেগুলো বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেবেন। এটাই ছিল আমাদের (বিএনপির) মূল কথা।
এ বৈঠকের জন্য বেলা সোয় ১২টায় ‘যমুনা’য় পৌঁছায় বিএনপি মহাসচিবসহ দলের স্থায়ী কমিটির ৭ সদস্য। পৌনে দুই ঘণ্টার বৈঠকে নির্বাচনী রোডম্যাপ, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার, শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
সরকারের পক্ষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ছিলেন উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে।
চিঠিতে যা বলা হয়েছে
চিঠিতে বিএনপি উল্লেখ করে, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিটি লড়াইয়ের নেতৃত্বদানকারী কিংবা গর্বিত সক্রিয় অংশীদার হিসেবে বিএনপি তার অবস্থান থেকে প্রতিটি লড়াইয়ের সুফল জনগণের জন্য কার্যকর করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে এবং করছে। সেই লক্ষ্যেই এবারও জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের সুফল জনগণের কল্যাণে এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে নিবেদিত করার টেকসই ক্ষেত্র প্রস্তুতের লক্ষ্যে দেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপরিচালনার ভার আপনার নেতৃত্বে অন্তর্র্বতী সরকার প্রতিষ্ঠায় আমরা সমর্থন জানিয়েছি এবং দায়িত্ব পালনে আপনাকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি এবং সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি। আপনার ও আপনার নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে প্রায় দেড় যুগ ধরে গণতান্ত্রিক অধিকারহীন জনগণের স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল। যত দ্রুত সম্ভব ফ্যাসিবাদী দল, তাদের দলীয় সরকার ও তার দোসরদের আইনের আওতায় এনে তাদের গণবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, দুর্নীতি-অনাচারের মাধ্যমে দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের বিচার ও পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধারের, ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে নিহত ও আহতদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পতিত সরকারের সব অপচক্র ও সিন্ডিকেট ধ্বংস করার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া, যাতে তারা সম্মিলিতভাবে দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি, উন্নত অর্থনীতি এবং জনগণের মানবিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘বিএনপি মনে করে যে জনগণের স্বার্থরক্ষা ও স্থায়ী কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য গণতান্ত্রিক শাসনের বিকল্প নেই। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংস্কার একটি সদা চলমান অনিবার্য প্রক্রিয়া। বিগত ফ্যাসিবাদী পতিত সরকারের মতো “আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র” যেমন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের অপকৌশল ছিল, এখনো কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর “আগে সংস্কার পরে গণতন্ত্র” তেমনই ভ্রান্ত কূটতর্ক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার মাধ্যমেই সবার জন্য উন্নয়ন সম্ভব এবং এ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইন, নীতি, বিধানের সংস্কার অপরিহার্য। এর সবগুলো পরস্পরের পরিপূরক, কোনোটাই কোনোটার বিকল্প নয়; পরস্পর সাংঘর্ষিকও নয়।’
এতে আরও বলা হয়, আজ যারা সংস্কারের কথা বেশি বেশি বলে এবং বিএনপিকে সংস্কারের বিপক্ষের শক্তি বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করছে, তাদের ভিশন-২০৩০ এবং রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা কর্মসূচিতে যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে ও যেসব পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে, তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়, গোষ্ঠীস্বার্থে এবং রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে হেয় ও অপ্রাসঙ্গিক করার অপচেষ্টায় অযথা সময়ক্ষেপণ করে জনগণকে তাদের ভোটাধিকার তথা রাষ্ট্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার কৌশলকে বিএনপি সমর্থন করে না। দেশ ও জনগণের স্বার্থে জনগণের সম্মতি নিয়ে ৩১ দফায় বর্ণিত এবং ঐকমত্যে গৃহীত সব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিএনপি সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। চিঠিতে আরও বলা হয়, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ও তার সরকারের বক্তব্য ও মতামতে সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি এর কিছু ব্যতিক্রম আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। আপনার সরকারের কিছু ব্যক্তি এবং আপনাকে সমর্থনকারী বলে দাবিদার কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রকাশ্য বক্তব্য ও অবস্থান জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আশা করি আপনি এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’
বিএনপি বলে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব আইন, বিধি, বিধান সংস্কারে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব পরিবর্তন জরুরি, তা সম্পন্ন করার মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব বলে আমরা মনে করি। সে লক্ষ্যে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমরা আপনার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা এনআইডি প্রকল্প নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখার এবং নির্বাচনি এলাকা পুনর্র্নিধারণের বিষয়ে আইনি জটিলতা দ্রুত নিরসনেরও প্রস্তাব করছি। একই সঙ্গে পতিত ফ্যাসিবাদী দল ও সেই দলীয় সরকারের সঙ্গে যারাই যুক্ত ছিল, তাদের বিচার দ্রুত করে রাজনীতির ময়দানকে জঞ্জালমুক্ত করার; জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসা দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার এবং দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনার অধিকতর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে ১/১১-এর অবৈধ সরকার এবং পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে করা সব মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি পুনর্ব্যক্ত করছি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সংস্কার আর নির্বাচন আলাদা জিনিস না। সংস্কার সংস্কারের মত চলবে। নির্বাচন নির্বাচনের মতো চলবে। এছাড়া সংস্কার প্রস্তাব যথাযথভাবে পর্যালোচনা করেই বিএনপি মতামত দিয়েছে বলেও জানান তিনি।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ে নিজ বাসভবনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টার সদ্য সমাপ্ত চীনসফর প্রসঙ্গে মহাসচিব বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে চীন এক তরফাভাবে একটা দলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে। তবে এখন তারা চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করে সব দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ছে। চীন বাংলাদেশে উৎপাদনে ও উন্নয়নে বিনিয়োগের জন্য যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটা দেশের জন্য আশাবাদের কথা।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, যে বিষয়ে মতের ঐক্য হবে সেগুলো মেনেই নির্বাচন হবে। যারাই নির্বাচিত হবে সেই সংস্কার করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পরে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কুশল ও ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তিনি। এসময় জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পয়গাম আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ, যুবদলের সদস্য সচিব জাহিদ হাসান, ছাত্রদলের সভাপতি মোহাম্মদ কায়েসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য