নরসিংদী জেলার যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু আমনের খেত, এ যেন সবুজের সমারোহ। আর এই সবুজ ধান গাছে দুলছে কৃষকের স্বপ্ন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সোনালি ধানের শীষ ঝলমল করবে মাঠের পর মাঠ। রাশি রাশি সোনালি ধানে ভরে উঠবে কৃষক-কৃষাণির শূন্য গোলা। পাশাপাশি তাদের মুখে ফুটে উঠবে হাসির ঝিলিক।
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় ৩৬ হাজার ৯০৯ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এখানে ৪১ হাজার ৬৯ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ করা হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ হাজার ১৬০ হেক্টর বেশি। তার মধ্যে ৩৬ হাজার ১৮০ হেক্টর জমিতে উফশী এবং ৪ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের ধানের চাষ করা হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১২ লাখ ৬৫ হাজার ৬ টন।
উপজেলাওয়ারী হিসেবে নরসিংদী সদর উপজেলায় ৩ হাজার ৬০ হেক্টর, শিবপুরে ৯ হাজার ৩৪৯ হেক্টর, পলাশে ৩ হাজার ৫৬০ হেক্টর, বেলাবতে ৫ হাজার ৬৪০ হেক্টর, মনোহরদীতে ১০ হাজার ৭০০ হেক্টর এবং রায়পুরায় ৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ করা হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, নরসিংদী জেলার ৭ হাজার ৫০০ জন কৃষকের মধ্যে প্রণোদনাস্বরূপ সার ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় সার, বীজ ও রোগবালাই কীটনাশক ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে। রায়পুরা উপজেলার আমিরগঞ্জ এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকায় আমন ধানের মাঠে সবুজের সমারোহ। প্রতিটি ধান খেতে ধানের শীষ উঁকি দিচ্ছে। কৃষকরা তাদের ধানের জমি পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
আমিরগঞ্জ গ্রামের প্রান্তিক কৃষক আব্দুল রশিদ জানান, এ বছর তিনি তার ৪ বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছেন। এ সময় তিনি তার জমির সুস্থ-সবল সবুজ ধান গাছে হাত নাড়াচাড়া করছিলেন। এমন সুন্দর ধান খেত দেখে তার মন খুশিতে ভরে উঠেছে।
হাসনাবাদ গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে কৃষি বিভাগের লোকদের পরামর্শ নিয়ে আমরা উপকৃত।’ নরসিংদী সদর উপজেলার মহিষাশুড়া গ্রামের প্রান্তিক কৃষক দেলোয়ার হোসেন, করিমপুর গ্রামের কৃষক রাজু মিয়া, রসুলপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রাজ্জাকসহ অনেক কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং সময়মতো বৃষ্টি হওয়ার কারণে আমন ধান গাছের চেহারা অনেক সুন্দর হয়েছে। ভালোভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারলে তাদের সারা বছরের খাদ্যের চাহিদা পূরণ হবে।
নরসিংদী সদর এবং রায়পুরা উপজেলার চরাঞ্চলের কৃষকের নিচু জমিগুলো আমন ধানের ওপর নির্ভরশীল। চরাঞ্চলের কৃষকরা জানান, বাজারে ধানের পর্যাপ্ত মূল্য না থাকায় তারা হতাশ। তারা জানান, এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, যে পরিশ্রম করা হয়, সে তুলনায় ধানের মূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা। ফলে অনেক চাষি তাদের জমিতে ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সরকারের কাছে তাদের দাবি, যেমন করে সার, বীজ ও কীটনাশকের ঘাটতি মেটানো হয়েছে, তেমনি করে তাদের উৎপাদিত ধানের সঠিক মূল্য নির্ধারণ করলে প্রান্তিক চাষিদের দুঃখ-দুর্দশা মুছে যাবে।
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আজিজুল হক বলেন, ‘আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে এ বছর জেলায় লক্ষ্যমাত্রার অধিক ধান উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া কৃষকের নিবিড় পরিচর্যা, যথাসময়ে জমিতে সার ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে আমন ধানের বাম্পার ফলনের আশা করছে কৃষি বিভাগ।
সারিয়াকান্দিতে কাঁচামরিচের খেতে এক ব্যক্তি।
বগুড়া সারিয়াকান্দির মরিচের খ্যাতি বাংলাদেশ জুড়ে রয়েছে। এখানে হাইব্রিড জাতের মরিচের হারভেস্টিং শুরু হয়েছে। বীর অঞ্চলের পাশাপাশি চরাঞ্চলের কাঁচামরিচ বাজারে আসতে শুরু করায় বাজারে মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছে। বৃষ্টির জন্য আগাম কাঁচামরিচ বাজারে উঠতে দেরি হলেও, অনুকূল আবহাওয়ার কারণে মরিচগাছগুলোতে মরিচ ধরতে শুরু করেছে। আগাম কাঁচামরিচ বাজারজাত করে বাজারে ভালো দাম পেয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।
গত কয়েকদিন আগেও বগুড়া সারিয়াকান্দির বাজারে ৩০০ টাকা কেজিতে কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছে। তবে বাজারের জন্য সুসংবাদ বয়ে নিয়ে আসছে চরাঞ্চলের উৎপাদিত হাইব্রিড জাতের কাঁচামরিচ। মরিচগুলো বাজারে উঠতে শুরু করেছে। উপজেলার চরাঞ্চলজুড়ে এখন বিভিন্ন জাতের সবুজ মরিচগাছ শোভা পাচ্ছে। এ বছর বন্যা না হওয়ায় কৃষকরা চরাঞ্চলের জমিতে আগামভাবে বিভিন্ন জাতের হাইব্রিড মরিচ জমিতে আবাদ করেছেন। শুরুতে বৈরী আবহাওয়ায় মরিচগাছ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, এখন আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মরিচগাছগুলো তরতর করে বেড়ে উঠেছে। বেশিরভাগ মরিচ খেতে মরিচ ধরেছে এবং তা পরিপক্ব হতে শুরু করেছে। যা কৃষকরা সবেমাত্র বাজারে তুলতে শুরু করেছেন। তাই বাজারে কাঁচামরিচের দামও কমতে শুরু করেছে। সারিয়াকান্দির বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে সেখানে প্রতি কেজি কাঁচামরিচ ১৫০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে, যা গত কয়েকদিন আগেও দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়েছে। সদর ইউনিয়নের চরবাটিয়ার কৃষক মিঠু মিয়া গত আগস্ট মাসের শেষের দিকে তিনি তার ১০ বিঘা জমিতে হাইব্রিড মরিচের চারা রোপণ করেছিলেন। গত কয়েকদিন আগে তিনি তার জমির মরিচের প্রথম তোলা দিয়েছেন। প্রথম তোলায় তিনি ৫ মণ মরিচ পেয়েছেন। দু-একদিনের মধ্যেই তিনি দ্বিতীয় তোলা দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। তিনি গত বছরও হাইব্রিড আগাম জাতের মরিচের চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছেন।
কৃষক মিঠু মিয়া বলেন, প্রথম একেবারেই কম মরিচ হয় গাছে। তার পরের তোলা থেকে প্রচুর পরিমাণে মরিচ জমি থেকে উত্তোলন করা যায়। এ বছর বন্যা না হওয়ায় আগামভাবে মরিচ উৎপাদন করতে পেরেছেন। যা বাজারে বিক্রি করে বেশ ভালো দাম পাচ্ছেন। তাদের চরের মরিচ বাজারে উঠতে শুরু করায় বাজারে মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণে এসেছে। শুরুতে বৈরী আবহাওয়ার কারণে মরিচগাছ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মরিচের বেশ ভালো ফলন হয়েছে। ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের জোড়গাছা গ্রামের চাষিরা হাইব্রিড জাতের মরিচ চাষ করেছেন। মরিচের ফলন ভালো হওয়ায় দাম একটু কম হলেও সন্তুষ্ট চাষিরা।
সারিয়াকান্দি কৃষি অফিসের তথ্যানুযায়ী, গত বছর এ উপজেলায় সর্বমোট ৩২০০ হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদ হয়েছে। এ বছর মরিচ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৩১০ হেক্টর। যা ২২৭০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। যা এখনো চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ১,৬০০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড মরিচের আবাদ হয়েছে এবং ৬৭০ হেক্টর জমিতে দেশি উফশী জাতের মরিচ চাষ হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৫০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড জাতের মরিচ উত্তোলন শুরু হয়েছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, যমুনা এবং বাঙালি নদীর অববাহিকায় অবস্থিত সারিয়াকান্দির মাটি বেলে-দোঁআশ। তাই এ মাটি প্রাচীনকাল থেকেই মরিচ চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এখানে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে মরিচ উৎপন্ন হয়। বগুড়া সারিয়াকান্দির মরিচের খ্যাতি বাংলাদেশ জুড়ে রয়েছে। গত কয়েকদিন ধরেই কৃষকরা আগাম জাতের কাঁচামরিচ উত্তোলন এবং তা বাজারজাত করতে শুরু করেছেন এবং ভালো দামে বিক্রি করছেন। সারিয়াকান্দির মরিচ বাজারে উঠতে শুরু করায় মরিচের বাজার স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে।
ইলিশ পচা গন্ধে বাতাস ভারী হয়েছে সামরাজ মৎস্যঘাটের। চিরচেনা এ মৎস্যঘাটে এমন ঘটনা হরহামেশাই না ঘটলেও ইলিশ শিকারের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার ছয় ঘণ্টা পরেই ঘটেছে। এ মৎস্যঘাটের অবস্থান ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে ইলিশ বোঝাই সাগরগামী শতাধিক মাছ ধরা ট্রলার মৎস্যঘাটে ফিরেছে। শত শত টন পচা ইলিশের ভাগাড় দেখে সাধারণ ক্রেতারা অবাক হলেও আড়তদার ও পাইকাররা ছিলো আনন্দমুখর। সূর্যের আলো উকি দেওয়ার সাথেই এসব সাগরগামী ট্রলার মৎস্যঘাটে এসে নোঙর করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার দীর্ঘ ২২ দিন গভীর সাগরে অবস্থান করে এসব ইলিশ মাছ শিকার করেছেন জেলেরা। যদিও এসব তথ্য অকপটে শিকার করেছেন সাগর থেকে ফেরা একাধিক জেলে।
সরেজমিনে রোববার সামরাজ মৎস্যঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ভোর হতেই একে একে মৎস্যঘাটে ফিরেছে ইলিশ মাছ বোঝাই শতাধিক সাগরগামী ট্রলার। ওই সময় এফবি বিসমিল্লাহ, এফবি আয়েশা-১, এফবি হামিম-২ থেকে জেলেরা ঝুড়িভর্তি ইলিশ মাছ বিক্রির জন্য আড়তগুলোতে নিতে দেখা গেছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আড়তগুলোতেও মাছ বিক্রি শুরু হয়। কেউবা ঢাকাসহ অন্যান্য জেলাগুলোতে ইলিশ সরবরাহ করতে গাড়ীতে তুলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাগর থেকে ফেরা এক জেলে জানান, ৪ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞার খবর শুনে তার আগের দিবাগত রাতে বরফ, তেল ও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ইলিশ শিকারের জন্য গভীর সাগরে গিয়েছেন। তারা ২২ দিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সাগরে ইলিশ শিকার করেছেন। দীর্ঘদিন ইলিশ মাছ বরফজাত করে রাখায় দুই-তৃতীয়াংশ মাছ পচে গেছে। এই জন্যই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
এফবি বিসমিল্লাহ ট্রলারের মাঝি নুরমোহাম্মদের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। তবে সামরাজ মৎস্য ঘাটের একতা ফিসের আড়তদার অহিদ বলেন, ‘আপনারাতো জানেনই এসব মাছ সাগরের। ২২ দিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যে জেলেরা সাগরে মাছ শিকার করেছে। এই মৎস্যঘাটে ৯৮ জন মৎস্য আড়তদার রয়েছে। এসব আড়তদাররা প্রায় দেড়শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।’
চরফ্যাশন উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ের তথ্যমতে, চরফ্যাশনের বড় মৎস্যঘাটগুলোর মধ্যে সামরাজ, নতুন স্লুইসগেট, খেজুরগাছিয়া, মাইনউদ্দি ঘাট, ঢালচর, বকসীরঘাট, ঘোষেরহাট, চরকচ্ছপিয়া ও কুকরি মুকরি অন্যতম। কাকডাকা ভোর থেকে প্রতিদিন ১৫ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয় এসব ঘাটে। উপজেলায় প্রায় ৯০ হাজার জেলে রয়েছে। নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৪ হাজার ২৮১জন। অনিবন্ধিত জেলে রয়েছে প্রায় ৪৬ হাজার। এসব জেলেরা নদী ও সাগরে মাছ শিকার করে। এ অঞ্চলে প্রায় ১২ হাজার ট্রলার ও নৌকা রয়েছে। এছাড়াও গভীর সমুদ্রগামী ৭ হাজার ট্রলার রয়েছে।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু জানান, এমন তথ্য আমার জানা নেই।
৬ ঘণ্টার মধ্যে সাগরগামী ট্রলার ইলিশ বোঝাই করে মৎস্যঘাটে ফিরে আসা কি সম্ভব? এমন প্রশ্নের প্রতিউত্তরে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আপনার কথায় যুক্তি আছে। আমার অফিসারের সাথে কথা বলে জানাব। এ বলেই তিনি কল কেটে দেন।’
গো-খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় কুমিল্লায় লোকসানে খামারিরা। গেল ৬ বছরে বন্ধ হয়ে গেয়ে আড়াইশ খামার। যেসব বাড়িতে সকালের ব্যস্ত শুরু হতো গরুর জন্য ঘাস কাটা, গরুর গোছল করানো ও দুধ দোহন। সেসব বাড়ি ও খামারে এখন সুনশান নীরবতা। দুধ উৎপাদনে লোকসান গুণতে হয় বলে গৃহস্থ ও খামারিরা এখন অন্য পেশায় ঝুঁকছেন।
সরেজমিনে কুমিল্লা লালমাই উপজেলার দুধের গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিলোনিয়া গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, অল্প কিছু বাড়িতে ব্যস্ত সময় পার করছেন খামারি ও গৃহস্থরা। অথচ বছর দশেক আগেও এটিসহ আশপাশের ১২টি গ্রামে ঘরে ঘরে এক সময় দুধ উৎপাদন হতো। গরু পালন, দুধ বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ছিলোনিয়া গ্রামে আড়াই শতাধিক পরিবার দুধ উৎপাদন করতেন। তবে গো-খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে লোকসানে পড়েন খামারিরা। এরপর অনেকে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু এ গ্রামেই ৬ বছরে আড়াইশ খামারের মধ্যে ২০০টি বন্ধ হয়ে গেছে। দুধের গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিলোনিয়া এখন অনেকটা নীরব-নিস্তব্ধ। এর পাশের গজারিয়া, হাপানিয়া, উৎসব পদুয়া, মাতাইনকোট, দোসারি চৌ, জামমুড়া, শাসনমুড়া, আটিটি, বাটোরা গ্রামেও এখন আর তেমন দুধ সংগ্রহ ও বিক্রির উৎসব হয় না।
স্থানীয়রা জানান, ছিলোনিয়া গ্রামে আগের মতো উৎসবের আমেজ নেই, অনেক খামার খালি পড়ে আছে।
ছিলোনিয়া গ্রামের মো. হোসেন, আবুল মিয়াসহ অন্তত ১০ জন খামারি জানান, করোনার আগে পর্যন্ত ভালোই চলছিল তাদের খামার। তারপরেই গো-খাদ্যর দাম বাড়তে থাকে। তবে সে তুলনায় বাড়েনি দুধের দাম। গড়ে ১ কেজি দানাদার খাবারের দাম ৭০-৮০ টাকা হলে ১ কেজি দুধের দাম হয় ৬০-৭০ টাকা। লোকসান গুণতে গুণতে বন্ধ হয়ে যায় ওই এলাকার অন্তত দুইশ দুগ্ধ উৎপাদন খামার।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের কুমিল্লা জেলার সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল আজিজ জানান, ২০০৬ সালে ডেইরি ফার্ম শুরু হয় ছিলোনিয়া গ্রামে। ২০১৯ পর্যন্ত ভালো অবস্থা ছিল। ২০২০ সালে করোনার ধাক্কায় পিছিয়ে যায় দুগ্ধ উৎপাদন। গো-খাদ্যের চেয়ে দুধের দাম কম হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েন খামারি ও গৃহস্থরা। ২৫০টি খামার থেকে এখন তা ৬০টিতে চলে এসেছে। সরকার দৃষ্টি না দিলে বাকি খামারিরাও হারিয়ে যাবেন।
কুমিল্লা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন জেলা জানান, খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুধের উৎপাদন কমেছে কুমিল্লায়। কুমিল্লা জেলায় দুধের বার্ষিক চাহিদা ৫.৩৪ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন ৫.০৩ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদনে বাড়াতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ। খামারের বিদ্যুৎ বিল কৃষির আওতায় আনা এবং খাদ্যে ভর্তুকির বিষয়ে উপদেষ্টারা অবগত বলে জানান জেলা এই কর্মকর্তা।
নবীন প্রজন্মকে কৃষির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘তারুণ্যের উৎসব ২০২৫’। গত বুধবার সকালে উপজেলা কৃষি অফিসের আয়োজনে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মোস্তফা এমরান হোসেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. জাহাঙ্গীর আলম লিটন, এবং সঞ্চালনা করেন সহকারী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জনাব শাহআলম মজুমদার।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, তরুণ উদ্যোক্তা, কৃষক ও জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
শহীদ কামরুল মিয়ার পিতা জনাব নান্নু মিয়া বলেন, ‘সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তরুণদের কৃষিতে সম্পৃক্ততা খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
অন্যদিকে সাইফুল্লাহ বলেন, ‘তরুণদের কৃষিতে আগ্রহী করতে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অত্যন্ত ইতিবাচক। এই ধরনের সামাজিক উদ্যোগ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. জাহাঙ্গীর আলম লিটন বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মকে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতেই এই বীজ বিতরণ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও নবীন চিন্তাধারার সংযোজন ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।’
এ সময় প্রধান অতিথি ড. মোস্তফা এমরান হোসেন বলেন, ‘সরকার আধুনিক কৃষিতে তরুণ ও শিক্ষিত শ্রেণিকে আকৃষ্ট করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাণিজ্যিক কৃষিতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কৃষি মন্ত্রণালয় সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে।’
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, অনুষ্ঠানে উপস্থিত তরুণ উদ্যোক্তা, কৃষক ও শহীদ পরিবারের সদস্যসহ মোট ২০ জনের মাঝে উন্নত মানের বীজ বিতরণ করা হয়।
চলতি শীত মৌসুমে প্রথমবারের মতো হাজারি জাতের উচ্চ ফলনশীল লাউ চাষ করে সফল হয়েছেন নরসিংদীর প্রান্তিক কৃষকেরা। বাজারে এ লাউয়ের চাহিদা থাকায় ভালো দাম পেয়ে খুশি তারা। কম খরচে এবং কম সময়ে ফলন আসায় হাজারি লাউ চাষে আগ্রহ বাড়ছে স্থানীয় কৃষকদের।
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় ১০ হাজার ৪১৭ হেক্টর জমিতে শীতকালীন শাক-সবজির চাষ করা হয়েছে। তার মধ্যে ১ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে লাউ চাষ করা হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে লাউ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ টন।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার রায়পুরা উপজেলার অলীপুরা ইউনিয়নের কাঙ্গালীমারা গ্রামের কৃষক আলী হোসেন তার বাড়ির আঙিনায় ২০ শতাংশ জমিতে এ লাউ চাষ করেছেন। মাচায় ঝুলছে লম্বা সবুজ রঙের অসংখ্য লাউ। যেদিকে তাকানো যায়, শুধু লাউ আর লাউ। বাগানের এসব সবুজ কচি লাউ দেখলে যেকোনো মানুষের চোখ জুড়িয়ে যায়। আলী হোসেন জানান, তিনি জৈব সারের সঙ্গে সামান্য রাসায়নিক সার ব্যবহার করেছেন। এতে কীটনাশক ও রোগবালাইনাশক ওষুধ ব্যবহারের প্রয়োজন হয়নি। এ জন্য বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি বাগানের লাউ খেতে যেমন সুস্বাদু, বাজারেও এর চাহিদা অনেক বেশ। তিনি আরও জানান, বাড়ির আঙিনায় ২০ শতাংশ জায়গা সারা বছরই পড়ে থাকত। তার এক নিকটতম আত্মীয়ের পরামর্শে এ বছর স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার সহযোগিতা নিয়ে প্রথমবার হাজারি জাতের লাউ চাষ শুরু করেন। বাজার থেকে লাউয়ের বীজ সংগ্রহ করে গত শ্রাবণ মাসের প্রথম দিকে জমিতে রোপণ করেন।
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আজিজুল হক জানান, হাজারি লাউ একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। এ জাতের লাউ রোপনের ৫-৭ দিনের মধ্যে চারা হয় এবং ৪২-৪৫ দিনের মধ্যে ফুল ধরতে শুরু করে। এছাড়া ৬০-৭০ দিনের মধ্যে বাজারজাত করা যায়। এ লাউ দেখতে খুব সুন্দর ও তরতাজা। খেতেও খুব সুস্বাসু। এছাড়া বাজারে এর চাহিদা এবং ফলন বেশি হওয়ায় এ লাউ চাষে কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এ বিষয়ে কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।
কেশবপুর উপজেলায় যশোরের দুঃখখ্যাত ভবদহের জলাবদ্ধতার কারণে প্রায় ১৮ হাজার বিঘা জমিতে এবার আমন আবাদ করতে পারেননি কৃষকেরা। এসব জমিতে ১২ হাজার টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল কৃষি বিভাগের। আমন আবাদ করতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বৃষ্টি ও নদ-নদীর পানি এসব বিলে ঢুকে পড়ায় কৃষিকাজ বন্ধ রয়েছে। জলাবদ্ধতার পেছনে অপরিকল্পিত মাছের ঘের ও নদ-নদী পলিতে ভরাট হয়ে পানি সরতে না পারা কারণ হিসেবে দেখছেন কৃষকেরা।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর এই উপজেলায় ৭১ হাজার ৬২৫ বিঘা জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩৬ হাজার ৫৫০ টন; যার বাজারমূল্য ১৩১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে এবারের আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ৫৩ হাজার ৭০০ বিঘা জমিতে ধান আবাদ হয়। অনাবাদি থেকে যায় ১৭ হাজার ৯২৫ বিঘা জমি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি আমন মৌসুম শুরুর আগেই মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। এছাড়া অপরিকল্পিত মাছের ঘের, নদীর নাব্যতা না থাকাসহ মানবসৃষ্ট জলাবদ্ধতায় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বর্ষার পানি শুষ্ক মৌসুমেও নামতে পারেনি। এতে বিস্তীর্ণ জমি জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে নিম্নাঞ্চলের বিলগুলোতে আমন আবাদ করতে ব্যর্থ হন কৃষকেরা।
উপজেলার মজিদপুর গ্রামের কৃষক মোতাহার হোসেন জানান, বুড়িভদ্রা নদীর পাশে তার প্রায় দেড় বিঘা জমি জলাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। এ কারণে তিনি এবার আমন আবাদ করতে পারেননি। অপরিকল্পিত মাছের ঘের ও নদ-নদী পলিতে ভরাট হয়ে পানি সরতে না পারায় তার মতো অনেক কৃষক আমন আবাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
পৌরসভা এলাকার ১ নম্বর ওয়ার্ডের বিশ্বাসপাড়ার কৃষক আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের বিলে এখনো হাঁটুসমান পানি। জলাবদ্ধতার কারণে আমার সাত বিঘা জমিতে আমন আবাদ করতে পারিনি।
একই এলাকার কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, নোনামাঠেল বিলে জলাবদ্ধতার কারণে কৃষকেরা এবার আমন আবাদ করতে পারেননি।
মজিদপুর ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল আলম বলেন, মজিদপুর, বাগদহ, দেউলী, হিজলতলাসহ অধিকাংশ এলাকার নিম্নাঞ্চলের বিলগুলো জলাবদ্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে কেশবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন দৈনিক বাংলা পত্রিকাকে বলেন, ভবদহের প্রভাবে জলাবদ্ধতায় নিম্নাঞ্চলের বিলগুলোতে আমন আবাদ হয়নি। এ জন্য এবার আমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কৃষকেরা ১১ হাজার ৯৫০ টন ধান উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তবে অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে আমনের আবাদ ভালো হয়েছে।
যশোর জেলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে ভবদহের অবস্থান। চার দশক ধরে এখানকার ৩৩০ কিলোমিটার এলাকার ৩ লাখ মানুষ জলাবদ্ধতায় ভুগছেন।
মন্তব্য